Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বল ছাড়াই ফুটবল খেলা-আশিস কুমার পন্ডা

বল ছাড়াই ফুটবল খেলা-আশিস কুমার পন্ডা
এক বিকালে, এক দল ছেলে খেলার মাঠে জড়ো হয়ে সঠিকভাবে ফুটবল খেলার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক করা হোল, পেশাদার ফুটবল ম্যাচে যে সব উপকরন ব্যবহার করা হয়, প্রত্যেকে তার কিছু না কিছু আনবে। সুতরাং, একজন বল আনল,…

 





বল ছাড়াই ফুটবল খেলা-আশিস কুমার পন্ডা


এক বিকালে, এক দল ছেলে খেলার মাঠে জড়ো হয়ে সঠিকভাবে ফুটবল খেলার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক করা হোল, পেশাদার ফুটবল ম্যাচে যে সব উপকরন ব্যবহার করা হয়, প্রত্যেকে তার কিছু না কিছু আনবে। সুতরাং, একজন বল আনল, আর একজন রেফারির বাঁশি, অন্যজন গোলপোস্ট এবং ক্রস বার, অন্যরা গোলরক্ষকের গ্লাভস, কর্নারের পতাকা, জলের বোতল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবার দুটি দল বাছাই করার পালা। কিন্তু, দুই দলের অধিনায়ক কে কে হবে এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ হোল। দলের অধিনায়কদের অনেক সন্মান এবং দায়িত্ব; তারা তাদের দলের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করবে, খেলার সময় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে। অনেক তর্ক বিতর্কের পরে ঠিক হোল, যে দুটি ছেলে প্রথম এবং দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসদুটি নিয়ে এসেছে, তারাই হবে দুই দলের অধিনায়ক। সবচেয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কে কে এনেছে- এ নিয়েও তারা একমত হতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হোল, তারা দু’দলে ভাগ হয়ে সব জিনিসগুলি ব্যবহার করে খেলা শুরু করবে এবং ধীরে ধীরে তারা একের পর এক জিনিস বাদ দিয়ে খেলতে থাকবে। এইভাবে কোন দুটি জিনিস সত্যিই অপরিহার্য, তা জানা যাবে। পেশাদার ফুটবল খেলার মত সঠিকভাবে খেলা শুরু হোল। প্রথমেই তারা রেফারির বাঁশি বাদ দিয়ে দিল, কারণ রেফারি বাঁশি বাজানোর বদলে চিৎকার করে তার কাজ করতে পারবে। তারপরে দু’দলের গোলরক্ষক তাদের গ্লাভস খুলে ফেললো, কারণ তারা খালি হাতে বল ধরতে পারবে। এমনকি তারা কর্ণারের পতাকা এবং গোলপোস্টগুলিকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গায় কয়েকটি পুরানো টিনের ক্যান রেখে দিল। এইভাবে খেলা চলতে থাকল, শেষ পর্যন্ত তারা ফুটবল সরিয়ে দিয়ে তার বদলে একটি পুরানো টিনের ডিব্বা দিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে লাগলো।


পুরো ঘটনাটি একজন বাবা ও তার ছেলে মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলেন। বাবা তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওখানে ছেলেরা যেভাবে খেলছে তার থেকে তুমি কি কোন শিক্ষা নিতে পারলে”? ছেলে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, "আমার মনে হয়, বল ছাড়াও ফুটবল খেলা যায়।" বাবা সামান্য হেসে মাঠের ছেলেদের দিকে ইশারা করে বললেন, “তুমি আংশিকভাবে ঠিক বলেছ। তুমি দেখতে পাচ্ছ, এই ছেলেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে উপযুক্ত সরঞ্জাম ছাড়াই তারা ফুটবল খেলতে পারে। কিন্তু তাদের অহংবোধ এবং কিছু প্রমাণ করার তাগিদের ফলে, তারা তাদের খেলার মানকে বিসর্জন দিয়েছে এবং এক ছন্দময় ফুটবল খেলাকে এক লজ্জাজনক প্রদর্শনে পরিণত করেছে। এইভাবে, উপযুক্ত সরঞ্জাম ছাড়া খেলার চেষ্টা করে তারা কখনই তাদের দক্ষতা উন্নত করতে বা একটি বড়মাপের খেলা উপভোগ করতে পারবে না।"


মানুষের অহংবোধের শেষ নেই। অনেক রকমের অহংবোধের সমারোহ আমাদের চারদিকে! স্থান, কাল, জাতি, লিঙ্গ, বয়স, পেশা নির্বিশেষে, আমাদের সকলেরই অনেক রকম মানুষের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এদের কেউ সবসময় নিজের সম্পর্কে গর্ব করেন, কেউ তার প্রতিটি কাজের জন্য কৃতিত্ব দাবি করেন, কেউ প্রতিটি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং খ্যাতির ছটায় আসার চেষ্টা করেন, কেউ সবসময় অন্যদের মতামতের সমালোচনা করেন এবং প্রবলভাবে তার মতামত অন্যদের উপর চাপিয়ে দেন, কেউ তাদের ভুলের সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করেন, কেউ হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখলে এড়িয়ে যাওয়ার রাস্তা খোঁজেন, কেউ আবার কখনই দলের লক্ষ্যের দিকে নজর না দিয়ে ব্যক্তিগত লক্ষ্য হাসিল করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। এই সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটি বৈশিষ্ঠের মিল আছে; তা হোল অহংবোধ। অহংবোধ মানব প্রকৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের ব্যক্তি সাধারণতঃ তার ক্ষমতাকে অত্যধিক মূল্যায়ন করেন এবং তাদের গুরুত্বের একটি বিকৃত চিত্র অন্যদের সামনে তুলে ধরেন। তারা নিজেকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হিসাবে দেখেন এবং তাদের নিজস্ব কর্মসূচী, মর্যাদা, কর্তৃত্বকে প্রাধান্য দেন এবং তাদের কাজের জন্য স্বীকৃতি দাবী করেন। দলের সকলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কার্যকরভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অহংবোধ সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একে প্রাধান্য দিলে সৃজনশীলতার ক্ষতি হয়, কার্যকারিতা কমে যায়, চাপ সৃষ্টি হয় এবং দলের বাকি সদস্যদের মনোবল কমিয়ে দেয়। দুর্বল যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যর্থ আলোচনা, ভুল সিদ্ধান্ত, ইত্যাদির ফলে ব্যক্তিবিশেষ, তাদের দল এমনকি সংস্থার চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়।


তাহলে মানুষ কেন তাদের অহংবোধের বাধা কাটিয়ে ওঠার জন্যে পদক্ষেপ নেন না? কখনও কখনও, অনেক ব্যক্তি বুঝতে পারেন না যে তাদের অহং শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের ঘন স্তরের মতো তাদের বুদ্ধিমত্তাকে ঘিরে ফেলে। অন্যদিকে অনেক আত্ম-সচেতন ব্যক্তি তাদের অহংবোধকে গোপনে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু অন্যের সামনে নিজেকে দুর্বল দেখানোর ভয়ে, ভাবমূর্তি হারানোর ভয়ে, এবং ক্ষমতা হারানোর ভয়ে, তাদের পক্ষে অহং স্বীকার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।


আমরা সবাই জানি যে অহংবোধ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু, কিন্তু এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি? আজকের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতামূলক কাজের পরিবেশে, অহং অবশ্যই একটি দায়। বহুপাক্ষিক ব্যক্তিগত দক্ষতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেও, শুধুমাত্র নিজের বৈশিষ্ট্যগুলির উপর নির্ভর করে সব প্রতিযোগিতায় সফল হওয়া সম্ভব নয়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য, আমাদের অন্যান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা এবং প্রতিভার সাহায্য নিতে হয়। অহং থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, আমরা মূল্যবান কয়েকটি নীতি আমাদের জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে পারি; 'অন্য কেউ’ হওয়ার চেষ্টা না করে, কাজ শুরু করতে হবে, ফলাফলের চেয়ে প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতে হবে, এবং অন্যদেরও সফল করার চেষ্টা করতে হবে। আত্ম-সচেতনতা এবং নম্রতার মনোভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে, সত্‍ প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য উন্মুক্ত থেকে, ক্রমাগত অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে, আমরা আমাদের লুকানো দুর্বলতাগুলি দূর করে একজন ব্যক্তি হিসাবে আমাদের মূল্য বাড়িয়ে তুলতে পারি। এক সমন্বিত দলের অংশ হিসাবে, দলের বৃহত্তর "আমাদের" সমর্থনে ব্যক্তিগত চাহিদা এবং প্রয়োজনগুলিকে একপাশে সরিয়ে রেখে দিতে পারলে, দল তার সেরা কাজ করার জন্যে তৈরি থাকবে। দলের সদস্যরা একটাই মাত্র লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে নিজেদের বদলে দলের হয়ে কাজ করার জন্য প্রতিবদ্ধ হলে, শেষ পর্যন্ত, সবাই একসঙ্গে জয়ী হবে।

No comments