Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পুরানো শার্ট--আশিস কুমার পন্ডা

পুরানো শার্ট--আশিস কুমার পন্ডা
এক কিশোর তার বাবা-মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে শহরের এক কুখ্যাত বস্তিতে থাকত। বাবা পুরানো জামাকাপড় কেনা-বেচার ব্যবসা করতেন। কিন্তু সেই সামান্য আয় তাদের সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। এক গরিব এবং বর্ণবৈষ…

 





পুরানো শার্ট--আশিস কুমার পন্ডা


 

এক কিশোর তার বাবা-মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে শহরের এক কুখ্যাত বস্তিতে থাকত। বাবা পুরানো জামাকাপড় কেনা-বেচার ব্যবসা করতেন। কিন্তু সেই সামান্য আয় তাদের সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। এক গরিব এবং বর্ণবৈষম্যময় পরিবেশে সে বড় হচ্ছিল। পড়াশোনা করতে তার একেবারেই ভালো লাগতো না এবং স্কুলের পরীক্ষায় খারাপ ফল করার জন্যে জন্য প্রায়ই তাকে স্কুলে বকুনি খেতে হোত। সে তার সহপাঠীদের মধ্যে সবদিক দিয়ে বেমানান ছিল, তাই তার কোন বন্ধুও ছিল না। ধীরে ধীরে, সব কিছুতেই সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল এবং বিরক্তি, চাপ এবং বিষন্নতা তাকে ঘিরে ধরেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, তার কানাকড়িও মূল্য নেই এবং তার ভবিষ্যত একেবারে অন্ধকার ও আশাহীন।


ছেলেটি সে বছর বোর্ডের পরীক্ষা দেবে, একদিন তার বাবা তাকে একটি পুরানো শার্ট দিয়ে বললেন, "এই শার্টটি বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া যেতে পারে?" ছেলেটি অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিল, "খুব বেশি হলে কুড়ি টাকা।" তার বাবা বললেন, "এটা কি পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করা যাবে? তুমি যদি এটা বিক্রি করতে পার, তাহলে মনে রাখবে, সেই টাকায় আমাদের পরিবারের অনেক উপকার হবে।“ ছেলেটি মাথা নেড়ে বললেন, "আমি খুব চেষ্টা করব, কিন্তু পারব কিনা সন্দেহ হচ্ছে।" ছেলেটি বাবার কাছ থেকে শার্টটি নিয়ে ভাল করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে নিল। বাড়িতে ভারি প্রেস না থাকায়, ব্রাশ দিয়ে শার্টটিকে পরিপাটি করে ভাঁজ করে বিছানার তলায় রেখে দিল। পরের দিন সকালে শার্টটিকে এক সুন্দর প্যাকেটের মধ্যে ভরে নিয়ে এক ব্যস্ত আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। বেশ কয়েকজন তরুণ এগিয়ে এসে শার্টটি কেনার জন্যে দর কষাকষি করে গেল। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তার পা দুটো টনটন করতে লাগলো। এক এক করে ছ’ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর  এক সময় সে শার্টটি পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করতে সফল হলো। প্রথম পারিশ্রমিকের অনুভূতি আলাদা। সামান্য কয়েকটা টাকা! তবুও এক জয়ের অনুভূতি। এই প্রথম তার মনে হলো, “আমিও পারি!” প্রায় দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে গিয়ে, সে বাবার হাতে টাকাটা তুলে দিল। তার সাফল্যে খুশি হলেন বাবা-মা থেকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। ছেলেটির মধ্যে জন্ম নিল এক উদ্দীপনা।    


এরপরে, প্রতিদিনই সে বাবার কাছ থেকে পুরানো পোশাক চেয়ে নিত, তারপর সেগুলি পরিপাটি করে ভাল দামে বিক্রি করতো। প্রায় এক সপ্তাহ পরে, তার বাবা আবার তার হাতে একটি পুরানো সাদা শার্ট তুলে দিয়ে বললেন, "তুমি কি এই শার্টটি ২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবে?" ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, "এটা কিভাবে সম্ভব? এটার দাম, খুব বেশি হলে ৩০ টাকা।" তার বাবা যেন তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, "একবার চেষ্টা করে দেখই না? হয়তো কোন একটা উপায় হতে পারে।" ছেলেটি শার্ট হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো। হঠাত, তার মাথায় চমৎকার একটা বুদ্ধি এলো। আগেরবারের মতই সে শার্টটি পরিষ্কার করলো, ইস্ত্রি করলো। তার বোন ফ্যাব্রিক পেইন্টিং শিখছিল। তার অনুরোধে বোন  সেই শার্টের উপরে যত্ন করে ডোনাল্ড ডাক এবং মিকি মাউসের ছবি এঁকে দিল। ছেলেটি এবার বাজারে না গিয়ে, ধনী পরিবারের বাচ্চাদের এক  স্কুলের গেটের সামনে পৌঁছে গেল। টিফিনের বিরতির সময়, এক ঝাঁক স্কুলের ছাত্র তাকে ঘিরে ধরে ডোনাল্ড ডাক এবং মিকি মাউসের ছবি আঁকা শার্টটির প্রশংসা করতে লাগলো। অবশেষে তাদের মধ্যে একজন ২০০ টাকায় শার্টটি কিনে নিল। গরীব ছেলেটির আনন্দের সীমা রইলো না। দু’শ টাকা ছিল তার কাছে এক বিরাট অঙ্ক, তাছাড়া এটা ছিল তার নিজের উপার্জন! বাড়িতে ফিরতেই, তার পরিবার ছেলেটিকে তার সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানালো এবং উত্সাহিত করলো।


পরের সপ্তাহে, তার বাবা তাকে আরেকটি পুরানো শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "তুমি কি এটা ২০০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবে?" তার বাবা  কৌতূহলী ও উত্তেজিত হয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন। এবার ছেলেটি বিনা দ্বিধায় শার্টটি নিয়ে নিল। আগের তুলনায় সে এখন অনেক অভিজ্ঞ ও আত্মবিশ্বাসী। সেই সপ্তাহের শেষের দিকে শহরের একজন জনপ্রিয় রক স্টার একটি প্রোগ্রামের জন্য তার শহরে এলেন। প্রাথমিক অনুষ্ঠানের পর, ছেলেটি তার নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ আড়াল করে, গ্রীণরুমে তার সামনে সামনে হাজির হয়ে বললো, “স্যার, আমি আপনার একজন অন্ধভক্ত। দয়া করে আমার এই শার্টে একটি অটোগ্রাফ দেবেন?” রক স্টার একজন উতসাহী তরুন ভক্তকে তার অটোগ্রাফ চাইতে দেখে, খুশি হলেন। না করার প্রশ্নই ওঠে না, শার্টের উপরে বড় বড় হরফে তিনি সই করে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে ছেলেটি আনন্দে আর উত্তেজনায় পৌঁছে গেল শহরের এক মলের সামনে। সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, "এই শার্টটিতে জনপ্রিয় রক স্টার মিস্টার এক্স-এর অটোগ্রাফ রয়েছে এবং এখন এটা নিলামে বিক্রি হবে।” ভিড় জমে উঠতেই, ছেলেটি শার্টটির নূন্যতম মূল্য ২০০০ টাকা ঘোষনা করে নিলাম শুরু করে দিল। দর্শকদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।  শার্টের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো, ২২০০ টাকা, ২৫০০ টাকা,  ২৭০০ টাকা-----। শেষ পর্যন্ত, একজন যুবক শার্টটি ৩২০০ টাকায় কিনে নিল।


বাড়ি ফিরে, বাবার হাতে শার্ট নিলামের ৩২০০ টাকা তুলে দিতেই, তিনি চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না, বললেন, "ভাবতেই পারছি না, কিভাবে তুমি এমন প্রায় অসম্ভব এক কাজ সম্ভব করতে পারলে! তুমি জানো না, তোমার মধ্যে এক প্রতিভা লুকিয়ে আছে!" সেদিন সন্ধ্যায়, তার বাবা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, "পুরানো শার্টগুলি বিক্রি করার অভিজ্ঞতা থেকে, তুমি কী শিক্ষা পেলে?" ছেলেটি বিশেষ কিছু না ভেবেই উত্তর দিল, "ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।" তার বাবা মাথা নেড়ে বললেন, "তুমি যা বলেছ তা একেবারে ঠিক!” কিন্তু এ ছাড়া আমি তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম, এক সাধারন পুরানো শার্টকে যেভাবে উন্নত করে অনেক টাকায় বিক্রি করা যায়, ঠিক সেইভাবে, একজন সাধারণ মানুষও চেষ্টা করলে উন্নত হয়ে তার মূল্য বাড়িয়ে তুলতে পারে। হতে পারে তুমি গরীব পরিবারে জন্মেছ বা স্কুলের পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারছো না, কিন্তু সেটা নিজেকে ছোট করার কারণ হতে পারে না। নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমে একদিন তুমিও উন্নতি করতে পারবে, তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। তোমার মধ্যে অসীম সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু, তুমি কতটা উন্নত হবে, তা নির্ভর করছে সেই সম্ভাবনার কতটা তুমি কাজে লাগাতে পার!"


প্রবাদ আছে, ‘নিজেকে মূল্য দিতে না জানলে কেউ মূল্য দেবে না!’  শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় ভাল না হলে, তাদের বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য এবং শিক্ষকরা তাদের মূল্যহীন মনে করেন, চটজলদি তাদের সাবধান বানী শুনিয়ে দেন, “তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না”, “তুমি অযোগ্য, নিকৃষ্ট”, “তুমি পারবে না” ইত্যাদি, ইত্যাদি। কাছের মানুষদের কাছে উপেক্ষিত হতে হতে, কিংবা ব্যর্থ হতে হতে জীবনের এক পর্যায়ে এসে, তারা নিজেদের মূল্যহীন বলে মনে করে। তারা নিজেদেরকে ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং তাদের প্রকৃত প্রতিভা প্রকাশ করতে ভয় পায়। বাস্তবে, প্রত্যেকেরই এক অনন্য প্রতিভা এবং ক্ষমতা রয়েছে। সব কিছুতে চাইলেই, তারা দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে না। এককথায়, প্রত্যেকে তার নিজের মতই; অন্য কারও সঙ্গে তার তুলনা হয় না। নিজস্ব মূল্যায়ন, অনুভূতি ও আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দিতে পারলে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে এবং সে নিজেকে ভালবাসতে পারবে। অন্যরা তার সম্পর্কে কি ভাবছে, কি আলোচনা করছে, বা কি মন্তব্য করছে, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন নেই। একবার, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলে, নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসীম ক্ষমতার হদিশ সে পেয়ে যাবে।


অবশেষে, এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে, জীবন মানে লড়াই করে টিকে থাকা। টিকে থাকবে তারাই, যারা প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে থাকবে। তাই, বয়স, পদ এবং কাজের ধারা নির্বিশেষে, নিজের উপর ক্রমাগত উন্নয়নমূলক কাজ করে যাওয়ার মাধ্যমে প্রত্যেককেই প্রতিযোগিতায় টেক্কা দেওয়ার জন্যে তীঘ্নধার হয়ে থাকতে হবে। ব্যক্তিবিশেষের অনন্য বৈশিষ্ট্য (প্রতিভা, দক্ষতা এবং লক্ষ্য) তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে তুলবে এবং তার এক ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড তৈরি করতে সাহায্য করবে। ঠিক যেভাবে বাজারে পণ্যগুলিকে নিয়মিত আপগ্রেড এবং উন্নত করা হয়, ঠিক সেইভাবে নিজেকে আরও মূল্যবান করে তুলতে তার নিজস্ব ব্র্যান্ডকে ক্রমাগত উন্নত করে যেতে হবে। চেষ্টা করে যেতে হবে, যাতে কালকের ব্যক্তিটির থেকে আজকের ব্যক্তিটির একটু হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। আত্ম-উন্নতি হল এক অন্তহীন যাত্রা, এর চূড়ান্ত কোন গন্তব্য নেই। এর জন্য প্রয়োজন উত্সর্গ, অধ্যবসায়, শিক্ষা এবং বৃদ্ধি পাওয়ার ইচ্ছা। এইভাবে, একজন তার নিজের সেরা সংস্করণে পরিণত হতে সক্ষম হবে এবং যে কোনও পরিস্থিতিতে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি থাকবে।



*আরো নিত্য নতুন আপডেট খবর দেখতে

আমাদের whatsapp চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন*

WhatsApp channel link - https://whatsapp.com/channel/0029VaCqqNUGk1FyEgWxaZ2r

No comments