অংকের জাদুকর কেশব নাগ
কেশবচন্দ্র নাগ - অঙ্কের জাদুকরী শিক্ষক।
অঙ্ক আপনি ভালবাসুন বা না বাসুন, ছাত্রজীবন থেকে শেষজীবন অবধি সে আপনার পিছু ছাড়বে না। ছাত্রজীবনে অনেক দুরূহ অঙ্ক মিললেও জীবনযুদ্ধে এমন অনেক অঙ্ক না মেলাতে পারায় অনেকে হারি…
অংকের জাদুকর কেশব নাগ
কেশবচন্দ্র নাগ - অঙ্কের জাদুকরী শিক্ষক।
অঙ্ক আপনি ভালবাসুন বা না বাসুন, ছাত্রজীবন থেকে শেষজীবন অবধি সে আপনার পিছু ছাড়বে না। ছাত্রজীবনে অনেক দুরূহ অঙ্ক মিললেও জীবনযুদ্ধে এমন অনেক অঙ্ক না মেলাতে পারায় অনেকে হারিয়ে যায় অচিরেই।
ইস্কুল যেতে পেটব্যথা হবে। পরীক্ষার হলে ঘাম দিতে থাকবে। তেল মাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে মাংকি! প্রোপোজ-টোপোজ ঘুচিয়ে ম্যাথস-এর কোচিং-এ প্রেস্টিজ ফুটো হবে। কেননা চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তত ক্ষণে সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আর উপরের কোন ব্যাটাচ্ছেলে খুলে দিয়েছে কল! এমতাবস্থায় কোনটে চাই, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, সেটুকু ধরতেই মাথা গুলিয়ে 'গ'। এই কিংকতর্ব্যবিমূঢ়তারই আদি পিতা কে সি নাগ।
আবার, কে সি নাগ একটা চ্যালেঞ্জের নাম। তেমন জুতসই একটা অঙ্কের সমাধান কারও কনফিডেন্সের ফুসফুসটা আরও ফুলিয়ে দেয়। এক-একটা অনুশীলনী যত গড়িয়ে আসতে থাকে, খেলা তত জমে। উনতিরিশ, তিরিশ, একত্রিশের দাগের অঙ্কগুলো যেন এক একটা হার্ডল, টপকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে সাঁইসাঁই রেস জেতার উল্লাস।
তখন শহরে গ্রামে বাঙালি মায়েরা বলতেন, বাছা শুয়ে পড়, নইলে কে সি নাগের অঙ্ক কষতে দেব। তেলমাখা বাঁশ দিয়ে উঠতে গিয়ে বাঁদর একবার উঠছে, আবার পড়ে যাচ্ছে। কতক্ষণে বাঁশের মাথায় উঠবে বাঁদরটি? প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে গতিময় ট্রেন, তার দৈর্ঘ্য কত? এমন হরেক রকম অঙ্ক কষে বের করতে হয়নি এমন পড়ুয়া হাতে গোনা। কারও কাছে এমন সব অঙ্ক এক নির্ভেজাল আতঙ্ক। কারও কাছে আবার সেই অঙ্কের উত্তর বের করা একটা অ্যাচিভমেন্ট। কচিকাঁচা পড়ুয়াদের অঙ্কের মেরুদণ্ড শক্ত করার শুরু যাঁর হাত ধরে সেই 'গণিত শিল্পী' কেশবচন্দ্র নাগের আজ জন্মদিন।
কেসি নাগ একদিকে ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক, অন্যদিকে শিল্পী। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নাম দিয়েছিলেন 'গণিতশিল্পী'। তিনের দশকে তাঁর প্রকাশিত ‘নব পাটিগণিত’-এর সময় থেকে এখন অঙ্কের সিলেবাসে অনেক বদল হয়েছে। তবু অঙ্ক নিয়েই যাঁরা পড়তে চান, তাঁদের কাছে এখনও কেসি নাগের বই জনপ্রিয়। বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই। পাকিস্তান বোর্ডের জন্যও বই লিখেছিলেন তিনি। রয়েছে তাঁর বইয়ের ব্রেইল সংস্করণ। অঙ্কই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ছাত্রদের অঙ্কভীতি কীভাবে দূর করা যায়, কী ভাবে আরও প্রাঞ্জল করে তোলা যায় কঠিন অঙ্ককে, সেটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। অনেকেই তাঁকে 'বাঙালির অঙ্ক শিক্ষক' বলে থাকেন।
উত্তম-সুচিত্রার ছবির ভক্ত, মোহনবাগান ক্লাবের কট্টর সমর্থক ছিলেন। ওনার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে বিকাশ রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। নাম দিয়েছিলেন 'রত্নবেদী'।
বাঙালি অঙ্ক শুনলেই যাঁকে গড় করে, সেই কে সি নাগকে নিয়ে লিখব শুনে এক বন্ধু বলেছিলেন, এত কঠিন কঠিন অঙ্ক উনি কী করে বানাতেন? যাঁরা গল্প-উপন্যাস লেখেন, তাঁদের না হয় মাথায় একটা প্লট, চরিত্র থাকে। ছবি আঁকতে গেলে তুলির আঁচড়েরও আগে কল্পনা লাগে। কিন্তু এমন কঠিন সব অঙ্ক ‘লিখতে’ পারার পিছনে কোন কল্পনা, কোন বাস্তব কাজ করেছিল কে সি নাগ, কেশবচন্দ্র নাগ নামের মানুষটির?
গণিত কি সমাপতনে বিশ্বাস করে? ১২৯ বছর আগে, ১৮৯৩, ১০ জুলাই, রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। বাবা রঘুনাথ, মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। শৈশবেই পিতৃহারা হন কেশব। সন্তানদের মানুষ করতে শুরু হল ক্ষীরোদাসুন্দরীর লড়াই। কেশবচন্দ্রের পড়াশোনার শুরু স্থানীয় বাংলা স্কুলে। গুড়াপে তখন ওই একটিই স্কুল। তার পর ক্লাস সেভেন থেকে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। রাত থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়া, তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্রতি দিন স্কুল যাওয়া। হেঁটেই ফেরা। ক্লাস নাইনে ভরতি হলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। ১৯১২ সালে সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া। এ বার রিপন কলেজ। বিষয় বিজ্ঞান। এই সময় থেকেই প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে দেন কেশবচন্দ্র। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগেই পাশ করলেন আই. এস. সি.।
যে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক দিন ছাত্র ছিলেন, সেখানেই শুরু করলেন শিক্ষকতা। যোগ দিলেন থার্ড মাস্টার হিসেবে। সংসারের ভার তখন কাঁধে, চাকরি ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার চেষ্টা চলল। বিজ্ঞান নয়, যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বি. এ. পাশ করলেন কেশবচন্দ্র। এ বার ডাক এল অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার, সেই ছাত্রবেলার কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে। সেখানেও কিছু দিন শিক্ষকতা করলেন তিনি। বড়দা এবং মেজদার মৃত্যুর পরে অভাবিতভাবেই সংসারের দায়ভার সামলাতে খুব অল্প বয়সেই শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন কেশব চন্দ্র নাগ। বহরমপুরের সেই বিখ্যাত স্কুলে চাকরির আগে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের কাছে কলকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন তিনি। আর এই স্কুলে শিক্ষকতা করতে করতেই গণিতের শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি বিস্তৃত হতে শুরু করে। এরপরে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বাড়িতে গণিতের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন কেশব চন্দ্র নাগ আর সেই সঙ্গে রাজবাড়ির বিশাল লাইব্রেরিতে দেশ-বিদেশের বই ঘাঁটার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে গণিতের বই লেখার সময় তাঁর কাজে লেগেছে।
তার পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল। এ সময়ই অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কেশবচন্দ্রের সুখ্যাতির কথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছয়। মানুষ চিনতে তিনি ভুল করেননি। মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা হয় কেশবচন্দ্রকে। ১৯২৪ সালে কেশব চন্দ্র নাগ যোগ দেন কলকাতার ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে। দীর্ঘ ৩৬ বছর এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।
রসা রোডে মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তত দিনে তাঁর জীবনের কেন্দ্রে কেবল একটিই শব্দ গণিত। এই মিত্র ইনস্টিটিউশনেরই প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন কেশবচন্দ্র। মেসবাড়ি ছেড়ে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনের নতুন বাড়িতে। আজও যে বাড়িতে ‘কেশবচন্দ্র নাগ’ লেখা নেমপ্লেটটি উজ্জ্বল! তাঁর শিক্ষকজীবনের শেষার্ধ কেটেছে কলকাতায়। তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু, অন্তরের টানে বারে বারে ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর মাটির কাছে।
না, কল্পনা নয়। বই লেখার কথা দূর কল্পনাতেও ছিল না। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়াতেন। সেখানে তাঁর অগ্রজ সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’। আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকরা। কেশবচন্দ্রও হয়ে ওঠেন সেই আড্ডার অন্যতম। শরৎচন্দ্রই নাকি তাঁকে প্রথম বলেন গণিতের বই লেখার কথা। তখন কেশবচন্দ্র বিষয়টাকে বড় একটা পাত্তা দেননি। তার পর এক দিন তাঁকে প্রায় চেপেই ধরেন কবিশেখর। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের জন্য বই লেখার কথা বলেন। ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ প্রবন্ধে সে কথোপকথনের একটা ইঙ্গিত রেখেছেন লেখক চিত্তরঞ্জন ঘোষাল। কালিদাসবাবু বলেন ‘ক্লাসে যেভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যেভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় ভাই যে তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তাহলে নিজে লিখতে পারবে না কেন?’ শুরু হল পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তখন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশিত হল ‘নব পাটীগণিত’। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই বই অল্পকালের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা পায় বইটি। কেশবচন্দ্র নাগের সেই ‘কে সি নাগ’ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই তামাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হল।
আক্ষরিকই, অপাঠ্য বই লিখেও অনেকের কপালে সাহিত্যিক-সুলেখকের তকমা জোটে। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে ‘লেখক’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্র্যাকটিসে নেই। ল্যাডলিমোহনের কেমিস্ট্রি বা সিআরডিজি-র ফিজিক্স অনেক বাজারি গপ্পো-কবিতার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, বেশি মানুষের ‘কাজে’ লেগেছে। তবু তাঁদের আমরা লেখক বলি না। কে সি নাগের ক্ষেত্রেও ‘পাঠক’-এর অবস্থানটা সেরকমই। ভুললে চলবে না, কে সি নাগকে অঙ্কের বই লিখতে বলছেন কবি আর কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্র মজা করেই তাঁকে ডাকছেন ‘গণিত-শিল্পী’ বলে! কে সি নাগের সেই সব অঙ্কবইয়ে কি তবে কোনও মৌলিকত্ব নেই? তাঁকে পুরোদস্তুর ‘লেখক’-এর তকমা দেওয়া কি উচিত নয়?
তাঁর বই প্রকাশ হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে শোনা যায়, শ্রেণিকক্ষে একদিন তিনি নিজের বই দেখিয়ে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেন যে এই বই পাঁচ টাকায় বিক্রি করলে তাঁর লাভ কত হবে! বইয়ের দাম তিন টাকা সেসময় প্রায় সকলেই জানতো আর তারা সকলেই যখন উত্তর দিল যে দু টাকা লাভ হবে, কেশব নাগ সহাস্যে বলেছিলেন যে পুরো পাঁচ টাকাই লাভ হবে কারণ তিনি তো কেনেননি বইটি।
ঘটনাচক্রে কেশবচন্দ্রের মেসে এক দিন এসে পড়েন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরেই ছিল কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা। দেখামাত্রই চমকে ওঠেন পরেশবাবু। কোন অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই বোধগম্য হবে ছাত্রদের, তার হরেক রকম টেকনিক লিখে রাখা পাতার পর পাতায়। সেই খাতাটি বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে একেবারেই রাজি হননি কেশবচন্দ্র। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়, না শিক্ষকদের জন্য গাইডবুক হবে এটি? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন প্রকাশক। ১৯৪২। প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। বেরনো মাত্রই বইটির চাহিদা হয়েছিল আকাশছোঁয়া।
একে একে তাঁর আরও বই প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন ‘পাক ম্যাথমেটিক্স’। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মার্টিন বার্ড স্নাইডার কে সি নাগের বইগুলির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য থিয়োরিটিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য সাবজেক্ট ইন দিজ বুকস ওয়্যার সুপিরিয়র টু দ্যাট ফাউন্ড ইন সিমিলার বুকস ইন দ্য ইউএসএ’। ১৯৫৫ সালে 'নাগ পাবলিশিং হাউজ' প্রতিষ্ঠা করে নিজের বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।
তিনি যেমন অঙ্কের শিক্ষক, তেমনই বিখ্যাত তাঁর পাটিগণিতের বই। কিন্তু কতজন জানেন এই অঙ্কপ্রাণ মানুষটি শ্রী শ্রী সারদা মায়ের মন্ত্রশিষ্য। যার বইয়ের অঙ্ক কষতে গিয়ে অনেক ছাত্র কেঁদে কুল পেত না, সেই তিনিই কেঁদে ভাসিয়েছিলেন শ্রী শ্রী মায়ের দেওয়া এক জিনিস কাছছাড়া হওয়ায়। মায়ের দীক্ষা লাভের পর মাত্র সতেরো মাস শ্রী শ্রী মায়ের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছিল কেশব নাগের। এর মধ্যেই তাঁর খুব কাছের হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই সারদা দেবীর পরলোকগমনের পর তিনি দুটি অমূল্য সম্পদের উত্তরাধিকারি হয়েছিলেন।
তার মধ্যে একটি ছিল মায়ের জপ করে দেওয়া রুদ্রাক্ষের জপের মালা ও আর একটি হল শ্রী শ্রী সারদা মায়ের অলক্তরঞ্জিত চরণচিহ্ন বা পায়ের ছাপ। ঘটনা হল তাঁর প্রাণের প্রিয় ওই জপের মালাটিই গিয়েছিল হারিয়ে। কেশবচন্দ্রের নিত্যসহচর ছিল জপের মালাটি। সেটি তাঁর পৈতৃক বাড়ি গুড়াপে যাওয়ার পথে হারিয়ে যায়। কেশব নাগ এই ঘটনার ফলে ব্যাপকভাবে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর এমন অবস্থা দেখে তাঁর প্রতিবেশীরাই তা খোঁজার উদ্যোগ নেন। কলকাতার নামকরা কাগজে আবেদন করেন, "৫৪ সংখ্যক একটি রুদ্রাক্ষের মালা যদি কেউ পেয়ে থাকেন, দয়া করে নিম্নোক্ত ঠিকানায় ফেরৎ পাঠালে ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করবেন।" অবাক করা কান্ড। ঠিক সাত দিনের মধ্যে কেশবচন্দ্রের ভবানীপুরের মেস বাড়িতে ডাকপিওন মালাটি দিয়ে যায়।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের গুড়াপ শাখার অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ তাঁর বন্ধুস্থানীয় এবং একইসঙ্গে তাঁর জীবনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভাই স্বামী অভেদানন্দের সান্নিধ্যেও এসেছেন কেশব চন্দ্র নাগ।
কেশবচন্দ্র নিছক গণিতজ্ঞ ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যমোদী মানুষ। মিত্র ইনস্টিটিউশনে তাঁর সহকর্মী ছিলেন কবিশেখর কালিদাস রায়। কবিশেখরের বাড়িতেই ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’ নামে এক সাহিত্য সংগঠনের আড্ডা বসত নিয়মিত।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কিংবা জলধর সেনের মতো প্রথিতযশা সাহিত্যিকের যাতায়াত ছিল সেই আড্ডায়। সাহিত্যপ্রিয় কেশবচন্দ্রও ছিলেন সেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য। 'রত্ন বেদী'তেও নিয়মিত লেখক ছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো তাঁর নামই দিয়েছিলেন 'গণিতশিল্পী'। ব্যক্তিগত ডায়েরি ‘রত্নবেদী’-তে লিখে গিয়েছেন বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন ‘বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ’! ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত টানা এই অভ্যাস চালিয়েছেন। এ ছাড়াও কেশবচন্দ্র বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরেজি বক্তৃতা। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার লেখাও। গণিত শিক্ষকের পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কখনো ভগিনী নিবেদিতার ‘শিব ও বুদ্ধ’ রচনার অনুবাদ, কখনো নিজের ডায়েরিতে সারদা মাকে নিয়ে ‘টু মাদার্স ফিট’ নামের কবিতা লিখেছেন তিনি।
গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও শামিল হয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। তাঁর বই তত দিনে বাজারে ঝড় তুলে দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন গ্রামে। ধনেখালি থানা কংগ্রেসের তখন তিনি সভাপতি। চলল মিছিল, আন্দোলন। পুলিশ গ্রেপ্তার করল কেশবচন্দ্রকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিন কাটতে লাগল জেলখানায়। গুজব রটল ইংরেজরা চাইছে কেশবচন্দ্রকে গুম করে দিতে! অবশেষে তিনি ছাড়া পেলেন বেশ কয়েক মাস পর। ফিরে এসে ফের যোগ দিলেন গাঁধীজির অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান। ভোটে দাঁড়াতে বলেন। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কেশবচন্দ্র।
এক বার তৎকালীন রাজ্যপাল এসেছিলেন মিত্র ইনস্টিটিউশন স্কুলে। এসে স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষকদের সকলের সঙ্গে আলাপ করেন। শুধু বাকি থেকে যান কে সি নাগ। কারণ, তখন কেশবচন্দ্র স্যর অঙ্কের ক্লাস নিচ্ছিলেন। রাজ্যপাল এসেছেন শুনেও তিনি ক্লাস থামাননি। রাজ্যপালও অপেক্ষা করেন তাঁর ক্লাস শেষ হওয়ার জন্য। অঙ্কের প্রতি এতটাই ছিল স্যরের ভালবাসা ও নিষ্ঠা।
স্যরের ছাত্রদের তালিকাটা স্বভাবতই বেশ লম্বা। তারকাখচিতও বটে। চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিকাশ রায়। রঞ্জিত মল্লিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ গ্রন্থে (চিত্তরঞ্জন ঘোষাল সম্পাদিত ও ‘গ্রন্থ সম্পুট’ প্রকাশিত) কলম ধরেছিলেন তাঁর এই সব কৃতী ছাত্ররা। নিজেদের মাঠে যাঁরা সব হিসেব এক্কেবারে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গণিতবিদ হয়েও বেদ-উপনিষদে কেশববাবুর যে টান, তাতেও এ দুইয়ের নিকটাত্মীয়তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।’ সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলছেন, ‘ছাত্রদের সাহায্য করতে (শুধু অঙ্কে নয়, যে কোনও ব্যাপারে) তাঁর দিনে রাত্রে কোনো সময়েই কিছুমাত্র অনাগ্রহ বা উদ্যমের অভাব ছিল না। এবং সে সাহায্যের মধ্যে কোনো দেনাপাওনার সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না।’ সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘অবাক হয়েছিলাম, যাঁকে দেখে ভয় হোত, কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হোত সেই কেশববাবু স্যারই যখন গান করার উৎসাহ দিতেন আমাকে।’ তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিতে দেখেছেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। তিনি লিখছেন, ‘তাঁরই প্রেরণায় উপলব্ধি করলাম অঙ্ক কত সহজ অঙ্ক একটা ম্যাজিক অঙ্কের মধ্যেও সাহিত্য-শিল্প আছে।’ আবার গুড়াপ সুরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের স্মারকগ্রন্থে লিখছেন অভিনেতা বিকাশ রায়, ‘মোটা চশমার আড়ালে গম্ভীর মুখের ছায়ায় একজোড়া সহানুভূতি-ভরা চোখ আমরা দেখেছিলাম, আমরা ভাল কিছু করতে পারলে সেই চোখে উৎসাহ জ্বলে উঠতো, আমাদের দুষ্টুমি দেখে সেই চোখে মৃদু ভর্ৎসনার সঙ্গে সামান্য indulgence ফুটে উঠতো।’
কেশবচন্দ্রের আরও এক আগ্রহের জায়গা ছিল খেলার মাঠ। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস সবেতেই সমান আগ্রহ। ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য। বয়সকালে মাঠে যেতে পারতেন না, রেডিয়োয় সম্প্রচার শুনতেন। আর পাটিগণিত থেকে শিফ্ট করে যেতেন জ্যামিতিতে! রিলে শুনতে শুনতেই কাগজে আঁক কেটে বুঝতেন ও বুঝিয়ে দিতেন মাঠের এক একটা মুভমেন্ট। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫। রেডিয়োয় চলছে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী। কানপুরে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট। কেরিয়ারের শুরুতেই তিন নম্বর সেঞ্চুরিটি হাঁকাচ্ছেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। টানটান রোমাঞ্চ। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেশবচন্দ্র। সেরিব্রাল। আরও দু’বছর পর থেমে গেল সব অঙ্ক। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭।
অঙ্কের সিলেবাসে এখন বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যারা অঙ্কের মধ্যে রসনা তৃপ্তি খুঁজে পায়, তাঁদের কাছে কেসি নাগের বই এখনও সেরা। অঙ্কই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ছাত্রদের অঙ্কভীতি কীভাবে দূর করা যায় সেটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন।
আমি-আপনিও কি কে সি নাগের ছাত্র নই? কে সি নাগ বহু মানুষের কৈশোরের এক অনিবার্য স্মৃতি। এক আইকন। তিনিই আমাদের পাঠ্যক্রমের একমাত্র অরণ্যদেব। অথচ বইয়ের টাইটেল পেজে নামের পাশে ডিগ্রি লিখতেন না তিনি। আজও তাঁর বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে। একটি তাঁর নিজের নামে, অন্যটি তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে। এই চ্যারিটি ফাণ্ডের অর্থানুকুল্যে তাঁর জন্মস্থান গুড়াপে তৈরি হয়েছে রাস্তা, স্কুল, লাইব্রেরি ইত্যাদি। এখনও প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় গুড়াপে। নাগপাড়ায় স্বামী বিশুদ্ধানন্দের জন্মভিটেতে আশ্রম তৈরি করে দাতব্য চিকিৎসালয় চালাতেন তিনি যা পরে রামকৃষ্ণ মিশনের অধীনস্থ হয়। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের উদ্যোগে। আয়োজিত হয় 'কেশবচন্দ্র নাগ স্মারক বক্তৃতা'। কিন্তু সে খবর আমরা ক’জন রাখি? ক’টা টিভি ক্যামেরা যায় সেখানে? আমাদের অবশ্য প্রণাম-ট্রনাম খুব ভাল আসে না। পাটিগণিতের মতোই, বেশ গুলিয়ে গেছে। এই নল দিয়ে ঢুকছিল শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধ আর ওই নল দিয়ে খরচ করে ফেলছিলাম ফুর্তিময় বিন্দাস মুহূর্ত, হাতে রইল যেন কী?
সাদা-কালো অক্ষরে ছাপা সেই অঙ্কের বইটির জন্মদাতাতে এখন প্রায় ভুলতেই বসেছে মানুষ। তাঁর জন্মদিনে না হয় কোনও ধুমধাম, না কোনও স্মরণ সভা। আমাদের শৈশবের শিক্ষা যাঁর হাত ধরে তাঁকে কি এতই সহজে ভুলে যাব আমরা? আগামী প্রজন্ম কি জানবে না তাঁর নাম? কে জানে! হয়ত সময়ই দিতে পারে এর উত্তর।
শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা হলুদ মলাটের বই। যার উপরে লেখা 'নব পাটীগণিত', কারও কাছে অমৃতভাণ্ড আবার অনেকের কাছে দুঃস্বপ্ন। বইয়ের ভেতর কখনও তেল চপচপে বাঁশে বাঁদর ওঠা নামার মজার অঙ্ক। আবার অঙ্ক শিখিয়ে পুত্রকে দিয়ে বের করে নেওয়া পিতার বয়স। কিংবা সেই চিরন্তন গরু-মহিষের অঙ্ক! বাঙালির অঙ্ক বইকে সামাজিক করে তুলেছিলেন কেশব চন্দ্র নাগ। আমি-আপনিও কি কে সি নাগের ছাত্র নই? কে সি নাগ বহু মানুষের কৈশোরের এক অনিবার্য স্মৃতি। এক আইকন। তিনিই আমাদের পাঠ্যক্রমের একমাত্র অরণ্যদেব।
আজ তাঁর জন্মদিবসে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
No comments