Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

“এক ভেড়ার পালের গণ আত্মহত্যা"

“এক ভেড়ার পালের গণ আত্মহত্যা" আশিস কুমার পন্ডা

৮ জুলাই ২০০৫, তুরস্কের এক দৈনিক পত্রিকায় তুরস্কের গেভাস গ্রামের “এক ভেড়ার পালের গণ আত্মহত্যা" শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৫০০ ভেড়া আ…

 




“এক ভেড়ার পালের গণ আত্মহত্যা" আশিস কুমার পন্ডা



৮ জুলাই ২০০৫, তুরস্কের এক দৈনিক পত্রিকায় তুরস্কের গেভাস গ্রামের “এক ভেড়ার পালের গণ আত্মহত্যা" শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৫০০ ভেড়া আত্মহত্যা করার জন্যে এক পাহাড় থেকে একে একে লাফ দিয়েছিল। আনুমানিক ৪৫০টি প্রাণী মারা গিয়েছিল এবং বাকি এক হাজারেরও বেশি ভেড়া চমকপ্রদভাবে বেঁচে গিয়েছিল। সংবাদটি অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের নজরে আসে এবং বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হয়। গল্পটি অনেকের  মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠে এসেছিল। এটা কিভাবে ঘটলো? কেন একপাল ভেড়া তাদের জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নিল? ভেড়ার মত মনুষ্য়েতর প্রাণীদের কি তাদের জীবন ও মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে পারে? বিবর্তনের ফলে ভেড়ারা কি আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে এবং উচ্চতর প্রজাতি হিসাবে বিকশিত হচ্ছে?

দূর দূরান্ত থেকে, প্রাণী বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের অনেক বিশেষজ্ঞ অনুসন্ধানের জন্য সেই সময় তুরস্কের গেভাস গ্রামে পৌঁছে যান। প্রায় ছ’মাস গবেষণা করার পর তারা সিদ্ধান্তে আসেন, সেই দুর্ভাগ্যজনক সকালে, গ্রামের সমস্ত ভেড়াকে একত্রিত করে পাহাড়ী এলাকায় চরানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভেড়ারা সবসময় দলগতভাবে চলাফেরা করে এবং মেষপালকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। দলের প্রতিটি সদস্য তার সামনের ভেড়াকে অনুসরণ করে। দলের মধ্যে কোন স্থায়ী নেতা থাকে না, কেউ একজন নেতার ভূমিকায় থাকলে বাকিরা নির্বিবাদে অনুগামীর ভূমিকা নেয়। অনুগামী বিশ্বাস করে, তার সামনের ভেড়া সঠিক রাস্তায় এগোচ্ছে, অন্যদিকে সামনের ভেড়া মনে করে, যেহেতু অনুগামী তাকে অনুসরণ করছে এবং অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে, সে অবশ্যই সঠিক রাস্তায় এগিয়ে চলেছে। ঘটনাটি ঘটার ঠিক আগে যখন মেষপালকরা একসঙ্গে তাদের প্রাতঃরাশ সারছিলেন, ভেড়ার দল হঠাৎ একটি পাহাড়ের কিনারায় এসে পড়ে। দলের একেবারে সামনের ভেড়া (নেতা) হয়তো সেই সময় থামতে চেয়েছিল, কিন্তু অনুগামী ভেড়ারা  ভিড় থামার কোন সংকেত না পেয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগোতে থাকে। এই কারণে, হতভাগ্য সামনের ভেড়াটি নিজেকে সামলাতে না পেরে পাহাড় থেকে অনেক নিচে পাথরের উপর আছড়ে পড়ে এবং মারা যায়। এর পরে একটি হৃদয়বিদারক ধারাবাহিক ঘটনা ঘটে যায়, যাকে কোনোভাবেই ‘আত্মহত্যা’র তকমা দেওয়া যায় না। প্রথম ভেড়াটি পাহাড়ের নিচে পড়ে যাবার পরে, পরের লাইনের অনুগামীরা পাহাড়ের কিনারায় এসে পড়ে। তাদের নেতা নিখোঁজ হওয়ার ফলে আকস্মিক শূন্যতা এবং সামনে আসন্ন বিপদ তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। তারা হয়ত প্রথম ভেড়াটির মতো থামতে চেয়েছিল, কিন্তু অনুগামী ভেড়াদের ভরবেগ (momentum) থেকে মুক্ত হতে পারেনি এবং অনিচ্ছাসত্বে পাহাড়ের একেবারে কিনারায় পৌঁছে যায়। একের পর এক, ১৫০০ ভেড়া তাদের ভারসাম্য হারিয়ে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যেতে থাকে। প্রথম ৪৫০টি ভেড়া পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে মারা যাবার পর, পাহাড়ের নীচে মৃত ভেড়ার এক নরম স্তূপ তৈরি হয়ে যায়, যার ফলে বাকি হাজারেরও বেশি ভেড়া সেই নরম কুশনের উপর পড়ে গিয়ে বেঁচে যায়।

তুরস্কের ভেড়াদের মতোই, এই বিশ্বের সমস্ত মানুষদের জীবনের কোন না কোন সময়ে দলের প্রতি আনুগত্য দেখানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে। সামাজিক প্রাণী হিসাবে আমরা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অন্যদের কাছ থেকে তথ্য অনুসন্ধান করে থাকি। কোনরকম চিন্তা, প্রশ্ন, যুক্তি বা সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার না করেই আমরা একে অপরকে অনুসরণ করি। আমাদের পেশার নির্বাচন, পোশাক, ভোগ্য়পণ্যের নির্বাচন, ফ্যাশনের প্রবণতা, আর্থিক সিদ্ধান্ত সবই সামাজিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত  হয়। আমরা এগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে থাকি কারণ সমাজ বা দল আমাদের সংরক্ষণ, সুরক্ষা, স্বীকৃতি এবং আত্মীয়তার অনুভূতি দেয়। একই সময়ে, আমরা সমাজের মধ্যে বিসদৃশ, অনিশ্চিত বা অদ্ভুত হওয়ার ভয় থেকে মুক্তি পাই।

পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে, ভিড়কে অনুসরণ করা সহায়ক হতে পারে বা ক্ষতিকারক হতে পারে। ভিড়কে অন্ধভাবে অনুসরণ করা ক্ষতিকারক হতে পারে যদি তা তোমার মূল্যবোধ এবং স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। মনে রাখতে হবে, জনসাধারণ যা করে তুমি যদি তাই কর তবে জনসাধারণ যেখানে রয়েছে সেই জায়গাতেই তুমি থেকে যাবে, যাকে বলা হয় 'মধ্যমতা' (mediocrity)। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “যিনি ভিড়কে অনুসরণ করেন তিনি সাধারণত ভিড়ের চেয়ে বেশি যান না। যিনি একা হাঁটেন তিনি নিজেকে এমন জায়গায় খুঁজে পাবেন যা আগে কেউ পায়নি।" ভিড়ের বাইরে গিয়ে অপ্রচলিত কিছু নির্বাচন করার জন্য অনেক সাহস এবং দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন, কিন্তু এই অবস্থান তোমাকে এক ব্যতিক্রমী মর্যাদার মুকুট পরিয়ে দেবে। বিশিষ্টদের তালিকায় খুব বেশি লোক নেই, কারণ ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে কখনও শীর্ষে পৌঁছানো যায় না। তারা গড়পড়তা লোকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকে এবং তারা কিসে সক্ষম তা কখনই জানতে চায় না। তারা জীবন থেকে কিছু পাওয়ার জন্যে পরিকল্পনা বা পরিশ্রম, কিছুই করে না। পরিবর্তে, তারা তাদের জীবনকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয় বা অলস হয়ে বসে থেকে কোন যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে।

তুমি যদি এক ব্যতিক্রমী জীবন পেতে চাও, তা সে সম্পর্ক হোক, সমৃদ্ধি হোক বা মহান পেশা হোক, তোমাকে অবশ্যই অপ্রচলিত কিছু নির্বাচন করতে হবে। তোমার এই ধরনের নির্বাচন সমাজ স্বীকৃতি নাও দিতে পারে, কারণ জনতাকে যারা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, সমাজ তাদের পছন্দ করে না। মনে রাখতে হবে, তুমি আজ যে ব্যক্তি রয়েছ, সেই একই ব্যক্তি হয়ে তুমি কোনও বিষয়ে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। তুমি সবসময় ভাল কিছু পাওয়ার দাবী করতে পার না, যখন তুমি আরও ভাল হবে তখনই তুমি আরও ভাল জিনিস পাবে।  

সবশেষে বলি, ভিড়ের বাইরে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে ভয় পেও না। তোমাকে এমন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতে পারে যা তুমি আগে অনুভব কর নি, কারণ তুমি এমন এক জায়গার দিকে এগিয়ে চলেছো, যেখানে তুমি কখনও যাওনি। তোমার শিক্ষা এবং জীবনের অভিজ্ঞতা ক্রমাগত ধার দিয়ে তোমাকে তীক্ষ্ণ করাতের মত করে তুলুক। তুমি যত ভাল মানুষ হতে থাকবে, তত ভাল পরিস্থিতির মধ্যে তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে।

ভেড়া ভেড়াকে অনুসরণ করে, পায়রা পায়রাকে অনুসরণ করে, কিন্তু ঈগল কখনও ঈগলকে অনুসরন করে না। ভেড়া হয়ো না, ঈগল হও। স্বাধীন ও নির্ভীক মানুষ হও, তুমি তোমার মনিব হও।

No comments