ভারতের লিপি সমূহ- শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার
প্রাচীন ভারতে দু'ধরনের লিপি অর্থাৎ ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির প্রচলন ছিল। এই দু'ধরনের লিপিই ভারতের প্রথম মুসলমান রাজার রাজত্বকালে ছাগলের চামড়ার উপর লেখা অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্রাহ্…
ভারতের লিপি সমূহ- শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার
প্রাচীন ভারতে দু'ধরনের লিপি অর্থাৎ ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির প্রচলন ছিল। এই দু'ধরনের লিপিই ভারতের প্রথম মুসলমান রাজার রাজত্বকালে ছাগলের চামড়ার উপর লেখা অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্রাহ্মী লিপি লেখা হত বাম থেকে ডান দিকে আর খরোষ্ঠী লিপি ডান দিক থেকে বাম দিকে।
পরবর্তীকালে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপি বিবর্তিত হয়ে যায়। ব্রাহ্মী লিপি তিনভাগে বিভক্ত হয়ে সারদা ,নারদা ও কুটিলা লিপিতে পর্যবসিত হয়। সারদা লিপির প্রচলন ছিল প্রয়াগের উত্তর পশ্চিম দিকের জনগণের মধ্যে, আর নারদা লিপির প্রচলন ছিল দক্ষিণ পশ্চিম দিকে। এই লিপি দুটিই ইংরেজির মত বাঁ দিক থেকে ডান দিকে লেখা হত। প্রয়াগে ছিল সারদা নারদা লিপির সঙ্গমস্থল। কুটিলা নামে পরিচিত আরেকটি নতুন লিপির উদ্ভব হল—যেহেতু কৌসাম্বী অঞ্চল থেকে প্রকৃতপক্ষে এই লিপির উদ্ভুতি সেইহেতু এই লিপির অপর নাম ছিল কৌসাম্বী লিপি।যেহেতু রাজা শ্রী হর্ষের সিলমোহরে এই লিপি ব্যবহৃত হয়েছিল সেইহেতু এই লিপি শ্রীহর্ষলিপি নামেও পরিচিত হয়েছিল। এলাহাবাদের পূর্বদিকে এই লিপি প্রচলিত ছিল।
নাগর ব্রাহ্মণদের প্রভাবে নারদা লিপির অপর নাম হয়ে গিয়েছিল নাগরী লিপি। গুপ্ত যুগের পর এলাহাবাদের পূর্বাংশে কিছু অঞ্চলে কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণদের প্রভাব কমে যাওয়ায় ও নাগর ব্রাহ্মণদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় কুটিলা লিপি থেকে নারদা লিপির ব্যবহার বেড়ে গেল। কাশীর পন্ডিত বর্গ আগে কুটিলা লিপিতে লিখতেন, কিন্তু নাগর ব্রাহ্মণদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় নাগরী লিপি কুটিলা লিপির স্থান অধিকার করে নিল। কুটিল লিপি ভারতের পূর্বাঞ্চলে ব্যবহৃত হতে থাকল। হর্ষবর্দ্ধনের সময়কালে কুটিলা লিপির প্রচলন বেশী ছিল। তাই সেই সময়কার শিলালিপি ও তাম্রলিপি সমূহ কুটিলালিপিতে খোদিত হয়েছিল। নাগরি লিপি' এল গুপ্ত যুগের পরে। মুঘল যুগে কায়স্থরা নাগরীর বিবর্তিত লিপিতে সরকারী নথিপত্র লিখত।যেহেতু কায়স্থরা এই লিপিতে লিখত তাই এই লিপির নাম হয়ে গেল কায়থীলিপি। উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে ও বিহারে এই লিপি প্রচলিত ছিল। ভোজপুরী ভাষা এই লিপিতে লেখা হত। মুঘল রাজত্বের সরকারি ভাষা অবশ্য ছিল উর্দু। কায়থী লিপিতে কোন যুক্তাক্ষর ছিলনা। ব্রিটিশ যুগে আদালতে এই লিপি ব্যবহৃত হত। কায়থী লিপির সঙ্গে গুজরাতী লিপির খুবই মিল ছিল। ৭০/৮০ বছর আগেও তার ব্যবহার ছিল। যখন আগ্রা অবধ ও রোহিলাখন্ড মিলিত হয়ে আগ্রা ও অবধ সংযুক্ত প্রদেশ হ'ল তখনই আদালত থেকে কায়থী লিপি অন্তর্নিহিত হল আর তার জায়গায় এল উর্দু লিপি।
সারদা বা সারস্বত লিপির কয়েকটি বিভাজন ছিল। কশ্মীরে ব্যবহৃত হত কাশ্মিরী সারদা, দ্বিগর্তভূমিতে(জম্মু) ব্যবহৃত হত ডুগ্গরদেশীয় সারদা, হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের টেক্ড়ি/টেগ্ড়ি বা টেংড়েই, লাদাখী ও সপ্তসিন্ধুতে ব্যবহৃত হত পাঞ্জাবী সারদা। পরবর্তীকালে পঞ্জাবে শিখ গুরু অর্জুনদেব গুরুমুখি লিপির প্রবর্তন করেন। পার্সি লিপিরও বহুল প্রচলন ছিল। পাঞ্জাবীতে বহু তদ্ভব শব্দ ব্যবহৃত হয় যাতে যুক্তাক্ষর নেই। সেজন্য পাঞ্জাবি ভাষায় 'স্কুল' ও 'স্টেশন' শব্দ দুটি যথাক্রমে 'সকুল' ও 'সটেশন' হিসেবে উচ্চারিত ও লিখিত হয়। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবী সারদার বিবর্তিত রূপ হিসেবে লানদেই লিপির প্রচলন হয় ও সিন্দ্ধের(ব্যবসায়ী) লোকেরা এই লিপিতেই লিখতে থাকে।
জম্মু-কশ্মীরে হিন্দু রাজা ছিল। রণবীর সিং সেখানে ডোগরীলিপিকে জনপ্রিয় করতে চেয়ে ছিলেন। সেই সময় হিন্দু প্রভাবিত রাজ্যে কেবল ব্রাহ্মণ ও সান্ধিবিগ্রাহিকরাই(কায়স্থরা )মন্ত্রী হতে পারত। রাজ্য যেহেতু সকলের জন্যেই সেজন্যে এই নিয়ম ঠিক নয়। জম্মু-কশ্মীরের ব্রাহ্মণরা কাশ্মিরী সারদা লিপিকে পছন্দ করল। তাদের প্রভাবের কারণেই জম্মু-কশ্মীরে ডোগরী লিপি গৃহীত হল না। পরবর্তীকালে কাশ্মীর অঞ্চলে অবশ্য উর্দু ব্যবহৃত হতে থাকে।
বাংলা অসমীয়া বই ও কোষ্ঠী দুইই শ্রীহর্ষ লিপিতে লেখা হয়, কিন্তু মিথিলায় কোষ্ঠি লেখা হয় শ্রীহর্ষ লিপিতে আর বই লেখা হয় নাগরীলিপিতে। কশ্মীরে কোষ্ঠি লেখা হয় সারদা লিপিতে। প্রাচীনকালে পঞ্জাবে কোষ্ঠি ও বই লেখা হত পাঞ্জাবী সারদা লিপিতে অর্থাৎ সপ্তসিন্ধু সারদায়,কিন্তু এখন কোষ্ঠি লেখা হয় পাঞ্জাবী সারদায় আর বই লেখা হয় গুরুমুখী লিপিতে।
ওড়িয়া লিপি তালপাতায় লোহার কলমে লেখা হত। লোহার কলমের খোঁচায় তালপাতা যাতে ছিড়ে না যায় সেজন্যে অক্ষরগুলিকে গোল করে লেখা হত। বাংলায় কিন্তু কোণাচে অক্ষরেই লেখা হত। কিন্তু শিলালিপি গুলি কোণাচে ভাবে বা উৎকলিও ভাবে লেখা হত। আর শ্রীহর্ষ লিপি কোণাচে ভাবে বা গৌড়ীয় ভাবে লেখা হত।
সারদা বলতে বোঝায় বুদ্ধি বা বুদ্ধিমত্তা। কশ্মীরের বুদ্ধিজীবীদের লিখিত লিপিকে বলা হত সারদালিপি।বেদের শ্লোক গুলি যখন তৈরি হয় তখন সেগুলি গুরু থেকে শিষ্য পরম্পরায় স্মৃতিতে রাখার ব্যবস্থা করা হত। যেহেতু সে সময় লিপি আবিষ্কৃত হয়নি সেইহেতু বেদ লিখিত রাখাও সম্ভব ছিল না। বেদকে সেজন্য বলা হয় শ্রুতি(ঋকবেদের সময় লিপি ছিলনা)। বেদকে লিখিত রূপ না দেওয়া একটা কুসংস্কারের দাঁড়িয়েছিল, আর এই কুসংস্কারের কারণে বেদের অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও কশ্মীরের পন্ডিতরাই সর্বপ্রথম সারদা লিপিতে বেদ লিখে ফেলেন। তাঁরা অথর্ববেদ লিখেছিলেন।
এলাহাবাদের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে কচ্ছের রান পর্যন্ত ,বোম্বের উত্তর পর্যন্ত নারদা লিপি ব্যবহৃত হত। যেহেতু গুজরাটের নাগর ব্রাহ্মণরা এই নারদা লিপির আবিষ্কর্তা, সেজন্য এই লিপিকে নাগরীলিপি বলা হত। এই ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত ভাষা (যাকে দেবভাষা বলা হত) নাগরী লিপিতে লিখতেন বলে সেই লিপির নাম হল দেবনাগরী লিপি। এইভাবে দেবনাগরী লিপি গুজরাট থেকে এসেছিল —উত্তর প্রদেশ থেকে নয়। গুজরাটী লেখা হয় অক্ষরের উপর কোন মাত্রা না দিয়ে খুবই সরল ভাবে। যখন এই লিপিতে সংস্কৃত লেখা হ'ল, অক্ষরের ওপর মাত্রা দেওয়া হল। এই ধরনের মাত্রা যুক্ত লিপি নাগরী লিপির একটি বিশেষ রূপ যা দেবনাগরী লিপি নামে পরিচিত হল।
এলাহাবাদের পূর্বদিকে কুটিলা লিপি ব্যবহৃত হত। যেহেতু এই কুটিলা লিপিতে জটিল যুক্তাক্ষর ছিল সেইহেতু এই লিপিকে কুটিলা লিপি বলা হত। কুটিল মানে জটিল। রাজা অশোকের সময় কালে কুটিলা লিপি খুবই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু শিলালিপি লিখিত হয়েছিল ব্রাহ্মী লিপিতে। গুপ্ত যুগের পর থেকে ভারতে পাঠানো আক্রমণের সময়কাল পর্যন্ত কাণ্বকুব্জ ও সরজূপারী ব্রাহ্মণদের প্রভাব কমে এসে ছিল আর নাগর ব্রাহ্মণরা সেই স্থান দখল করে নিয়েছিল। বারাণসীতে নাগর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ছিল। তারই ফলস্বরূপ কুটিলা লিপি আধিপত্য কমে গিয়ে সেখানে দেবনাগরী লিপির আধিপত্য তৈরি হয়েছিল। বারাণসী দেবনাগরী লিপিকেই তাদের লিপি হিসাবে গ্রহণ করেছিল। যখন ব্রিটিশরা ভারতে এসেছিল তখন অনেক ব্রিটিশ পন্ডিত দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন। জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলারও দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত লিখেছিলেন। যদিও সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোন লিপি নেই তবুও ভারতে দেবনাগরীই সংস্কৃত লিপি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ বিভিন্ন লিপিতেও সংস্কৃত লেখা হত।সুতরাং কারও মনে যেন এই ধারণা না হয় যে দেবনাগরী সংস্কৃত ভাষার একমাত্র লিপি।
পৈশাচী ও পাশ্চাত্ত্য প্রাকৃতে তদ্ভব ও বিবর্তিত সংস্কৃত শব্দের প্রাচুর্য রয়েছে। প্রাচীনকালে মানুষ যাযাবর ও জিপসীদের মত এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস না করে ঘুরে বেড়াত। পরবর্তীকালে তারা গ্রামে গ্রামে বসতি স্থাপন করল। বৈদিক সংস্কৃতে 'অন্ন' শব্দের অর্থ মূল খাদ্য, আর 'পিণ্ড' শব্দের মানে যে কোন খাদ্য। যেখানে মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে তার নাম ছিল 'পিণ্ড'+ইক=পিন্ডিক। পৈশাচী প্রাকৃতে তা হল পিন্ডা।বর্তমানের পাঞ্জাবী ভাষায় পিন্ডা বা পিন্ডী মানে গ্রাম।(রাওয়ালপিন্ডী। পাঞ্জাবী ভাষায় বহু তদ্ভব সংস্কৃত শব্দ রয়েছে।
৮০০ বছর আগে এই নাগরী লিপি দেবনাগরী আখ্যা পায়। সারদা লিপি ১৩০০ বছর ধরে চলছে। কুটিলা লিপি অর্থাৎ ওড়িয়া, বাংলা ,ভোজপুরী, মৈথিলী ,অঙ্গিকা প্রভৃতি ভাষাতে প্রচলিত লিপি ১১০০ বছরের পুরোনো লিপি।
কৃষ্ণের মাতৃভাষা ছিল শৌরসেনী প্রাকৃত। রহিম ও সুরদাস প্রাকৃত ভাষার কবি ছিলেন। ব্রজবাসী আগরওয়ালরা ব্রজ এলাকার অধিবাসী—তারা মাড়োয়ারী নন। এলাহাবাদের মুসলমানরা অবধী ভাষা বলেন। কেবল শিয়ারা উর্দু বলেন।
তথ্যসূত্র>নব্য মানবতা ভিত্তিক শিক্ষা
No comments