বাদু’র ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বায়োটেকনোলজি’র শিক্ষক ডঃ অনির্বাণ মিত্র।মাইকেল ক্রাইটনের সাড়া-জাগানো ‘জুরাসিক পার্ক’ উপন্যাসে সহজভাবে একটি বৈজ্ঞানিক দর্শনের কথা বলা আছে— ‘আধুনিক বিজ্ঞান এখন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ফলে এই প…
বাদু’র ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বায়োটেকনোলজি’র শিক্ষক ডঃ অনির্বাণ মিত্র।
মাইকেল ক্রাইটনের সাড়া-জাগানো ‘জুরাসিক পার্ক’ উপন্যাসে সহজভাবে একটি বৈজ্ঞানিক দর্শনের কথা বলা আছে— ‘আধুনিক বিজ্ঞান এখন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ফলে এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বের বহু ঘটনা সম্বন্ধে সত্যের অনুসন্ধান করতে পারে। শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুর কী কাজ বা বহু দূরের নক্ষত্রে কী ঘটছে, তা নির্ভুলভাবে জানাতে পারে। অথচ এমনও বেশ কিছু জিনিস আছে যার সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয় না।’
কোনও বিষয়ে বলতে পারা সম্ভব নয় মানে কিন্তু তা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা নয়, বরং এও বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিরই অংশ। উদাহরণ হিসেবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কথা বলা যায়। এখন ‘ওয়েদার ফোরকাস্ট’ অনেক বেশি উন্নত। সামনের সপ্তাহে কোথায় কখন বৃষ্টি হতে পারে বা রাক্ষুসে ঘূর্ণিঝড় উপকূলের ঠিক কোথায় আছড়ে পড়বে সেটা আজকের আবহাওয়াবিদরা অনেক নির্ভুলভাবে জানাতে পারেন। এমনকী ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আবহাওয়া কেমন থাকবে, সেই ব্যাপারে আগাম এবং অনেকখানি সঠিক আভাসও দিতে পারে। তবে হ্যাঁ, চার মাস দূরের শীতকালে ঠিক কোন দিনে কোথায় কতক্ষণ এক পশলা বৃষ্টি হবে সেটা বলতে পারবে না। তার কারণ, আবহাওয়া, বিভিন্ন ইকোসিস্টেম, আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজার, অস্ট্রেলিয়ার দাবানল, হাইতির ভূমিকম্প বা পাহাড়ে ধস এমনই শৃঙ্খলহীন রীতির অন্তর্গত যে তার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেলেও একেবারে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না।
তার ওপর মহামারী, অতিমারী রয়েছে। প্যানডেমিক, এনডেমিক হল দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশৃঙ্খল অবস্থা। অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তে বড় ও ক্ষুদ্র তথ্যের ভিত্তিতে অতিমারীর গতিপ্রকৃতি অল্পস্বল্প পাল্টে যেতে থাকে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, আপনি কর্মসূত্রে কোনও অফিসে গিয়েছেন। সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল এবং দুই-তিন মিনিট কথাবার্তার মধ্যে অবধারিতভাবে এল ‘আজকেই খবরে দেখলাম আবার থার্ড ওয়েভ আসবে রে...’ ইত্যাদি। এই আড্ডার সময়ে আপনারা দু’জনেই নাকের ওপরে মাস্কটা ভাল করে আটকে নিলেন। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটি সামান্য। অথচ বন্ধুর সঙ্গে তথ্যের আদানপ্রদানের কারণে ঘটা এই ছোট্ট পরিবর্তন আপনার করোনা আক্রান্ত হওয়া আর না-হওয়ার মধ্যে তফাৎ করে দিল। কারণ আপনার অজান্তে ওই অফিসে হয়তো একজন উপসর্গহীন আক্রান্ত ছিলেন! মাস্ক আলগা থাকলে ডেল্টা-ভাইরাস ঠিকই আপনার নাকে ঢুকে যেত। অর্থাৎ, দুই ব্যক্তির মধ্যে ‘তৃতীয় ঢেউ এল বলে’ নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছিল, সেই আলাপই তাঁদের করোনা আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করল। আর তৃতীয় ঢেউয়ের আগমনী থেকে এক পয়েন্ট কমিয়ে দিল। অবশ্য, আপনার সঙ্গে তো ওই বন্ধুর দেখা নাও হতে পারত! তাহলে? কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তি অফিসে কামাই করতেও পারতেন? রোজ সমাজে এরকমই অসংখ্য সম্ভাব্য ঘটনা ঘটে চলে এবং মানুষ ও ভাইরাস এই দুই প্রজাতির মধ্যে যোগাযোগের তারতম্য ঘটাতে থাকে। সেই জন্যেই, দুই-তিন সপ্তাহ পরে কী হবে ভালো আন্দাজ পাওয়া গেলেও তিন মাস পরে কী হবে তার সম্পর্কে ‘দিনক্ষণ বলে দেওয়া’ কার্যত অসম্ভব। তাই, আজ ‘নানা মুনির নানা মত’ শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু, এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ঢেউ-এর সূচনা ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বাড়বে না ১৭ অক্টোবর কী এসে যায়? গুরুত্বপূর্ণ হল এই যে অতিমারীর কেন্দ্রে আছে দু’টি জৈবিক প্রজাতি— মানুষ আর ভাইরাস। দুইয়ে মিলে অতিমারী। আর বিশৃঙ্খল অবস্থা বলে যেমন আমরা নিখুঁত পূর্বাভাস করতে পারি না, তেমনই অনস্বীকার্য যে নিজেদের আচরণ বিজ্ঞানসম্মত করে আমরা এই সমীকরণ থেকে যদি মানুষকে বাদ দিতে পারি, তাহলে অতিমারীর ঢেউ কমতে বাধ্য। অর্থাৎ, আজকের সমাজের অধিবাসীরা কী কী করছেন সেটাই ঠিক করে দেবে তৃতীয় ঢেউ-এর উচ্চতা বড় হবে কি না।
একই কথা কালান্তক দ্বিতীয় ঢেউ-এর ক্ষেত্রেও সত্যি ছিল। বিজ্ঞানীরা-ডাক্তাররা বারবার সাবধান করেছিলেন যে সেকেন্ড ওয়েভ আসবে। হ্যাঁ, অনেকেই ভেবেছিলেন সেটা গত বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আছড়ে পড়বে। সেই পূর্বাভাস মেলেনি। কারণ ওই যে— বিশৃঙ্খল অবস্থার নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। তাই, দিনক্ষণ মেলেনি, আমরা বেপরোয়া হয়ে উৎসব করেছি, আট-দফা ভোটও হয়েছে। আর সেই সুযোগেই হিংস্র দ্বিতীয় ঢেউ দেশের কয়েক কোটি পরিবারকে ছারখার করে দিয়েছে। তার মূল কারণ, মানুষ ভাইরাসকে ‘সাহায্য’ করেছিল!
তবে সেই তুলনায় এবার আমরা কিছুটা প্রস্তুত। কারণ, বেশ কয়েক কোটি মানুষ অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন, আর তার মাধ্যমে আমরা ভাইরাসের পথে একাধিক প্রাচীর গড়ে তুলতেও পারব। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ১৪ শতাংশ নাগরিক দু’টি ডোজ পেয়েছেন এবং আরও ২২ শতাংশ পেয়েছেন এক ডোজ। বড়-জনসংখ্যার রাজ্যগুলির মধ্যে এই টিকাকরণের গতি উল্লেখযোগ্য। এবং রাজ্যের অতিমারীর এপিসেন্টার দুই জেলা কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা মিলিয়ে ৪৬ শতাংশ নাগরিক এক ডোজ পেয়েছেন এবং ২৪ শতাংশ নাগরিকের টিকাকরণ সম্পূর্ণ। তাই এই সব অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও (কারণ ভাইরাস তো বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে) গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট কম।
কিন্তু, একই তথ্য এও জানান দিচ্ছে যে যেসব অঞ্চলে হাসপাতাল অপ্রতুল সেখানে দ্রুত টিকাকরণ খুবই প্রয়োজনীয়। এছাড়া, এখনও পর্যন্ত যদি এক হাজার পুরুষ ভ্যাকসিন পেয়ে থাকেন, মহিলাদের মধ্যে সেই সংখ্যা মাত্র ৯০১। এইসব বৈষম্য দূর না হলে গ্রামেগঞ্জে একাধিক ছোট ঢেউ হওয়ার বিপদ থেকে যাচ্ছে। ভাইরাস ধুরন্ধর। আমাদের ডিফেন্সে ফাঁক পেলেই গোল দিতে দ্বিধা করবে না!
তাছাড়া, অন্যান্য যা করণীয় সে তো আমরা এতদিনে জেনেই গিয়েছি। তবে অফিস, ব্যাংক, পোস্টঅফিস, ট্যাক্সি, মল, রেস্তোরাঁ এসব জায়গায় জানলা-দরজা খুলে দিয়ে হাওয়া-বাতাস চলাচল অত্যন্ত জরুরি।
মনে রাখতে হবে, একটিমাত্র ভাইরাস কণা সংক্রমণ করতে পারে না। সংক্রমণের জন্যে একটি নির্দিষ্ট ভাইরাস-ঘনত্ব প্রয়োজন (যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় ভাইরাল লোড বলে)। আর এই ভাইরাস-ঘনত্ব কমিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে সোজা উপায় জানলা-দরজা খুলে দেওয়া। সেইজন্যেই এখন বিভিন্ন দেশের ‘কী কী করণীয় লিস্টে’ ইনডোর ভেন্টিলেশন-এর ওপরে খুব বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে যখন স্কুল-কলেজ খুলবে (১৭৫টি দেশে স্কুল খুলে গিয়েছে) তখনও প্রত্যেক ক্লাসরুমে এই হাওয়া-বাতাস চলাচল খুবই প্রয়োজনীয় হবে।
No comments