শিখধর্মের দশম গুরুর প্রয়াণ দিবসে-স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করি
গুরু গোবিন্দ সিং (জন্ম : ২২ ডিসেম্বর, ১৬৬৬ - মৃত্যু : ৭ অক্টোবর, ১৭০৮) ছিলেন শিখধর্মের দশম গুরু। তিনি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গুরু গোবিন্দ…
শিখধর্মের দশম গুরুর প্রয়াণ দিবসে-স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করি
গুরু গোবিন্দ সিং (জন্ম : ২২ ডিসেম্বর, ১৬৬৬ - মৃত্যু : ৭ অক্টোবর, ১৭০৮) ছিলেন শিখধর্মের দশম গুরু। তিনি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গুরু গোবিন্দ ১৬৭৫ সালের ১১ নভেম্বর মাত্র নয় বছর বয়সে পিতা গুরু তেগ বাহাদুরের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন শিখ জাতির নেতা, যোদ্ধা, কবি ও দার্শনিক। শিখ সমাজে গুরু গোবিন্দ সিং হলেন আদর্শ পৌরুষের প্রতীক। তিনি তাঁর উচ্চশিক্ষা, দক্ষ অশ্বচালনা, সশস্ত্র যুদ্ধবিদ্যায় পটুতা ও চারিত্র্য দাক্ষিণ্যের জন্য প্রসিদ্ধ।
শিখদের আদর্শ ও দৈনন্দিন জীবনে গুরু গোবিন্দ সিং-এর জীবন ও শিক্ষার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তাঁর 'খালসা' প্রবর্তন শিখ ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি মুঘল ও শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলের মুঘল সহকারী রাজাদের সঙ্গে কুড়িটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন। গোবিন্দ সিংহই শেষ মানব শিখগুরু। ১৭০৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি শিখধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ 'গুরু গ্রন্থসাহিব'-কে শিখদের পরবর্তী এবং চিরস্থায়ী গুরু ঘোষণা করেন। তাঁর চার ছেলে ছিল : অজিত সিং, জুজহার সিং, জোরাওয়ার সিং, ফতেহ্ সিং।
শিশুকাল :
গোবিন্দ সিং ছিলেন নবম শিখগুরু গুরু তেগ বাহাদুর এবং মাতা গুজরির একমাত্র পুত্র । তিনি ১৬৬৬ সালের ২২ ডিসেম্বর বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন, যখন তাঁর পিতা বাংলা ও আসাম সফর করছিলেন। গুরু গোবিন্দ সিং যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁর নাম ছিল গোবিন্দ রাই এবং যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর জীবনের প্রথম চার বছর অতিবাহিত করেছিলেন, সেই বাড়ির জায়গাটিকে চিহ্নিত করে 'তখত শ্রী পাটনা হরমিন্দর সাহেব' স্থাপিত হয়। গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর জীবনের প্রথম ৫ বছর পাটনা শহরে কাটান।
একবার পাটনা শহরের রাজা ফতে চাঁদ ও তাঁর রাণী, যাঁরা সন্তানহীন ছিলেন, শিব দত্ত এর কাছে আসেন এবং একজন সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে বলেন। শিব দত্ত তাঁদের শিশু গুরু গোবিন্দ সিং এর সাথে দেখা করতে ও তাঁর আশীর্বাদ নিতে বলেন। গুরু গোবিন্দ সিং এর সাথে দেখা করার পর রাণী তাঁকে ছেলে সন্তানের জন্য আশীর্বাদ দিতে অনুরোধ করেন, এতে গুরু গোবিন্দ সিং হাসি দিয়ে বলেন যে, তাঁদের ছেলে সন্তানের দরকার কি, তাঁকেই তাঁরা ছেলে হিসাবে ডাকতে পারেন। এরপর হতে রাণী তাঁকে ছেলের মর্যাদা দেন এবং তাঁকে ছেলে বলে ডাকতেন। গুরু গোবিন্দ সিং তখন প্রায়ই তাঁদের প্রাসাদে যেতেন ও খেলা করতেন। রাণী তাঁকে ও তাঁর খেলার সাথীদের পুরি ও ছোলার ডাল রান্না করে দিতেন। আজও সেই প্রাসাদে পুরি ও ছোলার ডাল রান্না করা হয় এবং তা গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়। প্রাসাদটি এখন গুরুদোয়ারাতে পরিণত হয়েছে। নওয়াব করিম বখশ ও রহিম বখশ তাঁকে পছন্দ করতেন এবং গুরু গোবিন্দ সিংকে একটি গ্রাম ও বাগান উপহার দিয়েছিলেন।
শিক্ষা জীবন :
গুরু তেগ বাহাদুর আনন্দপুর নগরী-র সূচনা করেন ১৬৬৫ সালে, বিলাসপুরের(কাহলুর) শাসকের হতে জমি ক্রয়ের মাধ্যমে। তাঁর পূর্ব ভারত ভ্রমণ শেষ হলে তিনি তাঁর পরিবারকে আনন্দপুর আসতে বলেন।
১৬৭০ সালে, তাঁর পরিবার পাঞ্জাবে ফিরে আসে এবং ১৬৭২ সালের মার্চ মাসে তাঁরা উত্তর ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে চক নানকিতে চলে যায়, যাকে শিবালিক রেঞ্জ বলা হয়, যেখানে তিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন।
গুরু গোবিন্দ সিং ১৬৭২ সালে আনন্দপুরে পৌঁছান। গুরু গোবিন্দ সিং শুরুর শিক্ষা জীবনে পাঞ্জাবি, সংস্কৃতি, পারসিক, আরবি ভাষা শেখেন, এবং একজন সেনা হিসাবে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি হিন্দি ও সংস্কৃত পাটনা শহরে শিক্ষা লাভ করেন। আনন্দপুরে, তিনি পাঞ্জাবি শেখেন সাহিব চাঁদ, ও পারসিক কাজী পীর মুহাম্মদের থেকে।
পানোটাতে জীবন :
এপ্রিল ১৬৮৫ সালে, গুরু গোবিন্দ সিং বাসস্থান বদল করে পানোটাতে যান সিমুর রাজ্যর রাজা মাত প্রকাশ এর অনুরোধে। সিমুর রাজ্যের ইতিহাস অনুসারে, গুরু গোবিন্দ সিং আনন্দপুর নগরী ত্যাগ করতে বাধ্য হন ভিম চাঁদ এর সাথে মতবিরোধ থাকার জন্য, এবং টোকা নামক স্থানে চলে যান। টোকা নামক স্থান হতে তিনি নাহান (সিমুর রাজ্যর রাজধানীতে) চলে যান। তিনি নাহান, হতে পানোটাতে গমন করেন।
সিমুর রাজ্যর রাজা মাত প্রকাশ অনুরোধ করেন গুরু গোবিন্দ সিংকে তাঁর রাজ্যে আসার জন্য, যাতে করে রাজা ফতে সাহ যিনি গুরওয়ালের শাসক ছিলেন, তার বিপক্ষে যাতে পদ ও অবস্থান সুরক্ষিত হয়। রাজা মাত প্রকাশ এর অনুরোধে, গুরু গোবিন্দ সিং পানোটাতে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন, তাঁর অনুসারীদের সাহায্যে খুবই অল্প সময়ের মাঝে। তিনি তাঁর সেনাবাহিনীতে সেনা সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। পানোটাতে গুরু গোবিন্দ সিং তিন বছর অবস্থান করেন এবং অনেক শ্লোক রচনা করেন। সিমুর রাজ্যের রাজা মাত প্রকাশ এবং গুরওয়ালের রাজা ফতে সাহ-র মাঝে উত্তেজনা বাড়তে থাকে, এবং পানোটা এর কাছাকাছি স্থান থেকে অবশেষ এ ভাংগানী এর যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৬৮৮ সালে গুরওয়ালের রাজা ফতে সাহ আক্রমণ শুরু করেন। এই যুদ্ধে রাজা গুরু গোবিন্দ সিং জয় লাভ করেন।
চমকৌরের যুদ্ধ :
এটি ছিল নাহার খানের নেতৃত্বে মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে; সেনাপতি নাহার খানকে হত্যা করা হয়, শিখদের পক্ষে থাকাকালীন গুরুর বাকি দুই বড় ছেলে - অজিত সিং এবং জুজহার সিং, অন্যান্য শিখ সৈন্যদের সাথে এই যুদ্ধে নিহত হন।
আনন্দপুরের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৭০৪) :
পণ্ডিতদের মতে, আনন্দপুরে সশস্ত্র শিখদের বিস্তারের ফলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, ক্রমবর্ধমান সৈন্যসংখ্যা রসদ সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করেছিল। এর ফলে শিখরা স্থানীয় গ্রামগুলিতে খাদ্য এবং চর্যার সরবরাহের জন্য অভিযান চালায়, যা নাটকীয়ভাবে স্থানীয় পাহাড়ি রাজাদের হতাশ করেছিল, যারা জোট গঠন করেছিল। আওরঙ্গজেব তখন শিখ প্রতিরোধকে ধ্বংস করার জন্য ১৭০৪ সালের মে মাসে দুই জেনারেল, ওয়াজির খান এবং জাবেরদাস্ত খানের সাথে একটি বৃহত্তর সেনাবাহিনী পাঠান। এই যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী যে পন্থা অবলম্বন করেছিল, তা হল আনন্দপুরের বিরুদ্ধে মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ অবরোধ করা, বারবার যুদ্ধের সাথে সাথে সমস্ত খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া। কিছু শিখ পুরুষ ১৭০৪ সালে আনন্দপুর অবরোধের সময় গুরুকে পরিত্যাগ করে এবং তাদের বাড়িতে পালিয়ে যায় এবং তারা পরবর্তীতে গুরুর সেনাবাহিনীতে পুনরায় যোগ দেয় এবং ১৭০৫ সালে তাঁর সাথে যুদ্ধ করে মারা যায়। শেষের দিকে, গুরু, তাঁর পরিবার এবং অনুগামীরা আনন্দপুর থেকে নিরাপদ পথের আওরঙ্গজেবের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। দুই দলে আনন্দপুর ত্যাগ করার সময়, মুঘল সৈন্য আক্রমণ করে, এবং মাতা গুজরি এবং গুরুর দুই ছেলে - জোরাওয়ার সিং এবং ফতেহ সিং - মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী করা হয়। ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর ১৭০৪ সালের দিকে, ছোট ছেলে, সাহেবজাদা ফতেহ সিং , ৬ বছর বয়সী এবং জোরওয়ার সিং, ৯ বছর, যদি তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তাহলে নিরাপদ পথের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছিল; এবং পরবর্তীকালে, উজির খান তাঁদের দেয়ালে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করেন। শিশুদের ঠাকুরমা মাতা গুজরিও সেখানেই মারা যান। দন্ডনের স্থানে বর্তমানে গুরুদুয়ারা ফতেহগড় সাহেব অবস্থিত।
অন্তিম দিনগুলি :
ওয়াজির খান, মুসলিম সেনাপতি এবং সিরহিন্দের নবাব, যার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুরু গোবিন্দ সিং বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছিলেন, দুই আফগান, জামশেদ খান এবং ওয়াসিল বেগকে গুরুর সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন, যখন তারা বাহাদুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য অগ্রসর হয়েছিল। দু'জন গোপনে গুরুকে অনুসরণ করেন, যার সৈন্যরা ভারতের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে ছিল এবং শিবিরে প্রবেশ করে, যখন শিখরা কয়েক মাস ধরে গোদাবরী নদীর কাছে অবস্থান করছিল। তারা গুরুর কাছে প্রবেশ করে এবং জামশেদ খান তাঁকে একটি মারাত্মক ক্ষতসৃষ্টিকারী ছুরিকাঘাত করেন। সেই আঘাতের ক্ষতেই গুরুর মৃত্যু হয়। বর্তমানে সেখানে "হুজুর সাহেব" অবস্থিত।
No comments