সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শেষ স্থান -আশিস কুমার পন্ডা
দিনটি ছিল ২০ অক্টোবর, ১৯৬৮, লাতিন আমেরিকায় প্রথম অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হচ্ছে মেক্সিকো সিটিতে। উষ্ণতম সেই রবিবারের বিকেলের শেষ ইভেন্ট ছিল পুরুষদের ম্যারাথন। ৪১টি দেশের ৭৫ জন প্রতিয…
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শেষ স্থান -আশিস কুমার পন্ডা
দিনটি ছিল ২০ অক্টোবর, ১৯৬৮, লাতিন আমেরিকায় প্রথম অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হচ্ছে মেক্সিকো সিটিতে। উষ্ণতম সেই রবিবারের বিকেলের শেষ ইভেন্ট ছিল পুরুষদের ম্যারাথন। ৪১টি দেশের ৭৫ জন প্রতিযোগী মেক্সিকো সিটির ২০০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং ২৩% কম অক্সিজেনকে উপেক্ষা করে ৪২.১৯৫ কিলোমিটার দূরত্ব দৌড়ে গ্রীক পুরাণের ফেইডিপিডেসের মতো নিজের দেশের বিজয়ের বার্তা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন স্টিফেন আখওয়ারী, যার সঙ্গে আরও তিনজন তানজানিয়ার ক্রীড়াবিদকে প্রথম অলিম্পিক পদক বিজয়ের জন্য পূর্ব আফ্রিকা থেকে মেক্সিকো সিটিতে দীর্ঘ যাত্রায় পাঠানো হয়েছিল। এই অলিম্পিকের ঠিক আগে আখওয়ারি, ২:১৫ সময় নিয়ে আফ্রিকার ম্যারাথন চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তাই বিজয় মঞ্চের সম্ভাব্য দাবীদাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন।
স্থানীয় সময় ঠিক ৩:০০টায় বন্দুকের গুলির শব্দ হলো এবং প্রতিযোগীরা তাদের সর্বোচ্চ সহ্যের সীমা দেখানোর জন্য দৌড় শুরু করলেন। অন্য অনেক দৌড়বিদদের মতো, আখওয়ারির উচ্চ-উচ্চতায় প্রশিক্ষণের কোন সুযোগ ছিল না। প্রায় ৩০ কিমি দৌড়ানোর পর তার গতি কমে এলো, অক্সিজেনের অভাবে তার পায়ের পেশীতে টান ধরতে শুরু করলো। ঠিক এইসময় ঘটলো এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা! অন্য একজন ধাবককে পাস কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়, ধাক্কা লেগে বেসামাল হয়ে তিনি রুক্ষ কংক্রিটের রাস্তায় ভয়ঙ্করভাবে ছিটকে পড়লেন। আখওয়ারীর হাঁটুতে মারাত্মকভাবে আঘাত লাগলো, ডান পায়ের হাঁটুর জয়েন্ট সরে গেল এবং তার কাঁধেও প্রচণ্ড আঘাত লাগলো। চিকিৎসা কর্মীরা দ্রুত এসে তার রক্তাক্ত ক্ষত ব্যান্ডেজ করে দিলেন। কিন্তু স্থানচ্যুত হাঁটুর জন্য শহরের রাস্তায় যতটা প্রাথমিক চিকিত্সা দেওয়া সম্ভব হল তার চেয়ে অনেক বেশি চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। তাকে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হল, কিন্তু তানজানিয়ার এক সাধারণ কৃষকের ছেলে, আখওয়ারীর কাছে সেই মূহুর্তে প্রতিযোগিতা এড়িয়ে হাসপাতালে যাওয়া কোন বিকল্প ছিল না। বাকি প্রতিযোগীরা ততক্ষণে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আখওয়ারী কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে, রাস্তায় নেমে আবার ছুটতে শুরু করলেন। অলিম্পিকের সেই ম্যারাথনে যখন শুরুর ৭৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ১৮ জন ইতিমধ্যে অক্সিজেনের অভাবে রেস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, হাঁটুতে অসহ্য ব্যথা নিয়েও আখওয়ারী এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছিলেন না, তা ছাড়া তার চোট এতটাই গুরুতর ছিল যে তার পক্ষে স্বাভাবিক গতিতে দৌড়ানো একেবারেই অসম্ভব ছিল। কখনও ধীরগতিতে দৌড়ে, কখনও খুঁড়িয়ে চলে, এবং কখনও শুধুই হেঁটে, তিনি এগিয়ে চললেন। মেক্সিকোর রাজধানীর রাস্তায় ভিড় জমতে শুরু করলো, পথচারীরা হাততালি দিয়ে আখওয়ারীকে উত্সাহিত করতে শুরু করলেন।
এদিকে স্টেডিয়ামের মধ্যে, ইথিওপিয়ার মামো ওয়াল্ডে ২:২০:২৬ সময় নিয়ে সবার আগে ফিনিশিং লাইন পার করে ফেলেছেন। বাকি বেশিরভাগ প্রতিযোগী পরের কয়েক মিনিটের মধ্যে দৌড় শেষ করে ফেলেছেন। ম্যারাথন ছিল দিনের শেষ ইভেন্ট। মেক্সিকো সিটির অলিম্পিক স্টেডিয়ামে তখন সন্ধ্যা ৭টা। আলো ম্লান হতে শুরু করেছে এবং তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাডলাইট একে একে জ্বলতে শুরু করেছে। ক্রীড়াবিদ এবং দর্শকরা স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছেন। ঠিক সেই মূহুর্তে দর্শকদের উদ্দেশে ঘোষকের আওয়াজ ভেসে এলো, “আপনারা আর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন। একজন চূড়ান্ত ম্যারাথন ধাবক কিছুক্ষণের মধ্যে ময়দানে প্রবেশ করছেন।“ সবাই শেষ মুহূর্ত দেখার জন্যে উত্সুক হয়ে উঠলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি স্পষ্ট ছিল। শেষ ম্যারাথন ধাবকও তো এক ঘন্টা আগে স্টেডিয়ামে পৌঁছে গেছেন এবং মেডেলও হস্তান্তর করা হয়ে গেছে! এই ধাবক এতক্ষণ কি করছিলেন? দূর থেকে পুলিশ সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। যারা স্ট্যান্ডে উঁচুতে বসেছিলেন তারা দেখতে পেলেন কয়েকটি মোটরসাইকেলের ফ্ল্যাশিং নীল আলোর সঙ্গে একজন ধাবক স্টেডিয়ামের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন।
পুলিশ এস্কর্টের অনুসরণে তানজানিয়ার রঙের পোশাক পরে আখওয়ারি অবশেষে স্টেডিয়ামের ভিতরে পৌঁছে গেলেন। দর্শকরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, ঠোঁট কামড়ে ধরে তিনি প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করছেন এবং তার হাঁটুর চারপাশের ব্যান্ডেজ আলগা হয়ে বাতাসে পতপত করে উড়ছে। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া আর বাধা মানলো না। আখওয়ারীকে তার দৌড়ের শেষ কয়েক গজ পার হওয়ার সময় উত্সাহ দেওয়ার জন্যে জোরে জোরে করতালি দিতে লাগলেন, যা দৌড়ে প্রথম হওয়া ব্যক্তির জন্য করতালির আওয়াজকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বেদনা যতই অসহ্য হোক না কেন, চূড়ান্ত অবস্থান যাই হোক না কেন, জন স্টিফেন আখওয়ারি সবার শেষে ৩:২৫:২৭ সময় নিয়ে (প্রথম হওয়া প্রতিযোগীর প্রায় ১ ঘণ্টা ৫ মিনিট পরে) অলিম্পিক ম্যারাথনের ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করলেন।
কয়েকজন উত্সাহী সাংবাদিক মাঠের দিকে ছুটে এলেন এবং আখওয়ারিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি যে ধরনের আঘাত পেয়েছেন তা সহ্য করে এবং রেসে আপনার স্থান পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই দেখেও, কেন আপনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ফিনিশিং লাইনের দিকে এগিয়ে এলেন?" সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি যে লাইন দুটি উচ্চারণ করেছিলেন তা অলিম্পিকের ইতিহাসে অমর হয়ে গেল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, "আমার দেশ কেবল এই দৌড় শুরু করার জন্য আমাকে ৫০০০ মাইল দূরে পাঠায়নি। তারা আমাকে এটি শেষ করতে ৫০০০ মাইল দূরে পাঠিয়েছে। বিজয় মঞ্চে না দাঁড়িয়েও জন স্টিফেন আখওয়ারি সেই সন্ধ্যায় প্রকৃত অর্থে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শেষ স্থান বিজয়ী হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন।
জন স্টিফেনের মাঝপথে রেস থেকে অবসর নিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। তার একটি পা গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, হাঁটু স্থানচ্যুত হয়েছিল, তার কাঁধেও প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। যদি তিনি চিকিত্সাকর্মীদের পরামর্শ মেনে অবসর নিয়ে হাসপাতালে চলে যেতেন, তবে কেউ তার বিরুদ্ধে কিছু বলত না, কেউ সমালোচনা করতো না। কিন্তু তিনি তা না করে গন্তব্যে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যে কোন মূল্যে আখওয়ারীর ম্যারাথন শেষ করার এই কাহিনী আমাদের এক জনপ্রিয় উপদেশ মনে করিয়ে দেয়; 'কখনও হাল ছেড়ে দিও না! তোমার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত, যত কঠিন বাধা আসুক না কেন, এগিয়ে যেতে থাক”। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে, শিক্ষাগত, পেশাদার এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অলিম্পিক ম্যারাথনের মতো আমাদেরও অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। সব যাত্রা, পরিকল্পনা অনুযায়ী নাও হতে পারে। আমাদের গতিপথে অনেক বাধা আসতে পারে যার কারণে যাত্রা শেষ করা অসম্ভব বলে মনে হতে পারে যেমন; সমালোচনা, ভয়, সাময়িক বিফলতা, অসুস্থতা, হতাশা, এবং দুর্ভাগ্য। এই অবস্থায়, আমাদের সামনে দুটি বিকল্প খোলা থাকে; পরাজয় স্বীকার করা এবং হাল ছেড়ে দেওয়া, অথবা জন স্টিফেন আখওয়ারির মতো হওয়া৷ যেদিন আমরা বুঝতে পারব যে আমাদের সাময়িক বিপর্যয়গুলিই শেষ কথা নয়, বরং সেগুলি আমাদের নতুন উদ্যমে আবার দৌড় শুরু করার এক সুযোগ, সেদিন আমরা সফলভাবে আমাদের অন্তরের বিজয়ীকে জাগ্রত করতে পারবো। সেই সময় দাঁত টিপে, অসহ্য ব্যথা সহ্য করে এগিয়ে গিয়ে ধাপে ধাপে ফিনিস লাইনে আমরা পৌঁছে যেতে পারবো। ফার্স্ট, সেকেন্ড বা থার্ড হওয়া বড় কথা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমরা যা শুরু করেছি তা শেষ করা। এভাবেই আমরা আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারবো।
No comments