Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

কোন তরুণ ভারতকে স্বপ্নে দেখেছিলেন নিবেদিতা

কোন তরুণ ভারতকে স্বপ্নে দেখেছিলেন নিবেদিতা
আইরিশ ন্যাশনালিজমের মধ্যে বড় হওয়া মার্গারেট সেদিন নিবেদিতা অবস্থাতেও দেখতে পেয়েছিলেন, আধ্যাত্ম আর চিৎশক্তিতে ঋদ্ধ ভারতবর্ষ বিজ্ঞান আর সাহিত্য, মনন আর দর্শনের এক নতুন জগতে কদম রাখতে চলেছে…

 




কোন তরুণ ভারতকে স্বপ্নে দেখেছিলেন নিবেদিতা


আইরিশ ন্যাশনালিজমের মধ্যে বড় হওয়া মার্গারেট সেদিন নিবেদিতা অবস্থাতেও দেখতে পেয়েছিলেন, আধ্যাত্ম আর চিৎশক্তিতে ঋদ্ধ ভারতবর্ষ বিজ্ঞান আর সাহিত্য, মনন আর দর্শনের এক নতুন জগতে কদম রাখতে চলেছে।


তিনি ভারতে আগন্তুক। কিন্তু তাঁর চাইতে বড় ভারতবাসী কে? মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল সম্পর্কে ভাবতে বসলে এ কথাই সবার আগে মাথায় ঘুরপাক খায়। কোনও গিমিকের বশবর্তী হয়ে নয়, কোনও প্রাপ্তির আশায় নয়, ঠিক কেন যে এক সাতাশ-আঠাশ বছরের তরুণী লন্ডনের মতো এক আধুনিক শহর ছেড়ে কাহিনি, কিংবদন্তি আর কুসংস্কারে মোড়া (সেই সময়ে ইউরোপে ভারত সম্পর্কে এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল) ভারতবর্ষে চলে এলেন, তা আজ, তাঁর জন্মের ১৫০ বছর পরে বুঝে ওঠা দুরূহ। বুঝে ওঠা দুরূহ, এক তরুণ ভারতীয় সন্ন্যাসীর মধ্যে কী এমন দেখেছিলেন এই নারী, যে উনিশ শতকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইংল্যান্ডের ভোগবাদ তাঁর কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। না, ১৯৭০ দশকের হিপি বিদ্রোহের মধ্যে আর যাই হোক, নিবেদিতাকে পাওয়া যাবে না। হিপিদের মধ্যে কোনও নিবেদিতা ছিলেন না।


তা হলে কি ধরে নিতে হবে, কোনও এক আশ্চর্য তারুণ্যের প্রণোদন কাজ করেছিল এই তরুণীর সন্ধান-সূত্রে? ব্রিটেনে দ্রুত থেকে দ্রুততর শিল্পায়ন, সভ্যতার একবগ্গা অর্থ তৈরি করে তা বিশ্বের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা আর ক্রমাগত কলোনির বিস্তার মার্গারেট তীক্ষ্ণ মেধায় প্রশ্নাতীত বলে মনে হয়নি। তিনি তারুণ্যের অন্য অর্থের সন্ধান করছিলেন। 


আয়ারল্যান্ডের এক ধর্মপ্রাণ পরিবার থেকে আগত এই তরুণী খ্রিস্টধর্মের অন্য ব্যঞ্জনাকে জানতেন। তিনি জানতেন, ধর্মাশ্রয় বা প্রতিষ্ঠানের চাইতেও বড় এ মানবজমিন। আর সেই বিন্দুতে দাঁড়িয়েই কি তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামক আর এক তরুণের মধ্যে দেখেছিলেন ঝড়ের প্রতিশ্রুতি? না, এই ঝড় বিধ্বংসী নয়। এই ঝড় দিনবদলের বার্তাবাহী। 


স্বামীজিকে অনুসরণ করে কলকাতায় চলে আসা এবং বিবেকানন্দের কাছে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা নেওয়ার সময়ে কি এই তরুণী জানতেন না, ব্রহ্মচর্য মানে কী? জানার উপায় তেমন নেই। কিন্তু ভাবতে ইচ্ছে করে, জীবনের একটা নতুন মানে, তারুণ্যের একটা নতুন ব্যঞ্জনাকেই নিবেদিতা খুঁজে পেয়েছিলেন এই ব্রাতধারণের মধ্যে। হাজার হাজার বছরের এক ঐতিহ্য, যেখানে জরা নেই, মারী নেই, এমনকী মৃত্যু নামক প্রহেলিকাটিও অনুপস্থিত, সেই বাসাংসী জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি-র ভূমিতে দাঁড়িয়ে চিরনবীন সপ্তর্ষিমণ্ডল আর চিরযুবা কালপুরুষের নক্ষত্রছায়ায় তিনি জেনেছিলেন, এখানেই একমাত্র অমৃতের পুত্রকে আহ্বান করা যায় প্রত্যক্ষ ভাবে। কোনও সন্দেহ নেই স্বামীজি ও তাঁর দর্শনের মধ্যে এক চিরনবীনের সন্ধান পেয়েছিলেন নিবেদিতা।


ভগিনী নিবেদিতা বা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল ছিলেন একজন অ্যাংলো-আইরিশ বংশোদ্ভুত সমাজকর্মী, লেখিকা, শিক্ষিকা এবং স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা। ১৮৯৫ সালে লন্ডন শহরে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ পান এবং ১৮৯৮ সালে ভারতে চলে আসেন। একই বছর ২৫ মার্চ তিনি ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করলে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নামকরণ করেন “নিবেদিতা”।


১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মায়ের নাম ছিল মেরি ইসাবেলা। মাত্র দশ বছর বয়সে মার্গারেটের বাবা মারা যান। তারপর তাঁর দাদামশাই তথা আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হ্যামিলটন তাঁকে লালনপালন করেন। লন্ডনের স্কুলে মার্গারেটের শিক্ষা লাভ। সতেরো বছর বয়সে শিক্ষা শেষ করে মার্গারেট শিক্ষিকার পেশা গ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে উইম্বলডনে নিজের একটি স্কুল খোলেন। পাশাপাশি নানা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে ও চার্চের হয়ে নানা সেবামূলক কাজও শুরু করেন।


১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাস। তখনও ইংল্যান্ডে একজন সাধারণ শিক্ষিকা হিসেবেই পরিচিতি মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের। ওয়েস্ট এন্ডের একজন পরিচিতের বাড়ি গিয়েছেন তিনি। কয়েকদিন আগেই বিশ্ব ধর্মসম্মেলন হয়ে গেছে শিকাগোতে। সেখানে সবাইকে মোহিত করে রেখেছিলেন গেরুয়া পরিহিত এক ভারতীয় সাধু। তিনিই নাকি এই বাড়িতে আসবেন। সেই প্রথম মুখোমুখি হন মার্গারেট নোবেল এবং স্বামী বিবেকানন্দ। জীবন তখন দোলাচলে; কোথাও স্থির হতে পারছেন না। বিবেকানন্দের কথা, ভারতবর্ষের কথা যেন ভেতরে ঢেউ নিয়ে এল। নিজেকে চিনতে পারলেন না মার্গারেট। ভেসে চলেছেন সেই অপার ঢেউয়ে। আর ভাসতে ভাসতে চলে এলেন ভারতবর্ষে, কলকাতায়। তারপর বিবেকানন্দকেই নিজের গুরু বলে বরণ করে নেন।


১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময় বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, সমাজতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনে মার্গারেট ভারতকে চিনে নেন। ভারতে আসার কয়েক দিন পর শ্রী রামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এর কিছুদিন পর স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। তিনিই মার্গারেটের নতুন নাম রাখেন ‘নিবেদিতা’।


মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিবেদিতা উত্তর কলকাতার  বাগবাজার অঞ্চলে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনে নিজে 'নিবেদিতা গার্লস স্কুল' খোলেন। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারী দেখা দিলে তিনি স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় রোগীদের জন্য 'শিব আশ্রম' গড়েন ও পল্লী সংস্কারের কাজ করেন।


১৯০২ সালের ৪ জুলাই নিবেদিতার গুরু স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতে শুরু করেন নিবেদিতা। এই সময় অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে।এসবের পাশাপাশি তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল ‘কালী দ্য মাদার’, ‘ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’, ‘ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম’, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আই শ হিম’ ইত্যাদি।

পরাধীন ভারতের প্রথম নিজস্ব পতাকার শৈলী যিনি তৈরি করেন, তিনি নিবেদিতা। তাঁর সেই পতাকার মুখ্য কেন্দ্র ছিল বজ্র। কারণ দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র তৈরি মহর্ষি দধিচীর হাড় দিয়ে। দেবকুলের রক্ষাকল্পে মহর্ষির এই অনবদ্য আত্মত্যাগকেই ভারতের ভিত্তি বলে জেনেছিলেন লোকমাতা নিবেদিতা।

অরবিন্দ ঘোষ আর অনুশীলন সমিতির সঙ্গে তাঁর সংযোগ তাঁকে তাঁর গুরুভ্রাতাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। বিবেকানন্দ-পরবর্তী রামকৃষ্ণ মিশন হয়তো নিজেকে আটকে রাখতে চেয়েছিল আধ্যাত্মিক চর্চায় আর সেবাকার্যে। কিন্তু নিবেদিতার সামনে তখন উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে এমন এক ভারতবর্ষ, যে ভারতবর্ষকে তাঁর গুরু তাঁকে দেখিয়েছিলেন। অরবিন্দের মধ্যে আর এক তারুণ্যকে খুঁজে পান নিবেদিতা, যা বিরলের মধ্যে বিরলতম। আইরিশ ন্যাশনালিজমের মধ্যে বড় হওয়া মার্গারেট সেদিন নিবেদিতা অবস্থাতেও দেখতে পেয়েছিলেন, আধ্যাত্ম আর চিৎশক্তিতে ঋদ্ধ ভারতবর্ষ বিজ্ঞান আর সাহিত্য, মনন আর দর্শনের এক নতুন জগতে কদম রাখতে চলেছে। এই ভারতের চোখে তারুণ্যের স্বপ্ন। তার ঠোঁটে ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গান। 

ভারতের পরিস্থিতিও সেসময় সুখকর ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছে ভারতের 'জাতীয় কংগ্রেস'। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের কোপ পড়ল অবিভক্ত বাংলার ওপর। বিদেশিনী হলেও, এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি ভগিনী নিবেদিতাও। অবশ্য তখন তাঁকে বিদেশিনী বলিই বা কি করে! শুধু সমাজ সংস্কারই তো নয়; ভারতের স্বাধীনতা, ভারতীয়দের স্বাধীনতার জন্যও লড়ে গেছেন তিনি। এই সূত্রেই আলাপ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে, অকুস্থল সেই দার্জিলিংই। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই একদিন দেখা দেশবন্ধুর সঙ্গে। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর হাতের গোলাপফুলটি গুঁজে দিলেন দেশবন্ধুর কোটের বোতামে। ব্যস, বন্ধুত্বের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।

কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে ভুলেই গিয়েছিলেন শরীরের কথা। ব্রেন ফিভারের পর যথেষ্ট দুর্বল তিনি। তারপরেও থেমে নেই নিবেদিতা। কলকাতা তো বটেই, দার্জিলিংয়েও যখন যাচ্ছেন কাজ করে যাচ্ছেন আপন মনে। সঙ্গে বসু দম্পতি ও অন্যান্য বন্ধুরা থাকলে কী হবে? মনের দিক থেকে কি তিনি সম্পূর্ণ একা? এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছেন। ১৯০৯ সালে আমেরিকা থেকে খবর এল, স্বামীজির স্নেহধন্য মিসেস বুল গুরুতর অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিং থেকেই রওনা দিলেন তাঁকে দেখতে। খেয়ালই করলেন না, তাঁর নিজের শরীরও খুব একটা ভালো নয়। যখন ফিরলেন, তখন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অতঃপর, আবারও যাত্রা দার্জিলিং। কে জানত, সেটাই হবে শেষ যাত্রা।

১৯১১ সাল। দার্জিলিংয়ের রায় ভিলায় বসে জগদীশচন্দ্র বসু ঠিক করলেন, একবার সিকিম বেড়াতে যাবেন। সেখানকার বৌদ্ধ সংস্কৃতি, মঠ দেখবেন। এমন কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে পড়লেন ভগিনী নিবেদিতাও। তিনি নিজেও যে যেতে চান! অমন পবিত্র পরিবেশে একটু মন না রাখলে হয়! সমস্ত কিছু ঠিক করা হল। যাত্রাও শুরু হবে; এমন সময় দুঃসংবাদ। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার। নিবেদিতার শারীরিক অবস্থা  পরীক্ষা করেই বুঝলেন, গতিক ভালো নয়। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। জগদীশ আর অবলা মিলে দিনরাত সেবা করতে লাগলেন তাঁর। আর নিবেদিতা? মৃত্যুর শব্দ ততক্ষণে শুনতে পেয়ে গেছেন তিনি। এক অদ্ভুত আলো দেখতে পাচ্ছেন। দার্জিলিংয়ের বিশাল পাহাড়ের কোল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আলো। সেটাই দেখতে চান নিবেদিতা। ‘দ্য বোট ইজ সিঙ্কিং, বাট আই শ্যাল সি দ্য সান রাইজ’… ১৩ অক্টোবর, ১৯১১। রায় ভিলার ঘরেই শেষে তরী ডুবল ভগিনী নিবেদিতার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর।

স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসার পর মার্গারেট নোবেল আক্ষরিক অর্থেই তাঁর পরবর্তী সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ভারত ও ভারতবাসীর সেবায়। আইরিশ খাপ খোলা তলোয়ারের মতো তেজস্বিনী এক নারীকে স্বামীজি কী মন্ত্রে আদ্যন্ত ভারতীয়ায় রূপান্তরিত করলেন, তার থই আজও পাওয়া যায় না। তাঁর বই 'মাতৃরূপা কালী' পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভারতমাতা' ছবিটি আঁকেন। নিবেদিতার স্বপ্ন ছিল-অখণ্ড ভারতবর্ষ। ভারতের গ্রাম ও নগরকে পুনরুজ্জীবিত করে সমৃদ্ধ ভারতের গঠনে যুবকদের অনুপ্রাণিত করতেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় মুক্তিলাভই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। ভারতের রাষ্ট্ৰীয় মুক্তি তার মতে আত্মিক মুক্তির উপায়মাত্র, তা উপেয় নয়। বিবেকানন্দ প্ৰদৰ্শিত অদ্বৈতবাদের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ অনুরাগ ছিল।

গুরুদেব বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'হও তুমি ভারতের সন্তান'। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল গুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী হয়ে উঠেছিলেন ভারতবাসীর ভগিনী নিবেদিতা। অপূর্ব তাঁর জীবন অগ্নিশিখার মতো শুদ্ধ, পবিত্র, অম্লান; অমৃতবিন্দুর মতো 'শক্তিময়ী'। নিবেদিতাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'লোকমাতা'। শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, 'শিখাময়ী'। গিরিশচন্দ্র বলেছিলেন, 'পবিত্রা নিবেদিতা'। ভগিনী নিবেদিতা ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় নবজাগরণের দ্রষ্টা, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণাদাত্রী। তাঁর ভারতপ্রেমের সঙ্গে মিশে আছে গুরু বিবেকানন্দের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও আনুগত্য। আবেগ নয়, যুক্তি দিয়ে ভারতীয় সমাজের মূলধারাকে বিশ্লেষণ করার অপূর্ব শক্তি তিনি দেখিয়েছেন বারবার। নিবেদিতার দৃষ্টিতে ভারতীয় দেবভাবনার বিবর্তনের ধারা বা বৌদ্ধ নগরকে কেন্দ্র করে তাঁর নগরসমাজতত্ত্বের ধারণা আজও বিস্ময় সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে শিক্ষাশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, শিল্পকলা, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত থাকায় তাঁর বহুমুখী চিন্তা গভীর, বিস্তৃত ও ব্যাপক।

নিজেকে ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা' হিসেবে উল্লেখ করতে ভালবাসতেন তিনি ঠিকই, কিন্তু নিবেদিতার এই আন্তরিক আত্মনিবেদনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হবে, এই পরিচয়ের মধ্যে এক সীমাবদ্ধতা আছে। এবং অদ্যাবধি নিবেদিতাচর্চা অনেকটাই এই সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত। তাঁর আচার্য মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের নামকরণ করেছিলেন ‘নিবেদিতা’। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘নিবেদিতা - তাঁর আদর্শের প্রতি, তাঁর গুরুর শিক্ষার প্রতি, তাঁর প্রিয় ভারতবর্ষের প্রতি। দার্জিলিংয়ের নির্জন শ্মশান প্রান্তরে তাঁর অনাড়ম্বর স্মৃতিস্তম্ভটিতে যেমন লেখা - 'HERE REPOSES SISTER NIVEDITA WHO GAVE HER ALL TO INDIA'। এত সংহত, সত্য এপিটাফ বড় দুর্লভ। নিজেকে উজাড় করে ভারতবর্ষের বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি, ধর্মচেতনা, সাংবাদিকতা ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রকে ভগিনী নিবেদিতা সমৃদ্ধ করে গেছেন নিঃস্বার্থে।

মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের খোলস থেকে জন্ম নিলেন ভগিনী নিবেদিতা। স্বয়ং স্বামীজির ভাবশিষ্যা। শুধু কি কলকাতাতেই আটকে ছিলেন তিনি? বাগবাজারের ১৬ নং বোসপাড়া লেনই কি ছিল একমাত্র আশ্রয়? তা তো নয়! তাঁর কাজ তখন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলায়। নিজের শিক্ষকসত্তাকে জাগিয়ে তৈরি করেছেন নিজের স্কুল। তবে কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন আরও উঁচুতে। পৌঁছে গিয়েছিলেন শৈলশহর দার্জিলিংয়ে। ধীরে ধীরে সেই শহরই জায়গা করে নিল মনের কোণে। নিবেদিতার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কখন যে দার্জিলিংও জড়িয়ে পড়ল, বোঝাই গেল না।

শক্তিপক্ষেই তাঁর পৃথিবীতে আসা। শক্তিপক্ষেই তাঁর চিরতরে চলে যাওয়া। আমরা শুধু পড়তে পাই দার্জিলিঙের হিমেল শ্মশানভূমিতে তাঁর সমাধির ওপর লেখা কনকনে বাক্যগুলো - "এখানে শান্তিতে শুয়ে আছেন তিনি, যিনি ভারতবর্ষকে তাঁর সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন - সিস্টার নিবেদিতা : ২৮ অক্টোবর ১৮৬৭ - ১৩ অক্টোবর ১৯১১।" 

খ্রিস্টান হলেও, নিবেদিতার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়নি; সনাতন হিন্দু রীতি মেনে দাহ করা হয়েছিল মুর্দাহাটির শ্মশানে। তারপর তাঁর চিতাভস্মের একটি অংশ দিয়েই তৈরি হয় সমাধিক্ষেত্র। বহু বছর অবহেলার মধ্যে পড়েছিল সেই জায়গাটি। জন্মস্থান থেকে বহু দূরে, একা নির্জন হয়ে কেটেছিল অনেকটা সময়। এমনকি, ভগিনীর শেষ ঠিকানা রায় ভিলাও অনেক হাত ঘুরেছে। অনেক স্মৃতি নষ্টও হয়েছে। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল সমাধি ক্ষেত্রটি। হায় রে ইতিহাস! এভাবেই কত জিনিস হেলায় হারিয়ে ফেলি আমরা। স্বয়ং ভগিনী নিবেদিতাও রেহাই পেলেন না সেই জাঁতাকল থেকে। তবে কয়েক বছর আগে পরিস্থিতির কিছু বদল হয়েছে। 

জায়গাটির পরিচয় মুর্দাহাটি নামে। স্থানীয়দের কাছে এটা 'দার্জিলিং শশ্মান' বলেও পরিচিত। পাহাড়ী রাস্তায় যেখানে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ঘুমের দিকে রওনা হয়। সেই স্টেশন থেকে এই জায়গা পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। আর এখানেই অযত্নে, অনাদরে পাহাড়ের কোলে শুয়ে রয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। দার্জিলিংয়ের লেবং কার্ট রোডের 'রায় ভিলা'তে ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর মারা যান ভগিনী নিবেদিতা। সেই রায় ভিলাও দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে বেহাল হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার ও তৎকালীন 'জিটিএ'র সহায়তায় সাজিয়ে তোলা হয় রায় ভিলাকে। আপাতত সেখানেই 'রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র'। যা শুধুমাত্র পাহাড়ের গ্রামীণ এলাকার বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখানো শুধু নয়। নানা রকম কারিগরি শিক্ষাও দেওয়া হয়। কিন্তু নিবেদিতার সমাধির জায়গা সেই অবহেলাতেই পড়ে রয়েছে।

ভগিনী নিবেদিতা ভারত-ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ যুগের ধাত্রী-জননী। স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা নিবেদিতার বজ্রদ্যুতিময় সমগ্র জীবন আত্মনিবেদনের কাহিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় নবজাগরণের দ্রষ্টা, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণাদাত্রী। এদেশের মানুষের দুঃখ ও স্বপ্নকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। অধ্যাত্ম জগতে তাঁর উপাসনা-নিষ্ঠা কালজয়ী।

আজ লোকমাতা মহিয়সী নিবেদিতার জন্মদিবসে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি।



No comments