Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জীবনের শিক্ষা খেলাচ্ছলে-অর্পিতা সরকার (চন্দ)

জীবনের শিক্ষা খেলাচ্ছলে-অর্পিতা সরকার (চন্দ)
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরেই নাকে মুখে দুটো গুঁজে দিয়ে ছুট খেলার মাঠের দিকে। সব সঙ্গীসাথী পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুরু হতো গোনা— ‘একতলা দুইতলা পুলিস গেল নিমত…


 

জীবনের শিক্ষা খেলাচ্ছলে-অর্পিতা সরকার (চন্দ)


ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরেই নাকে মুখে দুটো গুঁজে দিয়ে ছুট খেলার মাঠের দিকে। সব সঙ্গীসাথী পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুরু হতো গোনা— 

‘একতলা দুইতলা 

পুলিস গেল নিমতলা

পুলিসের হাতে ঝাঁটার কাঠি,

ভয় পায় না কংগ্রেস পার্টি।’

কি অচেনা লাগছে? হতেই পারে। কিন্তু যদি বলি ‘উবু দশ কুড়ি ত্রিশ...’— হ্যাঁ, ঠিক চিনেছেন, দুটোই খেলায় কে চোর হবে, সেটা চিহ্নিত করার পদ্ধতি। চোর চিহ্নিত হয়ে গেলেই শুরু হতো খেলা। তবে প্রথম ছড়াটির আড়ালে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম আর অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস আছে, সেটা তখন তো বোঝার মতো বয়স হয়নি। কিন্তু পরবর্তী দু-তিন ঘণ্টা কেটে যেত খেলার মধ্যে অনাবিল আনন্দে।  

বিজ্ঞান বলে খেলা হল মানুষের জন্মগত সাধারণ প্রবৃত্তি। খেলা শিশুকে যে আনন্দ দেয় তার মধ্যে আছে স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীলতা। মনোবিদদের মতে, স্বতঃস্ফূর্ত আচরণধর্মী খেলাগুলি শিশুকে আনন্দ ও তৃপ্তি দেওয়ার সঙ্গে তার সৃষ্টিশীলতারও বিকাশ ঘটায়। শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক গুণগুলি বিকশিত করে ভবিষ্যৎ জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ও দায়িত্ববান করে খেলা। তা ছাড়াও খেলার মাধ্যমেই কচিকাঁচারা কত কিছু শিখে নেয় বড়দের থেকে। সংখ্যা গোনা থেকে আত্মরক্ষার কৌশল, সামাজিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতি থেকে জীবনশৈলীর শিক্ষা— সব শেখা যায় খেলার ছলে।   

কাজের ফাঁকে অবসর বিনোদনের উদ্দেশ্যে কিন্তু খেলার উদ্ভাবন হয়নি। আদিম মানুষের কঠিন জীবন সংগ্রামের সহায়ক হিসাবে জন্ম হয় খেলার। বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য দরকার ছিল সবল আর সচল শরীর আর কিছু রণকৌশলের জ্ঞান। শারীরিক ক্ষিপ্রতা ও শক্তি বাড়াতে আর পরবর্তী প্রজন্মকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এই কৌশলগুলো খেলাচ্ছলে শিখিয়ে দিতেই একদিন জন্ম নিল ‘খেলা’। খেলা তখন অবসর বিনোদন নয়, বাঁচার কৌশল অধ্যয়ন। আজকের শিক্ষা-বিজ্ঞানীরাও কিন্তু ছোটদের খেলার মাধ্যমে অঙ্ক সহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতিকেই সমর্থন করছেন।  

খেলাধুলোর রীতি ও কৌশল মানুষের আয়ত্ত হয়েছে নানা প্রয়োজনবোধ থেকে। কয়েকটি খেলার আদি উৎস ও বৈশিষ্ট্য বিচার করলে দেখা যায় যে, জীবিকা অর্জন ও আত্মরক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ রূপেই খেলাগুলির জন্ম। এক সময় সে পশু ও মৎস্য শিকার করত আহারের জন্য, আর আজ তা মানুষের শখে পরিণত হয়েছে। ঠিক তেমনই যুদ্ধরীতির কৌশল ও রহস্য লুকিয়ে আছে দাবা, ষোলোগুটি ইত্যাদি খেলার মধ্যে। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ সবই বদলেছে আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খেলাগুলোর ধরনও বদলেছে। 

সভ্যতার যাত্রাপথে মানুষের একটি বড় পদক্ষেপ ছিল কৃষির আবিষ্কার। মানুষ কৃষিকাজ শিখল, তারপর লাঙলের ব্যবহার শিখে উৎপাদন বাড়াল, করল উদ্বৃত্ত উৎপাদন, খাবার মজুতের কৌশল শিখে খাদ্যের জোগান সুনিশ্চিত করল। আর তার ফলে সুযোগ এল অবসর বিনোদনের। জীবনরক্ষা ও জীবিকার্জনের নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কৌশল ও দক্ষতাগুলি আর জীবনদায়ী পর্যায়ের রইল না। সেগুলি ঐচ্ছিক ক্রীড়া-কৌতুক ও বিনোদনের মাধ্যমে পরিণত হল। এই উন্নয়নের হাত ধরে জাতি-গোষ্ঠীগুলি তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ, ধর্ম বিশ্বাস, দর্শন, জীবনযাপন পদ্ধতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করল কিছু খেলাধুলো— যেগুলি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হতে লাগল আর সঙ্গে জন্ম হতে থাকল নতুন নতুন খেলার।    

এই ধরনের খেলাগুলিকে আমরা লোকক্রীড়া বলে থাকি। ‘বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ’-এর মতে লোকক্রীড়া হল ‘...প্রাচীন খেলাধুলা যা মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক অনমনীয় নিয়মকানুনের মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রসারিত হয় না, মানুষের জীবন চর্চার মধ্যে দিয়ে এক যুগ থেকে অন্য যুগে সঞ্চারিত হয়ে যায়, যা জীবনের অনুকৃতির প্রতীকিরূপ এবং যার মধ্যে ফ্যান্টাসি ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের অভিব্যক্তি সেই ক্রীড়াগুলোই লোকক্রীড়া।’ লোকক্রীড়াগুলিকে অবহেলা না করে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে সমাজ বিবর্তনের ধারা লুকিয়ে আছে প্রতিটি খেলার মধ্যে। লোকসমাজের সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক উপাদান লুকিয়ে আছে এই খেলাগুলির আড়ালে। লুকিয়ে আছে আমাদের অতীত জীবনের আর্থ-সামাজিক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। 

সমাজে চলার নিয়মকানুন এবং ভালো-খারাপ জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন খেলাচ্ছলে।  যেমন ধরা যাক— রুমাল চোর খেলা। খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। এই খেলায় যে চোর হয়, সে ঘুরতে ঘুরতে একজনের পিছনে রুমালটা ফেলে দেবে। যদি সে বুঝতে না পারে যে তার পেছনে রুমাল পড়ে আছে, তখন চুরির দায়ে তাকে শাস্তিস্বরূপ কিল খেতে হবে। চুরি করা যে অন্যায় আর তার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হয়, এই খেলা সেটাই শেখায়। আবার এর একটা অন্য দিকও আছে। খেলাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি সাবধানবাণী। খেলাচ্ছলে এখানে ছোটদের শেখানো হয় যে, সমাজে চলতে গেলে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। নাহলে অসাধু লোকজন অন্যের ওপর নিজের অপকর্মের দোষ চাপিয়ে দিলে তার ফল ভোগ করতে হয় নির্দোষকে।  

এবার আরেকটা খেলার কথা বলা যাক। দই-খই-চিঁড়ে-মুড়ি— বাঙালির এক প্রিয় জলখাবার, আবার গ্রাম বাংলার একটি জনপ্রিয় খেলাও বটে। এই খেলার আপ্তবাক্য হল  ‘একতায় উত্থান, বিভেদে পতন’। খেলাটিতে ছয়জন খেলোয়াড় থাকবে, তার মধ্যে দু’জন চোর হবে। খেলার শুরুতে চারটি পাশাপাশি ঘর কাটা হবে। চোর দু’জন ছাড়া বাকি চারজন চারটি ঘরে থাকবেন।  চোর দু’জন দাগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবেন। চোরেদের কাজ হল চারটি ঘরে থাকা চারজনকে একটি ঘরে একত্রিত হতে না দেওয়া। একত্রিত হতে পারলেই এক গেম হয়ে যাবে। এদের আলাদা আলাদা রাখতে পারলেই চোর দু’জনের জয়। চারজন খেলোয়াড় চোর দু’জনকে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে একত্রিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। আর একত্রিত হতে পারলেই জিত!  

ছেলেখেলা বলে আমরা যাকে স্নেহ এবং উপেক্ষার চোখে দেখতে অভ্যস্ত, বস্তুত তার ‘ছেলেমানুষি’-র আংশিক ভাগটুকু বাদ দিলেই বেরিয়ে আসে আমাদের সমাজ বিবর্তনের অজস্র স্মৃতিচিহ্ন।  যেমন ধরুন— লুকোচুরি খেলা, বাচ্চাদের খুব প্রিয় একটি খেলা। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন এই খেলার মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের আদিম সংগ্রাহক ও শিকারজীবী পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা। পশুশিকারি ও বন্যপশুর মধ্যেকার সম্পর্কই এই খেলায় মূর্ত হয়েছে। লুকিয়ে থাকা খেলোয়াড়রা হল গভীর অরণ্যের শ্বাপদকুল আর ‘চোর’ হল শিকারি। লুকিয়ে থাকা চোর দূর থেকে এক-একজনকে দেখতে পেয়ে তাদের নাম করে এক, দুই বললে সেই খেলোয়াড় ‘মরা’ বা মোর হয়ে যান।  এই দূর থেকে মোর করা ব্যাপারটির মধ্যেই নাকি লুকিয়ে আছে নিরাপদ দূরত্ব থেকে শিকারির তির বা বর্শা নিক্ষেপ করে শিকার করার প্রতীক। আবার শিকারিকেও যে লুকিয়ে থাকা পশুদের থেকে সতর্ক থাকতে হতো, নাহলে শিকারিকেই হয়ে যেতে হতো শিকার। তার প্রতিফলন হল লুকিয়ে থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে কেউ চোরকে ছুঁয়ে ‘ধাপ্পা’ দিয়ে দেওয়ার নিয়মের মধ্যে।    

বন্য অবস্থার জীবন সংগ্রামের রূপই ফুটে উঠেছে লুকোচুরির মতো গাছুয়া খেলাটির মধ্যে। এই খেলাটিতে একজন বাঘ হয়। সে দাঁড়িয়ে থাকে গাছের গুঁড়ির কাছে আর বাকি খেলোয়াড়রা গাছে চড়ে থাকে। বাঘের কাজ হল গাছে থাকা খেলোয়াড়দের ছুঁয়ে দেওয়া। সে যাকে ছোঁবে সে মরা হয়ে পরবর্তী দানে বাঘ হবে।

এই ধরনের খেলার ছড়াগুলির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে অনেক নৃতাত্ত্বিক উপাদান। যেমন গাছুয়া খেলাটির সময় বাচ্চারা যে ছড়াটি বলে সেটি হল—

‘গাছুয়া রে গাছুয়া,

গাছে ক্যারে?

বাঘের ভয়ে।

বাঘ কই?

জমির পরে।

জমিন কই?

ওই তো।

তরা কয় ভাই?

সাত ভাই।

এক ভাই দিবি?

ছুঁইতে পারলে নিবি।’

বন্য অবস্থায় মানুষ হিংস্র প্রাণীকুলের আক্রমণ থেকে বাঁচতে গাছের উপর আশ্রয় নিত এবং অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা তার বুদ্ধি বেশি থাকায় অনেক সময় সেই বুদ্ধির জোরে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হতো। গাছুয়া খেলাটির মধ্যে পশুদের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার সেই আদিম কাহিনিই লুকিয়ে আছে। বাংলায় বাঘ ছিল সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী আর এখানকার অধিবাসীদের বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে হতো। সেই বাঘের হাত থেকে বাঁচার কৌশল পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে যাওয়া ছিল সামাজিক দায়। আর সেটাই হয়তো বড়রা করতেন খেলাচ্ছলে একটা ‘ছদ্ম আক্রমণের’ পরিবেশ তৈরি করে। একদিন যা ছিল জীবন সংগ্রামের অঙ্গ তা-ই কালে কালে পর্যবসিত হল মজার খেলায়।  আবার বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, আমাদের আদিম অস্ট্রিক সমাজের জাদু বিশ্বাসের ছবিও আছে খেলার ছড়াটির মধ্যে। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর কাছে ‘সাত’ সংখ্যাটি হল জাদু সংখ্যা। আজও আমাদের মধ্যে  সাত জন্ম, সাত পাক, সপ্তঋষি, সপ্তমাতৃকা ইত্যাদি খুবই পবিত্র।     

মানুষ চাষবাস শেখার পর চাষযোগ্য জমি এবং উৎপাদিত ও উদ্বৃত্ত শস্যের ওপর অধিকারই হল ক্ষমতার উৎস। আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জমির ওপর চাপ বাড়ল, শুরু হল জমির অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব। হা-ডু-ডু, গাদি, এক্কাদোক্কা প্রভৃতি খেলার মধ্যে লুকিয়ে আছে এই সংঘাতের ছবি। বাংলার যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয় হা-ডু-ডু খেলাটির মধ্যে আদিম কৌমের গোষ্ঠী-সংগ্রাম ও জমি দখলের লড়াইয়ের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এই সব কৌমগুলি তাদের নিজেদের অঞ্চলকে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে বেঁধে রাখত। আর সুযোগ বুঝে অন্যের সীমানা অতিক্রম করে আক্রমণ চালিয়ে নিজের এলাকা বাড়িয়ে নিত। এই খেলায় আক্রমণ ও আত্মরক্ষার যে সমস্ত পদ্ধতি দেখা যায় তার সঙ্গে যুদ্ধনীতির খুব মিল। আক্রমণ ও আত্মরক্ষার পদ্ধতিই হয়তো শেখানো হতো এই খেলাটির মাধ্যমে। মূলত অতীতে যে এটি একটি পুরুষ প্রধান খেলাই ছিল, তা এই খেলার বল প্রয়োগের নীতি থেকেই স্পষ্ট। নিজের এলাকা থেকে একদমে বিপক্ষের সীমানায় আক্রমণ শানিয়ে তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ফিরে আসা বা ফসল ছিনিয়ে আনা বা বিপক্ষ গোষ্ঠীর লোককে খতম করে আসার প্রতিচ্ছবি এই খেলাটি। তাছাড়াও, অতর্কিত এই সব আক্রমণের সময় সবাই একজোট হয়ে ব্যূহ গঠন করে আক্রমণকারীকে আটকানোর কৌশলের মধ্যেও রয়েছে প্রাচীন যুদ্ধনীতির ছাপ। যে সাহসী, বলশালী, বুদ্ধিমান ও কুশলী সে কঠিনতম ব্যূহ ভেদ করে শত্রুকে মেরে বা সম্পত্তি লুঠ করে ফিরতে পারত। আর যে  শারীরিক ও কৌশলগত দুই দিক থেকেই দুর্বল, সে শত্রুদের হাতে ধরা পড়ত। আদিম কৌমগুলির বসবাসের নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে পশুচারণভূমি, পতিত জমি, বনভূমি ইত্যাদি কিছু নিরপেক্ষ অঞ্চল থাকত যা কোনও গোষ্ঠীই নিজের বলে দাবি করত না। আজও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পশুচারণের এলাকাকে ‘চরাই’ বলে। যারা হা-ডু-ডু খেলেছেন তাদের মনে আছে নিশ্চয়ই যে এই খেলার দুই পক্ষের মাঝের সীমারেখাকে বা নিরপেক্ষ অঞ্চলকে ‘চরাই’ বলা হয়। 

ছোটবেলার আর একটি গ্রামীণ জনপ্রিয় খেলা ‘গাদি’। এই খেলাটিও যেন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের ব্যূহ ভেদ করে সাফল্য অর্জনের কৌশল। গাদি খেলায় একটি আয়তাকার ক্ষেত্রকে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে দু’টি সরলরেখায় মোট ছ’টি সম-আয়তনের ঘরে ভাগ করা হয়। ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট আর গাদি খেলার কোর্ট একই রকম। একদল খেলোয়াড় প্রথম ঘরটিতে থাকে আর বিপক্ষের খেলোয়াড়রা বিভাজক রেখার উপর দাঁড়ায় পাহারাদার হিসেবে। প্রথম ঘরের সমস্ত খেলোয়াড়কে দাগে দাঁড়ানো খেলোয়াড়দের ছোঁয়া বাঁচিয়ে একঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হয়। এই কোর্ট ডিঙিয়ে যাওয়ার সময় একজন খেলোয়াড়ের ভুলের খেসারত সমগ্র দলকে দিতে হয়। তাই এই খেলায় প্রতিটি খেলোয়াড়ের ওপর সমান দায়িত্ব থাকে, তা পালনে ব্যর্থ হলেই পুরো দলের পরাজয়।  

এই খেলায় যে ঘর থেকে খেলাটি শুরু হয় তার পাশের ঘরটির নাম ‘নুনঘর’। আর সবক’টি ঘর ঘুরে সেখানে একজন খেলোয়াড় পৌঁছতে পারলেই সমগ্র দলটি জয়ী হয়। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এত কিছু থাকতে হঠাৎ ‘নুনঘর’ কেন?  কারণটা খুব মজার। এই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা লবণ ব্যবসার ইতিহাস। জলের পর নুনই সম্ভবত মানুষের ব্যবহৃত প্রাচীনতম রাসায়নিক যৌগ। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে এই ব্যবসা যে অত্যন্ত লাভজনক ছিল, তা ইতিহাস সাক্ষী। লবণ এতটাই বহুমূল্য ছিল যে একটা সময় রোমান সৈনিকদের বেতন হিসেবে নুন দেওয়া হতো। ইংরেজি ‘salary’ শব্দটিও Latin ‘Salarium’ থেকে এসেছে যার মানে ‘Salt money’। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল পর্যন্ত  দেখি লবণে রাষ্ট্রের বা রাজার একচেটিয়া অধিকার। একদিকে জিনিসটি মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন এবং অন্যদিকে তার উপর রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকার জন্য নুন ছিল মহার্ঘ। তাই এর চোরাচালানও হতো সেই আদিকাল থেকেই এবং তা আটকাতে লবণ গোলাগুলিতে থাকত কড়া পাহারা। চৌকিদারের নজর এড়িয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় লবণ পৌঁছতে পারলেই মিলত মোটা টাকা।      

এই নুন চুরির ছায়া নাকি দেখা যায় গাদি খেলায়। খেলাটিতে নুনঘরে ঢুকে খেলোয়াড় চিৎকার করে বলে ‘গাদি’ অর্থাৎ চৌকিদারের নজর এড়িয়ে লবণ গাদায় ফেলা হল, অর্থাৎ কাজ হাসিল। এখন প্রশ্ন, এই খেলাটা কত পুরনো? সেটা জানতে আমাদের সাহায্য নিতে হবে ‘কামসূত্র’-এর অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয়ের। তিনি বলেছেন গাদি খেলার এই নুন ঘরই হল বাৎস্যায়ন বর্ণিত ‘লবণবীথিকা’ অর্থাৎ নুন জমা রাখার ঘর বা নুন তৈরির ঘর। বাৎস্যায়ন ‘কামসূত্রম’-এ নায়ককে নায়িকার সঙ্গে নানারকম খেলায় অংশ নিতে উপদেশ দিয়েছেন— সুনিমীলিতক, আরদ্বিক, লবণবীথিকা, অনিলতাড়িতকা, গোধূমপঞ্জিকা, আঙ্গুলিতাড়িতকা ইত্যাদি। পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয় ‘লবণবীথিকা’ ও ‘গাদি’ খেলা দু’টির খেলার কৌশলকে সামনে রেখে দেখিয়েছেন খেলা দু’টি এক। সমস্তটাই লবণ কেন্দ্রিক। ফলে আমরা যদি ধরে নিই বাৎস্যায়নের কালে খেলাটির উৎপত্তি তা হলেও এই খেলার বয়স প্রায় দু-হাজার বছরের কাছাকাছি।  

এবার আরেকটা খেলার কথা আসা যাক। সাতচাড়া বা পিট্টু। এই খেলাটি শুধু গ্রাম নয়, শহরেও এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। সাতটা খোলামকুচি একটার উপর একটা সাজিয়ে একটা স্তম্ভ তৈরি হয়। দু’টি দল থাকে। একদলকে বলে ‘পুরন্দর’। তারা বল ছুড়ে স্তম্ভটি ভাঙবে আর একদল হল ‘দস্যু’ বা ‘দাস’, যারা স্তম্ভটি নির্মাণ করেছেন। পুরন্দর মানে ইন্দ্র আবার নগর ধ্বংসকারীও বটে। ডঃ অসীম দাস বলেছেন যে, সিন্ধুসভ্যতার নাগরিকদের সঞ্চিত ধন-সম্পদ লুঠ করতে তাদের নগরগুলির উপর যে লুণ্ঠন চালানো হতো এবং লুণ্ঠনকে অবাধ করতে তাঁদের নগর ও দুর্গগুলি ধ্বংস করা হতো, সেই প্রক্রিয়াটির স্মৃতি ‘সাতচাড়া’ খেলায় রয়ে গিয়েছে।  দাস বা দস্যু কিন্তু আদিতে ছিল জাতি। ঋগ্বেদের বর্ণনা আছে যে, পুরন্দরের নেতৃত্বে দেব বাহিনী এসে দাস তথা দস্যুদের ‘অশ্বময়ী সপ্তপুরী’-কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। অশ্বময়ী সপ্তপুরী হল পাকা ইটের তৈরি বাড়ি। সাতচাড়া খেলায় ব্যবহৃত সাতটি খোলামকুচির স্তম্ভ বা ‘গড়’ হল ‘অশ্বময়ী সপ্তপুরী’-র বা সিন্ধু সভ্যতার নগর দুর্গের প্রতীক। এই খেলায় দেখি যে, আক্রমণকারী বা পুরন্দরের বল অর্থাৎ বজ্রের আঘাতে তা ধ্বংস হচ্ছে আর নগরের অধিবাসীগণ যারা দস্যু নামে পরিচিত, তারা স্তম্ভগুলি পুনঃনির্মাণ করে আত্মরক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। 

এতক্ষণ ছুটোছুটি করে আসুন এবার একটু বসি। কোথাও বসে খেলা যায় এমন অজস্র খেলার মধ্য একটি ‘ষোলোগুটি’। অনেকে এই খেলাটিকে দাবা খেলার গ্রাম্য সংস্করণ বলেন।  ষোলো গুটির ছকের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। বুদ্ধি, ধৈর্য, কৌশল ও সতর্কতার সঙ্গে খেলাটি খেলতে হয় বলে খেলাটি একসময় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই খেলার উপকরণ একদম সহজলভ্য। পাথর, ইটের টুকরো ইত্যাদি দিয়ে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়ের ১৬টি করে মোট ৩২টি গুটি সাজানো হয় নির্দিষ্ট একটি ছকে। খেলার সুবিধার্থে উভয়পক্ষের গুটির রং বা চেহারা আলাদা হয়। সাধারণত মাটিতে দাগ কেটে ষোলো গুটির ঘর বানানো হয়। শুধু ঘরের মাঝখানের দাগটি দান চালার জন্য খালি থাকে। কোনাকুনি দাগের গুটিগুলো সারা ঘর জুড়ে এক ঘর করে কোনাকুনি যেতে পারে। উল্লম্ব দাগ কাটা ঘরের গুটিগুলো লম্বভাবে এক ঘর করে যেতে পারে। বিপক্ষের গুটিকে ডিঙোতে পারলেই সে গুটিটি কাটা পড়ে, যাকে কেল্লার ভাষায় বলে ‘গুটি খাওয়া’।  এই ভাবে প্রতিপক্ষের গুটির সংখ্যা কমিয়ে শূন্য করে ফেলতে পারলেই অপর পক্ষ জয়ী হয়। 

ষোলো গুটি বুদ্ধির খেলা। খেলার পদ্ধতি ও ছকে যুদ্ধের কৌশল প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তাই এটিকে ‘স্ট্র্যাটেজি গেম’ পর্যায়ের খেলা বলা যেতে পারে।  বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এক সময় এই খেলার বহুল প্রচলন ছিল। এখনও কিছু কিছু অঞ্চলে এই খেলা যথেষ্ট জনপ্রিয়। কোথাও কোথাও এর নাম ‘মঙ্গলপাটি খেলা’, যার উৎস ‘মোঘল-পাঠান খেলা’ শব্দবন্ধ থেকে। যুদ্ধবিদ্যার ছায়াতেই যে খেলাটি উদ্ভাসিত হয়েছে তা তার নাম দেখেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য প্রায় পুরো ষোড়শ শতক জুড়ে মোগল ও পাঠানদের মধ্যে লাগাতার যুদ্ধ চলতে থাকে। সেই যুদ্ধের স্মৃতি যেন জাগিয়ে রাখে এই লৌকিক খেলাটির ঐতিহাসিক উৎস। অনুমান করা হয়, এই খেলাটি ওই সময়ের পর এদেশে চালু হয়েছে। 

এই সব লৌকিক খেলাধুলোর মধ্যে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এত ধরনের স্মারক লুকিয়ে আছে যে, ভাবতেও আশ্চর্য হতে হয়। যদিও এই খেলাগুলির আজকাল আর তেমন সামাজিক মর্যাদা নেই, তবু চিত্তবিনোদন ছাড়াও শরীরচর্চা, বুদ্ধিচর্চা, জ্ঞানচর্চার পরিসর গড়ে দেওয়ায় এগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।  স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তেমন মত প্রকাশ করেছিলেন। আজকের কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্রা বা জীবনশৈলী শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে লৌকিক ক্রীড়া বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে এই সব সাধারণ খেলার সাহায্য আমরা নিতেই পারি। ছোটরা খেলাচ্ছলে আনন্দ করে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলবে হাত ধোয়া সহ অন্যান্য ভালো অভ্যাসে। তাই বিদ্যালয় সহ অন্যান্য পরিসরে লৌকিক ক্রীড়ার চর্চাকে উৎসাহ দিলে যেমন ছোটরা শরীর ও মনে সুস্থ সবল হয়ে উঠবে, তেমনই এই চর্চা আমাদের ঐতিহ্য ও সামাজিক ইতিহাস সংরক্ষণেও সহায়ক হবে।


No comments