হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা- আশিস কুমার পন্ডা
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা এক জনপ্রিয় প্রাচীন গল্প যা বার বার বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় সাতশ' বছর আগের কথা। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের রাজধানী হানোভার…
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা- আশিস কুমার পন্ডা
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা এক জনপ্রিয় প্রাচীন গল্প যা বার বার বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় সাতশ' বছর আগের কথা। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের রাজধানী হানোভার শহরের দক্ষিণে, হ্যামেলিন নামে ছোট্ট এক শহরের মানুষ ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ইঁদুর বাসা বানাতে শুরু করেছিল শহরের প্রতিটি রাস্তায়, গলিতে, বাড়ির আনাচে-কানাচে, আলমারিতে, রান্নাঘরে, এমনকি বিছানার তলায় পর্যন্ত। তারা সংখ্যায় এতই বেশি হয়ে গিয়েছিল যে, কোনরকম প্রতিরোধ ছাড়াই তারা শহরে তাদের শাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি, বাড়ির বিড়ালদের তারা তাড়া করে শহর-ছাড়া করেছিল। তাই ইঁদুরের সংখ্যা বেড়েই চললো এবং পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে শহরের মানুষ শান্তিতে খেতে, ঘুমাতে, এমনকি রাস্তায় হাঁটতেও পারছিলেন না। শহরের মানুষরা মরিয়া হয়ে, ইঁদুরের সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক কিছুই চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুই কার্যকরী হলো না। একদিন বিকালে, শহরের মেয়র এবং কাউন্সিলাররা যখন শহরবাসিদের দুর্দশা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, রঙ বেরঙের পোশাক পরা এক অদ্ভুত বাঁশিওয়ালা মেয়রের চেম্বারে হাজির হলেন। তিনি বললেন, "বন্ধুগণ, আমি আপনাদের কষ্টের কথা শুনেছি এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমার কাছে এর সমাধান আছে। আমার এই বাঁশি জাদু করতে পারে। এই বাঁশির সুরে আমি ইঁদুরদের প্রলুব্ধ করে, তাদের সবাইকে নিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলে দিতে পারি, যেখান থেকে তারা বেঁচে ফিরতে পারবে না। তবে, এই কাজের জন্যে আমি পারিশ্রমিক নেব ঠিক এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, যা আপনাদের এই গৌরবময় শহরে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য খুব বেশি নয়!" বাঁশিওয়ালার কথা শুনে কয়েকজন কাউন্সিলর মুচকি হাসলেন, কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে টিপ্পনী করলেন, কিন্তু নিরুপায় মেয়র রাজি হলেন এই অদ্ভুত প্রস্তাবে। তিনি বললেন, “এমন জাদু দেখার জন্য এক হাজার সোনার মুদ্রা খুবই সামান্য! আপনি শুরু করুন।“ শহরের অলি-গলি ঘুরে বাঁশি বাজিয়ে চললেন বাঁশিওয়ালা। বড় অদ্ভুত সেই সুর। বাঁশির মায়াবী সুর শুনে একে একে সব ইঁদুর তাদের আস্থানা থেকে বেরিয়ে এসে বাঁশিওয়ালার পিছু নিলো। হ্যামেলিনবাসী অবাক চোখে দেখলেন, বাঁশিওয়ালা শহরের রাজপথ দিয়ে তালে-তালে বাঁশি বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, সেই তালে নাচতে নাচতে তাকে অনুসরণ করে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ইঁদুর। একসময় পথ শেষ হল, সামনেই জল টলটল ওয়েজার নদী। বাঁশিওয়ালা কিন্তু থামলেন না, একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজিয়ে চললেন। তার পিছু পিছু হামেলিনের ইঁদুরবাহিনীও নেমে পড়লো নদীর জলে। হাবুডুবু খেতে খেতে একসময় তারা নদীর জলে তলিয়ে গেল। বাঁশিওয়ালা হ্যামলিনে ফিরে এসে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক চাইলেন। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিলেন শহরের মেয়র ও গণ্যমান্য মানুষরা। রাগে, অভিমানে, তখনকার মতো শহর ছেড়ে চলে গেলেন বাঁশিওয়ালা।
কিছুদিন পর, এক ধর্মীয় উৎসবের দিনে, ফিরে এলেন সেই বাঁশিওয়ালা। শহরের বড়রা তখন গির্জায় জমায়েত হয়ে, সেন্ট জন-পল দিবস পালন করছিলেন। বাঁশিওয়ালা বাজানো শুরু করলেন তার মায়াবী বাঁশি, তবে এবার অন্য এক সুরে। তার বাঁশির সুরে সম্মোহিত হয়ে শহরের সব শিশু নাচতে নাচতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাতে বাজাতে এবার অন্য এক রাস্তায় এগিয়ে চললেন, আর শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে অনুসরণ করলো। বাঁশিওয়ালা শিশুদের নিয়ে হ্যামেলিন শহরের বাইরে এক পাহাড়ের ফাটলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই রহস্যময় বাঁশিওয়ালাকে কিংবা শিশুদের এরপর আর কখনোই দেখা যায়নি।
বহুল প্রচলিত এই গল্পটি একনজরে, সততা এবং প্রতিশ্রুতি পালনের গুরুত্বের শিক্ষা দেয়। তবে, এই গল্পটি নিয়ে চিন্তা করলে কয়েকটি সহজ প্রশ্ন মনে আসে; বাঁশিওয়ালা কি সত্যিই এতটা শক্তিশালী ছিলেন? কেনই বা তার বাঁশি শুনে ইঁদুরেরা এবং শিশুরা তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেছিল? আজকের উন্নত বিজ্ঞানের গবেষনায় জানা গেছে ৫০ কিলো হার্জের শব্দতরঙ্গ ইঁদুরদের আকৃষ্ট করে। গল্পের শেষের অংশে শিশুদের স্বাভাবিক কয়েকটি মানসিক প্রবৃত্তির প্রতিফলন সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাঁশিওয়ালার পোশাক ও বাঁশি বাজানো; শিশুদের কাছে ছিল নতুন, অস্বাভাবিক ও রহস্যময়, যা তাদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল। বাঁশিওয়ালা তাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন এক আদর্শ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তি (role model), তাই তারা বাঁশিওয়ালার সঙ্গ নিতে দ্বিধা করেনি। বাঁশিওয়ালার পিছু পিছু তাদের চলে যাওয়ার নেপথ্যে তাদের সমষ্টিগত মনস্তত্ত্ব ও (Herd mentality) কাজ করেছিল, যেখানে জ্ঞাণ, অভিজ্ঞতার ও স্বাধীন চিন্তার অভাবে শিশুরা অন্যদের বা দলের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করেছিল।
বাস্তবে, শুধু শিশুরা নয়, বেশীরভাগ মানুষেরই নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। শিশুরা যেমন পরিবারের সদস্য, শিক্ষক বা পছন্দের কাউকে অনুকরণ করতে চায়, ঠিক তেমনি প্রাপ্তবয়স্করাও তাদের জীবনযাত্রায় জনপ্রিয় ও সফল ব্যক্তিদের আচরণ, মতামত বা জীবনধারা অনুসরণ করতে চায়। সেই সব আদর্শ ব্যক্তিরা পরোক্ষভাবে, তাদের সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রেরণা যোগান। সেই আদর্শ ব্যক্তিরা হয়ে ওঠেন তাদের জীবনে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। কিন্তু, আদর্শ ব্যক্তিরা প্রেরণা এবং শিক্ষার মূল্যবান উৎস হলেও, তাদের অন্ধ অনুকরণ সকলের জন্যে কার্যকরী হয়ে ওঠে না। এর মূল কারণ হলো, প্রতিটি মানুষের শর্ত, পরিস্থিতি, জীবনের পথ, এবং লক্ষ্য আলাদা। তাই, প্রত্যেকের অবশ্যই নিজস্ব পরিচয়ের বোধ বজায় রাখতে হবে। আদর্শ ব্যক্তিদের পদাঙ্ক অন্ধভাবে অনুসরণ না করে, বিজ্ঞতা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজের নিজের ব্যক্তিত্ব এবং শর্ত অনুযায়ী মার্জিত করে প্রত্যেকের নিজস্ব পথ তৈরি করে নিতে হবে।
No comments