Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

এক বিজ্ঞানীর জীবনদর্শন’ রানা চক্রবর্তী

‘এক বিজ্ঞানীর জীবনদর্শন’ রানা চক্রবর্তী
বিশ্বকবি ‘রবীন্দ্রনাথ’, মহাবিজ্ঞানী ‘আইনষ্টাইন’ প্রমুখ মনীষীরা তাঁদের নানা লেখায় ও আলোচনায় নিজেদের জীবনদর্শনের কথা যেমন স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে গেছেন, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু সেভাবে …

 





‘এক বিজ্ঞানীর জীবনদর্শন’ রানা চক্রবর্তী


                                              

বিশ্বকবি ‘রবীন্দ্রনাথ’, মহাবিজ্ঞানী ‘আইনষ্টাইন’ প্রমুখ মনীষীরা তাঁদের নানা লেখায় ও আলোচনায় নিজেদের জীবনদর্শনের কথা যেমন স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে গেছেন, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু সেভাবে তাঁর জীবনদর্শন কোথাও ব্যক্ত করে যাননি। তবে তাঁর নানা লেখায় ও ভাষণে তাঁর জীবনদর্শনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেগুলোর সাহায্যে তাঁর জীবনদর্শন সম্পর্কে আভাস দেবার চেষ্টা করা যেতে পারে। সত্যেন্দ্রনাথের মনীষা ও মানবিকতার কথা ছোট-বড় ঘটনার মধ্যে দিয়ে বলা খুব একটা কঠিন নয়। তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানও সংক্ষেপে সাধারণভাবে আলোচনা করা সম্ভব। কিন্তু জীবনের নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি যে বিশ্বাসভূমি গড়ে তুলেছিলেন সেটার আলোচনা করা কিন্তু মোটেই সহজ কাজ নয়।


সত্যেন্দ্রনাথ স্বধর্মে বিজ্ঞানী ছিলেন, সে-কারণে স্বভাবতই ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে তাঁর কি বিশ্বাস ছিল - এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠে আসে। এই প্রসঙ্গে ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের’ পুত্র ‘দিলীপকুমার রায়ের’ সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তাঁর যে সব পত্রালাপ হয়েছিল, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়ে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। ধার্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি দিলীপকুমারের গভীর অনুরাগ আবাল্যকাল থেকেই ছিল এবং পরবর্তীকালে তিনি একজন ভগবৎপ্রেমী সাধকের জীবনই সম্পূর্ণরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। সেই বিচারে সত্যেন্দ্রনাথ বসু একেবারেই বিপরীত পথের পথিক - একজন বিজ্ঞানসাধক ছিলেন। কিন্তু এই বৈপরীত্য সত্ত্বেও তাঁদের দু’জনের মধ্যে এক গভীর অন্তরঙ্গতা ও সৌহার্দ্য বিদ্যমান ছিল। এই প্রসঙ্গে দিলীপকুমার রায় বলেছিলেন, “সত্যেন মাঝে মাঝে আমাকে স্নিগ্ধ ব্যঙ্গের সুরে হেসে বলত : ‘আমার মতন নাস্তিকের দিকে তুই ঝুঁকলি কি করে বল্ তো?’ কিন্তু আমি এটুকু বুঝতাম যে সত্যেন সহজে ধরা দেয় না, তাই টুকতাম : ‘তুমি কখনোই নাস্তিক নও। সত্যি নাস্তিক হলে তোমার আমার মধ্যে একটা ব্যবধান আসতই আসত।’ এ-কথা আজও আমি বিশ্বাস করি আরো এইজন্যে যে মুখে নিজেকে নাস্তিক বললেও সত্যেন তাঁর চিঠিপত্রে বরাবরই ভাগবত সত্যের অস্তিত্ব সম্বন্ধে শ্রদ্ধাই প্রকাশ করত। আমাকে একটি চিঠিতে সে লিখেছিল, তোমার সাধনায় যেন তুমি সিদ্ধিলাভ করো।” দিলীপকুমার রায়কে আরেকটি চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, “সারা জীবন তুমি যে পথে যে সত্যের সন্ধান করে বেড়াচ্ছ আমার কাছে তা অজানা হলেও তোমার সত্যসন্ধিৎসু মনকে তো আমি অবজ্ঞা করতে পারি না। মানুষের মনের সব দরজার খবর কি সকলে পায়? যে পথে তোমার মনের মধ্যে সঙ্গীতের সুরসুন্দরীরা আসা-যাওয়া করেন, তা তো আমার কাছে চিরকাল গোপন রহস্যই রয়ে গেল। ঐকান্তিক সাধনার প্রসাদে তুমি যে সিদ্ধির পথে এগোবে, এ আমি বিশ্বাস করি। এদেশের বাতাসে ও ধূলিকণায় মিশে আছে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির স্মৃতি। মরমী খবর সব সময়েই এদেশের মনকে অদ্ভুতভাবে দোলা দেয়। অবশ্য সকলে তো অধিকারী নয় ভাই, তাই অনেক ক্ষেত্রেই দোলন হয় ক্ষণস্থায়ী।” দিলীপকুমার রায় তাঁর ‘অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির কথা’ জানিয়ে সত্যেন্দ্রনাথকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন। কিন্তু এই যোগবিভূতির আকর্ষণ সাধকের লক্ষ্যে পৌঁছবার পথে বাধাস্বরূপ - এ কথা শ্রীরামকৃষ্ণ একদা স্বামী বিবেকানন্দকে বলেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ কোন আধ্যাত্মিকতাবাদী যোগী ছিলেন না, তবু তাঁর তত্ত্বান্বেষী মনে শ্রীরামকৃষ্ণের কথার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তাই তিনি এই প্রসঙ্গে দিলীপকুমার রায়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “যে সব অপূর্ব অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছ, তা আমার কাছে সম্পুর্ণ অজানা। তোমার পথের শেষ কোথায় জানি না, তবে মাঝ রাস্তার এই সব অনুভূতির রাজ্য ছাড়িয়ে হয়ত তোমাকে আরো অনেকদুর এগিয়ে যেতে হবে। অপ্রত্যাশিত বিভূতির আকর্ষণে জড়িয়ে পড়লে হয়ত অনেকটা বাকী থেকে যাবে শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে। উপনিষদের নির্দেশ ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’ হযত এর বেলাতেই প্রযোজ্য।” ধর্মসাধকের অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি সম্বন্ধে সত্যেন্দ্রনাথের মনোভাব বিশ্লেষণ করে দিলীপকুমার রায় লিখেছিলেন, “সত্যেন স্বভাবে ঠিক বিশ্বাসী না হলেও দুরন্ত সংশয়ীও নয়।” এরই আভাস পাওয়া যায় দিলীপকুমার রায়কে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে - “সৃষ্টির রহস্য আমরা কেউই ভেদ করতে পারি নি ভাই। তা ছাড়া সাধকের সাধনার ধন কিভাবে তাঁর কাছে পৌঁছায় ক’জন মানুষই বা লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছে বলো? তুমি হয়ত যে পথে এগিয়ে চলেছ সেখানে সব কিছুর সত্যস্বরূপ এমনি আপনা-আপনিই চোখে ভেসে ওঠে কথার অপেক্ষা না রেখে।” সত্যেন্দ্রনাথ স্বধর্মে বিজ্ঞানী ছিলেন, তাই একজন বিজ্ঞানীর কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়ে তিনি দিলীপকুমার রায়ের আধ্যাত্মিক সাধনাকে দেখেছিলেন ও তাঁর নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। আরেকটি চিঠিতে তিনি দিলীপকুমার রায়কে লিখেছিলেন, “নিজেকে খুঁজে পেয়েছ, তাই শান্তিও তোমার করায়ত্ত হয়েছে। এতদিনে যে তোমার সকল খোঁজ সফল হয়েছে তাইতেই আমার আনন্দ। বিজ্ঞানীর চোখে জগতটা চিরকালই বিস্ময়কর বস্তু হয়ে থাকবে - কৌতূহলকে চিরঞ্জীবী রাখাই তাঁর পরম কাম্য। এ মনোভাবকে আশা করি তুমি নিছক পাষণ্ডীপনা ভাববে না। তোমার আমার কিংবা বহুসহস্র সাধকের এমন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে যাদের প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবু বহু লক্ষ বহু কোটি জীবের মধ্য দিয়ে যে প্রকাশ চলেছে তার মধ্যেই সে যুক্তি ও ন্যায়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চেষ্টা করছে।”                                       

সত্যেন্দ্রনাথ চিরদিন ‘স্থিতধী’ ছিলেন, তাই ধর্ম সম্পর্কে কোনোদিনই তিনি বিশেষ আলোচনা করেন নি বা করতে চান নি। ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান দাবিটি হল - ‘বিশ্বাসে মিলয়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর’। কিন্তু কোন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীর পক্ষে এই দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীর মন সব কিছুর মধ্যে যুক্তি-প্রমাণের সন্ধান পেতে চায়। সত্যেন্দ্রনাথের পক্ষেও এ দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না বলেই তিনি ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে সাধারণতঃ নীরব ও সংযতবাক থাকতেন। তবে ‘তথাকথিত’ ধর্মাচরণ সম্পর্কে একটি বিষয়ে তিনি তাঁর মনোভাব সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন। ধর্মের নামে কোন ধরনের ভড়ঙের বা আধ্যাত্মিকতা জাহিরিপনার তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এদেশে কথায় কথায় দার্শনিকতা বা আধ্যাত্মিকতার ধুয়ো তুলে পাশ্চাত্য বস্তুতান্ত্রিকতাকে হেয় প্রতিপন্ন করার যে চেষ্টা করা হয়, সেটাকে তিনি কোনদিনই সমর্থন করতে পারেন নি। তাই তিনি তীব্র ভাষায় বলেছিলেন, “এদেশে ধর্মধ্বজীরা যখন অনেক সময় নিজেদের দুর্দশার কথা বলে যান এবং চোখ দিয়ে অনবরত দুঃখের অশ্রু যখন তাঁদের পড়ে, তখন আমার মনে হয় যে ঘরের কোণে বসে কেবলমাত্র ভগবানের ওপর দোহাই না পেড়ে এবং মাথা না ঠুকে যদি প্রতীচ্যের লোকেরা বেরিয়ে পড়ে যে মানুষের শত্রুকে আমবা দমন করব, সেটা কিছু একটা চিরন্তন সত্যের মধ্যে নিম্নস্তরের মনোভাব এই বলে নিজেদের বাহবা নেবার কোনো দরকার নেই।” পারলৌকিক পরমার্থ লাভের চেষ্টায় ঐহিক জীবনের প্রতি ঔদাসীন্যের যে মনোভাব এদেশে যুগের পর যুগ ধরে চলে এসেছে, তাতে জাতির সামগ্রিক কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি হয়েছে বলে সত্যেন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাই তিনি বলেছিলেন, “... it cannot be denied that a persistent propaganda that the world is a place of temporary stay of the individual who should think of his own salvation as the principal aim in life has its repercussion in creating a carelessness in all mundane matters.” এই ‘আত্মমুক্তি দার্শনিকতা’র ফল হয়েছে মারাত্মক এবং সেটার জন্য বহু মূল্যও ভারতের মানুষকে দিতে হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন, “While this philosophy flourished in our country the neglect of a serious acceptance of life by our first-class thinkers brought second-rate petty people into prominence who gave lip-adoration to philosophy, but actually indulged in jealousy, squabble aud internal strife. As a result foreign invaders came, often by invitation, and established in India centuries of slavedom.” বহু শতাব্দীর শিক্ষা থেকে বর্তমান যুগে এই কথা উপলব্ধি করবার সময় এসেছে যে আত্ম-মুক্তির উপরে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ না করে জীবনকে মানবোচিত দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এই বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন, “The weal or the woes of the individual should not be made the principal object of philosophy, but the men in any country, closely knit by a common heritage, may be regarded as taking part in a relay race, where the advancement of the country is more important than the fate of the individual runner.” এই বিকল্প জীবনদর্শনও মূলতঃ ভারতীয়, যদিও “... it may ultimately deny the individual soul as the ultimate reality and preach the sovereign rule of Karma (কর্ম).” এই কর্মযোগের কথা গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দও বলেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ সেই মুক্তির কথা বলেছিলেন, যে মুক্তি নঙৰ্থক নয়, সদর্থক; যে মুক্তি কর্মত্যাগে নয়, সাধুকর্মের মধ্যে আত্মত্যাগে; যে মুক্তি রাগদ্বেষবর্জনে নয়, সর্বজীবের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীসাধনায়। স্বামী বিবেকানন্দও বলেছিলেন, “তোমরা সব ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দাও, এমন কি নিজেদের মুক্তি পর্যন্ত দূরে ফেলিয়া দাও; যাও, অপরের সাহায্য কর। তোমরা সর্বদাই বড় বড় কথা বলিতেছ, কিন্তু এই তোমাদের কর্মপরিণত বেদান্ত স্থাপন করিলাম।” আর এই জ্বলন্ত বিশ্বাসের বলেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু একদা বলেছিলেন, “May I be born again and again, and suffer thousands of miseries so that I may worship the only God that exists, the only God that exists, the only God I believe in, the sum total of all souls-and above all, my God the wicked, my God the miserable, my God the poor of all races, of all species, is the special object of my worship.” ধর্মপ্রবক্তাদের মধ্যে গৌতম বুদ্ধ ও স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগের প্রভাব সত্যেন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রতিফলিত হয়েছিল বলে তাঁর জীবনীকাররা মনে করেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমি বোধ হয় পৃথিবীর মধ্যে সবার থেকে বেশি ভক্তি করি বুদ্ধদেবকে”। আর স্বামী বিবেকানন্দ যে আত্মমুক্তির চেযে মানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবের কাজে আত্মনিয়োগের জন্যে বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান জানিয়েছিলেন, তার মধ্যে নিজের জীবনদর্শনের মন্ত্র খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “May we all remember his (Swamiji’s) message, and gird up our loins to raise the wheel of the car of humanity from the mire in which it has got stuck and sunk!”


ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আর সে-কারণেই সত্যেন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, “জীবনদেবতার সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, তার চর্চা ও অনুশীলন নিভৃতে হওয়া দরকার। তার ভেতর থেকেই মানুষ হয়ত পাবে তাঁর প্রতিদিন কাজ করার শক্তি ও প্রেরণা।” জীবনদেবতা সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত না করলেও তিনি এ-কথা বলতে কুণ্ঠিত হন নি যে, “a harmonisation of worldly duties with the other-worldliness may be brought about.” আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুতান্ত্রিকতা নিয়ে মানুষের মতদ্বৈধ দীর্ঘকালের - অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “পৃথিবীতে মানুষ যতদিন আছে তার মনে এই দ্বৈতভাব থাকবেই। কিন্তু বিবর্তনের ফলে মানুষ ক্রমশ ওপরের দিকে চলেছে, তাঁর সভ্যতা ক্রমশঃ ঊর্ধ্ব পথে চলেছে – এটা বিজ্ঞানী বিশ্বাস করে। কাজেই সে ভাবে নিছক কল্পনার উপর নির্ভর করলে মানুষের জয়রথ এগোবে না। প্রকৃতির শক্তিভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ-করা জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মানব সভ্যতাকে।” সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এই দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য বস্তুতান্ত্রিকতার সামঞ্জস্য দেখে কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পাবেন যে তিনি বুঝি তাঁর স্বদেশকে যথার্থ ভালোবাসতেন না। এর উত্তবে সত্যেন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছিলেন, “আমি যে আমার নিজের দেশকে ভালবাসি না তা নয়। তবে আমি এই বলি যে ভালবাসা যদি এমন রূপ নেয় যাতে পদে পদে সত্যের অপলাপ করতে হয়, তা হলে সে ভালবাসার কোন দাম নেই। যাকে গ্রহণ করতে হবে, যার প্রতি পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে, তার যদি সমস্ত দোষ পর্যন্ত আমি গুণ বলে বৰ্ণনা করি তা হলে সে কাব্যের জগতেই চলে। মানুষের মধ্যে সেই মনোভাব আনা অত্যন্ত দুষ্কর।”                                        

যাঁরা ‘আধ্যাত্মিকতাবাদী’ তাঁরা বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উত্থাপন করে থাকেন - আজকাল এদেশে ও অন্যত্র বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার উপরে যে অস্বাভাবিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে, সেটার ফল হয়তো শেষ অবধি মানব সমাজের পক্ষে মঙ্গলময় হবে না। বিজ্ঞান হয়তো শেষ অবধি আমাদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে - শ্রেষের আসনে প্রেষকে বসাচ্ছে। পর পর দুটি বিশ্ব যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষ দেখতে পেয়েছে যে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি ডেকে এনেছে। এই প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, “দুঃখের কথা এই যে, যাঁরা দেশে দেশে রাষ্ট্রের হাল ধরেছেন তাঁরা বিজ্ঞানী নন। অনেক সময় তাঁরা ধার্মিক, অনেক সময় তাঁরা জাতীয়তাবাদী। অনেক সময় তাঁরা বিশ্বাস করেন, একটা বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে তাঁর স্বজাতির সৃষ্টি হয়েছে এই পৃথিবীতে এবং তাঁর বিশেষ কর্তব্য হচ্ছে জমি দুরমূস করে অন্য সকলের উপর এই এক সভ্যতার গাড়ি চালিয়ে দেওয়া। সম্প্রতি যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হয়ে গেল তার জন্যে দায়ী যাঁকে বলা হয় সেই ডিক্টেটর হিটলার সত্যকারের খুব ধার্মিক লোক ছিলেন। তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনা করলে আমরা দেখব, তিনি আমিষ কখনও ছুঁতেন না ইত্যাদি অনেক কিছু। যে সব বাহিরের অঙ্গ থেকে আমরা বিচার করি, তা থেকে আমাদের মনে হবে ধার্মিক লোকের কাছ থেকে যা পাওয়া যায় তা সত্য করেই মানুষের পক্ষে ভালো। জার্মান জাতি বিপদের কবলে একেবারে যখন রসাতলের অধঃস্থলে যেতে বসেছিল, তখন হিটলার এগিয়ে এসেছিলেন দেশের ‘ত্রাতা’ হিসাবে। বলেছিলেন, ‘যদি এ যুদ্ধে আমরা হারি, তা হলে জার্মান জাতি হাজার বছরের মধ্যে আর উঠতে পারবে না।’ তারপর কত কি ঘটে গেল জার্মানীর ভাগ্যে। আজ শুধু এইটুকু বলতে ইচ্ছে করে, আজকের দিনে সেই অত্যন্ত নিম্ন রসাতল পতিত জাতি যদি আবার উঠে থাকে তা হলে সেটা বিজ্ঞানের জোরেই। বিজ্ঞানীরাই আবার তাকে টেনে তুলেছে। জার্মান জাতির মধ্যে যা কিছু দেবার ছিল সে শুধু দর্শনশাস্ত্র নয়, সেই সঙ্গে ছিল জীবনের সর্বক্ষণ কাজে লাগিয়ে জ্ঞান সংগ্রহের অদম্য প্রয়াস। তাই মহাযুদ্ধের মধ্যে তার সর্বস্ব বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও মানুষের সেবায় সেই জ্ঞানের সাহায্যে জার্মান জাতি অল্প সময়ের মধ্যেই সেই বিনষ্ট সমৃদ্ধি পুনরায় গড়ে তুলেছে।” বিজ্ঞানচর্চার ফলে মানুষের মধ্যে হিংসা দ্বেষ হানাহানি বেড়ে গেছে - এ অনুযোগও আধ্যাত্মিকতাবাদীরা করে থাকেন এবং সেই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে আধ্যাত্মিকতার পথে মানুষ চালিত হলে এই সমস্ত দূরীভূত হবে। এ-সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, “শুধু দর্শনশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে যদি আমরা ভাবি যে আমরা মানুষ সকলে এক ও এইভাবে হিংসাদ্বেষ বিসর্জন দিয়ে আমরা সারা জীবন কাটাতে পারব তা হলে এতদিন পর্যন্ত সে-কথা কেবল বৃথা মনোভাবেই পর্যবসিত হয়েছে - হাজার হাজার বৎসরের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা তা বুঝতে পারব। এইভাবে দার্শনিক ব্যাখ্যা যেখানে যে দেশে পূর্ণভাবে বিদ্যমান ছিল বলে আমরা মনে করি - সেখানেও কোনকালে হিংসা দ্বেষ সংঘাতের বিরাম হয় নি। আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেন যে শুধু দার্শনিক দিয়ে যদি এই পৃথিবী ভরে থাকত (এরকম নাকি একসময়ে ভারতে ছিল) তা হলেও বোধ হয় পৃথিবী থেকে হিংসাদ্বেষ লোপ পেত না। বিজ্ঞান চর্চা থাকত না, কাজেই আণবিক বোমার আবিষ্কার হত না। তবুও নিপাত করার ও উৎসন্ন দেবার যে-সব সাধারণ অস্ত্র ছিল, সেই সব অস্ত্রের ব্যবহার চলত এবং সেগুলি ঠিক সেরকমই নির্মম ও সর্বনেশে। মানুষকে মানুষ ভেবে মানুষ যে বিশেষ সম্মান করে এসেছে এতকাল তা আমার মনে হয় না। তবু আজকের দিনে বিংশ শতাব্দীতে মানুষ সেইভাবে সাধনার পথে সবে এগোতে শুরু করেছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানচর্চার ফলেই। কেননা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ সমাজ এক - একথা কেবল বিজ্ঞানীরাই বলেছেন।” তিনি আরও বলেছিলেন, “মানুষ জাতির মনোভাব আজকের দিনে কোন পথে চলেছে কে বলবে? তবে এইটুক আশার কথা, যে-সব ছোট ছোট দেশ জাতীয়তাবাদের মধ্যেই মনটা ডুবিয়ে বাখত, আজকের দিনে তাঁরা মানুষের জন্যে ভাবতে শিখেছে। কাজেই নানা সময়ে বার বার সকলে মিলে এইটেই আলোচনা করছে - ভবিষ্যতে মানবসমাজে আমাদের কি কর্তব্য? - মানুষকে বাঁচিযে রাখতে হলে, একে আরও উন্নত করতে হলে আমাদের মনোভাব কিভাবে বদলাতে হবে? বহু দেশবাসী যে একত্র হয়ে আজ ভাবতে চাচ্ছে - এক হিসাবে বিজ্ঞান না থাকলে এটা কখনও সম্ভব হত না।” কিন্তু এ-কথাও অনস্বীকার্য যে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সভ্যতার সৌধ যদিও পৃথিবীর সর্বত্র গড়ে উঠেছে, তবু সব মানুষের মনে আজও শুভবুদ্ধি জাগেনি। আজও প্রতিযোগিতা চলেছে যে অমোঘ মারণাস্ত্র সৃষ্টি করে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোন জাতি জগতে একেশ্বর হয়ে বিরাজ করবে। তাই অবশ্যই প্রশ্ন জাগে - বিজ্ঞানসেবা কি শেষ অবধি হিংসার ইন্ধন জুগিয়ে পরিণামে মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করবে? সব দেশের বিজ্ঞানপ্রেমিকদের বর্তমানে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। সত্যেন্দ্রনাথও এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র ‘বিজ্ঞানপ্রেমিক’ ছিলেন না, তিনি ‘মানবপ্রেমিক’ও ছিলেন। তাই মানবতার প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে তিনি বলেছিলেন, “মানুষের ভবিষ্যৎ মানুষের হাতে - সে যদি অনুসরণ করে ব্যক্তিনির্বিশেষে দয়া ও সহযোগিতার মনোভাব, তা হলে যে সংঘাত ও দ্বেষের প্রকোপ আজ দেখা যাচ্ছে, তার নিরসন হবে। তা হলেই সার্বজনীন বিশ্বমানবের আবির্ভাব হবে। অন্যথায় যেমন অতিকায় জীবজন্তুরা অতীতেই লোপ পেয়েছে ও সাক্ষ্য দিতে আছে মাত্র তাদের প্রস্তরীভূত কঙ্কালের অবশেষ, ভবিষ্যতে মানবসভ্যতারও ঐরূপ বিষাদভরা পরিণাম হওয়া বিচিত্র নয়। … ভবিষ্যতের সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে জাতিধর্মনির্বিশেষে, তার মধ্যে থাকবে সব মানুষের স্থান। বিজ্ঞানোচিত মনোভাব, হিংসাদ্বেষের পরিবর্তে সহযোগিতা ও প্রেমের প্রতিষ্ঠা দরকার। বিজ্ঞানের পথেই জয়লাভ হবে।” সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিভিন্ন সময়ের লেখা ও বক্তৃতা পড়ে এটাই মনে হয় যে তাঁর জীবনদর্শনের মূলমন্ত্রটি ছিল - ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। একটি ভাষণে এই গভীর প্রত্যয় প্রকাশ করে একদা তিনি বলেছিলেন, “Man is the ultimate and the Supreme truth which realise and I would hope that this we should supreme realistic view preached by the ancient poet of the land should be accepted as a symbol and as an ideal.” এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতেই তিনি মানুষের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশ সর্বদা কামনা করেছিলেন এবং যে সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্রনীতি মনুষ্যত্বকে অবমাননা করে, যা কিছু মনুষ্যত্ব বিকাশের পরিপন্থী - সেগুলোর প্রতি তিনি কোনোদিন তাঁর সমর্থন জানাতে পারেন নি। বিশ্বকবির অন্তরাকাঙ্ক্ষার অনুরণন তুলে তিনিও তাই একান্ত ভাবে আকাক্ষা করেছিলেন এমন মানুষ ও মানবসমাজের -


“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী

বহুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি, …”

                                             

(তথ্যসূত্র:

১- সত্যেন্দ্রনাথ বসু: চেনা বিজ্ঞানী অজানা কথা, দেবীপ্রসাদ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১২)।

২- সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ।

৩- বিজ্ঞানসাধক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মনোতোষ দাশগুপ্ত, অর্ক প্রকাশ (২০১২)।)

                                          

No comments