কলকাতা যখন বন্দর হয়নি, পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে তখন বন্দর হয়েছে। বড়ো বড়ো মাল-বোঝাই জাহাজ যখন কলকাতার গঙ্গার ঘাটে আসত না, তখন খেজুরির উপকূলে তারা নোঙর বাঁধত। মালপত্র বোঝাই ও খালাস করা হত এখানে। শহর কলকাতার বাল্যজীবনে তাই খেজুরি …
কলকাতা যখন বন্দর হয়নি, পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে তখন বন্দর হয়েছে। বড়ো বড়ো মাল-বোঝাই জাহাজ যখন কলকাতার গঙ্গার ঘাটে আসত না, তখন খেজুরির উপকূলে তারা নোঙর বাঁধত। মালপত্র বোঝাই ও খালাস করা হত এখানে। শহর কলকাতার বাল্যজীবনে তাই খেজুরি বন্দরের গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় এই খেজুরি বন্দর হয়েই সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। পরে ১৮৪২ ও ১৮৪৫ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুরও এই বন্দর দিয়েই বিদেশযাত্রা করেছিলেন। মগ-ফিরিঙ্গী (আরাকানি ও পর্তুগিজ) জলদস্যুবিধ্বস্ত, বন্যজন্তু-উপদ্রুত খেজুরি অঞ্চল মানুষের বাসোপযোগী হয়ে ওঠে কোম্পানির আমল থেকে। মগ-ফিরিঙ্গীদের জন্যই এই অঞ্চলকে ‘মগের মুলুক’ বলা হতো।
সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা গ্রামের পরবর্তী ইতিহাসের রোমান্টিক আলোয় খেজুরির ইতিহাস ম্লান হয়ে গেছে। এখনকার খেজুরি দেখে বোঝার উপায় নেই, একসময় এই জায়গার ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। সমুদ্রপথে বালেশ্বর থেকে খেজুরি পর্যন্ত ইংরেজ নাবিকদের যাতায়াত করতে হত তখন। বিদেশি নাবিকরা সেইসময় খেজুরিকে ‘কেডগিরি’, ‘ক্যাজুরি,’ ‘কাদজেরী’ ও ‘গ্যাজুরী’ প্রভৃতি নামে সম্বোধন করতেন। ‘ফ্যাক্টরী রেকর্ড’-এ হেজেস ও স্টেনশ্যাম মাস্টারদের ডায়েরিতে, খেজুরির এই পথের চমকপ্রদ সব বিবরণ পাওয়া যায়। কত বিদেশি নাবিক বিপন্ন হয়ে, বালেশ্বরের পথে খেজুরিতে আশ্রয় নিয়েছেন তখন।
বাংলাদেশ থেকে জলপথে যাত্রার মুখেই ছিল খেজুরি, বিশেষ করে হুগলি ও কলকাতা থেকে। কলকাতা শহরের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে, জব চার্নকের আমল থেকেই তাই খেজুরি একটি প্রধান বন্দর হয়ে ওঠে। আর সেকারণেই একটি ‘এজেন্ট হাউস’ ও দেশের প্রথম ‘পোস্ট অফিস’ও সেখানে নির্মিত হয়। খেজুরি বন্দর থেকে কলকাতা পর্যন্ত প্রতিদিন ডাক যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট ছিপে করে ডাকনৌকা বা ব্যবস্থা ছিল। দ্রুতগামী এই ডাকনৌকা নামধারী ছিপে করেই ডাক পাঠানো হত। বিলেত থেকে জাহাজ খেজুরি বন্দরে পৌঁছান মাত্র কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা বিলাতি সংবাদ সংগ্রহ করে দ্রুতগামী ছিপে করেই কলকাতায় যেতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই খেজুরি ছোটখাটো টাউন হয়ে ওঠে। বিদেশিদের এমন কোনও বাণিজ্যকেন্দ্র, বসবাসকেন্দ্র ও বন্দর ছিল না, যেখানে ট্যাভার্ণ, কফি-হাউস বা হোটেল ছিল না। যেহেতু খেজুরি বিদেশি বণিক ও নাবিকদের প্রধান বিশ্রাম আর আড্ডার জায়গা হয়ে উঠেছিল, তাই বড় বড় ডাকবাংলো, বন্দর, অফিস, এজেন্ট হাউস, ডাকঘর ইত্যাদির সঙ্গে সেকালের ট্যাভার্ণ ও হোটেলও সেখানে ছিল। কলকাতায় ছিল, শ্রীরামপুরে ছিল, হুগলিতে ছিল, খেজুরিতে ছিল। বিখ্যাত সব ট্যাভার্ণ। কলকাতার পার্কস্ট্রিট ও এসপ্ল্যানেড অঞ্চল ট্যাভার্ণ ও কফিহাউসের নাচ-গান-পানে যেমন সরগরম হয়ে থাকত, খেজুরির বন্দরনগরও তাই থাকত। সেই সব ট্যাভার্ণ তো নেই-ই, সেই খেজুরিও এখন আর নেই।
১৮৬৪ সালে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ের ফলে খেজুরি বন্দর পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছিল এবং তার আঁচ লেগেছিল খেজুরিতে অবস্থিত দেশের প্রথম ডাকঘরটিতেও। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির আমলে স্থানীয় মানুষ ও বিধায়ক সুনির্মল পাইকের উদ্যোগে বহু চিঠি-চাপাটির পর ডাকঘরটি মনুমেন্টের স্বীকৃতি পায়। সংস্কারের আদেশও আসে। যোগাযোগ ভবন রক্ষণবেক্ষণের চেষ্টাও শুরু হয়। কিন্তু, ক্ষুদ্র রাজনীতির পাল্লায় পড়ে অচিরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর গতবছর আমফানের তাণ্ডবে তিনতলা পোড়ো বাড়িটি এখন অবলুপ্তির পথে।
শুধু বন্দর বা পোতাশ্রয় বলে নয়, বীরকুল, খেজুরি, হিজলী, কাঁথি—এসব অঞ্চল ছিল তখন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের মূল ঘাঁটি। দার্জিলিং, পুরী, গোপালপুর তখনও সাহেবদের স্বাস্থ্যনিবাসকেন্দ্রে পরিণত হয়নি। অনেকে আবার গিয়ে আর ফিরতেন না, খেজুরিতেই দেহ রাখতেন। এরকম কত বিদেশি বণিক, নাবিক, কর্মচারী ও স্বাস্থ্যান্বেষী যে খেজুরিতে সমাধিস্থ হয়ে রয়েছেন তার ঠিক নেই। এখন খেজুরিতে দু’একটি ভাঙা বাড়িঘরের চিহ্ন আছে শুধু, আর আছে গোরস্থানটি। খেজুরির এই সাহেবদের গোরস্থানটিতে ঘুরলে ইতিহাসও পিছু পিছু ঘুরবে। গা ছমছমও করতে পারে। কবরে খোদিত লেখা গুলো পড়লে জানা যাবে কোন পোতে অবস্থানকালে বা যাত্রাকালে, কে কত বছর বয়সে মারা গেছে, কে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আশায় এসে ইহলোক ছেড়েছেন, এই রকম অনেক কথাই। তার মধ্যে প্রেমিকার উদ্দেশে প্রেমিকের খেদোক্তিও আছে এবং কাব্যের ছন্দোবদ্ধ ভাষায়। দিনাজপুরের তদানিন্তন জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী এমেলিয়া, অসুস্থ অবস্থায় স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এখানে এসে ২৮ বছর বয়সে, ১৮২২ সালের ২৬ জুলাই মারা যান। খেজুরির অতীত জীবনের হৈ-হল্লা, হাসিকান্নার দিনগুলি, কোম্পানির আমলের বিচিত্র সব স্মৃতিকথা, এই গোরস্থানটিতে কিছু-কিছু খোদাই করা আছে। আর আছে ঝাউবনের শনশন শব্দ, মনে হয় যেন গোরস্থানের সাহেবরা অতীতের মগের মুলুকের লুন্ঠনের সেই দিনগুলির কথা ভেবে, সমাধির ভিতর থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।
No comments