Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সরস্বতী পুজোর পুণ্য লগ্নে আজ অতীতের যুগে যুগে মা সরস্বতীর প্রতিমার নানা দিক সম্পর্কে-তমাল দাশগুপ্ত

সরস্বতী পুজোর পুণ্য লগ্নে আজ অতীতের যুগে যুগে মা সরস্বতীর প্রতিমার নানা দিক সম্পর্কে-তমাল দাশগুপ্ত
সরস্বতী পুজোর পুণ্য লগ্নে আজ অতীতের যুগে যুগে মা সরস্বতীর প্রতিমার নানা দিক সম্পর্কে জানব। মা সরস্বতী হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই উপমহ…




সরস্বতী পুজোর পুণ্য লগ্নে আজ অতীতের যুগে যুগে মা সরস্বতীর প্রতিমার নানা দিক সম্পর্কে-তমাল দাশগুপ্ত


সরস্বতী পুজোর পুণ্য লগ্নে আজ অতীতের যুগে যুগে মা সরস্বতীর প্রতিমার নানা দিক সম্পর্কে জানব। মা সরস্বতী হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই উপমহাদেশে গত পাঁচ হাজার বছর ধরে একটানা পূজিত, তিনি সারা পৃথিবীর মধ্যেই প্রাচীনতম মাতৃকা যিনি আজও সমানভাবে আদৃত, উপাস্য। তাঁর বীণাপাণি মূর্তি আমাদের দেশে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই প্রাপ্ত হয়। আজ সরস্বতী মূর্তির রূপরেখা, মূর্তিতত্ত্বের নিরিখে যুগে যুগে সরস্বতী প্রতিমার বিবরণ সম্পর্কে একটি আলোচনা রইল।


★ হরপ্পা সভ্যতায় এক মাতৃকার মূর্তি দেখা যায়, যিনি নৌকোবাহিনী, এবং অনুচর পরিবেষ্টিত। ইনি হরপ্পা সভ্যতার নদীমাতৃকা হতে পারেন। বেদে উল্লিখিত সরস্বতী ও ঊষা প্রকৃতপক্ষে হরপ্পা সভ্যতার মাতৃকা ছিলেন এরকম প্রমাণ করেছেন ডি ডি কোসাম্বি।


★ ঋগ্বেদের প্রাচীনতম অংশে দেখা যায় ইড়া ভারতী ও সরস্বতী একত্রে উল্লিখিত এবং আহুত হন যজ্ঞে। তন্ত্রের ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্নার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বৈদিক যজ্ঞে এঁদের আহ্বান করা হত সন্দেহ নেই। বাক হিসেবেও এই তিনজনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঋগ্বেদে তাঁকে শুভ্রবর্ণা বলা হয়। শুক্ল যজুর্বেদ অনুযায়ী সরস্বতী চিকিৎসার দেবী। সর্বোপরি, সরস্বতী নদীদেবতা হিসেবেও ঋগ্বেদে বর্ণিত। 


কিন্তু এই পর্যন্ত বৈদিক সাহিত্যে সরস্বতীর কোনও স্পষ্ট মূর্তিকল্প নেই। বরং যেটা বারবার দেখা যায়, সেটা হল সরস্বতীর ক্ষমতার প্রতি একটা লোভ। ফলে তিনি কখনও ইন্দ্র কখনও মরুৎ কখনও অশ্বিদ্বয় কখনও অগ্নি কখনও সূর্য কখনও বৃহস্পতি প্রভৃতি বৈদিক দেবতার শক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছেন স্ত্রী রূপে। 


অনেক পরে এই আবহে পৌরাণিক যুগে নতুন পৌরাণিক দেবতা ব্রহ্মার সঙ্গে সরস্বতীর সংযুক্তি ঘটেছিল।


বৈদিক আর্য মূর্তি পূজক ছিলেন না আমরা জানি, তাই মূর্তিকল্প না থাকার বিষয়টি বোঝা যায়। কিন্তু এমনকি পৌরাণিক যুগের শুরুতেও মা সরস্বতীর মূর্তির বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে না সহজে আর্যাবর্ত টেক্সটগুলিতে।


★ মৎস্য পুরাণে প্রতিমা বর্ণনা অধ্যায়ে,  কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে, বরাহমিহির রচিত বৃহৎ সংহিতার প্রতিমা লক্ষণ অধ্যায়ে সরস্বতী মূর্তির কোনও বর্ণনা নেই। বলা দরকার যে বরাহ মিহিরের গ্রন্থ খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের। 


★ অথচ এর সাতশ বছর আগেই, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মধ্যপ্রদেশের ভারহুত স্তূপে বীণাবাদনরত সরস্বতী মূর্তি পাওয়া গেছে। এটিই উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন বীণাপাণি মূর্তি। হরপ্পা সভ্যতায় নদীমাতা হিসেবে তাঁর উপাসনা প্ৰচলিত থাকলেও সেই সরস্বতী মূর্তির রূপ আজকের মত ছিল না। হরপ্পা পতনের পরে তাহলে প্রথমবার বীণা হস্তে সরস্বতী মূর্তি পাচ্ছি গঙ্গারিডাই যুগে। 


তবে আর্যাবর্তের এত গ্রন্থে সরস্বতীর মূর্তি বর্ণনা নেই কেন? সহজ উত্তর, তিনি ব্রাত্যধর্মীয়, তন্ত্রাশ্রয়ী, মাতৃকা উপাসক সভ্যতার দেবী ছিলেন বলেই তাঁর মূর্তিকল্প এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। 


★ খ্রিষ্টপূর্ব যুগে গঙ্গারিডাই সাম্রাজ্যে ভারহুত সরস্বতীর পরে আবার তাঁর মূর্তি পাচ্ছি খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে, ১৩২  খ্রিষ্টাব্দে, মথুরা অঞ্চলে। এটি জৈন ধর্মে পূজিত সরস্বতীর মূর্তি। বৌদ্ধরাও সরস্বতীকে বাগীশ্বরী রূপে উপাসনা করতেন।


★ প্রথম যে আর্যাবর্ত গ্রন্থ সরস্বতীর মূর্তিরূপের কোনওরকম বর্ণনা দেয়, সেটা ষষ্ঠ শতকে শ্রী শ্রী চণ্ডী। তবে বীণাপাণি নন, এই গ্রন্থ মহাসরস্বতীর রূপকল্প দেয়। তিনি অষ্টভুজা, পদ্ম ঘন্টা শূল হল শঙ্খ মুষল চক্র ধনুর্বাণ ধারণ করেন। মহাসরস্বতী অবশ্যই দুর্গার রূপভেদ।


★ হরপ্পা পতনের পরে উপমহাদেশের তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃধর্মের ভরকেন্দ্র পূর্ব ভারতে সরে আসে, আজ পর্যন্ত একটানা সেই গৌরবের উত্তরাধিকার বহন করি আমরা, এই বাঙালি মহাজাতি। পাণ্ডু রাজার ঢিবির উত্থান ঘটে অন্তিম হরপ্পা সভ্যতার সময়, চার হাজার বছর আগে। মহাভারতের যুদ্ধের সমসাময়িক কালে পাণ্ডু রাজার ঢিবির পতন, মোটামুটি তিন হাজার বছর আগে। এর বেশ কয়েক শতাব্দী পর গঙ্গারিডাই সভ্যতার উত্থান। আনুমানিক দুহাজার বছর আগে গঙ্গারিডাই সভ্যতার পতন। এর পাঁচশ বছর পরে আবার গৌড়ের উত্থান। তন্ত্রধর্ম বারবার মাথা তোলে, মাতৃকা উপাসক সভ্যতা বারবার সমস্ত আগ্রাসন সহ্য করেও ঘুরে দাঁড়ায়। এবং গৌড়ে পালযুগে সরস্বতী প্রতিমা বেশ কয়েকটি পাওয়া গেছে, ছবি রইল এই পোস্টের সঙ্গে। 


দ্বিভুজা বীণাপাণিই বারবার দেখি গঙ্গারিডাই যুগের ভারহুত থেকে পালযুগের গৌড়বঙ্গে। চার অনুচর সহ বজ্র সারদা মূর্তিও পাওয়া গেছে পালযুগে।


★ পালযুগের পরে আবার মধ্যযুগের শুরুতেই দেখি চণ্ডীদাসের উপাস্য নানুর বিশালাক্ষী প্রকৃতপক্ষে সরস্বতী। এই মূর্তি চতুর্ভুজ। মায়ের পেছনের দুই হাতে জপমালা ও পুস্তক, সামনের দুই হাতে বীণা।


★ মধ্যযুগে সপ্তদশ শতকের বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে মা সরস্বতীর বেশ কয়েকটি ধ্যানমন্ত্র অর্থাৎ মূর্তিকল্প পাওয়া যায়। নিচে দেওয়া হল।


■ আগমবাগীশ কর্তৃক সংগৃহীত প্রথম মন্ত্রটি সারদা তিলক থেকে উদ্ধৃত। মায়ের ললাটে শশিকলা, হাতে লেখনী ও পুস্তক, শ্বেতপদ্মে আসীন। দেবী দ্বিভুজা।


■ দ্বিতীয় মন্ত্রে মা চতুর্ভুজ। জ্ঞানমুদ্রা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাকলস ও বিদ্যা ধারণ করেন।


■ তৃতীয় মন্ত্রেও মা চতুর্ভুজ। বীণা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাকলস ও পুস্তক ধারণ করেন।


■ চতুর্থ মন্ত্রে চতুর্ভুজ দেবী দুটি পদ্ম, জপমালা ও পুস্তক ধারণ করেন।


■ পঞ্চম মন্ত্রে চতুর্ভুজ দেবী ব্যাখ্যামুদ্রা, মাতৃকাবর্ণমালা, মণিকলস এবং পুস্তক ধারণ করেন।


■ প্রপঞ্চসার তন্ত্র থেকে উদ্ধৃত ষষ্ঠ মন্ত্রটি চতুর্ভুজ মাতৃকার হাতে পুস্তক, বীণা, অমৃতকুম্ভ এবং রুদ্রাক্ষমালার বিবরণ দেয়।


★ এই সময় তন্ত্রে সরস্বতীর প্রভূত উপাসনা হচ্ছে। সারদা তিলক গ্রন্থের আর একটি মন্ত্রে নরকপাল, বিদ্যা, জপমালা ও বরমুদ্রা হাতে সরস্বতীর বিবরণ পাওয়া যায়।


★ মহানির্বাণতন্ত্র এবং সারদা তিলক উভয়েই মা সরস্বতীর বিগ্রহ পঞ্চাশ বর্ণমালা দ্বারা নির্মিত বলেছে। প্রসঙ্গত আমরা জানি মা কালীকেও পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী আখ্যা দেওয়া হয়। বাংলা বর্ণমালা তন্ত্রধর্মীয় মাতৃকা উপাসক সভ্যতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।


★ গঙ্গারিডাই যুগের খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের ভারহুত থেকেই আমাদের সরস্বতী মূলত বীণাপাণি।


★ গৌড়বঙ্গে সেনযুগে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে রচিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী মা  সরস্বতী চতুর্ভুজ। চার হাতে থাকে বীণা, পুস্তক, ব্যাখ্যামুদ্রা এবং অভয়মুদ্রা। মা পীতবসনা।


★ মা সরস্বতীর বাম হাতে বীণা পুস্তক, ডান হাতে মালা ও কমণ্ডলু থাকে, বলেছে কালিকা পুরাণ।


★ মধ্যযুগের শেষে কবি ভারতচন্দ্র সরস্বতীর বর্ণনা এভাবে দেন: "শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস শ্বেতবীণা শ্বেতহাস শ্বেতসরসিজনিবাসিনী। বেদ বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র বেণু বীণা আদি যন্ত্র নৃত্য গীত বাদ্যের ঈশ্বরী"।


  


ছবিতে দেখছেন শিকাগো আর্ট মিউজিয়ামে পালযুগের সরস্বতী প্রতিমা, বিদেশে নিলাম হওয়া পালযুগের সরস্বতী মূর্তি, কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে পালযুগের বজ্রসারদা মুর্তিমণ্ডল (চার অনুচর সহ) এবং দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পালযুগের সরস্বতী প্রতিমা। সবগুলিই পালযুগের গৌড়বঙ্গে খ্রিষ্টীয় দশম একাদশ শতকে উৎকীর্ণ। বজ্রসারদা ব্যতীত মা সর্বত্রই বীণাপাণি।


আমি সারা ভারত ঘুরে দেখেছি, এই বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো মূলত বাঙালির উৎসব, বাকি ভারতে এর এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও দেখা যায় না। বাঙালির ঘরে ঘরে তাঁর আরাধনা হয়, বাঙালির পল্লীতে পল্লীতে অস্থায়ী মণ্ডপ করে কচিকাঁচার দল তাঁর উপাসনা করে। স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র তাঁর প্রতি অঞ্জলি দেয় বাঙালি শিক্ষার্থী। মা সরস্বতীর প্রতিমায় বাঙালির আবহমানকালের ধর্ম ও প্রজ্ঞা নিহিত আছে, তাই সেই মূর্তিতত্ত্বের নানা দিকের সম্যক আলোচনা করে নিজের বাঙালি জন্ম সার্থক করলাম।


এ লেখাটি শেষ করি মায়ের বন্দনা মন্ত্রে:


সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমোস্তুতে।।

No comments