আবর্জনার ট্রাক -আশিস কুমার পন্ডাএকদিন সকালে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ট্যাক্সি করে বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। অফিসের ভিড় তখনও শুরু হয়নি, রাস্তায় যানজট ছিল না, ট্রাফিকের লালবাতির সিগন্যালও ছিল না। মসৃণ রাস্তায় ট্যাক্সি মধ্যম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি…
আবর্জনার ট্রাক -
আশিস কুমার পন্ডা
একদিন সকালে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ট্যাক্সি করে বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। অফিসের ভিড় তখনও শুরু হয়নি, রাস্তায় যানজট ছিল না, ট্রাফিকের লালবাতির সিগন্যালও ছিল না। মসৃণ রাস্তায় ট্যাক্সি মধ্যম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পাশের এক শাখা রাস্তা থেকে এক কালো রঙের ব্যক্তিগত গাড়ি কোন সঙ্কেত না দিয়ে ঝড়ের বেগে ট্যাক্সির ঠিক সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুই ড্রাইভারই খুব জোরে ব্রেক কষলেন, টায়ারগুলি কর্কষ আওয়াজ করে উঠলো, দুটি গাড়িই কিছুটা পিছলে গিয়ে মাত্র কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে দাঁড়িয়ে পড়লো। কোন অঘটন ঘটলো না। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে গেলেন বৃদ্ধ ব্যক্তিটি। ট্যাক্সি ড্রাইভার পিছন ফিরে বৃদ্ধকে প্রশ্ন করলেন, “স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো? বৃদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করলেন এবং নিজেকে সামলে নিয়ে বুঝতে পারলেন তারা এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। আশেপাশের লোকেরা ঘটনার চোখে দেখা রিপোর্ট সংগ্রহ করতে গাড়ি দুটিকে ঘিরে ফেললেন। শাখা রাস্তা দিয়ে যিনি ঝড়ের বেগে তার গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন, তিনি তড়িঘড়ি তার গাড়ি বন্ধ করে ট্যাক্সির ড্রাইভারের জানালার কাছে চলে এলেন এবং তাকে দোষারোপ করে অভদ্র ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন। ট্যাক্সির ড্রাইভার একেবারে নিশ্চুপ; তিনি তার গাড়ি বন্ধ করলেন না বা কালো গাড়ির চালকের সঙ্গে তর্কাতর্কিতেও জড়ালেন না! এয়ার কন্ডিশনারের তাপমাত্রা আরও কমিয়ে দিয়ে মিউজিক সিস্টেমের ভলিউম বাড়িয়ে তিনি তার পছন্দের গান শুনতে ব্যস্ত রইলেন। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে কালো গাড়ির চালককে বললেন, “দেখুন, আপনি ভুল করছেন। ইনি আপনার পথ আটকান নি এবং ট্রাফিক সিগন্যাল মেনেই সঠিক লেন ধরে যাচ্ছিলেন। ওকে কেন অকারনে দোষ দিচ্ছেন?” কালো গাড়ির চালক কোন কথাই শুনতে রাজি হলেন না। আরও কিছুক্ষণ উঁচু স্বরে গালিগালাজ করে, মুখ লাল করে, তিনি তার গাড়িতে ফিরে গিয়ে গাড়ি চালু করে নিজের রাস্তা ধরলেন। কালো গাড়িটি চলে যাওয়ার সময়, ট্যাক্সির ড্রাইভার তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে হাত নাড়লেন এবং শুভ কামনা জানালেন। তিনি এমন আচরণ করলেন যেন তিনি কালো গাড়ির ড্রাইভারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তার চিৎকার তিনি বেশ উপভোগ করেছেন। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি তার ড্রাইভারকে অস্বাভাবিক রকমের শান্ত থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি ওই গাড়ির চালককে কোন উত্তর দিলেন না কেন? আপনার তো কোন দোষ ছিল না, তবুও উনি আপনাকে গালাগালি করে গেলেন! তারই দোষে এক দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল! আর একটু হলে তিনি আপনার গাড়ি ও আমাদের দুজনকে হাসপাতালে পাঠাতে যাচ্ছিলেন"! ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি চালানোয় মন দিয়ে, মুচকি হেসে বললেন, “স্যার, যেতে দিন!”
যখন সমাজের প্রতিটি স্তরে অধৈর্য, তর্ক-বিতর্ক, মারামারি, হিংসা, খুন, এবং সভ্যতার সামগ্রিক পতন এক সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে তখন এই এই ব্যতিক্রমী গল্পটি এক গভীর শিক্ষা দিয়ে যায়।
আমেরিকার একজন মনোবিজ্ঞানী, ডেভিড জে. পোলে, এই গল্পটির নীতিসমূহকে একটি জীবন দর্শনে রূপান্তরিত করেছেন, যার নাম হলো "The Law of Garbage Trucks" বা “আবর্জনার ট্রাকের সূত্র”। এই সূত্রে বলা হয়েছে, ‘অনেক মানুষ আবর্জনার ট্রাকের মতো। ময়লা ফেলার ট্রাকগুলি যেমন বিভিন্ন জায়গা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে, ঠিক তেমনি তারা নিজেদের মধ্যে মানসিক আবর্জনা (রাগ, ভয়, হতাশা, বিরক্তি, নেতিবাচকতা) নিজেদের মধ্যে জমা করতে থাকেন। এই মানসিক আবর্জনা যখন অতি মাত্রায় জমে ওঠে, তখন তারা এই আবর্জনা (নেতিবাচক অনুভূতি) অস্বাস্থ্যকর উপায়ে অন্যদের উপর উজাড় করে দেন।‘
দৈনন্দিন জীবনে, আমরা সকলেই অনেক অপ্রত্যাশিত মুহূর্তের মুখোমুখি হই, যখন কোন গাড়ি সুরক্ষা অগ্রাহ্য করে আমাদের পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যায়, কেউ আমাদের গাড়ি রাখার জায়গা দখল করে নেন, কোন রেস্টুরেন্টে বা ক্যাফের ওয়েটার আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিষেবা দেন না, সিনেমা হলে পাশের সিটের ব্যক্তি তার মোবাইল ফোনে অনর্গল কথা বলে যান, অথবা আমাদের অফিসের অহংকারী বস আমাদের সম্বন্ধে অসম্মানজনক বা কটু মন্তব্য করেন। এই ধরনের মুহূর্তগুলি স্বল্পস্থায়ী হলেও, তা আমাদের মনের মধ্যে রাগ, বিরক্তি, হতাশা, অসম্মান ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগের সৃষ্টি করে আমাদের অভ্যন্তরীণ শান্তিকে প্রভাবিত করে। ঘটনার ঠিক পরবর্তী সময়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর তাগিদ সামলানো কঠিন হয়, কিন্তু তর্ক-বিতর্ক, আরোপ-প্রত্যারোপ ইত্যাদির কোনটাই পরিস্থিতির সমাধান তো করেই না বরং পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। সেই সঙ্গে আমাদের মনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনা, চাপ, বা বিরক্তির সৃষ্টি করে। সেই নেতিবাচকতা আমাদের অশালীন আচরণ, মন্তব্য, অসতর্ক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা আমাদের আশেপাশের মানুষদের উপর গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। আমরা হারাই আমাদের সম্পর্ক, আমাদের ভাবমূর্তি, মানসিক শান্তি এবং জরুরী কাজের জন্যে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা।
ডেভিড জে. পোলে এর ‘আবর্জনা ট্রাকের সূত্র’ আমাদের মানসিক আবর্জনা ব্যবস্থাপনা করার উপায় দেখায়। তিনি বলেন, “আপনার জীবন, আপনার মনোভাব, আপনার অনুভূতি—এগুলো আপনার নিজের হাতে। যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে কেউ আবর্জনার ট্রাকের মতো আচরণ করছে এবং তাদের নেতিবাচকতা আপনার উপর ফেলছে, তখন আপনি তাদের এই নেতিবাচক আবেগের সঙ্গ নেবেন না। আপনার মনোভাব নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। আবর্জনা নিয়ে বিশ্লেষণ, চিন্তা, আলোচনা, প্রতিক্রিয়া বা কোনরকম উস্কানিতে সাড়া না দিয়ে আপনি তাদের এড়িয়ে যাবেন এবং নিজের কাজে মনোযোগ দেবেন, ঠিক যেমনটা এই গল্পের ট্যাক্সি ড্রাইভার করেছিলেন। ঠিক একইভাবে, যখন আমরা মানসিক চাপ, হতাশা, বা অস্থিরতা অনুভব করি, তখন আমাদের উচিত তা অন্যদের উপর না চাপানো বা তাদের ক্ষতি না করা। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সংগ্রাম থাকে, এবং তাই আমাদের উচিত নিজেদের নেতিবাচকতা (মানসিক আবর্জনা) অন্যদের উপর চাপিয়ে না দেওয়া।
সেরা নেতারা জানেন যে তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার দিকে মন দিতে হবে, সেরা বিক্রয়কারীরা জানেন যে তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, সেরা পিতামাতারা জানেন যে তাদের সন্তানের প্রতি সঠিকভাবে মনোযোগ দিতে হবে, সেরা খেলোয়াড়রা জানেন যে তাকে খেলার মাঠে তার সেরাটা দিতে হবে। এই সব সেরা ব্যক্তিরা সারাদিনে অনেক আবর্জনা ট্রাকের মুখোমুখি হয়েও তাদের প্রতিটি কাজ, উদ্যোগ এবং লক্ষ্যগুলি সফল করার জন্যে গভীর মনোযোগ, পরিশ্রম, দায়িত্বশীলতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত থাকেন এবং সত্যিকার অর্থে কী গুরুত্বপূর্ণ তার উপর নজর দেন।
শেষ কথা হলো, যখন আপনি মানসিক আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী হয়ে উঠবেন, তখন আপনার জীবনে খারাপকে দূরে সরিয়ে রেখে ভালোর জন্য জায়গা তৈরি করে নিতে পারবেন। লড়াই, ঝগড়া, আফসোস, দুঃখ বা অনুশোচনা নিয়ে সময় না কাটিয়ে জীবনের সুন্দরতা এবং নতুন সম্ভাবনার দিকে নজর দিতে পারবেন।
No comments