Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জাপানে নেসলে-কফির জাদু: আশিস কুমার পণ্ডা

জাপানে নেসলে-কফির জাদু:  আশিস কুমার পণ্ডা
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাপান ছিল চায়ের দেশ। চা শুধু একটি পানীয় নয়—এটি ছিল জাপানের সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে, যখন জাপানের অর্থনীতি জোর ক…

 



জাপানে নেসলে-কফির জাদু:  আশিস কুমার পণ্ডা


শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাপান ছিল চায়ের দেশ। চা শুধু একটি পানীয় নয়—এটি ছিল জাপানের সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে, যখন জাপানের অর্থনীতি জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক খাদ্য ও পানীয় সংস্থা নেসলে বুঝতে পারে, জাপানে ব্যবসা শুরু করার জন্য এটাই সেরা সময়। তারা তাদের জনপ্রিয় কফি ব্র্যান্ড ‘নেসকাফে’ জাপানে চালু করল; উদ্দেশ্য একটাই— চা-প্রেমী জাপানিদের কফির দিকে আকৃষ্ট করা। বিজ্ঞাপন, আকর্ষণীয় প্যাকেজিং, ছাড়, ও নানা ধরনের প্রমোশনের পিছনে নেসলে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করল, তবুও কিছুতেই ফল হল না। কফি জাপানিদের মন জয় করতে পারল না। প্রচলিত সব মার্কেটিং কৌশল ব্যর্থ হল। এই পরিস্থিতিতে, নেসলে এক নতুন পথ বেছে নিল। তারা নিয়োগ করলো জিলবেয়ার ক্লোতার রাপাইয়ে নামে একজন ফরাসি মনোবিশ্লেষক ও মার্কেটিং বিশেষজ্ঞকে। তার কাজ ছিল একটাই—জাপানের মানুষ কফি কেন পছন্দ করে না, সেটা খুঁজে বের করা। রাপাইয়ে এই নিয়ে ব্যপক গবেষণা করে এক সহজ অথচ বৈপ্লবিক সত্য নেসলের সামনে তুলে ধরলেন: “মানুষের খাদ্য ও পানীয়ের প্রতি আবেগের শিকড় গড়ে ওঠে শৈশবেই। জাপানের শিশুরা ছোটবেলায় কফির স্বাদ পায় না—তাই তাদের মধ্যে কফি নিয়ে কোন স্মৃতি বা আবেগ তৈরি হয় না।“ এই সত্যকে ভিত্তি করে রাপাইয়ে নেসলেকে পরামর্শ দিলেন—“প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে কফি বিক্রি করার চেষ্টা না করে, শিশুদের জন্য কফির-স্বাদযুক্ত মিষ্টি খাবার বাজারে আনুন।“ নেসলে ঠিক তাই করল; কফি বিক্রির পিছনে না ছুটে, তারা স্মৃতি গড়ায় বিনিয়োগ করলো। শিশুদের পছন্দের উপযোগী অনেক মজাদার কফি-স্বাদের খাবার তারা বাজারে আনল—যেমন কফি-লজেন্স, কফি-চকলেট, কফি-জেলি, এবং নানা ধরনের কফি-স্বাদের মিষ্টি খাবার। লক্ষ্য ছিল একটাই—শিশুদের মনে কফি নিয়ে ছোট ছোট ভালো লাগার মুহূর্ত তৈরি করা। যেন তারা বড় হয়ে কফিকে শুধু একটি পানীয় নয়, শৈশবের একটুকরো মিষ্টি স্মৃতি হিসেবেও মনে রাখে।

ফলাফল?

১৯৮০-এর দশকে সেই শিশুরাই বড় হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করল। কাজের চাপ আর ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি থেকে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে তারা খুঁজতে লাগল শক্তির উৎস। স্বাভাবিকভাবেই তারা বেছে নিল এমন কিছু, যার সঙ্গে তাদের ছোটবেলার ইতিবাচক স্মৃতি জড়িয়ে ছিল—অর্থাৎ কফি। নেসলে তখন আবার বাজারে তাদের ইনস্ট্যান্ট কফি এবং নতুন নতুন কফির পণ্য চালু করল। এবার, নেসলে শুধু কফি বিক্রি করল না, জাপানিদের কফির প্রেমে পড়তে সাহায্য করল। সাফল্য এল ঝড়ের মতো। বিক্রি হল আকাশচুম্বী, কফির দোকান গজিয়ে উঠল দেশের কোনায় কোনায়, আর কফি হয়ে উঠল ফ্যাশন, রুচি, আর আধুনিকতার প্রতীক। ২০১০-এর দশকে জাপান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কফি আমদানিকারক দেশে পরিণত হল। আজকের দিনে, জাপান প্রতিবছর ৫ লক্ষ টনেরও বেশি কফি আমদানি করে, এবং সেখানে নেসলে-ই বাজারে একক আধিপত্য ধরে রেখেছে।

নেসলের এই সাফল্য শুধু ব্যবসায়িক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় নয়—এটি আমাদের শিশুদের বিকাশ ও প্রাথমিক অভ্যাস গঠনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

একটি শিশু শৈশবে যা দেখে, শোনে, খায় বা শেখে —সেই অভিজ্ঞতাই তার অভ্যাসে রূপ নেয়। আর এই অভ্যাসই ধীরে ধীরে তৈরি করে তার রুচি, চিন্তা আর পছন্দ। তাই শিশুদের শেখাতে হবে খুব যত্ন নিয়ে, ভেবে-চিন্তে। কারণ, তারা অনেক সময় এমন কিছু মুহূর্ত আজীবন মনে রাখে যা আমরা খেয়ালই করি না। আমরা যখন শিশুর হাতে মোবাইল, খাবার বা গল্প তুলে দিই—তখন আমরা শুধু তাদের সময় কাটানোর উপায় করে দিই না, আমরা গড়ে তুলি আগামীর সমাজ। শৈশব শুধু জীবনের শুরু নয়—এটাই জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই এই সময়টিকেও সম্মানের সঙ্গে দেখা দরকার। আপনি সত্যিই যদি একটি প্রজন্মকে বদলাতে চান, তাহলে শুরু করুন শিশুদের দিয়ে—কারণ, বদলের আসল বীজ বপন হয় সেখানেই।

No comments