সেফটি পিন: কালজয়ী এক আবিষ্কার -আশিস কুমার পণ্ডা!১৮৪৯ সালের ব্যস্ত নিউ ইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে, তিপান্ন বছর বয়সী এক স্বশিক্ষিত যন্ত্রবিদ এবং উদ্ভাবক ওয়াল্টার হান্ট তার অগোছালো ডেস্কে সেদিন ঝুঁকে বসে আছেন। চারপাশে ছড়িয়ে আছে…
সেফটি পিন: কালজয়ী এক আবিষ্কার -আশিস কুমার পণ্ডা!
১৮৪৯ সালের ব্যস্ত নিউ ইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে, তিপান্ন বছর বয়সী এক স্বশিক্ষিত যন্ত্রবিদ এবং উদ্ভাবক ওয়াল্টার হান্ট তার অগোছালো ডেস্কে সেদিন ঝুঁকে বসে আছেন। চারপাশে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন আকারের কাগজের উপর আঁকা অজস্র স্কেচ ও ছোট ছোট নোট—কিছু যান্ত্রিক, কিছু চিকিৎসাবিষয়ক; প্রতিটি ভাবনাতেই নতুন কিছু গড়ে তোলার স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। কিন্তু সেই বিশেষ দিনে, হান্ট কোন বড় কিছু আবিষ্কারের পেছনে ছুটছিলেন না, তিনি তাড়াহুড়ো করছিলেন একটি ছোট ও সহজ কিছু তৈরি করতে, যাতে করে মাত্র ১৫ ডলারের একটি ঋণ শোধ করা যায়। আট ইঞ্চি লম্বা একটি পিতলের তার নিয়ে তিনি চিন্তিতভাবে আঙুলের চারপাশে স্প্রিংয়ের মতো প্যাঁচাচ্ছিলেন। হঠাৎই তাঁর মনে দেখা দেয় এক উজ্জ্বল ভাবনার ঝলক। সেই ভাবনা অনুযায়ী তারটিকে নিয়ে কাজ করতে করতে তিনি গড়ে তুললেন এক অভিনব সরঞ্জাম; যার এক প্রান্তে রইলো একটি ছোট স্প্রিং, অন্য প্রান্তে তারের একদিকে একটি সূচালো মাথা এবং সেই প্রান্তেই তারের অন্যদিকে একটি বন্ধনী বা ক্ল্যাম্প । স্প্রিং চেপে ধরে তিনি তারের ধারালো প্রান্তটি বন্ধনীর মধ্যে গুঁজে দিলেন। ধারালো প্রান্তটি ঠিকঠাক বন্ধনীতে আটকে গেল। একেবারে সহজ, কার্যকর এবং সবচেয়ে বড় কথা নিরাপদ।
এইভাবেই ওয়াল্টার হান্ট আবিষ্কার করলেন ‘সেফটি পিন’—যা তিনি সেই সময়ে ‘ড্রেসিং পিন’ নামে পরিচিত করিয়েছিলেন।পোশাক আটকাতে পিন ব্যবহারের ধারণা অবশ্য নতুন ছিল না। প্রাচীন মিশর, গ্রীস ও রোমে কাঁটা পিন ব্যবহারের ইতিহাস ছিল।
হাড়, কাঠ বা ধাতু দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পিন পোশাক আটকাতে ব্যবহার করা হতো। ১৯শ শতকে ধাতব পিন প্রচলিত হলেও তা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সূচালো প্রান্তভাগ এবং ভালো করে আটকানোর কোনও ব্যবস্থা না থাকায় এগুলো সহজেই আঙুলে বিঁধত বা খুলে যেত। হান্টের ডিজাইন সেই সমস্যার সমাধান করল। তার আবিষ্কারের অভিনবত্ব ছিল একটি কুণ্ডলী যা স্প্রিং-এর মতো কাজ করত এবং একটি বন্ধনী যা ধারালো প্রান্তটিকে ঢেকে রাখত; সহজ কিন্তু মেধাবী এক সমাধান—পরিচিতের মাঝে নতুনত্ব।
১৮৪৯ সালের ১০ জুলাই—এই দিনটিতে ওয়াল্টার হান্ট সেফটি পিনের পেটেন্ট লাভ করেন। পরবর্তীকালে এই দিনটিই ‘আন্তর্জাতিক সেফটি পিন দিবস’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু, আর্থিক টানাপোড়েনে, মাত্র ৪০০ ডলার মূল্যে তিনি W.R. Grace and Company-কে এই পেটেন্টটি বিক্রি করে দেন। হান্ট তার আবিষ্কার থেকে ধনী হতে পারেননি, কিন্তু তার ছোট্ট সৃষ্টি নিঃশব্দে সাধারণ মানুষের জীবনে বড় পরিবর্তন এনে দেয়।
সেফটি পিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার উপযোগিতা প্রমাণ করেছে। এটি কেবল একটি উপকরন নয়; এটি ছিল বিশ্বাসের এক সহজ রূপ। মায়েরা এটি দিয়ে শিশুদের ডায়াপার আটকাতেন। হারিয়ে যাওয়া বোতাম এবং জীপারের বিকল্প হিসাবে বা ঢিলা পোশাক ধরে রাখতে সকলেই এটি ব্যবহার করতেন। নার্সেরা ব্যান্ডেজ আটকে রাখতেন। দর্জিরা কয়েক সেকেন্ডেই পোষাকের ছেঁড়া দিক ঠিক করে ফেলতেন। বিদ্রোহী রক তারকারা এটি পরতেন বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে। সৈনিকরা ইউনিফর্মে ব্যাজ আটকে রাখতেন। আর শরণার্থীরা সব কচু হারিয়ে ফেলার পরেও সম্মান টিকিয়ে রাখতেন এই পিনের মাধ্যমে।
এর পর, বছরের পর বছর কেটে গেছে, যুগ বদলেছে। পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে গেছে। ঘোড়ার গাড়ির বদলে পেট্রোলের গাড়ি রাস্তায় ছুটছে। টেলিফোন মুঠোফোন হয়ে গেছে। কম্পিউটার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। মানুষ চাঁদে পা রেখেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো লিখতে ও ভাবতে শুরু করেছে। একটিমাত্র টিকায় মারণ রোগের প্রতিকার মিলেছে। তবু, এত পরিবর্তনের মধ্যেও সেফটি পিন রয়ে গেছে—নম্র, সাদামাটা ও অপরিবর্তিত।বছরের পর বছর ধরে, ইঞ্জিনিয়ার ও ডিজাইনাররা সেফটি পিনে নতুনত্ব কিছু আনতে চেয়েছেন। কেউ রঙ্গীন প্লাস্টিকের আবরণ যোগ করেছেন, কেউ ঝাঁ-চকচকে বন্ধনী তৈরি করেছেন, কেউ বা চুম্বকীয় লক লাগিয়েছেন। কিন্তু বারবার মানুষ ফিরে গেছেন হান্টের সেই মূল ডিজাইনে—সরল, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত, ঠিক তেমনই। এক প্রতিভার নিঃশব্দ সাক্ষ্য হয়ে, আজও সেফটি পিন রয়ে গেছে আমাদের চারপাশে— মহিলাদের হাতব্যাগে, ড্রেসিং টেবিলে, সেলাই বাক্সে, ফার্স্ট-এইড কিটে, যন্ত্রপাতির বাক্সে, এমন কী জাদুঘরের শোকেসে।
সেফটি পিন আমাদের এক নিঃশব্দ অথচ গভীর সত্য শেখায়:
‘টিকে থাকার জন্য, সব কিছুর পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না’।
আজকের পৃথিবীতে যেখানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তণ, হালফ্যাশন ও নতুন সংস্করনই সাফল্যের মাপকাঠি, সেখানে সেফটি পিন স্থিরতা, স্বচ্ছতা ও উদ্দেশ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ১৭৫ বছর ধরে এটি একটুও পাল্টায়নি: এমন নয় যে একে অবহেলা করা হয়েছে, বরং এটি শুরু থেকেই যথেষ্ট ছিল। এমন নিখুঁত ভারসাম্য ও কার্যকারিতা ছিল এর নকশায়, যা আর কিছু যোগ না করেই যুগের পর যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক থেকেছে। তাই, সত্যিকারের স্থায়িত্ব আসে ধারাবাহিকতা থেকে, পরিবর্তন থেকে নয়। কিছু জিনিস এত স্পষ্ট লক্ষ্য ও সরলতায় তৈরি হয় যে সময় তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তারা নিজের কাজটাই এত নিখুঁতভাবে করে যে নতুন কিছু হওয়ার দরকার পড়ে না। সেফটি পিন তাই শুধু এক বস্তু নয়—এ এক চিরকালীন আস্থা, এক পরিণত নকশার নিঃশব্দ বিজয়।
No comments