Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ফুটবল মাঠের পায়ে বল না থাকা একুশ জন -আশিস কুমার পন্ডা

ফুটবল মাঠের পায়ে বল না থাকা একুশ জন -আশিস কুমার পন্ডা

‘সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল’। শুধু বাঙ্গালী নয়, বিশ্বের দু’শটির বেশি দেশের মানুষদের ভালোবাসা আর আবেগের নাম ফুটবল। আর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে এক হাই-ভোল্টেজ ফুটবল ম্…

 




ফুটবল মাঠের পায়ে বল না থাকা একুশ জন -আশিস কুমার পন্ডা


 


‘সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল’। শুধু বাঙ্গালী নয়, বিশ্বের দু’শটির বেশি দেশের মানুষদের ভালোবাসা আর আবেগের নাম ফুটবল। আর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে এক হাই-ভোল্টেজ ফুটবল ম্যাচ দেখা, এক রোমাঞ্চকর এবং অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। টিভি বা মোবাইলের ছোট পর্দায় ম্যাচ দেখে এই অতুলনীয় অনুভূতির ছিটেফোঁটাও কল্পনা করা সম্ভব নয়। প্রিয় দলের জার্সি পরা হাজার হাজার প্রাণ-চঞ্চল ফুটবল প্রেমিক, তাদের উৎসাহ, উল্লাস, স্লোগান, পতাকা, ক্যামেরার ভিড়; সব মিলিয়ে স্টেডিয়ামের কোনায় কোনায় টান-টান উত্তেজনা!  আপনি যদি ফুটবলের সত্যিকারের প্রেমিক হন তবে এই উত্তেজনার মাত্রা আপনাকে অবশ্যই দর্শকদের সঙ্গে একাত্ম করে তুলবে! আপনার প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা, তাদের পায়ের জাদুর ছন্দ আপনার সারা জীবনের সঙ্গী  হয়ে থাকবে।


ফুটবল খেলায়, দু’টি দল আক্রমণাত্মক বা রক্ষণাত্মকভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমন বা প্রতিপক্ষের আক্রমনকে নিরস্ত করার জন্য তাদের মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাবে। অ্যাকশন, গতি এবং উন্মত্ততায় ভরপুর ৯০ মিনিটের এই দম বন্ধ করা নাটকে থাকবে আক্রমন, প্রতি আক্রমন, থ্রো, কর্নার কিক, পেনাল্টি কিক, হার্ড ট্যাকল, ফাউল, অফসাইড, হলুদ কার্ড, লাল কার্ড, এবং এক্টুর জন্যে গোল না হওয়ার আক্ষেপ বা স্বস্তি। অবশেষে থাকবে বহুপ্রতীক্ষিত সেই গোল, এবং সেটিকে খেলার নির্ধারক এবং প্রভাবশালী মুহূর্ত হিসেবে গণ্য করা হবে। বলার মতো একটা গল্প রচনা হবে। গোল দাতাকে তার দক্ষতা, সময় ও সুযোগকে কাজে লাগানোর ক্ষমতার জন্যে প্রশংসা করা হবে। তার কৃতিত্বকে সন্মান জানানো হবে, কারণ তিনিই সেই খেলোয়াড় যিনি তার দলের সন্মিলিত প্রচেষ্টাকে এক সফল পরিনতি উপহার দিলেন এবং দলকে জয়ের দিকে একধাপ এগিয়ে দিলেন।


আমরা সবাই জানি যে ১১ জন খেলোয়াড়ের দুটি দলের মধ্যে একটি বল নিয়ে ফুটবল ম্যাচ খেলা হয়। ৯০ মিনিটের এক ম্যাচে, প্রতিটি খেলোয়াড় গড়ে ৩ মিনিটেরও কম সময়ের জন্য বলটিকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ পান। যে কোন সময়ে, শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড় বল নিয়ন্ত্রণে নেন এবং প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করে, বিপক্ষের গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: মাঠের বাকি ২১ জন খেলোয়াড়, নিজেদের পায়ে বল না থাকার বাকি সেই ৮৭ মিনিট ধরে কী করেন! তারা কি সেই সময়ে মাঠে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন? না কি বসে বিশ্রাম করেন? না কি জগিং করেন? না কি বল তাদের পায়ে এসে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করেন?


আপনি যদি ফুটবল পছন্দ না করেন, একনজরে আপনার মনে হতে পারে যে একগুচ্ছ মানুষ একটিমাত্র বলের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছেন। কিন্তু যারা ফুটবলের প্রেমে বিভোর হয়ে থাকেন, তাদের কাছে ফুটবল এক ছন্দময় শিল্পকলা। তাদের কাছে ফুটবল এক সুসংগঠিত সিম্ফনির মতো, যেখানে একদল স্বতন্ত্র সঙ্গীত শিল্পী তাদের অনন্য যন্ত্র বাজিয়ে একটি সুরেলা মাস্টারপিস তৈরি করেন। ম্যাচের সময়, একজন খেলোয়াড়ের পায়ে বল না থাকার অর্থ এই নয় যে তার করার মতো কোন কাজ নেই। আপনি দেখে অবাক হবেন, যাদের পায়ে বল নেই, তারা সবাই, বলের দিকে চোখ রেখে পুরো মাঠ জুড়ে এক নাগাড়ে উপরে-নিচে, ডাইনে-বামে, আড়াআড়ি, তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে চলছেন। এক মুহূর্তের জন্যে তাদের বিশ্রাম নেই।


আসলে, পায়ে বল না থাকা খেলোরাড়দের ভূমিকা পায়ে বল থাকা  খেলোয়াড়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ফুটবলের বোদ্ধারা ভাল করেই জানেন  যে ফুটবল খেলার বেশিরভাগটাই খেলা হয় বল ছাড়া। পায়ে বল না থাকা খেলোয়াড়দের প্রধান ভূমিকা হোল সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছে যাওয়া, কারণ তাকে তার সতীর্থদের জন্য জায়গা তৈরি করে দিতে হবে বা বল নিয়ে বিপক্ষের গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যাওয়া সহজ করে তুলতে হবে। মাঠের এমন এক জায়গায় তাকে তৈরি থাকতে হবে, যাতে তিনি বিনা বাধায় সতীর্থের দেওয়া পাস ধরতে পারবেন, বল নিয়ন্ত্রণে রেখে  সঠিক গতিতে, এমন এক সতীর্থের পায়ে পৌঁছে দিতে পারবেন, যিনি এগিয়ে যাওয়ার জন্য দলের সকলের চেয়ে সেরা অবস্থানে তৈরি আছেন। দলের প্রত্যেক সদস্য নিঃস্বার্থভাবে কখনও নিজের পায়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাবেন, আবার কখনও বা সেই দশজন পায়ে বল না থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হয়ে তাদের ভূমিকা ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন করে নিখুঁতভাবে সমন্বয় সাধন করে চলবেন।


প্রতিটি সফল টিমওয়ার্ক, তা সে কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাজ হোক, বা সমাজের কাজ হোক, বা সভ্যতার কাজ হোক, এক সুসংগঠিত ফুটবল খেলার মতো। যখন সব দর্শকের চোখ বল পায়ে থাকা খেলোয়াড়টির দিকে আটকে থাকে, তখন দলের অন্য খেলোয়াড়রা তাকে সাহায্য করার জন্যে সঠিক জায়গা খুঁজে নিচ্ছেন। কিন্তু ফুটবল অনেকটাই শুধু গোলের খেলা। তাই, বল পায়ে না থাকা খেলোয়াড়দের কঠোর ও নিস্বার্থ পরিশ্রম মূলত দলের সাফল্যে অবদান রাখলেও, দুর্ভাগ্যবশত তারা কখনই দর্শকদের মনোযোগ এবং প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন না। পাদপ্রদীপের আলোটা সবসময় চূড়ান্ত ফলাফল এবং গোলদাতার উপরে এসে পড়ে। আসলে, দলের সাফল্য কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়দের উপর নির্ভর করে না, দল জয়ী হয় যখন দলের প্রতিটি সদস্য এক সমন্বিত দল হিসাবে খেলেন। দলের প্রতিটি সদস্য সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির এক একটি অংশের দায়িত্ব নেন এবং তার কাজগুলি সম্পন্ন করে চলেন। একজন ব্যক্তি মঞ্চে বা মঞ্চের পিছনে যাই কাজ করুন না কেন, তার অনন্য দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দলকে লাভবান করেন।


এক প্রচলিত কথা আছে, ‘আমাদের কেউই নিজের জুতার ফিতা দিয়ে নিজেদেরকে টেনে এনে এখানে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা এখানে এসেছি কারণ কেউ একজন - একজন পিতামাতা, একজন শিক্ষক, একজন আইভি লীগের সহকর্মী বা কয়েকজন সন্ন্যাসীনি — নিচু হয়ে আমাদের জুতা সমেত তুলে ধরতে সাহায্য করেছেন’। আমরা সকলেই আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের বেঁচে থাকা, বিকাশ এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করে থাকি। এমন কি এক শিশুর প্রথম পদক্ষেপের জন্যে কারও হাতের প্রয়োজন হয় এবং শেষ যাত্রায় সময় এক মৃত ব্যক্তির অন্যের কাঁধের প্রয়োজন হয়। নাম না জানা অনেক ব্যক্তি এইভাবে আমাদের সকলকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে চলেছেন। এরা সবাই আমাদের উতসাহ দেন, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য জায়গা তৈরি করে দেন, আমাদের দিয়ে গোল করানোর জন্যে সঠিক সময়ে, সঠিক গতিতে আমাদের পায়ে বল ঠেলে দেন। যেহেতু তাদের মধ্যে অনেকেই দৃশ্যের আড়ালে কাজ করে যান, তাই প্রায়শই আমরা তাদের অবদান হাল্কা করে দেখি, তাদের দিকে প্রাপ্য মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হই। আমাদের জীবনের বৃদ্ধি এবং বিকাশের চেতনা তখনই সম্পূর্ণ হবে যখন আমরা আমাদের জীবন নাটককে সফল করার জন্যে মঞ্চের কুশীলবদের সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যের চেনা ও অচেনা ব্যক্তিদের ও যথাযোগ্য  সম্মান জানাতে  পারবো। 



No comments