আজ ৩০শে নভেম্বর। জগদ্বিখ্যাত বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস।
বসু বিজ্ঞান মন্দির (বোস ইনস্টিটিউট) ভারতের প্রাচীনতম এবং অন্যতম প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। ইনস্টিটিউটটি ১৯১৭ সালে ভারত-এ আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্…
আজ ৩০শে নভেম্বর।
জগদ্বিখ্যাত বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস।
বসু বিজ্ঞান মন্দির (বোস ইনস্টিটিউট) ভারতের প্রাচীনতম এবং অন্যতম প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। ইনস্টিটিউটটি ১৯১৭ সালে ভারত-এ আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রাণপুরুষ আচার্য স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যিনি প্রথম কুড়ি বছর ধরে তার পরিচালক ছিলেন। তারপর তাঁর ভাগ্নে দেবেন্দ্র মোহন বসু, পরবর্তী বিশ বছর ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদে আসীন ছিলেন।
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট :
১৮৯৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে কাজ করার সময় এক উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে এক স্বাধীন রাষ্ট্রীয় খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চিন্তা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর মনে উদয় হয়। একবার লর্ড র্যালে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য সিংহল এসেছিলেন। সেখান থেকে ইংল্যান্ড-এ ফিরে যাবার পথে লর্ড রিপন-এর আহ্বানে কলকাতায় কয়েকদিন ছিলেন। সেই সময় একদিন বিনা আমন্ত্রণেই তিনি জগদীশ চন্দ্রের ল্যাবরেটরি দর্শন করতে আসেন এবং খুবই মুগ্ধ হন। ওই দিন বিকালেই কলেজের অধ্যক্ষ জগদীশ চন্দ্রকে চার্জশিটের ভাষায় কৈফিয়ত তলব করেন, কেন কলেজ-এর অনুমতি ছাড়া র্যালের মত একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসেন? তাতে জগদীশ চন্দ্র খুবই অপমানিত বোধ করেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে কর্তৃপক্ষ তাঁর গবেষণার কাজে বাধার সৃষ্টি করতে থাকে। তাই জগদীশচন্দ্র মনস্থির করেন যে, তিনি নিজ তত্ত্বাবধানে এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান শুরু করবেন, যেখানে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। আর জগদীশ চন্দ্র বসুর সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের পথে চালিত করেন ভগিনী নিবেদিতা।
ভগিনী নিবেদিতা, যিনি স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে ২৮শে জানুয়ারী, ১৮৯৮ সালে ভারত-এ পদার্পণ করেন। ব্রাহ্মসমাজ-এর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে নিবেদিতা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ফলে জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার সাফল্যের সূত্র ধরে বিশ্ব বিজ্ঞান-এর দরবারে নব প্রতিষ্ঠিত এই ভারতীয় বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর আলাপ হয়। নিবেদিতার সাথে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্ক এতোই গভীর ছিল যে, নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রকে আদর করে 'ব্রায়ান' বলে ডাকতেন। স্কটিশ শব্দ ব্রায়ানের বাংলা অর্থ হল 'খোকা'। এথেকেই বোঝা যায় নিবেদিতা আজীবন জগদীশ চন্দ্রকে পুত্রের মত স্নেহ করতেন।
একবার ১৮৯৬ সালে জগদীশচন্দ্র লন্ডন-এর রয়্যাল সোসাইটিতে তাঁর মাইক্রোওয়েভ-এর কাজের উপর একটি বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন। তিনি সেই সময় এই রকম একটি গবেষণাগার ভারত-এ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ-এর সাথে আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু সে সময় এ পরিকল্পনা কার্যকরী হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নেবার পরই জগদীশ চন্দ্র আগের পরিকল্পনা সফল করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন এবং ১৯১৭ সালে তা পূরণ করেন। সেই সঙ্গে পূরণ হয় ভগিনী নিবেদিতার স্বপ্ন। তিনি হয়তো দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তিনি জীবনে চলার প্রতিটি মুহূর্তে জগদীশ চন্দ্রকে উৎসাহিত করেছেন এক সম্পূর্ণ ভারতীয় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। এমনকি আচার্যের নিজের ব্যক্তিগত গবেষণার কাজেও তিনি উৎসাহ দিতেন। জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার বিবরণ যাতে হারিয়ে না যায়, যাতে তা পরবর্তী বিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছায়, সে জন্য তিনি বলেছিলেন, "আমার কলম তোমার চিন্তাকে ভৃত্যের মত অনুসরণ করবে"। নিবেদিতা জীবিত থাকাকালীন জগদীশচন্দ্রের সমস্ত গবেষণার বিবরণ তিনি নিজে লিপিবদ্ধ করে দিতেন।
একবার ১৯০৯ সালে জগদীশ চন্দ্র, নন্দলাল বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নিবেদিতা বুদ্ধগয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মহান ত্যাগের প্রতীক বজ্র দেখেন, যা কিনা দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা নির্মিত। সেই বজ্রকে তিনি স্বাধীন ভারত-এর জাতীয় পতাকার মাঝখানে স্থাপিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যদিও তাঁর স্বপ্ন তদান্তীন ভারতীয় রাজনেতাদের কারণে সফল হয়নি। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের মর্যাদা রেখেছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু।
বিজ্ঞান মন্দির নির্মাণের এই বিশাল পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল অনেক অর্থের। সম্পূর্ণ সরকারী সহযোগিতা ছাড়া তিনি তা জোগাড় করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৯৯ সালে নিবেদিতা বিশিষ্টা ইউরোপীয় মহিলা মিসেস ওলি বুল-এর সাথে জগদীশচন্দ্রের পরিচয় করিয়ে দেন। জগদীশচন্দ্রের গবেষণার অগ্রগতির কথা শুনে মিসেস বুল খুবই উৎফুল্ল হয়েছিলেন। এর ফলে তাঁদের মধ্যে এক অত্যন্ত সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একবার ১৯০০ সালে প্যারিস আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগদান করতে গিয়ে বসু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মিসেস বুল সেই সময় জগদীশ চন্দ্রকে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন। আর সেই থেকে জগদীশ চন্দ্র বুলকে মায়ের বিকল্প হিসাবে দেখতেন। মিসেস বুল তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসাবে তাঁর উইলে(ইচ্ছাপত্রে) অনেক অর্থ জগদীশচন্দ্রের গবেষণা ও ভারত-এ বিজ্ঞান-এর অগ্রগতির জন্য দান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জগদীশচন্দ্রের অন্যতম মিত্র। তিনিও অনেক অর্থ সংগ্রহ করে জগদীশ চন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন।
এই অর্থ সংগ্রহ কার্যে যাঁর কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে, তিনি হলেন শ্রীমতী অবলা বসু। তিনি তাঁর নিজের যা কিছু সম্পদ ছিল (প্রায় চার লক্ষ টাকা) তা এই মহৎ কাজে অঞ্জলি দিয়েছিলেন। আর এই সময় তিনি অত্যন্ত কঠোর মিতব্যয়িতার সাথে সংসার চালিয়ে এই অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে 'সর্বগুণসম্পন্না সাধ্বী গৃহিণী' বলে উল্লেখ করেছিলেন। জগদীশচন্দ্রও তাঁর দেশের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ-এর পৈতৃক সম্পত্তিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
৯৩/১, আপার সার্কুলার রোড (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড)-এ এই বিজ্ঞান বীক্ষণাগার-এর উদ্দেশ্যে বাড়ি নির্মাণ শুরু হয়। অবশেষে ১৯১৭ সালের ৩০শে নভেম্বর জগদীশ চন্দ্রের ৬০তম জন্মদিনে তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন সার্থক হয় এই বোস ইনস্টিটিউশনের দ্বারোদঘাটনের মধ্য দিয়ে। জগদীশ চন্দ্র এই দ্বারোদঘাটনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি গান রচনা করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ব্যস্ততার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের বাইরে ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি চিঠিতে উত্তর লিখে পাঠিয়েছিলেন, "..... তোমার বিজ্ঞান মন্দিরের প্রথম সভা উদ্বোধনের দিনে যদি আমি থাকতে পারতুম, তাহলে আমার খুব আনন্দ হতো। বিধাতা যদি দেশে ফিরিয়ে আনেন, তাহলে তোমার এই বিজ্ঞান যজ্ঞশালায় একদিন তোমার সাথে মিলনের উৎসব হবে এই কথা মনে রইল।....." রবি ঠাকুর জগদীশচন্দ্রের আশা পূরণ করেছিলেন। তিনি বিদেশ থেকেই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের উদ্দেশ্যে রচনা করে পাঠিয়েছিলেন সেই বিখ্যাত "আবাহন"।
প্রতিষ্ঠা :
১৯১৫ সালে বসু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর দুই বছর পরিকল্পনার পরে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জগদীশচন্দ্র তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "এই প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র বীক্ষণাগার নহে, এটি একটি মন্দিরও। স্থূলভাবে আমরা জানি যে, চেতনার দ্বারা বিজ্ঞান সত্যকে আরোহণের চেষ্টা করে এবং যন্ত্রপাতি সেই চেতনাশক্তিকে বিস্তৃত করে। এমন কিছু সত্য আছে, যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গন্ডির বাইরে থাকে, সেই সত্যকে বিশ্বাসের দ্বারা অর্জন করতে হয়। তাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা, কারণ একমাত্র মন্দিরই সেই বিশ্বাস প্রভাবিত সত্যকে বোঝবার উপযুক্ত জায়গা।" এই যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলায় নামকরণ করেছিলেন "বসু বিজ্ঞান মন্দির"। সেই সঙ্গে নিজেই একটি হস্তলিখিত নিবেদনপত্রের দ্বারা এই বিজ্ঞান মন্দিরকে জাতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিলেন। "ভারতের গৌরব ও জগতের কল্যাণ কামনায় এই বিজ্ঞান মন্দির দেবচরণে নিবেদন করলাম।"
নিবেদিতার কল্পিত সেই বজ্রচিহ্নকে জগদীশচন্দ্র তাঁর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে স্থান দিয়েছিলেন। যা বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতীক চিহ্ন হিসাবে আজও মন্দিরের শোভা বর্ধন করে চলেছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড থেকে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ঢুকতেই মূল গেটের উপরে যে পতাকা রয়েছে, সেই পতাকার মধ্যে অবস্থান করছে শাশ্বত ভারতবর্ষর চিরন্তন ত্যাগের প্রতীক। এবং গেটের কার্ণিসের উপরে রয়েছে সম্রাট অশোক-এর আত্মত্যাগের চিহ্ন বহনকারী আমলকী গাছ। নিবেদিতা এই বিজ্ঞান মন্দিরকে দেখে যেতে পারেননি। তাই নিবেদিতার ইচ্ছাকে স্মরণ রেখেই মন্দির-এর শীর্ষে বজ্রকে স্থাপন করা হয়েছিল। এরপরই মন্দির-এর ভিতরের প্রাঙ্গণে রয়েছে লজ্জাবতী ও বনচাঁড়াল গাছ। যা কিনা জগদীশচন্দ্রের উদ্ভিদবিদ্যাকে নিয়ে গবেষণার প্রেরণার উৎস। মূল গেট দিয়ে প্রবেশের পরই বাঁ দিকে ছোট্ট একটি পাথর-এর পদ্মাকৃতি জলাশয়। সেই জলাশয়-এর পাশেই রয়েছে LADY WITH THE LAMP এর রিলিফ মূর্তি যা নিবেদিতার প্রতিরূপ বলে কথিত। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কৃতি ছাত্র কৃষিবিজ্ঞানী বশিশ্বর সেন-এর তথ্য থেকে জানা যায় যে, ঐ জলাশয়-এর নিচেই নিবেদিতার চিতাভষ্ম রাখা আছে। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ঢুকতে প্রথমে পরে মিউজিয়াম। সেই মিউজিয়াম-এর এন্ট্রান্স হলের গেটে আছে বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাঠ-এর দরজা।
মিউজিয়াম-এ ঢুকতেই যার দিকে দৃষ্টি পড়ে, সেটি হল ডি. পি. রায়চৌধুরীর ভাষ্কর্য, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর আবক্ষ মূর্তি, আর মূল ক্যাম্পাসের প্রাঙ্গণে রয়েছে আচার্যদেবের স্মৃতি মন্দির।
বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ভবনটি ধূসর রক্তবর্ণ বেলে পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ভবনটি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এই সমগ্র ভবনটি জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজন্তা ইলোরার কারুকার্য ও হিন্দু-বৌদ্ধ শিল্পকলার নিদর্শন। যা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বসু বিজ্ঞান মন্দির শুধু বিজ্ঞান সাধনার কেন্দ্র নয়, এটি একটি জাতীয়তার প্রতীক। এই বিজ্ঞান মন্দির-এর প্রবেশ পথের ডান দিকে রয়েছে জগদীশচন্দ্রের অতি প্রিয় ১৫০০ আসন বিশিষ্ট বক্তৃতা কক্ষ। শিল্পী নন্দলাল বসু এই হলের ভিতরে ও বাইরের প্রধান দরজার চিত্রগুলি পরিকল্পনা দিয়েছেন। বক্তৃতা হলের মঞ্চের নিচে নন্দলাল বসু নির্মিত সপ্তাশ্বযোজিত রথ খচিত তাম্রফলক রয়েছে, আর কক্ষের উপরে রয়েছে ওনারই পরিকল্পিত বিখ্যাত দেওয়াল চিত্র (ফ্রেস্কো)। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভারতমাতা এই কেন্দ্রের সৌন্দর্যবর্ধন করেছিল।
এই বিজ্ঞান মন্দিরকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল আরো অনেক অর্থের। সেই অর্থ সংগ্রহের জন্য জগদীশ চন্দ্র এক অভিনব পদ্ধতি নিয়েছিলেন। তিনি এই ভারতীয় বীক্ষণাগারের জন্য সমগ্র দেশবাসীর কাছে অর্থ সাহায়্যের আবেদন রেখেছিলেন। আর সেই আবেদনে সকল দেশবাসীর সাড়া ছিল অকল্পনীয়। কাশিমবাজার-এর মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ২ লক্ষ টাকা অর্থ সাহায়্য করেছিলেন। পাতিয়ালার মহারাজ, বরোদার মহারাজ, কাশ্মীর-এর মহারাজ, মহারাজা গাইকোয়ার, শেঠ মুলরাজ, শ্রী বামেনজী প্রমুখেরা অনেক অর্থ সাহায্য করেছিলেন। তিনি যেসব জায়গায় বক্তৃতা দিতে যেতেন, সেখানে টিকিটের ব্যবস্থা করা হতো। আর এভাবেই বিভিন্ন সভা থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবেই সকলের সহযোগিতায় তিনি ১১ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। যখন জনসাধারণের এই অর্থে বিজ্ঞান মন্দির-এ স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গবেষণার কাজ চলতে লাগল, তখন ব্রিটিশ সরকার বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিল। জীবিতকালে তিনি ১২ লক্ষ টাকার একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী অবলা বসু তখনকার অবশিষ্ট সম্পত্তির সাহায্যে তিনি আরো একটি লক্ষাধিক টাকার ফান্ড তৈরি করেন। আর একটি বিশেষ কথা হল, এই প্রতিষ্ঠানে বসু কোনো বিদেশী সদস্য রাখেননি।
গবেষণা ও অগ্রগতি :
বর্তমানে এখানে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদ জীববিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, জীবসংখ্যাতত্ত্ব, ফলিত জীববিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষণা হয়। ইনস্টিটিউটটি ভারত তথা এশিয়ায় খ্যাতির শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। ইনস্টিটিউটে গবেষণা করেছেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারে অবদান রেখেছেন শম্ভু নাথ দে(কলেরা টক্সিন আবিষ্কারক), জগদীশ চন্দ্র বসুর ভাগ্নে দেবেন্দ্র মোহন বসু (ফটোগ্রাফিক ইমালসন প্লেট সংক্রান্ত গবেষণা), গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, শ্যামদাস চ্যাটার্জী প্রমুখ। স্পষ্টতঃই, বোস ইনস্টিটিউটের প্রারম্ভে জগদীশ চন্দ্র বসুর উদ্ভিদের উদ্দীপনা সংক্রান্ত কাজ, যা আজ 'সিস্টেম জীববিদ্যা' নামে পরিচিত, এই বিজ্ঞানকেন্দ্রকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া বর্তমানে এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গ-এর পাঁচটি জেলার প্রায় চল্লিশটি গ্রামে চলছে রুরাল প্রোজেক্ট। এই প্রকল্পগুলো পশ্চিমবঙ্গ-এর স্বল্পবৃষ্টিসম্পন্ন অঞ্চলগুলিতে পানীয় জল-এর চাহিদা মেটানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থার দিশা দেখিয়েছে; যেমন : দূষিত জল পরিস্রুতকরণ, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ প্রভৃতি। ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত গবেষণা চলছে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এখান থেকে চারজন বিজ্ঞানী শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পেয়েছেন। এখনও পর্যন্ত বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকে ৩৩ জন গবেষক দেশে বিদেশে বিভিন্ন সায়েন্স অ্যাকাডেমির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন।
বিভিন্ন সময়ে সম্মানীয় অধ্যক্ষগণ :
জগদীশ চন্দ্র বসু, ১৯১৭-১৯৩৭
দেবেন্দ্র মোহন বসু, ১৯৩৭-১৯৬৭
সৌরিন্দ্র মোহন সরকার, ১৯৬৭-১৯৭৫
সুশীল কুমার মুখার্জী, ১৯৭৬
এস. সি. ভট্টাচার্য, ১৯৭৭-১৯৮৪
বীরেন্দ্র বিজয় বিশ্বাস, ১৯৮৫-১৯৯১
পি. কে. রায়, ১৯৯২-২০০০
মাসুদ সিদ্দিকী, ২০০১-২০০৫
শিবাজী রাহা, ২০০৬-২০১৬
সিদ্ধার্থ রায় (অফিসিয়েটিং), ২০১৬-২০১৮
সুজয় কুমার দাশগুপ্ত (অফিসিয়েটিং), ২০১৮-বর্তমান।
মিউজিয়াম :
জগদীশ চন্দ্র বসু নিজেই প্রথম একটি প্রদর্শনশালা নির্মাণ করে তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতিগুলি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে এই মিউজিয়ামের উদ্দেশ্য হল বসুর আবিষ্কৃত সেই অভিনব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলিকে সংরক্ষণ করা, জনসাধারণের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা এবং বসুর লেখা কিছু গ্রন্থ, বসুর স্মরণীয় কিছু জিনিসপত্র ইত্যাদি সযত্নে সংরক্ষণ করা। বর্তমানে এটি ৯৩/১, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড-এর (আগে নাম ছিল আপার সার্কুলার রোড) প্রধান ক্যাম্পাসে অবস্থিত এবং সপ্তাহের প্রতিদিন খোলা থাকে।
No comments