Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

দুটি বীজের গল্প: পরিবর্তনের সাহস বনাম ভয় আশিস কুমার পন্ডা

দুটি বীজের গল্প: পরিবর্তনের সাহস বনাম ভয়আশিস কুমার পন্ডাহেমন্তের এক সকালে, একজন কৃষক দুটি ছোট বীজ তার ক্ষেতের উর্বর মাটিতে ছুঁড়ে দিলেন। বীজদুটি পাশাপাশি শুয়ে রইল, তাদের জানা ছিল না যে ভবিষ্যতে তাদের কী হবে। দিন যায়, হেমন্তের রাত…

 





দুটি বীজের গল্প: পরিবর্তনের সাহস বনাম ভয়

আশিস কুমার পন্ডা

হেমন্তের এক সকালে, একজন কৃষক দুটি ছোট বীজ তার ক্ষেতের উর্বর মাটিতে ছুঁড়ে দিলেন। বীজদুটি পাশাপাশি শুয়ে রইল, তাদের জানা ছিল না যে ভবিষ্যতে তাদের কী হবে। দিন যায়, হেমন্তের রাত ঠান্ডা হতে শুরু করে। ভোরবেলা থেকেই পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ক্ষেতের শিশিরভেজা নরম মাটি ঠুকরে, এলোমেলো করে, পোকামাকড়ের খোঁজ করে চলে। বীজদুটি ধীরে ধীরে মাটির গভীরে ডুবে যেতে থাকে। এক সময়ের নরম এবং মনোরম মাটি, তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হতে শুরু করে। শীতের ঠান্ডা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে এবং বীজদুটি উষ্ণতা ও আদ্রতার অভাবে কুঁকড়ে যায়। দেখতে না পেলেও, তারা অনুভব করে যে তাদের উপরের পৃথিবী একটু একটু করে বরফের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। তাদের আশেপাশের মাটি জমে পাথরের মতো হয়ে যায়, তারা বুঝতে পারে যে তাদের এখন করার কিছুই নেই। তাই, প্রচণ্ড শীতের কামড় সহ্য করে তারা মাটির কোলে চুপচাপ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে।  


দিন এগিয়ে যায়, একসময়, ঋতু পাল্টাতে থাকে এবং ঋতুরাজ বসন্ত বসন্ত তার উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে। বসন্তের জাদুময়ী স্পর্শে পৃথিবী যেন এক নতুন অনুভূতি নিয়ে জেগে ওঠে। বাতাস উষ্ণতা ছড়ায়, মাটির উপরে বরফের আস্তরণ গলতে শুরু করে। সেই জলের ছোঁয়ায় মাটিতে এক নতুন শক্তির সঞ্চার হতে থাকে। প্রথম বীজ, পৃথিবীর তল থেকে মুক্ত হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়ার জন্য এক প্রবল তাগিদ অনুভব করে। সে কৌতূহলী হয়ে ভাবতে থাকে, "উপরে কি কিছু আছে?" সে তার শক্ত আবরণ ভেঙে দিয়ে সবুজ নরম অঙ্কুরকে নরম  মাটি বিদীর্ণ করে উপরের দিকে এগিয়ে দিতে শুরু করে। "আর নীচে কি আছে?", একই সঙ্গে তার মনে প্রশ্ন জাগে এবং পৃথিবীর গভীর থেকে পুষ্টি এবং শক্তি সংগ্রহ করার জন্যে শিকড়গুলিকে জলে ভেজা মাটির নিচে পাঠাতে শুরু করে।


অন্যদিকে, দ্বিতীয় বীজটি অজানার ভয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। সে ভাবে, উপরে কী রয়েছে? তা হয়তো বিপদজনক হতে পারে! হয়তো এখানেই আমার আরো কিছু সময় থাকা উচিত। নিজের পরিচিত জগৎ ছেড়ে অজানার দিকে পা বাড়ানোর কোন দরকার নেই”! তাই, সে যেখানে যেমনভাবে ছিল সেইভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।  


প্রথম বীজ পৃথিবীর বুক চিরে বেরিয়ে এসে এক গভীর আনন্দের অনুভূতি লাভ করে। সূর্যের উষ্ণতা এবং সতেজ বাতাস তার নরম পাতাগুলিকে আলিঙ্গন করে। সে অবাক হয়ে দেখতে পায়; উপরে বিশাল আকাশ, চারপাশে সবুজ ঘাস ও রঙ-বেরঙের ফুল। সে নিজেকে শক্তিশালী এবং মুক্ত বোধ করে, যেন পৃথিবী তার জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বীজ, তখনও তার দ্বিধা নিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে চলে, “কে জানে উপরে আমার জন্যে কী অপেক্ষা করছে? হয়তো কিছু অচেনা বিপদ! তবে, এখানে তো আমি নিরাপদ, যতক্ষণ না পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি, ততক্ষণ এখানে আর কিছুটা সময় অপেক্ষা করাই ভালো।“ কিন্তু, দ্বিতীয় বীজ অপেক্ষা করে থাকলেও, পৃথিবী এগিয়ে চলে। বসন্তের শেষে, প্রথম বীজের কান্ড মাটি ছেড়ে ধীরে ধীরে অনেকটা উপরে উঠে যায়। তার শাখা-প্রশাখা, সবুজ পাতা গর্ব এবং কৃতিত্বের অনুভূতি নিয়ে আকাশের দিকে উঁকি দেয়। তার শিকড় মাটির গভীরে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে কাণ্ডকে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্যে দৃঢ় ভিত্তি নিশ্চিত করে দেয়। দিন যত এগিয়ে যায়, প্রথম বীজ প্রতিটি পরিবর্তন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে থাকে। সূর্যের উষ্ণতা, সতেজ হাওয়া এবং মাটির পুষ্টিকর নির্যাস তাকে আরও শক্তিশালী হতে সাহায্য করে। সে অনুভব করে যে এখন তার শরীর ও মন প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ, এবং যতই বিপদ আসুক না কেন, সেগুলির সঙ্গে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করার জন্য সে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। এদিকে, দ্বিতীয় বীজ তখনও তার ভয় এবং দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে না পেরে, তার গোপন জায়গাতেই থেকে যায়।


একদিন, এক কৌতূহলী মুরগি খাবারের সন্ধানে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে দ্বিতীয় বীজটিকে আবিষ্কার করে ফেলে। কোন দ্বিধা বা দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই সে বীজটিকে ঠোঁটে তুলে নিয়ে গিলে ফেলে। দ্বিতীয় বীজটি কখনও সূর্যের কাছে পৌঁছানোর, পৃথিবী তাকে কী দিতে পারে তা দেখার বা জীবনের পূর্ণতা অনুভব করার সুযোগ পায় না।  


গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস একবার বলেছিলেন, "জীবনের একমাত্র ধ্রুব সত্য হল পরিবর্তন।" পরিবর্তন ছাড়া ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বৃদ্ধি ও বিকাশ একেবারেই অসম্ভব। আমরা যা আছি যদি তাই থেকে যাই, তবে আমাদের স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না। পরিবর্তন কিন্তু, এক দ্বি-ধারী তলোয়ারের মতো; যা একদিকে যেমন উন্নতির সুযোগ এনে দেয়, অন্যদিকে, অনিচ্ছাকৃত নেতিবাচক পরিণতিও ডেকে আনতে পারে। পরিবর্তন যদি ধীরে ধীরে এবং ঠিক সময়ে হয়, তা সহজে গ্রহণযোগ্য এবং স্থায়ী হয়। তাই, সঠিক তথ্যের সঙ্গে সুবিধা-অসুবিধা, সঠিক সময় বিবেচনা করে আমাদের পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  


মানুষ হিসেবে, আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি হল পরিবর্তনকে বাধা দেওয়া। এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে, পরিবর্তন আমাদের আরামের অঞ্চলের বাইরে যেতে বাধ্য করে, যেখানে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না! আরামের অঞ্চল নিরাপদ, পরিচিত এবং আমাদের পুরানো অভ্যাস বা বিশ্বাস ছেড়ে নতুন কিছু গ্রহণ করার দরকার পড়ে না। আমরা অনেকেই পরিবর্তন চাই, কিন্তু একেবারে নিখুঁত মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করি। নিজেদেরকে বোঝাই, "আজকের চেয়ে আগামীকাল ভালো।“ আসলে, আগামীকাল বলে কিছু নাই, আগামীকাল কখনও আসে না। এ এক ফাঁদ এবং এই অপেক্ষার খেলা আমাদের 'ভবিষ্যতের একদিন' এর চক্রে আটকে রাখে। তবুও, আমরা এর পিছনে ছুটতে থাকি। আমাদের সামনে সুযোগ আসতে থাকে, কিন্তু, সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায়, আমরা তাদের চলে যেতে দিই। শেষে আমরা যতটা পাই তার চেয়ে অনেক বেশি হারাই। কারণ, আসল অপচয় আমরা যে পদক্ষেপ নিই তাতে হয় না, বরং নিখুঁত মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করে যে মূল্যবান মুহূর্তগুলি হারিয়ে ফেলি তা কখনও ফিরে আসে না। তাই, পরিবর্তনের জন্য কখনই ১০০% নিরাপদ ও সঠিক সময় আসবে না এবং জীবনও নিখুঁত মুহূর্তের জন্য কখনই অপেক্ষা করবে না। পরিবর্তনের ডাক যখনই আসবে, তখনই তা গ্রহণ কর এবং তাকে নিখুঁত করে তোল। ব্রাজিলের প্রসিদ্ধ গীতিকার এবং ঔপন্যাসিক পাওলো কোয়েলহো বলেছিলেন, "একদিন, তুমি জেগে উঠবে এবং তুমি সবসময় যা চেয়ে এসেছো, তা করার জন্য আর সময় থাকবে না। তাই সঠিক সময় হলো ‘এখনই’।" মনে রাখবে, জীবন খুবই ছোট এবং আমাদের স্বপ্ন আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা উচিত নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাক।

No comments