বন্ধুত্ব সবসময়েই একটা অন্যরকম সম্পর্ক। ফ্রেন্ডশিপ ডে-র আগে বন্ধুত্বের খুঁটিনাটি
বন্ধু চল...
নয়ের দশকের একেবারে শেষ দিক। শহরে এক সরকারি গার্লস কলেজের বাস্কেট বল কোর্টে আড্ডা বসেছে ইংরেজি বিভাগের জনা পঁচিশ ছাত্রীর। হাসিঠাট্টায় মু…
বন্ধুত্ব সবসময়েই একটা অন্যরকম সম্পর্ক। ফ্রেন্ডশিপ ডে-র আগে বন্ধুত্বের খুঁটিনাটি
বন্ধু চল...
নয়ের দশকের একেবারে শেষ দিক। শহরে এক সরকারি গার্লস কলেজের বাস্কেট বল কোর্টে আড্ডা বসেছে ইংরেজি বিভাগের জনা পঁচিশ ছাত্রীর। হাসিঠাট্টায় মুখর চারদিক। অপর্ণা শুরু করল— 'মেয়েদের কলেজে বন্ধুত্ব আর আড্ডা যেমন জমাটি রূপ পায়, কো-এড হলে তেমনটা হতো না।' সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদে সরব অন্যরা। 'কেন? ছেলেরা কি ভালো বন্ধু হতে পারে না?' অপর্ণা নিজের বক্তব্যের পক্ষে আবার বলল, *মেয়েলি আড্ডার একটা চরিত্র আছে। এই দেখ না, সবাই কেমন খোলামেলা গল্পে মজেছি। ফ্যাশন, খেলা, রাজনীতি— আড্ডার স্রোতে বেয়ে চলেছে সবই। এই যদি কো-এড হতো তাহলে আকাশ হয়তো মধুরার দিকে ঝুঁকে পড়ত, বিকাশের আলগা স্নেহ চুঁইয়ে পড়ত লিপির উপর। তারপরেই নানা গ্রুপে ভেঙে যেত দলটা।' কথাটায় পুরোপুরি একমত না হলেও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারল না কেউ। প্রসঙ্গ বদলে এবার নবনীতা প্রশ্ন করল, 'বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা তাহলে কী?' প্রায় একইসঙ্গে অনেকে বলে উঠল, 'নিঃশর্ত ভালোবাসা আর পাশে থাকার অঙ্গীকার।' তবে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সমমনস্কতার যে একটা জায়গা রয়েছে তা ওই অপরিণত, তারুণ্যে ভরা, আবেগপ্রবণ মনে ধরা পড়েনি।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বন্ধুত্ব বহু প্রাচীন সম্পর্ক। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে বন্ধুত্বের ইতিহাস নাকি তেরো থেকে ষোলো শতক নাগাদ শুরু হয়। চিঠি মারফত বন্ধুত্বের ফরমান দূরদূরান্তে পৌঁছে যেত সেই সময়। ইউরোপের জার্মানিতে প্রথম এমন চিঠির খোঁজ মিলেছিল। বন্ধুত্বের সেইসব চিঠিতে অমলিন ভালোবাসার প্রকাশ ছিল। দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর 'অন ফ্রেন্ডশিপ' প্রবন্ধে বন্ধুত্বের বিশ্লেষণ করেন। সেই ব্যাখ্যায় বন্ধুত্বের রসঘন আভাস পাওয়া যায় না। তবে বন্ধুত্ব যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিচারবোধ ও সমমনস্কতা থেকেই যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত সে কথা অ্যারিস্টটলও বলেছেন।
বন্ধুত্বের ধারণা ঘনীভূত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। মৃত্যুশোক ভুলতে, একাকিত্বের মোকাবিলা করতে অথবা নিছক মনের কথা জানাতে মানুষ একে অপরের প্রতি আরও
নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সেই সময়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে একটা 'কমিউনিটি ফিলিং তৈরি হয়। বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। সমমনস্ক মানুষ পারস্পরিক মত আদানপ্রদান শুরু করে। তাদের মধ্যে এক এমন সম্পর্ক তৈরি হয় যা আত্মীয়তার নয়, সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ।
তবু তো বন্ধুত্ব ভাঙে। সম্পর্কে মরচে ধরে। আসলে যে কোনও চলমান সম্পর্কই কখনও ওঠে, কখনও পড়ে। সমান্তরাল রেখায় তাকে বাঁধা যায় না। বন্ধুত্বও তেমন। মন যত পরিণত হয় সম্পর্কেরও বাঁক তত ঘুরে যায়। সময়ও একটা বড় ফ্যাক্টর। যুগ বদলায়, চিন্তাধারা পাল্টায়, জীবন আধুনিক হয়, এই সবই প্রভাব ফেলে বন্ধুত্বের উপর।
বন্ধুত্ব পরিণত হলে তার আকর্ষণ বদলে যায়। যেমনটা ঘটেছে সোনালি, রুমি, মধুরা আর অর্ণবের ক্ষেত্রে। স্কুলজীবনে তারা ছিল অভিন্নহৃদয় বন্ধু। তবু বন্ধুত্বে ভাটা পড়ল। পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে, সংসার—সবকিছুর মাঝে কবে যে ছিঁড়ে গেল চারজনের বন্ধুত্বের
সুতো, তা আজ আর কেউই মনে রাখেনি। কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর পর সোশ্যাল মিডিয়া মারফত যোগাযোগ হতে তারা বুঝেছে মধ্যবয়সে এসেও বন্ধন মজবুত। পরিণত বন্ধুত্বের মজাটা আলাদা। অলস বিকেলের আড্ডায় স্মৃতি ঘাঁটা হোক বা বিপদেআপদে একে অপরের পাশে থাকা, সবই তারা করছে। স্কুলজীবনের ঠাট্টা, বাড়ি লুকিয়ে সিনেমা দেখা নেই ঠিকই। তার বদলে একটা ভরসা তৈরি হয়েছে।
সময়ের সঙ্গেও বন্ধুত্বে বিস্তর বদল ঘটে। মানসিক গঠন যেমন বদলায় তেমনই পাল্টায় বন্ধুত্বের চাহিদা। যেমন টিনএজার দুই কন্যা রাজরূপা আর মেঘনার চোখে অনেক স্বপ্ন। বাবা মাকে লুকিয়ে সিনেমা দেখা থেকে বিদেশে পড়াশোনার খোঁজ, সবই তারা নিজেরা করতে চায়। টিউশন পালিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ, শহরটার সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত হওয়া — অভিজ্ঞতা লাভ একসঙ্গে। বছর কুড়ি আগে স্কুল বা কলেজপড়ুয়াদের স্বপ্নগুলোর মধ্যে ফারাক ছিল। তখনও সিনেমা দেখা থেকে বয়ফ্রেন্ড সবই ছিল হয়তো, কিন্তু তার মাত্রাটা ছিল ভিন্ন।
আসন্ন বন্ধুত্ব দিবসের প্রাক্কালে উপহার নিয়ে একটু আলোচনা না করলেই নয়। নিঃশর্ত সম্পর্কে আবার উপহারের বালাই কেন? আসলে বন্ধুত্বের উপহার স্মৃতির স্মারক হয়ে থেকে যায়। সম্পর্কের ওঠাপড়ায়, জীবনযাপনের ছন্দে যদি বন্ধুত্বে ছেদও পড়ে, তবু উপহার ভালোবাসার বার্তা হয়ে থেকে যায়। বন্ধুত্বের উপহারের রকমফের রয়েছে। আগেকার দিনে চকোলেট, ফুলের তোড়া বা কার্ডে যে বন্ধুত্বের অঙ্গীকার সীমাবদ্ধ ছিল তা এখন ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, কাস্টমাইজ করা কফি মাগ, চকোলেট বোকে, ডিজিটাল ফোটোফ্রেম ইত্যাদিতে গড়িয়েছে। আর একটু দামি উপহার দিতে চাইলে পারফিউম সেট, কলম ইত্যাদিও দিতে পারেন। সদ্য চাকরিতে ঢোকা বন্ধুটির জন্য বাছতেই পারেন অফিস ব্যাগ। আপনার বন্ধু যদি কর্পোরেট চাকরি করে তাহলে টাই, ঘড়ি, চাবির রিংয়ের সেট দিতে পারেন। মোটমাট বন্ধুত্বের উপহারে একটা ভালোবাসার রেশ থাকা চাই। আপনি যে বন্ধুটির কথা ভেবে কিছু কিনেছেন সেই বার্তা থাকুক উপহারে।
No comments