ব্রিটিশ সাইক্লিংয়ের রূপান্তর: ছোট জয়ের শক্তি -আশিস কুমার পন্ডা
এই শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত, গ্রেট ব্রিটেনের পেশাদার সাইকেল চালকরা প্রায় একশ বছর ধরে মাঝারী মাপের প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন। শেষবারের মতো তারা সোনা জিতেছিলেন ১৯০৮ সা…
ব্রিটিশ সাইক্লিংয়ের রূপান্তর: ছোট জয়ের শক্তি -আশিস কুমার পন্ডা
এই শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত, গ্রেট ব্রিটেনের পেশাদার সাইকেল চালকরা প্রায় একশ বছর ধরে মাঝারী মাপের প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন। শেষবারের মতো তারা সোনা জিতেছিলেন ১৯০৮ সালে লণ্ডন অলিম্পিকে, এবং ১৯০৩ সাল থেকে শুরু হওয়া সাইক্লিংয়ের সবচেয়ে বড় রেস, ট্যুর ডি ফ্রান্স এর ইতিহাসে কোন ব্রিটিশ তখনও পর্যন্ত জয়ীর তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশ সাইকেল চালকদের প্রদর্শন এতটাই অস্বস্তিকর ছিল যে ইউরোপের এক শীর্ষ বাইক প্রস্তুতকারক ব্রিটিশ দলের কাছে তাদের সাইকেল বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছিল, কারণ তারা ভয় পেয়েছিল যে অন্য পেশাদাররা যদি ব্রিটিশদের তাদের সাইকেল ব্যবহার করতে দেখেন, তবে তাদের বিক্রি কমে যেতে পারে। গ্রেট ব্রিটেনের পেশাদার সাইকেল চালানোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেক চেষ্টা করেও দলের হাল ফেরাতে পারেনি। যাই হোক, ২০০৩ সালে, দলের নতুন পারফরম্যান্স ডিরেক্টর হিসেবে হিসাবে নিযুক্ত হলেন ৩৯ বছর বয়সী ডেভ ব্রেইলসফোর্ড। ডেভ ব্রিটিশ দলের কাছে এক পরিচিত মুখ, গত ছ’বছর ধরে তিনি দলের পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করে চলেছেন। তিনি ছিলেন একদিকে ক্রীড়া বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের স্নাতক, শেফিল্ড হ্যালাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ, অন্যদিকে একজন অপেশাদার সাইকেলচালক হিসেবে ফ্রান্সে চার বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।
ব্রিটিশ সাইকেল দলের ভাগ্য যে এতো তাড়াতাড়ি পাল্টে যাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। ডেভ দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র পাঁচ বছর পরে, ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে, ব্রিটিশ স্কোয়াড ১০টির মধ্যে সাতটি স্বর্ণপদক জিতে নেয়। চার বছর পরে, লন্ডন অলিম্পিক গেমসে, তারা ন’টি অলিম্পিক রেকর্ড এবং সাতটি বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। একই বছরে, ব্র্যাডলি উইগিন্স, ট্যুর ডি ফ্রান্স প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার ছিনিয়ে নেন। ২০০৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত, ব্রিটিশ সাইকেল চালকরা ১৭৮টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ৬৬টি অলিম্পিক বা প্যারালিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে নেন এবং পাঁচটি ট্যুর ডি ফ্রান্স জয় করেন।
ব্রিটিশ সাইকেল চালকদের এক মাঝারী অবস্থা থেকে এক শক্তিশালী দলে রূপান্তর কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এর প্রেক্ষাপটে ছিল ডেভ ব্রেইলসফোর্ডের এক উদ্ভাবনী কৌশল যা তাকে পূর্ববর্তী কোচদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল তা হল; ‘ক্ষুদ্র উন্নতির সমষ্টিকরণ’ (aggregation of marginal gains), যা হোল সমস্ত কিছুতে সামান্য উন্নতির উপায় খুঁজে চলার এক দর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ক্ষুদ্র উন্নতিগুলি একের পর এক জড়ো হয়ে এক উল্লেখযোগ্য সামগ্রিক উন্নতির সৃষ্টি করে।
ব্রেইলসফোর্ড এবং তার প্রশিক্ষকরা একটি বিশ্বমানের পেশাদার সাইকেল চালক দল তৈরি করার লক্ষ্যে, প্রতিটি ছোটখাটো দুর্বলতার দিকে নজর দিলেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সামগ্রিক; সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণের রুটিন, শারীরিক সুস্থতা, পুষ্টি এবং এমনকি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির অভ্যাসের ছোট ছোট উন্নতি করা শুরু করলেন। তারা এমন সব এলাকাগুলির উন্নতির দিকেও নজর দিলেন, যেগুলি এর আগে কেউ প্রয়োজনীয় বলে মনে করেননি। তাদের ছোট ছোট কৌশলগুলি ছিল এই রকম:
• অতিরিক্ত আরাম এবং স্থিতিশীলতার জন্য সাইকেলের আসনগুলিকে নতুন করে ডিজাইন করা হয়েছিল।
• রাস্তাকে ভাল করে আঁকড়ে ধরার জন্য টায়ারে অ্যালকোহল ঘষা হতো।
• সাইকেল রাখার স্টোর বা পরিবহনের জন্যে ট্রাকের ভিতরের অংশ সাদা রঙ করা হয়েছিল, যা তাদের সামান্য ধূলিকণাও চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছিল, কারণ সামান্য ধূলিকনাও বাইকের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারতো।
· বায়ুগতিবিদ্যার নিরিখে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে রেসিং স্যুট নির্বাচন করা হয়েছিল।
· শরীরের বিশেষ করে পায়ের পেশী দ্রুততম উপায়ে পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন ম্যাসেজ জেল পরীক্ষা করা হয়েছিল।
· সাইকেল চালানোর সময় পেশীর আদর্শ তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য চালকদের বৈদ্যুতিকভাবে উত্তপ্ত ওভারশর্ট পরানো হয়েছিল।
· প্রতিটি ক্রীড়াবিদ একটি নির্দিষ্ট ওয়ার্কআউটে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানান তা নিরীক্ষণ করার জন্যে বায়োফিডব্যাক সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছিল।
· প্রতিটি সাইকেল চালকের ভালো রাতের ঘুমের জন্যে উপযুক্ত বালিশ এবং গদির ধরন নির্ধারণ করা হয়েছিল। চালকদের ব্যক্তিগত সাইকেলের মতো, এই উপকরণগুলিও তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।
• ঠান্ডায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমানোর জন্যে একজন পেশাদার চিকিত্সক দ্বারা হাত ধোয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
• সাইকেল চালকদের মনস্তাত্বিক উন্নতির জন্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
ব্রিটিশ সাইক্লিংয়ের রূপান্তরের এই কাহিনী ছোট ছোট উন্নতির শক্তির এক জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই কাহিনী আমাদের শিক্ষা দেয় যে এক ধারাবাহিক এবং ক্রমবর্ধমান উন্নতি সামগ্রিকভাবে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ভাল বা খারাপ-যাই হোক না কেন, আমাদের প্রতিটি ক্রিয়া এবং অভ্যাস হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ছোট ছোট জয় বা পরাজয়ের ফলাফল।
ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বা সাংগঠনিক সাফল্যের যে কোন লক্ষ্য অর্জনই হোক না কেন, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে বিশাল সাফল্যের জন্য বিশাল পদক্ষেপের প্রয়োজন। তারা মনে করেন ছোট বা সাধারণ পরিবর্তনগুলি আদৌ প্রভাবশালী বা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা ঠিক যে ছোট ছোট উন্নতি শুরুতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না, কিন্তু, তারা দীর্ঘমেয়াদে এক বিস্ময়কর এবং অর্থবহ পার্থক্য করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এক সহজ গণিতের সাহায্যে এই ঘটনাকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: কেউ যদি এক বছর ধরে প্রতিদিন ১ শতাংশ হারে উন্নতি করতে থাকেন, তবে এক দিনের শেষে তিনি ১.০১ গুণ, এক মাসের শেষে ১.৩ গুণ, এক বছরের শেষে তিনি সাঁইত্রিশ গুণ উন্নত হয়ে যাবেন। বিপরীতভাবে, কেউ যদি এক বছর ধরে প্রতিদিন ১ শতাংশ হারে খারাপ হতে থাকেন, তবে বছরের শেষে তিনি প্রায় শূন্যে নেমে যাবেন। চক্রবৃদ্ধি সুদের মাধ্যমে অর্থ যেভাবে বৃদ্ধি পায়, একইভাবে উন্নতি বা অবনতির প্রভাবগুলি পুনরাবৃত্তি করার সঙ্গে সঙ্গে বহুগুণ হয়ে যায়। শুরুতে, এক শতাংশ উন্নতি বা এক শতাংশ অবনতির বিশেষ কোন পার্থক্য বোঝা যায় না। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই ছোটোখাটো উন্নতি বা অবনতিগুলি যৌগিক হয়ে যায় এবং যারা একটু ভালো সিদ্ধান্ত নেন এবং যারা নেন না তাদের মধ্যে, খুব বড় ব্যবধান তৈরি করে দেয়।
অবশেষে, কেউ একদিন হঠাত্ জেগে উঠে, কোন যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সফল হন না। তার প্রতিটি ছোট জয়, তাকে লক্ষ্যের দিকে বা সাফল্যের দিকে একটি করে ধাপ এগিয়ে দেয়। প্রতিটি ছোট উন্নতি তাকে আরও বেশি শক্তিমান, আত্মবিশ্বাসী এবং অনুপ্রাণিত করে তোলে। তিনি নিজের আরও ভাল, বা আরও উন্নত এক সংস্করণ হয়ে ওঠেন। তিনি যদি শিখরে পৌঁছাতে নাও পারেন, তবুও তিনি তার যাত্রায় অন্যদের থেকে এগিয়ে যান। এটাই হলো ছোট ছোট জয়ের বিস্ময়কর শক্তি।
No comments