বাঙালি ভাস্করের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিতুন কুন্ডুু [পুরো নাম: নিত্যগোপাল কুন্ডু] (জন্ম : ৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ - মৃত্যু : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৬) ছিলেন একজন বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী, নকশাবিদ, ভাস্কর, মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্প-উদ্যোক্তা। তিন…
বাঙালি ভাস্করের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিতুন কুন্ডুু [পুরো নাম: নিত্যগোপাল কুন্ডু] (জন্ম : ৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ - মৃত্যু : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৬) ছিলেন একজন বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী, নকশাবিদ, ভাস্কর, মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্প-উদ্যোক্তা। তিনি 'সাবাশ বাংলাদেশ', 'সার্ক ফোয়ারা' প্রমুখ বিখ্যাত ভাস্কর্যের স্থপতি। তিনি আসবাবপত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান "অটবি" স্থাপন করেন ও সফলতা লাভ করেন। তাঁর শিল্পে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৯৭ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'একুশে পদক'-এ ভূষিত করে।
প্রাথমিক জীবন :
নিতুন কুন্ডুর জন্ম দিনাজপুরে। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ১৯৪২ সালে বড়বন্দর পাঠশালায়। ১৯৪৭ সালে ভর্তি হন দিনাজপুর শহরের গিরিজানাথ হাই স্কুলে। ১৯৫২ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন। তিনি পড়ালেখা করেছেন তদানীন্তন ঢাকা আর্ট কলেজে
(বর্তমানের চারুকলা ইনস্টিটিউট)। সেখান থেকে তিনি ১৯৫৯ সালে চিত্রকলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও মরমি শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদের প্রিয় ছাত্র ছিলেন।
কর্মজীবন :
চিত্রশিল্পী নিতুন কুন্ডু ১৯৫৯ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ‘ডিজাইনার’ হিসেবে। ১৯৬২ সালে ইউনাইটেড স্টেটস্ ইনফরমেশন সার্ভিসেস (ইউসিস)-এর প্রধান ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তোপখানা রোডে বিখ্যাত বিজ্ঞাপনী সংস্থা "বিটপী"র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে নিতুন কুন্ডু ১৯৭৫ সালে "অটবি লিমিটেড" নামক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি আসবাবপত্র নির্মাণের ব্যবসায় শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে 'অটবি' নামে বর্তমান সময়ের বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি। 'অটবি'র আসবাবপত্র দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং এটি একটি ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ভাস্কর ও আসবাবপত্র ডিজাইনার হিসেবে পরিচিতি পেলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করার ব্যাপারেও তিনি আগ্রহী ছিলেন। শিল্পী হওয়ার নেশা ছিল তাঁর মজ্জাগত। শিল্পী হিসেবে তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে তাঁকে "একুশে পদক" প্রদান করে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান :
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিতুন কুন্ডু কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জনসংযোগ বিভাগে কাজ করেন। শিল্পী কামরুল হাসানের সাথে মিলে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে পোস্টার ডিজাইন ও অন্যান্য নকশা প্রণয়ন করেন। তাঁর প্রণীত পোস্টারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী ও বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ।
উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম :
১. সার্ক ফোয়ারা, ঢাকা (১৯৯৩), প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অবস্থিত।
২. সাবাশ বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২)।
৩. কদমফুল ফোয়ারা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
৪. মুর্যাল (পিতল), পাকিস্তান এয়ারলাইন্স অফিস, হোটেল শেরাটন, ঢাকা।
৫. ম্যুরাল (তেল রং) জনতা ব্যাংক, ঢাকা।
৬. ম্যুরাল (কাঠ, লোহা, পিতল) মধুমিতা সিনেমা হল, ঢাকা।
৭. সাম্পান, ঐতিহ্যবাহী নৌকার প্রতীক, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর (২০০১)।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সম্মুখে ফোয়ারা নির্মাণ।
উল্লেখযোগ্য কাজ :
• ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের পোস্টার ডিজাইন।
• স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২-এ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশে আগমন উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঞ্চ নির্মাণ।
• বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতার ট্রফির নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ।
• জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এর পদকের নকশা।
• প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ-এর নকশা।
• বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়ি পুরস্কার পদকের নকশা।
• প্রেসিডেন্ট শিশুকিশোর ফুটবল কাপের নকশা।
• শিল্পমেলা ট্রফির নকশা।
• এশিয়া কাপ ক্রিকেট পুরস্কার পদকের নকশা।
• জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের অভ্যন্তরের লাইটিংয়ের কারুকাজ।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার লাভ :
একুশে পদক (১৯৯৭),
ডেইলি স্টার-ডিএইচএল শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা পদক,
জাতীয় চিত্রকলা পুরস্কার ১৯৬৫।
দেহাবসান :
২০০৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর নিতুন কুন্ডু হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে ১৫ই সেপ্টেম্বর সকালে তিনি বারডেম হাসপাতালে মারা যান। ১৬ই সেপ্টেম্বর পোস্তগোলা শ্মশানে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
No comments