‘সরস্বতীর সেকাল’ -রানা চক্রবর্তী‘সরস্বতী’ একজন ‘বৈদিক দেবী’। ‘বেদে’ এই দেবীকে তিনটি বিশেষ অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষণে ভূষিতা করা হয়েছে। সেখানে সরস্বতীকে কখনও ‘দেবীতমে’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, কখনও বা ‘অম্বিতমে’ বলা হয়েছে, আবার…
‘সরস্বতীর সেকাল’ -রানা চক্রবর্তী
‘সরস্বতী’ একজন ‘বৈদিক দেবী’। ‘বেদে’ এই দেবীকে তিনটি বিশেষ অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষণে ভূষিতা করা হয়েছে। সেখানে সরস্বতীকে কখনও ‘দেবীতমে’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, কখনও বা ‘অম্বিতমে’ বলা হয়েছে, আবার কখনও ‘নদীতমে’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এই তিনটি বিশেষণের ভাব-সমষ্টি এবং সামগ্রিক রূপের মধ্যেই বৈদিক সরস্বতীকে স্বমহিমায় বিরাজিত দেখা যায়। কল্পনার দেবী ক্রমে ক্রমে ঋষি চেতনায় নিজের মূর্তি পরিগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ‘নিরাকারা’ থেকে ‘সাকারা’ হয়েছিলেন। সরস্বতী ‘দেবীতমা’ - অর্থাৎ, ‘দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা’। বেদের বর্ণনায় তিনি জ্ঞানরূপ পীযূষ দান করে অবোধ ও অজ্ঞান মানুষের ভ্রান্তিকে দূর করেন, মানুষকে তিনিই অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান, তাই তিনি হচ্ছেন ‘দিব্যব্রহ্ম জ্যোতিঃরূপিণী’। যিনি ‘দেবীতমা’, তিনিই ‘অম্বিতমা’৷ কারণ ‘অম্বিতমা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘মাতৃ-শ্রেষ্ঠা’। তিনিই অসহায় সন্তানকে পালন করেন, সন্তানের কণ্ঠে ভাষা দান করেন এবং স্নেহপরবশ হয়ে সন্তানকে লালন করেন। এই সরস্বতীই আবার ‘নদীতমা’। নদী কেবলমাত্র জলের উৎস নয়, শব্দ বা ‘নাদের’ও উৎস। ‘নদ’ শব্দটি থেকেই ‘নাদ’ শব্দটির উৎপত্তি। সরস্বতী নদী তাই ‘নাদময়ী’। আবার প্রাচীন ভারতবর্ষে সরস্বতী নামের নদীটি ‘পবিত্রতোয়া’ ছিল। সেই নদী ‘পাঞ্জাবের’ উপর দিয়ে প্রবাহিতা এবং সেখানকার প্রাচীন মানুষের প্রাণধারণের প্রয়োজন পূরণে শস্যসম্পদের মূল কারণ ছিল। অন্যদিকে দেখা যায় যে ওই নদীর তীরেই বৈদিক যুগের আর্য ঋষিরা সেই প্রাচীন যুগে আত্ম-উপলব্ধিতে পূর্ণ হয়ে ‘সামগান’, ‘বেদানুশীলন’ এবং ‘ব্রহ্মজ্ঞানের স্বরূপ বিদ্যাচর্চা’ করতেন। ওই নদীর ধারে ধারেই একদিন সেই সুপ্রাচীনকালে, যখন আজকের সভ্য জগৎ অন্ধকারে ছিল, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দর্শন-চিন্তার জন্ম হয়েছিল। সেখান থেকেই একদিন সমগ্র বিশ্বকে পরিপূর্ণ সাম্যবাদী ঋষিরা আহ্বান জানিয়েছিলেন - “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”। ফলে কালক্রমে বৈদিক চেতনায় দেবী সরস্বতী এবং নদী সরস্বতী একই রূপে বিকশিত। ইতিহাসে তিনি মা ও দেবীরূপে যেমন, নদীরূপেও তেমনি উজ্জ্বল। এই প্রসঙ্গে ‘রমেশচন্দ্র দত্তের’ (ঋগ্বেদের দেবগণ, পঞ্চম প্রস্তাব) বক্তব্যকে অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “প্রাচীনা দেবদেবীদিগের মধ্যে কেবলমাত্র সরস্বতী দেবী নদীও বটেন, বাগদেবীও বটেন। সরঃ শব্দ অর্থে জল, সরস্বতী অর্থে জলবতী। ভারতবর্ষে যে সরস্বতী নামক নদী আছে, তাহাই প্রথমে পবিত্ৰ নদী বলিয়া উপাসিত হইত। সুতরাং সরস্বতী নদী অচিরে সেই মন্ত্র ও স্তুতির দেবী, অর্থাৎ বাগ দেবী হইয়া গেলেন।” ‘ঋগ্বেদের’ প্রথম মণ্ডলের তৃতীয় সূক্তের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ মন্ত্রগুলো এমন ভাবে রচিত যে, সেই মন্ত্রগুলি একই সঙ্গে নদী ও দেবীর পক্ষে প্রযুক্ত হতে পারে। ‘ঋগ্বেদের’ দ্বাদশ মন্ত্রে বলা হয়েছে - “সরস্বতী প্রবাহিতা হইয়া প্রভূত জল সৃজন করিয়াছেন এবং জ্ঞান উদ্দীপন করিয়াছেন।” উক্ত তিনটি মন্ত্রের ব্যাখ্যা করে ‘সায়ণাচার্য’ বলেছিলেন - “দ্বিবিধা হি সরস্বতী বিগ্রহবদ্দেতা নদীরূপাচ”। অর্থাৎ, “নদী, দেবীর দুই রূপ শেষ পর্যন্ত এক রূপে এসে সার্থকভাবে মিলেছে।” বৈদিক যুগের প্রথম দিকে কিন্তু সরস্বতী ‘সাকারা’ ছিলেন না, কিন্তু কালক্রমে বাস্তব প্রয়োজনে এবং উপাসনার কারণে সরস্বতী ‘সাকারা’ হয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, অনেক ঋষি এবং আর্যকে সরস্বতী নদীর কুল ছেড়ে দিয়ে বাস্তব কারণেই ক্রমে ক্রমে সরস্বতীকুল থেকে দূর দূরান্তে দেশের অন্যান্য প্রান্তে চলে যেতে হয়েছিল। তাঁরা যখন অন্যান্য জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিলেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই নদী সরস্বতীর বিকল্প হিসেবে নিজেদের আরাধ্যা দেবীর ধ্যান করবার জন্য তাঁরা মূর্তি কল্পনা করতে শুরু করেছিলেন। সময়ের ব্যবধানে সেই কল্পনাশক্তির বিকাশেই সরস্বতী প্রতিমার আবির্ভাব ঘটেছিল। সরস্বতী নদীর পবিত্রতা এবং সরস্বতী দেবীর জ্যোতির্ময়তা বোঝাতেই দেবীপ্রতিমাকে ‘শুভ্রবসনা’ এবং ‘সর্বশুক্লা’ করা হয়েছিল। নদীর ‘নাদ’ এবং নদীকুলের ‘সামগান’ যেন দেবীর বীণার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। পদ্মময় এবং হংস-বিহারে চঞ্চলা নদী সরস্বতীর অস্তিত্বকে স্মরণ করেই একটা সময়ে দেবী মূর্তির সাথে পদ্ম ও হংসও যুক্ত হয়েছিল (অতীতের একটা সময়ে ‘ময়ূর’কে দেবী সরস্বতীর বাহন বলে গণ্য করা হত)। ফলে আর্যঋষির কল্পনায় শেষপর্যন্ত যে দেবীমূর্তি রচিত হয়েছিল, সেটার মধ্যেও ‘পবিত্রতোয়া’ নদীর রূপ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল এবং দুই রূপের মিলনে আরেক নতুন রূপ সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে বৈদিক সরস্বতীই ক্রমবিবর্তনের ধারায় পৌরাণিক সরস্বতীতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘দেবীভাগবতে’ বলা হয়েছে যে, সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতিরই অংশ। অর্থাৎ, তিনিই ‘মহামায়া’ এবং ‘জগন্মাতা’র এক বিশেষ রূপ। আবার কোথাও কল্পনা করা হয়েছে যে - ‘লক্ষ্মী’, ‘সরস্বতী’ ও ‘গঙ্গা’ - বৈকুণ্ঠনিবাসী নারায়ণের স্ত্রী। এসব সম্পর্কে অনেক পৌরাণিক কাহিনীও রয়েছে। আবার ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র ‘উত্তরলীলা’য় দেখা যায় যে, ‘মহাসরস্বতী’ ‘শুম্ভ’ ও ‘নিশুম্ভ’কে সংহার করেছিলেন। ‘স্কন্দপুরাণের’ ‘প্রভাস খণ্ডে’ দেবী সরস্বতীর নদীরূপে পৃথিবীতে অবতরণের কাহিনী পাওয়া যায়। আবার বিভিন্ন প্রচলিত লোককাহিনীতে লক্ষ্মী সরস্বতীর সপত্নী-বিরোধের অনেক লৌকিক ঘটনার বর্ণনাও পাওয়া যায়। ‘রামায়ণের’ যুগে, ক্রৌঞ্চমিথুনের শোকে ‘মহর্ষি বাল্মিকী’র অন্তরে যখন গভীর দুঃখবোধ দেখা দিয়েছিল, তখন ‘তমসা’ নদীর তীরে ‘বাগেশ্বরী’র আবির্ভাব ঘটেছিল। তারপরে দুঃখকাতর ও বেদনাহত ঋষির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল -
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।”
‘শোক’ থেকে জন্ম বলেই এর নাম ‘শ্লোক’। আর এই ছন্দেই ‘রামায়ণ’ রচিত হয়েছিল।
বর্তমানে শুনতে বিস্ময়কর লাগলেও, বৈদিক ভারতে কিন্তু বর্তমানের বিদ্যার দেবীর সামনে পশুবলি প্রচলিত ছিল। শুধুমাত্র প্রচলিত ছিল বললে কম বলা হবে, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র ও পুরাণে রীতিমতো নিয়ম করে দেবী সরস্বতীর উদ্দেশ্যে পশুবলির নিদান দেওয়া হয়েছে। ‘শতপথ-ব্রাহ্মণে’ সরস্বতীর কাছে বলি কেমন করে শুরু হয়েছিল সে সম্বন্ধে একটি আখ্যান আছে। ঋষি ‘ত্বষ্টা’র পুত্র ছিলেন ‘বিশ্বরূপ’। ইন্দ্রের সঙ্গে বিশ্বরূপের বিবাদ হয়েছিল, ফলে ইন্দ্র বিশ্বরূপকে নিহত করেছিলেন। বিশ্বরূপ ইন্দ্রের হাতে মারা যাবার পরে ত্বষ্টা ইন্দ্রের উপরে খুব চটে গিয়েছিলেন। ইন্দ্রকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য তিনি আশ্চর্য যাদুশক্তিসম্পন্ন ‘সোমরস’ আনিয়েছিলেন (‘ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ’-এর ১ম খণ্ড, ৩৫তম অধ্যায়ে ব্যাপারটি অন্য রকমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে ইন্দ্র ‘ত্বষ্টা’কে হত্যা করে ব্রহ্মহত্যাকারী হয়েছিলেন। এছাড়া ত্বষ্টা ‘বৃত্র’ নামের যে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি করেছিলেন, ইন্দ্র তাঁকেও হত্যা করেছিলেন। ইন্দ্র ‘যতিবেশী রাক্ষসদের’ মেরে বুনো কুকুরদের দিয়ে খাইয়েছিলেন। ইন্দ্র ব্রাহ্মণবেশধারী ‘অরুর্মঘদের’ বধ করেছিলেন। এমনকি ‘দেবগুরু বৃহস্পতিকে’ও তিনি প্রতিহত করেছিলেন। এই পাঁচ অপরাধের জন্য দেবতারা ইন্দ্রকে বর্জন করলে ইন্দ্র সোমপানে বঞ্চিত হয়েছিলেন। ‘কৌষীতকি-ব্রাহ্মণ উপনিষদ’ ও ‘তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে’ এই উপাখ্যানগুলি পাওয়া যায়)। ইন্দ্র সেই খবর পেয়ে ওই বিশেষ সোমরস পান করবার জন্য বড় উৎসুক হয়েছিলেন। তিনি যজ্ঞের জন্য আনা যজ্ঞার্থ ত্বষ্টার সেই সোমরস জোর করে কেড়ে নিয়ে পুরোটাই গলঃধারণ করেছিলেন। ফলে ত্বষ্টার যজ্ঞ পণ্ড হয়ে গিয়েছিল। ত্বষ্টা যাতে আর কোন যজ্ঞ না করতে পারেন, ইন্দ্র সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন। আর সেই কাজের ফল ইন্দ্রের জন্য খুব খারাপ হয়েছিল। ওই বিশেষ সোমরস তাঁর শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তিনি শরীরের জ্বালায় ছটফট করে চারিদিকে ছুটে বেড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রতি অঙ্গ থেকে বীর্য (ইন্দ্রিয়) খসে পড়তে শুরু করেছিল। ইন্দ্র তাঁর তেজ, বলবীর্য সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিলেন। (শতপথ ব্রাহ্মণ: ১২.৭.১.১-২) ‘নমুচি’ নামের এক অসুর ইন্দ্রকে জব্দ করবার জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। তিনি ওই সময় ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছিলেন। (শতপথ ব্রাহ্মণ: ১২.৭.১.১০) নমুচি ইন্দ্রের শারীরিক দৌর্বল্য দেখে তাঁকে সুরার সাহায্যে বিশেষরূপে বলহীন করে সোমের প্রভাব নষ্ট করে দিয়েছিলেন। ইন্দ্রের সেই দুর্দশা দেখে অন্যান্য দেবতারা হায় হায় করে উঠেছিলেন। দেবতারা ঠিক করেছিলেন যে যিনি ইন্দ্রকে সুস্থ করতে পারবেন, তাঁরা তাঁকে পশুবলি দেবেন। শেষে তাঁরা ঠিক করেছিলেন যে, ‘অশ্বিনীকুমার’দের ছাগ এবং ‘সরস্বতী’কে মেষ বলি দেওয়া হবে। (শতপথ ব্রাহ্মণ: ১২.৭.১.১০-১২) এদিকে ইন্দ্র নিজের রোগমুক্তির জন্য ‘ভিষকের’ সাহায্য গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। বৈদিক যুগে ‘ভিষক’ ছিলেন ‘অশ্বিনীদ্বয়’। তার পরেও বরাবরই তাঁদের ভিষক বলে খ্যাতি ছিল। ‘শুক্ল-যজুর্বেদ’ সরস্বতীকেও ভিষক বলেছে। শুধু সেটাই নয়, ভিষক যে অশ্বিনীদ্বয়, যজুর্বেদ সরস্বতীকে তাঁদের স্ত্রীও বলেছে। নদীরূপা সরস্বতীর সুস্থতাসম্পাদনকারিণী শক্তির পরিচয়ও প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। অশ্বিনীদ্বয় যখন নমুচির কাছ থেকে সোম গ্রহণ করেছিলেন, দেবী সরস্বতী সেটাকে ‘সংস্কৃত’ করে দিয়েছিলেন। ইন্দ্র অশ্বিনীদ্বয় ও সরস্বতীর শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। এই ইন্দ্রই নমুচিকে বর দিয়েছিলেন যে তিনি নমুচিকে দিনে বা রাতে দণ্ডাঘাতে, তীর ধনুক দিয়ে, খালি হাতে, শুষ্ক কিংবা আর্দ্র কোন বস্তু দিয়ে বধ করবেন না। সরস্বতী ইন্দ্রকে রোগমুক্ত করবার জন্য ‘সৌত্রামণী যাগের’ সৃষ্টি করেছিলেন। তাতে ইন্দ্র নীরোগ হয়ে নিজের আগের তেজ ফিরে পেয়েছিলেন। এরপরে সরস্বতী ও অশ্বিনীদ্বয় জলাভিসেচনপূর্বক ইন্দ্রের জন্য ‘বজ্র’ তৈরি করে দিয়েছিলেন। এরপরে ইন্দ্র রাত শেষ হয়ে আসছে অথচ সূর্যোদয় হয়নি এমন একটা সময়ে না-শুষ্ক না-আর্দ্র - ‘অভিষিক্ত ফেনের’ দ্বারা নামুচির শিরশ্ছেদ করেছিলেন। (শতপথ ব্রাহ্মণ: ১২.৭.৩.১-৪) সরস্বতী অশ্বিনীদ্বয়ের সাহায্যে সৌত্রামণী যাগের সৃষ্টি করেছিলেন বলে তিনি মেষ বলিস্বরূপ পেয়েছিলেন। তাই বৈদিক যুগের ভারতে সৌত্রামণী যাগে ইন্দ্র ও অশ্বিনীদ্বয়ের বলির সঙ্গে সরস্বতীর উদ্দেশ্যে মেষ বলিও দেওয়া হত। ‘শ্রৌতসূত্রকার কাত্যায়ন’ উপদেশ দিয়েছিলেন যে, সোমযাগে বিভিন্ন দেবতার কাছে জীববলি দিতে হয়। ‘কেশ-বপনীয়ের’ একমাস পরে অথবা ‘তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণ’ (১৮.১৯) মতে পক্ষান্তে অমাবস্যার দিন ও শুক্লা প্রতিপদে ‘ব্যুষ্টিদ্বিরাত্র’ করতে হয়। ব্যুষ্টিদ্বিরাত্র করতে হলে ‘অগ্নিষ্টোম’ ও ‘অতিরাত্র সোমযাগ’ করতে হয়। অতিরাত্রের সঙ্গে ‘ষোড়শী যাগ’ করবার ব্যবস্থা ছিল। ষোড়শীতে ইন্দ্রের দাবী অনুসারে তাঁর কাছে তিনটি বলি দিতে হত। ‘কাত্যায়নসূত্রের’ (৯.৮.৫) নির্দেশ অতিরাত্রে সরস্বতীর কাছে চতুর্থ বলিটি দিতে হত। তার একমাস পরে অথবা শ্রাবণী পূর্ণিমায় ‘ক্ষত্ৰধৃতি’ নামের অগ্নিষ্টোম করতে হত। তারপরে কৃষ্ণপক্ষে হত ‘সৌত্রামণী যাগ’। সৌত্রামণী যাগে অনেক বিশেষ করণীয় ছিল। ‘শতপথ-ব্রাহ্মণ’ (৫.৫.৪.১) অনুসারে, অশ্বিনীদ্বয় লোহিতাভ শ্বেত বর্ণের বলে তাঁদের কাছে ‘লোহিতাভ শ্বেত ছাগ’ বলি দিতে হয় এবং সরস্বতীর কাছে ‘মেষ’ (এড়ক) বলি দিতে হয়। সম্পূর্ণ সোমযাগের সাতটি অঙ্গ ছিল। সপ্তম ও শেষ অঙ্গ ছিল ‘বাজপেয়’৷ ‘অতিরাত্র’ ও ‘অপ্তোর্যাম’ ছাড়া বাজপেয় ছিল একটি স্বতন্ত্র যাগ। বাজপেয়েও ষোড়শী যাগ করে তিনটি বলি দিতে হত। তারপরে সরস্বতীর কাছে চতুর্থ বলিটি দিতে হত। অশ্বমেধ যজ্ঞের মধ্যম দিনে নানা দেবতার উদ্দেশ্যে ন্যূনতম ৩৪৯ টি গ্রাম্য ও আরণ্য পশুকে যূপে ও যূপান্তরালে বেঁধে রাখতে হত৷ যে পশুগুলিকে যূপে বাঁধা হত, সেগুলোর মধ্যে সব ধরনের রকম পশু, পাখি, কীট পতঙ্গই থাকত। ওই অশ্বমেধ যজ্ঞে অন্যান্য বিশেষ বিশেষ দেবতার মত বাক ও সরস্বতীর জন্য পৃথক বলির ব্যবস্থা ছিল। সরস্বতীর জন্য ‘মেষী’ প্রভৃতি গ্রাম্য পশু, এবং ‘পুরুষবাক’, অর্থাৎ মানুষের মত কথা বলতে পারে, এমন আরণ্য পশু থাকত। গ্রাম্য পশুগুলিকে সত্যি সত্যিই বলি দেওয়া হত, আর আরণ্য পশুগুলিকে মন্ত্রবলি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’তেও সরস্বতীর বলির কথা জানা যায়। সেখানে বাকশক্তিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি যদি ভালো করে কথা বলতে না পারে, তাঁকে সরস্বতীর জন্য একটি মেষী বলি দেবার নিদান দেওয়া হয়েছে, কারণ সরস্বতীই বাক। ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’ বলছে যে সরস্বতীর কাছে মেষী বলি দিলে সেই ব্যক্তি দেবীর প্রসাদে ‘বাগবিভব’ লাভ করবেন। ‘অশ্বমেধ-যজ্ঞে’ও একটি মেষীকে সরস্বতীর উদ্দেশ্যে বলি দিতে হত। (শতপথ ব্রাহ্মণ: ১২.২.২৪) শতপথ-ব্রাহ্মণ ছাড়াও ‘কৃষ্ণযজুর্বেদ’, ‘তৈত্তিরীয়-সংহিতা’ (১.৮.১৭), ‘তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণ’ (১. ৮.১), ‘আম্বলায়ন-শ্রৌতসূত্রে’ও (৩.৯.২) সরস্বতীর জন্য পশুবলির নির্দেশ রয়েছে। ‘পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ’ লিখেছিলেন, “সরস্বতীর নিকট বলির প্রথা এখনও লোপ পায় নাই। ভদ্রকালীর নিকট বলির ব্যবস্থা আছে। ভদ্রকালী সরস্বতী - নীলাভ৷ বাংলার বরিশাল অঞ্চলে আজও সরস্বতীর নিকট সাদা ছাগ বলি দেওয়া হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলায় ষোড়শোপচার আয়োজনে নীল সরস্বতীর পূজা হইয়া থাকে। প্রতিমা নীলবর্ণের হয়। নীল-সরস্বতীর নিকট শ্বেত ছাগ বলি দিবার ব্যবস্থা। মাদারীপুর সবডিভিজনের অন্তর্গত কার্তিকপুরেও সরস্বতীপূজার দিন সরস্বতীর নিকট ছাগাবলি দেওয়া হয়। মাদারীপুরের অন্যান্য জায়গায় এ প্রথা প্রায়ই নাই ৷ পাবনা জেলায় সিরাজগঞ্জ মহকুমায় সরস্বতী পূজায় সাদা ছাগল বলি দিবার ব্যবস্থা আছে। বরিশালে মাদারীপুরে এবং পূর্ববঙ্গের আরও দুই এক জায়গায় ছাত্রেরা পরীক্ষায় সাফল্যলাভ করিতে সরস্বতীর নিকট পাঁঠাবলির মানস করিয়া থাকে। পশ্চিমবঙ্গে সরস্বতী পূজার দিনে নিরামিষ ভোজনই বিধি। কিন্তু পূর্ববঙ্গে অধিকাংশ স্থলে ইহার ব্যতিক্রম দেখিতে পাওয়া যায়। বাখরগঞ্জ জেলায় বিশেষত বরিশাল, রহমৎপর, গৈলা প্রভৃতি স্থানে সরস্বতী পূজার পূর্বে কাহারও বাড়িতে ইলিশ মাছ আসে না; ঐ দিন প্রথম ইলিশ মাছ আনিয়া খাইতে হয়। জলাবাড়িতে ঐ দিন ইলিশ মাছ খায় এবং পাঁঠা বলি দেয়। সিরাজগঞ্জ মহকুমায়, বিক্রমপুর, ময়মনসিংহে ঐ দিন গৃহস্থগণ প্রথম ইলিশমাছ খায়। চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের অন্তর্গত কোটালিপাড়ায়ও ঐ দিন কেহ মাছ খায় না। কুমারখালি ও তাহার নিকটবর্তী স্থান পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের সীমায় অবস্থিত। এই সমস্ত স্থান অধুনা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হইলেও পূর্ববঙ্গের প্রথানুসারে সরস্বতীপূজার দিন প্রথম ইলিশ মাছ খাওয়ার নিয়ম বজায় রাখিয়াছে৷ মাদারীপুর সবডিভিজনে অধিকাংশ জায়গায়ই সরস্বতীপূজার দিন জোড়া ইলিশমাছ খাওয়ার নিয়ম আছে। যদি জোড়া ইলিশমাছ না পাওয়া যায়, তাহা হইলে একটি মাছের সঙ্গে একটি লম্বা বেগুন একসঙ্গে করিয়া জোড়া করিয়া লওয়া হয়। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলে বিজয়া দশমীর দিন কেহ কেহ জোড়া ইলিশ মাছ বাড়িতে আনিয়া থাকেন। ইহারা পরেও ইলিশমাছ খাইয়া থাকেন। কিন্তু যাঁহারা ঐ দিন জোড়া ইলিশ না আনেন, তাঁহারা সরস্বতীপূজা পর্যন্ত আর ইলিশ মাছ খাইতে পারেন না।”
অধুনা বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে বিস্ময়ের শেষ কিন্তু এখানেই নয়। ১২৭৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি–মার্চ মাসে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাবু’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ - ‘বাংলার নব্যবাবুদের নিয়ে’ ‘বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যঙ্গাত্মক একটি প্রবন্ধ’। সেখানে দুটো লাইন ছিল - “যিনি রূপে কার্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নির্গুণ পদার্থ, কর্মে জড়ভরত এবং বাক্যে সরস্বতী তিনিই বাবু। যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।” লাইন দুটির ‘আলঙ্কারিক অর্থ’, ‘সামাজিক ব্যঞ্জনা’ অনেক। সে সব সরিয়ে রেখে সাদা চোখে দেখলেও কিন্তু দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। এক, ‘সরস্বতী বাগ্দেবী’। দুই, ‘তিনি মূলতঃ পূজিতা হতেন পতিতাপল্লীতে’। ‘নিষিদ্ধপল্লীতে’ দেবী সরস্বতী! অবাক করা মনে হলেও এটা সত্যি। ‘বাৎসায়নের যুগ’ থেকে ‘বাবু–বিলাসের কলকাত্তাইয়া সংস্কৃতি’, সর্বযুগেই বিষয়টা সত্যি। ‘বাৎসায়ন’ লিখেছিলেন, ‘কামদেবের পুজো’ করতে হলে ‘চৌষট্টি কলা’ শিখতে হবে। আর সেই শিক্ষার শুরু হত ‘সরস্বতী পুজোর দিন’। সেই ‘চৌষট্টি কলার মধ্যে’ - ‘গীত’, ‘বাদ্য’, ‘নৃত্য’, ‘ছন্দোজ্ঞান’ যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ‘ছলিতকযোগ’, ‘দ্যূতক্রীড়া’, ‘আকর্ষক্রিয়া’ প্রভৃতিও। এক কথায় ‘নাচ–গান–বাজনা থেকে ছলকলা’, ‘জুয়ো খেলা’, ‘কবিতা লেখা ও বোঝা’, সব কিছুই ‘চৌষট্টি কলা’র মধ্যে পড়ে। আর এসব কিছুরই ‘অবিসংবাদী দেবী সরস্বতী’। ‘দেবীর শাস্ত্রসম্মত গায়ত্রী মন্ত্রে’ও তাই ‘কামদেবের অনিবার্য উল্লেখ’ পাওয়া যায় - “বাগ্দেব্যৈ বিদ্মহে কামরাজায় ধীমহি, তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ॥” ‘বাৎসায়ন’ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার ব্যাপারস্যাপার। প্রায় শ’দেড়েক বছর আগেকার কলকাতাতেও সেই ‘অভিন্ন ছবি’ ছিল। ‘সরস্বতী পুজোতে’ শহরের ‘নিষিদ্ধপল্লীর’ ঘরে ঘরে পাওয়া যেত ‘আনন্দ–আসরের চিত্র’। ‘নেবুতলা থেকে রামবাগান’, ‘হাড়কাটাগলি থেকে হালসিবাগান’, সর্বত্র একই ‘লহরী’ দেখা যেত। ‘সমাজ কুচিত্র নকশা’য় সেই ‘আনন্দলহরী’রই হদিশ দিয়েছিলেন ‘হুতোম প্যাঁচা’, অর্থাৎ ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ এভাবে - “সরস্বতী পুজোর আর পাঁচদিন আছে। রাত্রি ঘোর অন্ধকার, তথাপি ইয়ার দলের শঙ্কা অথবা বিরামের নাম নাই। ... সকল বেশ্যাবাড়ির দরজাতেই প্রায় জুড়ি, তেঘুড়ি, চৌঘুড়ি খাড়া রয়েচে। গৃহমধ্যে লালপানির চক্চক্, চেনাচুরের ছপ্ছপ্ ও বোতল গেলাসের ঠন্ঠন্ শব্দ শুনা যাচ্ছে। ... সরস্বতী পুজোর খরচের কল্যাণে অনেকস্থলে গাঁটকাটা, রাহাজানি, সিঁদ, হত্যা, ডাকাতি, জুয়াচুরি ইত্যাদি ঘটনা হচ্ছে। শহর টল্টোলে।” অর্থাৎ, ‘শ্রীপঞ্চমী’ আসার দিন পাঁচেক বাকি থাকতেই ‘নিষিদ্ধ পল্লীতে পল্লীতে’ সরস্বতী পুজোর আনন্দে ‘নিষিদ্ধ কর্মের বাড়াবাড়ি’ দেখা যেত। তখন ‘প্রতিপদ’ থেকেই বদলাতে থাকত ‘শহরের চালচিত্র’। বদলাতে থাকত ‘কুমোরটুলি’র ছবিটাও। সে সবও পাওয়া যায় ‘হুতোমের লেখা’ সেই ‘সমাজ কুচিত্র নকশা’য় - “কুমোরটুলির নগ্দা সরস্বতীরা বেধড়ক বিক্রি হয়ে মুটের মাথায় উঠ্চেন, কুমোরেরা শেষকালে আর জোগাতে না পেরে, বাড়তি দোমেটে করা জগদ্ধাত্রী ঠাকুরুনের হাতি ও সিঙ্গি ভেঙে দুখানি হাত কেটে ও ঘাড় বেঁকিয়ে সাদা করে স্থান পূর্ণ কচ্চে। রাজপথ যেন সরস্বতীময় বোধ হচ্চে। ডাকের সাজকর, মিঠাইকর, শোলার পদ্মফুল ও গাঁদাফুলের দোকানে আজ অসঙ্গত খদ্দের।” ‘কুমোরটুলি’র চারিদিকে ব্যস্ততা থাকত অন্তহীন। কারণ সরস্বতী পুজোর দিনই তো ‘নিষিদ্ধপল্লীর ঘরে ঘরে’ নতুন নতুন ‘নৃত্য প্রদর্শন’, ‘গীত পরিবেশনের’ শুরু হত। সেইসঙ্গে ‘বারঙ্গনা’ ও ‘তাঁদের বাবুদের’ নিজস্ব মনোরঞ্জনের জন্য ‘যাত্রাপালা’র বন্দোবস্ত করা হত। তখন প্রতিবেশে ব্যস্ততার প্রসৃতিতে মিশে থাকত সে সব অনুষঙ্গও। হুতোমের লেখা থেকে জানা যায়, “ওদিকে তালিম, অমিল ও মওলা দিতেই দুদিন কেটে গ্যালো। রাস্তার ধারে পোড়ো বাড়িতে ঝাঁকড়াচুলো যাত্রাওয়ালাদের মওলার ‘হ্যায় হ্যায়’ শব্দ থামলো। ... ফেরিওয়ালারা আজ বেগুনে বস্ত্র, ময়ূরপুচ্ছ দেওয়া চূড়ো ও চিত্রকরা হাঁড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরচে। আবির, আম্রমুকুল, অভ্র ও যবের শীষেরা তাহাদের হাঁড়ির ভিতর থেকে উঁকি মারচে।” অর্থাৎ, একদিকে যেমন পুজো-উপলক্ষে ‘নাচ-গান-যাত্রার মহড়া’ চলত, অন্যদিকে তেমনই চলত ‘পুজোর উপচার কেনাবেচা’। ‘তৃতীয়া’য় বাড়ি বাড়ি প্রতিমা আসার পর ব্যস্ততার ছবিটা বদলে যেত। হুতোম সেটার বর্ণনা করেছিলেন এভাবে - “বাড়ি বাড়ি প্রতিমে সাজানো আরম্ভ হয়েচে। এক বাড়ির বিবির আগে উজ্জুগ হয় নাই, দিন গ্যালো দেখে তিনি তাঁহার বাবুর গলায় অভিমানে গামছা দিয়েছেন। বাবু তাঁহার পিতামহীর সিঁদুক ভেঙে দুছড়া চাঁদি কাটা পৈঁছে ও একটা সিঁদুর চুপড়ি চুরি করে তাড়াতাড়ি মাটির কাজ আরম্ভ করে দিলেন। ... মোসাহেব ও উমেদারেরা আজ নিমেষমাত্র বাবুর কাছছাড়া হচ্চে না।” আর পুজোর আগের রাতে, ‘হুতোমের লেখা’ থেকে পাওয়া যায় - “আসার সাজানো, দেবীঘট, নারকেলের মুচি ও আম্রশাখা সংগ্রহ কর্ত্তেই দিন শেষ হল। রাত্রিতেও অনেক কাজ গুছিয়ে রাখা হল। অনেকের নিদ্রাই হল না।” কিন্তু ‘বাবুদের’ ছিল ‘সুখী শরীর’ ‘বিনিদ্র রজনী যাপনে’ সে শরীরে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই - “রেজিমেন্টের মতো ফুলবাবুর ঝাঁক গড়া গড়া শুয়ে পড়লেন; কিন্তু শয়ন কর্ত্তে কর্ত্তেই শৃগাল, কাক ও কুক্কুট ডেকে উঠল।” ওদিকে ভোর হতেই - “একটি কামিনী হাই তুলে আলস্য ত্যজে দেখলেন, তিনি তাঁহার দোলন নথের বিলিতি মুক্তোর নোলকটি ভক্ষণ করে ফেলেছেন।’’ ‘হুতোম’ বর্ণিত ‘নাকের নোলক’ ঘুমের ঘোরে গিলে ফেলার ঘটনাটা কতদূর সত্য, সেকথা জানার উপায় নেই। তবে একটা কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে ‘সেকালের কলকাতার যাবতীয় ব্যস্ততার কেন্দ্রস্থল’ আজকের মতো ‘স্কুল–কলেজ’ ছিল না, ছিল ‘বারঙ্গনাগৃহ’। এ নিয়ে ১৮৬৫ সালের ‘সমাজ কুচিত্র দর্পণ’ পত্রিকার জানুয়ারি সংখ্যায় যথেষ্ট ‘শ্লেষ’ লক্ষ্য করা যায়। ওই পত্রিকার ‘সরস্বতী পূজা’ শীর্ষক ‘নক্শায়’ লেখা হয়েছিল, “পাঠকগণ মনে করুন, আশ্বিন মাসের শারদীয় পঞ্চমীর মতো এ পঞ্চমীর তত মাহাত্ম্য নাই, তথাপি শহরে আমোদের স্রোত ধরচে না। ... বারঙ্গনা পল্লীর কথাই এক স্বতন্ত্র। সেখানে শহরের রকমারি আমোদের ও আমোদপ্রিয় দলের মানচিত্র অঙ্কিত হয়েচে। হিন্দুধর্ম যেন ইয়ং বেঙ্গলদের ভয়ে, ধুনো, শাঁখ, গঙ্গাজল ও পবিত্রতায় আচ্ছাদিত হয়ে ওই সকল কুঞ্জে লুকিয়ে রয়েচেন।” সেই যুগের কলকাতায় ‘উপপত্নীর বাড়িতে’ ‘বাবুদের স্পনসর করা সরস্বতী পুজো’ হত। সে পুজো দেখতে সাধারণ দর্শকের প্রচুর ভিড় হত। ‘নিমন্ত্রিত অতিথি’ হিসেবে সেখানে থাকতেন ‘বাবুদের ইয়ারদোস্তরা’ও। অতীতের ‘সমাজ কুচিত্র দর্পণ’ পত্রিকার পাতায় সে দৃশ্যও বর্ণিত হয়েছিল এভাবে - “দর্শকেরা এইরূপ রাজবেশে দশ বাড়ির ঠাকুর দেখে আমোদ করে বেড়াতে লাগলেন। ... আতরদান গোলাবপাশ হস্তে এক এক জন লম্বোদর প্রায় সকল বাড়ির প্রতিমের সমুখে হাজির আছেন। তাঁরা নিমন্ত্রিতদের মুখে, চোখে, বুকে গোলাপবৃষ্টি কচ্চেন, আর আড়ে আড়ে হাসছেন।” ওদিকে ‘শ্রীপঞ্চমীর রাতে’ এসব ছবি বদলে গিয়ে ‘অন্য দৃশ্যপট’ ফুটে উঠত। সেকালের কলকাতার ‘নিষিদ্ধপল্লী’তে ‘শ্রীপঞ্চমীর রাতে’ হত ‘কৌমার্যহরণের অনুষ্ঠান’, চলত ‘নথভাঙা’র আয়োজন। যাবতীয় ‘নান্দনিকতা’, ‘সরস্বতীর সঙ্গে সম্পর্কিত যাবৎ সৌকর্য’ সরিয়ে তখন সেখানে ‘কামের বহ্ন্যুৎসব’ শুরু হত। দাউ দাউ করে ‘কামের আগুন’ তখন বড্ড স্থূল হয়ে জ্বলত। সেই সঙ্গে থাকত ‘মদের নেশায় তাবৎ বেসামাল বাবুদের’ আকুতি। ‘সমাজ কুচিত্র নকশা’য় ‘হুতোম’ সেই ‘নরকদৃশ্যের’ বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে - “এক বাবু তালে তালে নাচতে নাচতে জড়িত জিহ্বায়’ গান জুড়েছেন। কখনও গাইছেন ‘দিবানিশি তোরো লাগি, ঝরে আমার দু–নয়ান’, কখনও আবার ‘ক্যান্ লো এমন হলি প্রাণপিয়াসী সই।’ …” বাবু গাইছেন আর ঘুরে ঘুরে নাচছেন, “বিবি তবলা বাজাচ্চেন।” দূরে ফেরিওলার কণ্ঠে ভেসে আসছে, “বেলফুল, চাই বরোফ।” এমন সময় পাঁচ মাতাল বাবু দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। তাঁদের গলায় একটাই কথা “মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ।” এমন গান আর দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঘরের ভেতরকার বাবুর গান বদলে গেল। তিনি ‘কালোয়াতি আওয়াজে’ ধরলেন “কে এলি শঙ্করী এলি উমা এলি মা”। বাবু দরজা খুলতে পা বাড়ালেন। “আর কর্রো কি?” বলে পেছন থেকে বাবুর কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করলেন বিবি। বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে বিবিকে দেখতে পেলেন। “... ‘কে মা শুভঙ্করি! পদ্ম থেকে উঠে এলি ক্যান বাপ?’ বলে বিবিকে নিয়ে প্রতিমের উপর বসাতে চল্লেন।” প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এসব নাটক চলল। বাইরে তখনও অপেক্ষমাণ পঞ্চ মাতাল। দরজা খুলে দেওয়ামাত্র তাঁদের প্রবেশ। প্রতিমা দেখেই তাঁদের সাষ্টাঙ্গ প্রণাম শুরু। সেই সঙ্গে মুখে বুলি, “মা আমার বসে রয়েচেন যেন লম্বোদরী দশানন।” বাড়ির কর্তা তখন অতিথিদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। তিনি বললেন, “কাম হিয়ার মাই জলি ফ্রেন্ডস”। আর বলার সঙ্গে করমর্দন অব্যাহত। বাড়িওয়ালি তখন বোতল ও গেলাস হাতে “এই এসো!” বলে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কোনও কোনও বাবু সরস্বতীর পাদপদ্মে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। বিচিত্র বস্তু নিবেদন। যেমন, “বাবুদের একজন তাঁর লবঙ্গ মাসির রান্নাঘর থেকে একটি ঝাড়ানো লাঙ্গুলবিশিষ্ট সাদা দধিমুখী মেনি বেড়াল চুরি করে এনেছিলেন, সেইটি মা সরস্বতীর শ্রীপাদপদ্মে উপহার দিলেন। একটা হাসির গর্রা উঠল।” আর পরদিন? “আমোদের খোয়ারিতে চক্ষু মহাদেবের মতো ঢুলু ঢুলু কচ্চে। ... বৈকালে পুলিসের পাসের নিয়মমতো মাকে বিসর্জন করে নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁরাও বাঁচলেন সরস্বতীরও এক বৎসরের মতো হাড় জুড়ুলো।”
মোটামুটি ‘খ্রীস্টিয় পনেরো শতকের শেষের দিকে’ ‘নবদ্বীপে’ বাস করতেন ‘স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য’। তিনিই ‘সারদাতিলক তন্ত্রের ধ্যানমন্ত্র’ থেকে সরস্বতীকে তুলে এনেছিলেন বাঙালির কাছে। ধ্যানমন্ত্রের সেই ‘দেবীমূর্তি অনিন্দ্য শুভ্রতা’ প্রকাশ পেয়েছিল ‘ভারতচন্দ্রের কলমে’ -
“শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস
শ্বেতবীণা শ্বেতহাঁস
শ্বেতসরসিজ নিবাসিনী।”
‘স্মার্ত রঘুনন্দন’ কিন্তু ‘সরস্বতীর মূর্তিপুজোর কথা’ কোথাও বলেননি। বঙ্গে প্রাচীনকালে মূর্তিপুজোর প্রচলনও তাই ছিল না। ‘যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি’ জন্মেছিলেন ১৮৫৯ সালে। তিনি বেঁচেছিলেন ১৯৫৬ পর্যন্ত। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “আমরা পাঠশালায় ... শুক্ল পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা করিতাম। কিন্তু ইস্কুলে সরস্বতী পূজা হইত না। আমরা বাড়িতে শ্লেট দোয়াত কলমে পূজা করিতাম। সে বই বাংলা কিংবা সংস্কৃত, ইংরেজি হইতে পারিত না। (কারণ) ইংরেজি ম্লেচ্ছ ভাষা।” সরস্বতীর অনেক কিছুর মতো ‘মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথি’র ব্যাপারটাও বেশ গন্ডগোলের। ‘মাঘী শ্রীপঞ্চমী তিথি’টা ছিল ‘লক্ষ্মী’র। ‘মহাভারত’–এর ‘বনপর্বে’ আছে, এই তিথিতে ‘স্কন্দ’ অর্থাৎ ‘কার্তিকের সঙ্গে দেবসেনারূপী লক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছিল’। সে বিয়েতে ‘পুরোহিত’ ছিলেন ‘স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি’। কিন্তু ‘শ্রী’ বা ‘লক্ষ্মী’র সঙ্গে লেপ্টে থাকা ‘তিথি’টাকে ‘সরস্বতীর জন্য হাইজ্যাক’ করেছিলেন ওই ‘স্মার্ত রঘুনন্দন’ই। তিনি বিধান দিয়েছিলেন, ওদিন ‘লক্ষ্মী’কে ‘ধূপ’, ‘অন্ন’, ‘ফুল’, ‘জল’ দেওয়া হোক আর ‘‘মস্যাধারং লেখনীঞ্চ’’কে পুজো করা হোক। ‘দোয়াত কলমের পুজো’ হবে। অতএব ‘লেখাপড়া’ ওদিন বন্ধ। আর সেদিনই পালন হবে ‘সারস্বত’ উৎসব। ‘উৎসব’ নিয়েই সেই অতীত থেকে লোকের যত মাতামাতি, ‘পুজো’ নিয়ে অত কে আর মাথা ঘামায়! ফল যা হবার সেটাই হয়েছিল। ‘লোকচরিত্রের’ এই বৈশিষ্ট্যের সৌজন্যে ‘শ্রীপঞ্চমী’ ‘লক্ষ্মী’কে ছেড়ে চলে এসেছিল ‘সরস্বতীর ঝুলিতে’। পরবর্তিকালে বলা শুরু হয়েছিল, সরস্বতীরও আর একটা নাম ‘শ্রী’। অথচ ‘অমর সিংহেয় সময় অবধি’ প্রাচীন কোনও ‘কোষে’ এরকম কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাতে কী বা আসে যায়! ‘শ্রীপঞ্চমীর শ্রী’ যদি সরস্বতী হন তবে ওদিন ‘সরস্বতী পুজো’টা বৈধতা ভালমতোই পেয়ে যায়। অতএব ‘লক্ষ্মীর তিথি’ সরস্বতীতে পুরোদস্তুর ‘অন্বিত’ হয়েছিল।
বর্তমানে সরস্বতী পুজোর রং, রূপ, জৌলুস সবই অনেকটা ফিকে হয়ে গিয়েছে। এখন মাঘের শীত বাঘের গায়ে তো দূরের কথা, বাঙালির গায়েও আর লাগে না। এখন আর পুরানো দিনের মত সরস্বতী পূজার আগের রাতে মালা গাঁথায়, শিকলি তৈরি করায় কচিকাঁচারা ব্যস্ত থাকে না। আগেকার দিনে - সাত সকালে নিম-হলুদ বাটা সর্বাঙ্গে মেখে ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করে, সরস্বতীর চরণতলে পড়ার সবচেয়ে শক্ত বইটি জমা রেখে, অঞ্জলি দিয়ে নারকেলি-টোপাকুল খেতে খেতে স্কুল কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া - এটাই ছিল ছাত্রছাত্রীদের বাৎসরিক রুটিন। তখন ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ছেলেরা, শাড়ি পরা মেয়েরা সবাই কেমন যেন অন্ততঃ এক দিনের জন্য হলেও বড় হয়ে যেত। তখন কোন বয়েজ স্কুলে ঢুকতে দুঃসাহসিনী মৌটুসিদের এক ফোঁটা জড়তাও কাজ করত না। তখন গার্লস স্কুলগুলোকে বছরের অন্যদিন রূপকথার গল্পের স্বার্থপর দৈত্যের বাগান বলে মনে হলেও, সরস্বতী পুজোর দিন কিন্তু ছেলেরা সেখানে অনায়াসে নির্বিবাদে ঢুকে পড়তে পারত। তখন বাড়িতে পুজো, কোচিঙে পুজো, পাড়ার পুজো - সবমিলিয়ে সরস্বতীপুজোর ওই একটা দিন যেন ছেলে মেয়েদের ব্যস্ততার কোন শেষ থাকত না। কিন্তু বছর বিশেক হল সেই পুরানো ছবিটা দ্রুত বদলে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় এখন কালী ও শনিভক্তদের দাপাদাপি লক্ষ্যণীয়। প্রায় দু’হাত দূরে দূরেই কালী আর শনিপুজো। কিন্তু সরস্বতী পুজো? আগের মত সবার উদ্যোগে, বিশেষতঃ ছোটদের উদ্যোগে বড়দের সাহায্যে কয়টা হয় সেটা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। এখন শাড়ি পরা বালিকা-কিশোরীরা শহরে তো নয়ই; এমনকি বাসন্তী পঞ্চমীর সকালে গ্রামের মোরামপথেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শখের বশে ওই একদিনের জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া কিছু পাওয়া গেলেও, ধুতি পরা বালক-কিশোরও এখন দুর্লভ। অনেক বাড়িতেই এখন আর সরস্বতীপুজো হয় না। স্কুলগুলিতেও প্রায় নমো নমো করেই পুজো সারা হয়। এখন আর সেই শাড়ি-ধুতি নেই; আধুনিক, অতি আধুনিক পোশাকে ‘বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে’র মেজাজে কিছু ছেলেমেয়ে ঘুরে ইতিউতি ঘুরে বেড়ালেও সরস্বতী পুজোর সেই জৌলুস আর নেই। বাংলার সরস্বতীপুজো এখন কেমন যেন বর্ণহীন হয়ে পড়েছে, আর যত দিন যাচ্ছে, সেই বর্ণহীনতা যেন আরো বেড়ে চলেছে।
সরস্বতীপূজা হোক বা দুর্গাপূজা - বাঙালির সোনালী অতীতের সঙ্গে কলকাতার যে পরিবারটি একসময় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল, বাঙালির চিন্তা ও সংস্কৃতির উপরে যে পরিবারটির ঐতিহাসিক প্রভাব রয়েছে, সেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সরস্বতীপুজোর কথা বললে সেকালের সরস্বতী পুজো নিয়ে লেখা অসম্পূর্ন থেকে যায়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সুদূর অতীতের একসময়ে মহাসমারোহে দুর্গাপুজো ও জগদ্ধাত্রীপুজো হত। যদিও পরবর্তীকালে সেখানে দুর্গা-জগদ্ধাত্রী সব পুজোই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পুজো বন্ধ হলেও ওই সব উৎসবের আনন্দ কিন্তু সবসময়ই জোড়াসাঁকোকে ছুঁয়ে যেত। সেখানকার বাসিন্দাদের মনে মনেও উৎসবের রং লাগত। জোড়াসাঁকোয় দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল ‘নীলমণি ঠাকুরের’ আমলে। ‘প্রিন্স দ্বারকানাথের’ আমলে সেখানে দুর্গাপুজোকে ঘিরে রীতিমত আনন্দ বিতরণের মচ্ছব বসত, আর সেই সুলভ আয়োজনে তখন কলকাতার সাহেবসুবোরাও যোগ দিতেন। তাঁদের জন্য সেখানে খানাপিনার যথেচ্ছ আয়োজন করা হত। এরপরে ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের’ ঠাকুরবাড়িতে পুজো নিয়ে সেই বাড়াবাড়ি দ্রুত কমে গিয়েছিল। ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠার পরে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী মহর্ষি অবশ্য পুজোর দিনগুলিতে বাড়িতে থাকতেন না। তিনি নিজে ব্রাহ্ম হলেও অন্যের ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া যে উচিত নয়, সেই বোধ তাঁর মধ্যে সর্বদাই জাগ্রত ছিল। তিনি বলতেন, “আমাদের পরিবারের মধ্যে কাহারো যদি ইহাতে বিশ্বাস থাকে, কাহারো ভক্তি থাকে, তাহাতে আঘাত দেওয়া অকর্তব্য।” তাই সেই বোধ থেকেই পৌত্তলিকতা বিরোধী ও ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী হয়েও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো বা জগদ্ধাত্রীপুজো - কোন পুজোই সহসা বন্ধ করে দেননি। ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠার বছর দশেক পরে বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সবার অনুমতি নিয়ে তবেই তিনি জগদ্ধাত্রী পুজো বন্ধ করেছিলেন। তবে ঠাকুরবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো বন্ধ হওয়ার পরেও সেখানে আরো ন’বছর ধরে দুর্গাপুজো অব্যাহত ছিল। কথিত রয়েছে যে, প্রিন্স দ্বারকানাথের অপরূপা সুন্দরী স্ত্রী ‘দিগম্বরী দেবী’র মুখের আদলেই নাকি ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মুখাবয়ব তৈরী করা হত। ইতিহাস বলে যে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর অল্পবয়সে, যখন তিনি ব্রাহ্ম হননি, তখন যথেষ্ট ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন। তখন তাঁর সেই বিশ্বাস যে কতটা তীব্র ছিল, সেটা তাঁরই স্বীকারোক্তি থেকে বুঝতে পারা যায়। তখন পরীক্ষা-বৈতরণী অতিক্রম করবার তাগিদে তিনি মন্দিরে টিপ-টিপ প্রণাম করতেন। এই প্রসঙ্গে ‘আত্মস্মৃতি’তে কোন রাখঢাক না করেই তিনি লিখেছিলেন, “প্রতিদিন যখন বিদ্যালয়ে যাইবার পথে ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীকে প্রণাম করিয়া পাঠের পরীক্ষা হইতে উত্তীর্ণ হইবার জন্য বর প্রার্থনা করিতাম, তখন মনের এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।” তাঁর সেই ভাবনার মধ্যে আর যেটাই থাকুক না কেন, কোন অভিনবত্ব অবশ্য ছিল না। তাঁর মতোই অধিকাংশ মানুষই তখন তাই ভাবতেন, আর আজও ভাবেন। ওই সময়ে ‘পাঠের পরীক্ষা’ নিয়ে ভাবিত দেবেন্দ্রনাথের সেই কালী-প্রণামের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি তাঁর আস্থা ও ভক্তি পরায়ণতাই স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। তাই সেই মানুষটিই যখন পরে সরস্বতী-বন্দনায় ব্রতী হয়েছিলেন বলে জানতে পারা যায়, তখন সেটাকে অভাবনীয় নয়, বরং স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন পরম বৈভবশালী বিত্তবান প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র। তাই সংগত কারণেই তাঁর সরস্বতী- বন্দনাতেও চূড়ান্ত বৈভব প্রদর্শিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে মহর্ষির জীবনীকার আশ্রম বিদ্যালয়ের শিক্ষক ‘অজিতকুমার চক্রবর্তী’ লিখেছিলেন, “একবার তিনি প্রায় লাখ টাকা খরচ করিয়া খুব ধুমধামের সঙ্গে বাড়িতে সরস্বতী পুজো করিয়াছিলেন।” অজিতকুমারের লেখা মহর্ষি জীবনীতে বলা সরস্বতীপুজোর প্রসঙ্গটি মহর্ষি কন্যা ‘সৌদামিনী দেবী’র লেখাতেও পাওয়া যায়। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পিতৃস্মৃতি’ রচনায় ওই প্রসঙ্গে সৌদামিনী দেবী লিখেছিলেন, “অল্প বয়সে পিতা একবার সরস্বতী পুজো করিয়াছিলেন। কী কারণে পিতামহ তখন বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না। সেই পূজায় পিতা এত প্রচুর অর্থব্যয় করিয়া সমারোহ করিয়াছিলেন যে সেই পার্বণে সহরে গাঁদাফুল ও সন্দেশ দুর্লভ হইয়া উঠিয়াছিল।” ঠাকুরবাড়ির ওই সরস্বতী পূজার ফলে বাজারে গাঁদাফুল ও ময়রার দোকানে সন্দেশ না থাকবার জন্য, সব ফুল-সন্দেশ জোড়সাঁকোয় চলে যাওয়ার জন্য, তখনকার কলকাতার সাধারণজনের যে কী দুর্ভোগ হয়েছিল, সেটা সহজেই অনুমেয়! হয়তো সাধারণ মানুষ সেবারে গাঁদাফুল ছাড়াই অঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, আর সন্দেশ ছাড়াই হয়ত দেবীর দেবীর প্রসাদ সাজানো হয়েছিল। কিন্তু মহর্ষি অত গাঁদাফুল দিয়ে কী করেছিলেন, আর কেনই বা তাঁকে বাজারের সব ফুল কিনে নিতে হয়েছিল - সেই প্রশ্নও মনে জাগাটা খুবই সংগত! এই প্রসঙ্গে অজিতকুমার জানিয়েছিলেন, “গাঁদাফুল দিয়া তিনি প্রকাণ্ড এক সামিয়ানার মতো তৈরি করিয়াছিলেন।” সেই ফুল-সামিয়ানার নিচে বসানো হয়েছিল সুসজ্জিত বিশালাকার সরস্বতী মূর্তি। মহর্ষির জীবনীকার আরো জানিয়েছিলেন যে, সেই বিশালাকার সরস্বতী প্রতিমাকে নিয়ে সবাইকে কী ঝঞ্ঝাট-দুর্ভোগই না সইতে হয়েছিল! অজিতকুমার লিখেছিলেন, “প্রতিমাও এত মস্ত হইয়াছিল যে, বিসর্জনের সময় নানা কৌশলে তাহাকে বাড়ি হইতে বাহির করিতে হয়। সব সুদ্ধ ব্যাপারটাতে যে কেবল ঐশ্বর্যের জাঁক-জমক ছিল তাহা নয়, সৌন্দর্যবোধেরও যথেষ্ট পরিচয় ছিল।” একই প্রসঙ্গে সৌদামিনী দেবীও লিখেছিলেন, “প্রতিমাও এত প্ৰকাণ্ড হইয়াছিল যে বিসর্জনের সময় নানা কৌশলে তাহা বাড়ি হইতে বাহির করিতে হয়।” কিন্তু তাতে ‘সৌন্দর্য বোধের’ কোন পরিচয় যতই থাকুক না কেন, সরস্বতীপুজোর নাম লাখ টাকার সেই বিপুল ব্যয় স্বয়ং দ্বারকানাথও মেনে নিতে পারেন নি। বৈভব প্রদর্শন, অর্থের অপচয়, আমোদ-প্রমোদ - এসব তখন দ্বারকানাথের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল; মহর্ষি সেদিক থেকে তাঁর পিতার পদাঙ্ককেই অনুসরণ করেও পিতৃদেবের বিরাগ-ভাজন হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে অজিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর তাঁর ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন, “পূজায় এতটা খরচ দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে বাড়াবাড়ি বলিয়া বোধ হইয়াছিল।” সৌদামিনী দেবীও তাঁর লেখায় দ্বারকানাথের অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, দেবেন্দ্রনাথ কি সেই একবারই ঠাকুরবাড়িতে সরস্বতী পূজার আয়োজন করেছিলেন, নাকি তারপরেও ঠাকুরবাড়িতে সরস্বতীপুজো হয়েছিল? সেই তথ্য নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। মহর্ষি পুত্র ‘সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ তাঁর ‘আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস’ গ্রন্থের ‘আমার বাল্যকথা’ পর্যায়ে জোড়াসাঁকো বাড়ির পুজোর কথা বলেছিলেন, এবং সেখানে সরস্বতী পুজোর কথাও ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে ষোল বছরের বড় ছিলেন। তাঁর বাল্যকালে জোড়াসাঁকোয় আদৌ সরস্বতী হত কি না, সেই তথ্য অবশ্য স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। তবে সত্যেন্দ্রনাথের স্মৃতিতে সরস্বতী পুজো নিয়ে ঘটে যাওয়া একটি নিদারুণ ঘটনা আমৃত্যু সজীব থেকে গিয়েছিল। সেই ঘটনাটি তাঁর জীবনে সুদূর প্রসারিত স্থায়ী ছাপও ফেলেছিল। একবার সরস্বতীপুজোয় অঞ্জলি দিয়ে তিনি দক্ষিণার টাকা প্রতিমার দিকে লক্ষ্য করে এমনভাবে ছুঁড়ে মেরেছিলেন যে তাতে দেবীর মুকুটই ভেঙে গিয়েছিল! তখন অল্প বয়সের জন্য সে কাজে তাঁর কোন অনুশোচনা না হলেও, পরে অবশ্যই হয়েছিল। এবং সেজন্যই পরিণত বয়সে নিজের জীবনের যাবতীয় ব্যর্থতার মধ্যে তিনি তাঁর প্রতি সরস্বতীর অপ্রসন্নতাকেই খুঁজে পেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, “অল্প বয়স থেকেই মূর্তি পূজার উপর আমার কেমন বিতৃষ্ণা ছিল। … এক সময়ে আমাদের বাড়ি সরস্বতী পূজা হত। মনে আছে একবার সরস্বতী প্রতিমা অর্চ্চনায় গিয়েছি শেষে ফিরে আসবার সময় আমার হাতে যে দক্ষিণার টাকা ছিল তাই দেবীর ওপরে সজোরে নিক্ষেপ করে দে ছুট! তাতে দেবীর মুকুট ভেঙে পড়ল। এই অপরাধে তখন কোনও শাস্তি পেয়েছিলুম কি না মনে নাই, কিন্তু হাতে হাতে সাজা না পেয়ে থাকি তার ফলভোগ এখন বুঝতে পারছি। বাঁশিতে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। আমার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা ক্ষয়ে যাচ্ছে - স্মৃতিভ্রংশ হতে আরম্ভ হয়েছে। আমি যে আমার সার্ভিসের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে পারিনি সেও ঐ কারণে। সরস্বতী প্রসন্ন থাকলে হাইকোর্টের আসন অধিকার করে পদত্যাগ করতে পারতুম - আমার ভাগ্যে আর তা হ’ল না।” সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস’ পর্যায়ের রচনাগুলি ‘ভারতী’ পত্রিকায় দু’বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি একটি আস্ত গ্রন্থ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৫ সালে, তার আট বছর পরে অর্শরোগে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন। তাই সহজেই অনুমান করা যায় যে, নিজের জীবনের একেবারে শেষ বেলায় পৌঁছে সরস্বতী পুজোয় করা অপকর্ম নিয়ে তাঁর মনে তীব্র অনুশোচনার সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু সরস্বতী কি তাঁর উপরে সত্যিই রুষ্ট হয়েছিলেন? সরস্বতী কি আদৌ কোনদিন ঠাকুর পরিবারের উপরে রুষ্ট হয়েছিলেন? ঠাকুরপরিবারের সরস্বতীর বরপুত্রদের নিয়ে আজও বাঙালির বিস্ময়ের কোন শেষ নেই! ওই পরিবারের শুধু পুত্ররাই বা কেন, কন্যা-বধূরাও তো সাহিত্য-শিল্প চর্চায় কম কিছু ছিলেন না। তাঁদের উপরেও নিশ্চয়ই সবসময় দেবীর অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ ছিল। ১৮৮১ সালে জোড়াসাঁকোয় ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকটি অভিনীত হয়েছিল। সেই নাটকে ‘হেমেন্দ্রনাথ’-কন্যা ‘প্রতিভা’ সরস্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে রবিজীবনীকার ‘প্রশান্তকুমার পাল’ লিখেছিলেন, “এদেশে ভদ্রঘরের কোনও নারীর প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ে, অভিনয়ের এইটিই প্রথম দৃষ্টান্ত।” ওভাবেই তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও নতুন, নতুনতর দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন। সেদিন সরস্বতীরূপী প্রতিভার কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল, “এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার, / যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার।” সেটা তো শুধু সরস্বতীর ‘বীণা’ ছিল না, সেটা ছিল এক আশ্চর্য ক্ষমতা, আর সেই দীপ্ত ক্ষমতার জোরেই জোড়াসাঁকো বাড়ির মানুষজন অতীতে যে দিকে নিজেদের হাত বাড়িয়েছিলেন, সেদিকেই সোনা ফলেছিল।
(তথ্যসূত্র:
১- হুতোম প্যাঁচার নকশা, সমাজ কুচিত্র পল্লীগ্রামস্থ বাবুদের দুর্গোৎসব; কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ।
২- সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩- পৌরানিক উপাখ্যান, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, সুবর্ণরেখা।
৪- সরস্বতী সারদার অনুধ্যানে, অরুণ কুমার বিশ্বাস, আনন্দ পাবলিশার্স।
৫- বিলুপ্ত সরস্বতী ও আর্য-হরপ্পা প্রসঙ্গ, কৃষ্ণেন্দু দাস, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স (২০১১)।
৬- সরস্বতী, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ।
৭- মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী।
৮- পিতৃস্মৃতি, সৌদামিনী দেবী।
৯- আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।)
No comments