কলকাতা ব ই মেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে গ্রাম বাংলার কবি প্রয়াত শম্ভু রক্ষিত- কলমে কবি আশিস মিশ্র
১. শম্ভু নিজেকেই রক্ষা করতেন
কবি - সম্পাদক শম্ভু রক্ষিতের জীবন কেমন কেটেছিল সেই কাহিনি বলে, লিখে শেষ করা যাবে না। তাঁর আয়ু ফু…
কলকাতা ব ই মেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে গ্রাম বাংলার কবি প্রয়াত শম্ভু রক্ষিত- কলমে কবি আশিস মিশ্র
১. শম্ভু নিজেকেই রক্ষা করতেন
কবি - সম্পাদক শম্ভু রক্ষিতের জীবন কেমন কেটেছিল সেই কাহিনি বলে, লিখে শেষ করা যাবে না। তাঁর আয়ু ফুরিয়ে আসার আগে ও পরে কয়েকটি গদ্যে তাঁকে আমার মতো করে লিখে রেখেছি। তিনি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের
' হাট ' ও ' বাজার ' নিয়ে তেমন কোনো দিন মাথা ঘামাননি। তিনি শুধু বলতেন, পত্রিকা প্রকাশের জন্য ভালো লেখা চাই। না হলে সব আটকে যাবে।
আজীবন শুধু কবিতা নিয়ে একটি ২ ফর্মার
" মহাপৃথিবী " সম্পাদনা করে গেছেন। সেখানে একটি কবিতা ছাপা হওয়ার পর কী যে আনন্দ পেতাম, তা বলে বোঝানো যাবে না। " মহাপৃথিবী " -র সেই অর্থে একটি ' হাট ' ও ' বাজার ' ছিলো। চেয়ারে পা গুটিয়ে, শরীরে আটপৌরে পোশাক , পায়ে ময়লা জুতো পরে নিঃশব্দে বসে থাকতেন তিনি। কবিতা ও নানা বিষয় নিয়ে আড্ডায় রাত ফুরিয়ে যেত তাঁর সঙ্গে।
তাঁর ছিলো না মাস মাইনের চাকরি। তাঁর ছিলো না ১০০০ বা ১২০০ পাতার মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিন। তাঁর ছিলো না কোনো বৈভবের সংসার। তাঁর ছিলো না কোনো সাজানো বাড়ি। তাঁর ছিলো শুধু একটি
" মহাপৃথিবী " ও কয়েকটি কবিতার বই।
তাঁর কাঁধে ছিলো শুধু একটি ময়লা ব্যাগ। সেখানে থাকতো সাহিত্যের মণিমুক্তো। সে- সব আজ ইতিহাস।
হাওড়া থেকে মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়া --তাঁকে মেদিনীপুরিয়া বলার সাহস কারুর ছিলো না। অথচ এখন এই বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করা লিটল ম্যাগাজিনের জগতে যখন বিশেষ সংখ্যা করার দৌড় শুরু হয়, তখনও তিনি শুধু কবিতা ছাড়া আর তেমন কিছু ভাবতেন বলে মনে হয় না। মুদ্রিত কাগজের ওজন যত বাড়ছে, ' বাজার ' তত ভারি হচ্ছে। কিন্তু সে যদি কেবল ' ভার ' - ই হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কী হবে।
এমন সব ' ভার ' - এর বাজারে দাঁড়িয়ে কোথাও লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শম্ভুদা। আর মুচকি হাসছেন।
তবু ভালো লাগলো কলকাতায় কিছু কাজের ফাঁকে বইমেলায় ঢুকে পড়েছিলাম। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নের মাথায় শম্ভুদা রয়েছেন। যেন এই
" মহাপৃথিবী "- র ঈশ্বর। এই ঈশ্বরের শরীরে তেমন ভার নেই, কেবল এক জাদু আছে। ভালো কবিতার জাদু।
গিল্ডকে ধন্যবাদ। তাঁরা শম্ভু রক্ষিতকে স্মরণ করেছেন, এই চরম দুঃসময়ে।
২. আগে সেলফি, পরে কেনাকাটা
অটো থেকে নেমে, মেট্রোর তলা দিয়ে এসে ১ নং গেট দিয়ে ঢুকেই পড়লাম। প্রশাসনিক নিরাপত্তা চোখে পড়ার মতো। চোখের সামনেই পেয়ে গেলাম দুটি লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন। চটদলদি বন্ধু কমল বিষয়ী বললো, আশিসদা দাঁড়িয়ে যা, শম্ভুদা। চটপট শম্ভুদাকে মাথায় রেখে কয়েকটি ছবি তোলা হলো। কমল বললো, তোর লেখার কপি হয়ে যাবে। তারপর পেছন দিকে দাঁড়িয়ে একজনের পিঠে হাত রাখলাম। বললাম, চিনতে পারছো? তিনি হেসে বললেন, আরে আশিস এসো। তিনি ''নৌকো " লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক অমলেন্দু বিশ্বাস। পাশের টেবিলে তখন কবি শর্বরী চৌধুরী। অমলেন্দু বিশ্বাস তাঁর একটি বই আমাকে দেখালেন। আমি কিনলাম বিনয় মজুমদারের " শব্দ ছাড়া বাক্য ছাড়া "। এই বইটিতে বিনয় মজুমদারের নতুন কিছু কবিতা রয়েছে। যা আগে কখনো পড়িনি। চমৎকার সব কবিতা। বইটি প্রকশনা করেছেন অমলেন্দু বিশ্বাস ও মন্দিরা বিশ্বাস। ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত কবিতাগুলি বিনয় মজুমদার লিখেছেন। এ এক অমূল্য প্রাপ্তি।
এর মধ্যে শর্বরী তাঁর " মখমলের ইস্তেহার " বইটি আমাকে উপহার দিলেন। তাও পড়ছি। উপহার দিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস তাঁর " কৃপাসিন্ধু " বইটি। তারপর ভাঁড়ের চা খেয়ে এদিক ওদিক চক্কর। দুটি লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে এক এক করে সম্পাদকরা এলেন, স্টল সেজে উঠলো। বাড়তে থাকলো সেলফি। দেখা হলো কবি বন্ধু নীলোৎপল জানা ও রজত দাসের সঙ্গে। আগে সেলফি, পরে কথা। এর মধ্যে আমি ও কমল বাংলাদেশ প্যাভিলয়নে ঢুকলাম। কমল খুঁজে চলেছে গাছ বিষয়ে বই। আমরা বন্ধু সাধনা বড়ুয়া ও অনিন্দ্য বড়ুয়ার মেয়ে তৃষার বিয়েতে যাবো সন্ধ্যায়। তাকে উপহার দেওয়ার জন্য কিনলাম হুমায়ূন আহমেদেরে একটি চমৎকার গল্পের বই
তারপর দেখা হলো কবি বন্ধু দেবজ্যোতি কর্মকার ও তাদের বন্ধুদের সঙ্গে। দেবজ্যোতি দিল তার পত্রিকা
" দর্পন মুখের খোঁজে "। আবার সেলফি। ঘুরতে ঘুরতে দেখা কবি বন্ধু সুচরিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে। আবার সেলফি। তাকে বললাম, তুমি একটি বই কেনো। চিন্ময় গুহর " ঘুমের দরজা ঠেলে "। সিগনেটের বই। আমি একটু আগে বইটি কিনেছি। সুচরিতা সিগনেট স্টলে চলে গেল।
দূর থেকে শুনলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মুক্ত মঞ্চে সুমিতা চক্রবর্তীর আলোচনা। রোদ্দুরের ঝাঁজ। আলোচনা চলছে। সামনে শ্রোতা খুব কম।
একটু পরে আমাদের আরও দুই বন্ধু ঢুকলো বইমেলায়। ত্রুপ্তি ও সুশান্তদা। কমল ও সুশান্তদা কিনলো কয়েকটি গান ও গাছের বই। চারপাশে তখন কেবলই সেলফি উঠছে। দেখলাম সন্দীপ দত্ত তাঁর স্টল সাজিয়ে বসেছেন। লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে তাঁর কত কাজ ও পরামর্শ। সেগুলি তিনি করে চলেছেন। বলতে বলতে দেখা কবি ও সম্পাদক শুভদীপ সেন শর্মা ও মৌমিতা পালের সঙ্গে। " আলোপৃথিবী " ও
" কথকতা " স্টলে তখন বেশ ভিড়। আমাদের আড্ডা ও সেলফি চলছে। ওদের প্রকাশনার কাজগুলি চমৎকার। আবার একটু ঘোরাঘুরি। না, এবার পরের গন্তব্যে যেতেই হবে। গুটি গুটি পায়ে রাস্তা পেরিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে।
৩. বইমেলা ও ফেসবুক
একটি সুবিধে আছে। তা হলো কে কখন বইমেলা যাবো বা যাচ্ছি, ফেসবুকে গেলেই তা জানা যায়। এবং আর একটি বিষয় -- তা হলো নিজেদের নতুন ও পুরনো বইয়ের ছবি পোস্ট দেওয়া। কত নং স্টলে বা কোন প্রকাশনীতে বইগুলি পাওয়া যাবে। এর ফলে পাঠক বা বন্ধুরা বইমেলা থেকে সেই সব বইগুলি কিনতে পারছেন। কোভিড অতিমারির সময়ে আমাদের সাহিত্য জগত একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছিল। ঘরে বসে যে যাঁর মতো করে কাজ করতে পেরেছি। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার তেমন সুযোগ হয়নি। ২০২২ সালে কলকাতা বইমেলায় মুখোমুখি হওয়ার একটা বড়ো সুযোগ হয়েছে। এটাও কম কী। এর পক্ষে - বিপক্ষে নানা মত থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সব আমরা পড়ছি। সে সব থাকুক। তার মধ্যে বই বিক্রি নিয়ে কথা। বইমেলার আসল উদ্দেশ্য হলো তাই।
৪. বইমেলার পুরনো স্মৃতি ও ময়দান
যেবার ময়দানে বইমেলায় আগুন ধরে যায়, তারপরও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো বইমেলা। ময়দান থেকে বইমেলা যখন সরে গেল, তখন কিন্তু আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়। নানা মত ও পথ উঠে আসে। কিন্তু এখন তো বেশ মানিয়ে নিয়েছি আমরা। ময়দান থেকে সল্টলেক -- এই কয়েকটা বছর চারপাশে কত বদল হয়েছে। বদলে গেছে আমাদের মনন জগত। এর মধ্যে মগজে ঢুকে পড়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইন্স্ট্রাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি। ময়দানের বইমেলায় যখন যেতাম, তখন আমাদের হাতে কোনো অ্যানড্রয়েড ফোন ছিলো না। তাই ফেসবুকেরও কোনো গল্প নেই। হাতে ফিল্ম ভর্তি ক্যামেরা ও কিপ্যাড ফোন। তাতেই কত কাজ।
সালটি মনে নেই। সেবার ময়দানের বইমেলায় " সংবাদ সাপ্তাহিক আপনজন " এর স্টল দেওয়া হয়। সে সময়
প্রায় হাজার পঁচিশেক টাকা খরচ হয়। তমালিকাদিকে নিয়ে আমরা কী আনন্দটাই করেছি।
সেবার দে' জ থেকে তমালিকা পণ্ডাশেঠের " হৃদয়ের মধ্যে থেকো " বইটি প্রকাশিত হয়। মঞ্চে কে নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, লক্ষ্মণ শেঠ, দূলেন্দ্র ভৌমিক, সুধাংশু দে প্রমুখ। প্রায় তিন চার দিন বইমেলায় আমরা ঘুরতাম। কেনা কাটা ও তুমুল আড্ডা।
কত প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিককে কাছ থেকে দেখতাম। ওই শুধু দেখা। কথা বলতাম না। বা অটোগ্রাফ নিতাম না।
একদিকে যদি কবি অরুণ মিত্র তবে অন্যদিকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ। একদিকে ভাস্কর চক্রবর্তী কবিতা পড়ছেন তো অন্য দিকে কেদার ভাদুড়ী আড্ডা দিচ্ছেন। হঠাৎ কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় ডাকলেন, এসো ডাব খাও।
একদিকে দাঁড়িয়ে আছেন অনিল ঘড়াই ও সমীরণ মুখোপাধ্যায় ও অন্যদিকে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তখন টিকিট কেটে ঢুকতে হতো। এখন আর টিকিট লাগে না। তখন সেলফি ছিলো না, ছিলো অটোগ্রাফ। তখন ঘাসে বসে, পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা ছিলো। এখন ঘাসের আড্ডা কম। মঞ্চ -আড্ডা বেশি। বেড়েছে চায়ের দামও। তখনও খাওয়ার স্টলে ভিড়। এখনও ভিড়। তখনকার বইমেলার লেখালেখি কেবল মুদ্রিত পত্রিকায়। এখন বইমেলার লেখালেখি আগে ফেসবুকে।
৫. কবি অজয় নাগ এবং
শম্ভু রক্ষিত লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের কাছেই দেখা হলো কবি অজয় নাগের সঙ্গে। দুজন অজয় নাগ। দুজনেই কবি। একজন মেদিনীপুরের একজন কলকাতার। কেমন আছেন অজয়দা? প্রায় দু'বছর পরে দেখা। ( মেদিনীপুরের অজয় নাগ প্রয়াত হয়েছেন)।
অজয়দা দুর্বল শরীরে দাঁড়িয়ে। বললেন, ওই..
আমি যে তাঁর সম্পাদিত " আলাপ পরিচয় " বইটি সুখবর পত্রিকার বইঘর পাতায় আলোচনা করেছি, তা তিনি জানতেন না। সেটা তাঁকে বললাম, এবং মোবাইল ফোনে সেই ছাপা কপিটি দেখালাম। বললাম, এটা আপনাকে পরে প্রিন্ট দিয়ে দেবো। তিনি বললেন, এসব আমার লাগবে না। কী হবে নিয়ে।
আমি বললাম, তা ঠিক। আপনার এসব নিয়ে কোনো লাভ নেই!
তিনি ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে বললেন, এটা নাও, আর কিছু দাও।
আমি একশ টাকা দিয়ে নিলাম " অন্য গানের খাতা "। তিনি "সুখবর " পত্রিকার খোঁজ- খবর নিয়ে চলে গেলেন অন্যত্র।
আমি দূর থেকে তাঁর হেঁটে যাওয়া দেখলাম। মনে হলো, সাহিত্য জগত নিয়ে তাঁর কেমন উদাসীনতা। কেমন নিস্পৃহতা। তবে কি তিনি এখনও অন্য গান খুঁজে চলেছেন? যাকে নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই!
বাংলা কবিতার পৃথিবীতে বিনয় মজুমদার, শম্ভু রক্ষিত ও অজয় নাগকে যদি এক লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় -- তাহলে কী হবে। মনে হয় ভিড়ের ভেতরে ও বাইরে এঁরা শুধু গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলেছেন --তাঁদের কোনো সেলফি নেই। ফেসবুকও নেই। কেবল কবিবাক্য রয়েছে।
No comments