Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শুধুই কি ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’ পাশ?

শুধুই কি ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’ পাশ? পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম ও প্রসঙ্গ উঠলে কোন দুটি কথা সর্বাগ্রে আমাদের মনে পড়ে? অবশ্যই ‘বর্ণপরিচয়’ এবং ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’। এই দুটি নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগরের জীব…

 





শুধুই কি ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’ পাশ? পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম ও প্রসঙ্গ উঠলে কোন দুটি কথা সর্বাগ্রে আমাদের মনে পড়ে? অবশ্যই ‘বর্ণপরিচয়’ এবং ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’। এই দুটি নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগরের জীবনের মহৎ দুটি কীর্তি, কিন্তু এই দুটির নিচে চাপা পড়ে গেছে এমন একটি ইতিহাস, তাঁর এমন একটি লড়াই - যেটি ছিল তৎকালীন সমাজে বিধবা বেড়ে যাওয়ার মূলে। সেই লড়াই লড়তে গিয়েও কম বাধার সম্মুখীন হননি তিনি। বরং বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাশের চেয়েও বেশি বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর খুব কাছের মানুষজনও সেই বিষয়ে তাঁর বিরোধিতা করতে ছাড়েননি। তাঁর সেই লড়াই ছিল ‘কৌলীন্য প্রথা’ ও বহুবিবাহের বিপক্ষে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘তারানাথ তর্কবাচস্পতি’ - এই নামটি এখন কারো স্মরণে না থাকারই কথা। তবে বিদ্যাসাগরের সময়ে তিনি যে সে লোক ছিলেন না। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ‘ইবি কাউয়েল’ সাহেব তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘‘Living Encyclopedia of Sanskrit Literature’’ বলে৷ তাঁর রচিত সংস্কৃত ভাষার অভিধান ‘বাচস্পত্য’ আজও পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় অপরিহার্য বলে পরিগণিত৷ তাঁর তৈরি বাজার নিয়ে ‘জেমস লঙ’ সাহেব লিখেছিলেন, ‘‘Culna (Kalna) is noted for the great trade, being the port of the burdwan district, the bazar has 1000 shops, the houses are chiefly of-bricks. Great quantities of rice brought from merchants of Rangpur, Dewanganj, Jaffirganj are here stored up, grain, silk and cotton also from a large staple.’’ ১৮৪৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে, বিদ্যাসাগর পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে কালনা গিয়েছিলেন, তাঁকে সংস্কৃত কলেজের প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপকের চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য রাজি করাতে। ঘটনাচক্রে, ওই পদে নিয়োগের জন্য বিদ্যাসাগরের নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মতে, ‘‘তারানাথ, আমার চেয়ে অনেক বড় পণ্ডিত, নিয়োগপত্র পাওয়ার যোগ্যতা তাঁরই আছে।’’ তারানাথের পাণ্ডিত্যের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচিতি হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, তাঁর সংস্কৃত কলেজের ছাত্রাবস্থায়। আর তাই ছাত্র বিদ্যাসাগরকে প্রায়ই দেখা যেত যে তিনি তাঁর কলেজের সিনিয়র তারানাথের ঠনঠনিয়া বাসাবাড়িতে বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্যদর্পণ’ পড়তে যেতেন। আবার পরে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে যখন সই সংগ্রহ করার কাজটি চলছিল, সেই আবেদনপত্রের দ্বিতীয় সইটি করেছিলেন এই তারানাথই। বিদ্যাসাগরের প্রভাবেই হয়তো তারানাথ বেথুন সাহেবের গার্লস স্কুলে তাঁর কন্যা ‘জ্ঞানদাদেবী’কে পাঠিয়েছিলেন। একাধারে অগাধ পাণ্ডিত্য, সমাজ সংস্কারক, অন্য দিকে, সফল ব্যবসায়ীর সমাহার ছিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি৷ এহেন মানুষের সাথেই বহুবিবাহের বিরোধ নিয়ে বিদ্যাসাগরের মধুর সম্পর্ক তিক্ততার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর পুস্তিকা লিখেছিলেন। প্রতিবাদপুস্তিকাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ পেয়েছিল। বহুবিবাহ বিরোধিতার পাঁচ জন প্রতিবাদীর অগ্রগণ্য ছিলেন এই তারানাথই। বিদ্যাসাগরও নাছোড় ছিলেন। তিনিও খোঁচা দিয়েছিলেন, 


‘‘অতি দর্পে লঙ্কাপতি সবংশে নিপাত।

অতি দর্পে বাচস্পতি তব অধঃপাত।।’’


এখানেই শেষ নয়, বহুবিবাহ নিয়ে বিবাদের জেরে তারানাথ ও তাঁর পুত্র উভয়কেই উপহাস করে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘‘খুড়োর এই সময় কলম করে রাখা ভাল। কারণ আঁটিতে যেটি হয়েছে সেটি টক ও পোকাখেকো।’’ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, বিধবা বিবাহ প্রচলন, এবং নারী শিক্ষা প্রসারে তারানাথের ভূমিকা ছিল অন্যতম৷ বিদ্যাসাগর পুত্র - নারায়ণচন্দ্রের বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক গিয়েছিলেন তারানাথ৷ ওই বিবাহে বিদ্যাসাগরের আত্মীয়রা নববধূকে বরণ করতে রাজি না হওয়ায় তারানাথ সহধর্মিনীকে দিয়ে নববধূকে বরণ করিয়েছিলেন৷ নিজের মেয়েদের বাল্যবয়সে বিয়ে না দিয়ে, তারানাথ তাঁদের যথাযথ শিক্ষা দিয়ে উপযুক্ত বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন৷ আবার অন্য দিকে, তারানাথ ছিলেন বহু -বিবাহের সমর্থক৷ আর সেই বৈপরীত্যের কারণে পরে তাঁর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতান্তর ঘটেছিল৷ তারানাথ নিজে তাঁর দুই স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তৃতীয়বার বিবাহ করেছিলেন৷ তারানাথের ছেলেও কম যেতেন না। ঈশ্বরচন্দ্রের পরে বিদ্যাসাগর হিসেবে যিনি সেই যুগে সমধিক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন, তিনি তারানাথ বাচস্পতি পুত্র ‘জীবানন্দ বিদ্যাসাগর’। একসময় যে সংস্কৃত কলেজে ছ’বছর অধ্যয়ন করে সর্বোচ্চ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে ‘তর্ক-বাচস্পতি’ উপাধি পেয়েছিলেন তারানাথ, সেই সংস্কৃত কলেজেই ভর্তি হয়েছিলেন জীবানন্দ। কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি, ন্যায়, সাংখ্য, মীমাংসা ইত্যাদি বহুশাস্ত্রের পাঠশিক্ষা করেছিলেন তিনি। ১৮৭০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর উপাধি অর্জন করেছিলেন 'জীবানন্দ'। বাবা তারানাথের সঙ্গে বহু কাজ করেছিলেন তিনি। অন্ততঃ ২১৫টিরও বেশি সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদনার কাজ তিনি করেছিলেন। তবে তিনিও ছিলেন বহুবিবাহের পক্ষে। এই ছোট্ট ঘটনাটাই প্রমাণ করে যে, বিধবাবিবাহ রোধ করার চেষ্টায় নিজের ভীষণ কাছের লোকের সাথেও কি ভাবে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক বিষিয়ে উঠেছিল। ‘কৌলীন্য প্রথা’র জন্যই তৎকালীন সমাজে বিধবার সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল। আর একই সাথে সমাজে বেড়ে গিয়েছিল অনাচার ও ব্যভিচার। বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন যে, কেবলমাত্র আইন পাশ করিয়ে বিধবাদের বিবাহ চালু করলেই হবে না, যদি বিধবা সৃষ্টির মূলকে ধ্বংস না করা যায় তাহলে নারীদের নারকীয় জীবন থেকে মুক্তির কোন সম্ভবনাই নেই। মধ্যযুগের বাঙালী সমাজ ‘কলঙ্কিত’ হয়েছিল এই ‘কৌলীন্য প্রথা’ নামক ‘অপপ্রথা’র জন্য। কুলীনের মেয়ের ছিল ‘অভিশপ্ত’ ও ‘কলঙ্কিত জীবন’। ‘কুলীনের মেয়ে’ বলতে মূলতঃ বোঝাত ‘কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা’দের। যে সকল ব্রাহ্মণ ‘কুলীন’ নামে ‘আখ্যাত’ হতেন, তাঁদের পদবী ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘চট্টোপাধ্যায়’, ‘গঙ্গোপাধ্যায়’ ও ‘মুখোপাধ্যায়’। ‘সামাজিক মর্যাদায়’ তাঁরা ছিলেন অন্যান্য ব্ৰাহ্মণের তুলনায় ‘উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ’। বিবাহ সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে যে ‘বিধান’ প্রচলিত ছিল সেই ‘বিধান অনুযায়ী’ ‘কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান’ ‘কুলীন বা অকুলীন ব্রাহ্মণ বংশে’ বিবাহ করতে পারত, কিন্তু ‘কুলীন ব্রাহ্মণকন্যারা’ তা পারত না। যদি সেরূপ মেয়ের বিবাহ অকুলীনের সঙ্গে হত, তাহলে তাঁর পিতার ‘কৌলীন্য ভঙ্গ’ হত। ‘সামাজিক মর্যাদায়’ সেরূপ বিবাহ ‘বংশ হীন’ বলে পরিগণিত হতো। সেজন্য ‘কুলীন ব্রাহ্মণ’রা নিজের ‘কন্যাদান’ কুলীন পাত্রেই করতেন। এছাড়া আরও ‘বিধিনিষেধ’ ছিল। ফলে কুলীন কন্যার ‘বিবাহ’ সম্বন্ধে সমাজে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুতঃ মধ্যযুগের বাঙালী ব্রাহ্মণ সমাজে ‘কৌলীন্য প্রথা’ যে জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তাতে ‘কুলীন কন্যাদের বিবাহ’ যে মাত্ৰ ‘দণ্ডকর’ হয়ে উঠেছিল তা নয়; ‘সামাজিক অশুচিতা’তেও পরিণত হয়েছিল। ‘অর্থগৃধ্নতা’ একশ্রেণীর কুলীন ব্রাহ্মণকে ‘প্রলুব্ধ’ করেছিল বিবাহকে একটা ‘বাণিজ্যিক পেশা’য় পরিণত করতে। ‘রামনারায়ণ তর্করত্ন’ তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে তাঁদের ‘বিবাহ বণিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘরে ‘অর্থের বিনিময়ে’ তাঁরা কুলীন কন্যার পিতাদের ‘কন্যাদায়’ হতে মুক্ত করত। তারপর ‘বিবাহান্তে’ ওই সকল ‘বিবাহবণিক’ নিজেদের খাতায় কন্যার ও তাঁর পিতার নামধাম লিখে নিয়ে ‘অন্তর্হিত’ হত। ফলে সেরূপ ‘বিবাহিতা’ কুলীন কন্যাকে পিতৃগৃহেই থাকতে হত। অনেক সময় কুলীন পিতা ‘কুলরক্ষার জন্য’ শ্মশানঘাটে ‘গঙ্গাজলী’র জন্য আনীত কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গেই কন্যার বিবাহ দিতেন। অচিরেই সেই কন্যা ‘বিধবা’ হত। এরূপ বিধবা কুলীন কন্যারাও পিতৃগৃহেই থেকে যেত। আবার গরীব কুলীন কন্যাদের অনেক সময় বিবাহই হত না। সারা জীবন তাঁদের ‘অনূঢ়া’ হয়েই পিতৃগৃহে থেকে যেতে হত। যাঁরা কুলীন কন্যাদের বিবাহ করা ‘পেশা’ রূপে গ্রহণ করেছিল, সে-সব কুলীন ব্রাহ্মণ খাতা দেখে নামধাম সংগ্রহ করে মাঝে মাঝে ‘শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ’ করত এবং এক রাত্রি জামাই আদরে থেকে ‘সালিয়ানা দক্ষিণা’ আদায় করে, কুলীন কন্যার পিতার বংশকে ‘কৃতাৰ্থ’ করে, সত্বর অপর গ্রামে অপর শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করবার জন্য যাত্রা করত। অনেকে আবার রাত্রিকালে নিদ্রিতা স্ত্রীর ‘অলঙ্কার অপহরণ’ করেও সরে পড়ত। অনেক সময়ই এরূপ ‘বিবাহ-পেশাদারী কুলীন ব্রাহ্মণরা’ শ্বশুরবাড়ির পথঘাটের সঙ্গে সম্যক পরিচিত থাকত না। কথিত আছে, এরূপ এক ‘কুলীন ব্রাহ্মণ’ এক গ্রামে গিয়ে শ্বশুরবাড়ি চিনতে না পেরে, পথে পুঙ্করিণী থেকে স্নানান্তে প্রত্যাগতা এক যুবতীকে দেখে তাঁকে সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করেন – ‘মা, অমুকের বাড়ি এ গ্রামের কোথায় বলতে পার?’ তিনি কেন সন্ধান করছেন জানতে চাইলে ব্রাহ্মণ বলেন - ‘আমি তাঁর জামাই।’ সে কথা শুনে সেই কন্যা ‘বুক পর্যন্ত অবগুণ্ঠিত হয়ে’, তাঁকে নিজ গৃহে নিয়ে যায়। আগেই বলা হয়েছে যে  সেই সমাজের মেয়েরা বিয়ের পর বাপের বাড়িতেই থেকে যেত। স্বামী ‘ক্বচিৎ কদাচিৎ’ শ্বশুরবাড়ি আসত। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এলে কি হবে! ‘বিনা দক্ষিণায়’ তাঁরা কখনও স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হত না। ‘রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র’ তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে এর এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে এক কুলীনের মেয়ের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন –


‘‘... আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে।

যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে।।


যদি বা হইল বিয়া কত দিন বই।

বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই।।


বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে।

পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে।।


দু-চারি বৎসরে যদি আসে একবার।

শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার।।


সুতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়।

তবে মিষ্টি মুখ নতুবা রুষ্ট হয়ে যায়।।’’


সুতরাং এরূপ সমাজে যে-সব মেয়ের ‘যৌনক্ষুধা’ প্রবল, তাঁদের ক্ষেত্রে যা ঘটত তা সহজেই ‘অনুমেয়’। ‘গোপন অভিসার’ কুলীন কন্যাদের স্বভাবে দাঁড়িয়েছিল। ‘আদিম যৌনক্ষুধা’কে তাঁরা অস্বীকার করতে পারত না। ‘অবৈধ সহবাসে’ তাঁরা ‘লিপ্ত’ হত। বস্তুতঃ খ্রীস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ‘রামনারায়ণ তর্করত্ন’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ সেটা খোলাখুলিই বলেছিলেন। ‘রামনারায়ণ’ তাঁর ‘কুলীনকলসর্বস্ব’ নাটকের ‘চতুর্থ অঙ্কে’ পিতা-পুত্রের সংলাপের ভিতর দিয়ে সেটা বলেছিলেন এভাবে: ‘‘পুত্র তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তাঁর একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। পুত্র আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন – বাপু হে, তাতে ক্ষতি কি? আমি বিবাহ করবার পর একবারও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। শুভদৃষ্টির পর একেবারে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়।’’ কুলীন কন্যাদের যখন ‘স্বামী ব্যতীতই গর্ভ’ হত, তখন মেয়ের ‘মায়েরা’ কি ‘কৌশল’ অবলম্বন করে সেই ‘সন্তানের বৈধতা’ পাড়াপাড়শীদের কাছে জানাত, তা ‘পণ্ডিত বিদ্যাসাগর’ তাঁর ‘বহুবিবাহ’ নিবন্ধে বিবৃত করেছেন। ‘পণ্ডিত বিদ্যাসাগর’ লিখেছিলেন – ‘‘কোনও কারণে কুলীন মহিলার গর্ভসঞ্চার হইলে, তাহার পরিপাকার্থে কন্যাপক্ষীয়দিগকে বিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। প্রথম সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়া জামাতাকে আনয়ন। তিনি আসিয়া শ্বশুরালয়ে দু-একদিন অবস্থিতি করিয়া, প্রস্থান করেন। ঐ গর্ভ তৎ সহযোগে সম্ভুত বলিয়া পরিগণিত হয়। দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃতকার্য হইতে না পারিলে, ব্যভিচার সহচরী ভ্রূণহত্যাদেবীর আরাধনা। এ অবস্থায় এতদ্ব্যাতিরিক্ত নিস্তারের আর পথ নাই। তৃতীয় উপায় অতি সহজ, অতি নির্দোষ ও সাতিশয় কৌতুকজনক। তাহাতে অর্থব্যয়ও নাই এবং ভ্রূণহত্যাদেবীর উপাসনাও করিতে হয় না। কন্যার জননী বা বাটির অপর কোন গৃহিণী একটি ছেলে কোলে করিয়া, পাড়ায় বেড়াইতে যান, এবং একে একে প্রতিবেশীদিগের বাটি গিয়া, দেখ মা, দেখ বোন অথবা দেখ বাছা, এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া, কথা প্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেক দিনের পর কাল রাত্ৰিতে জামাই আসিয়াছিলেন, হঠাৎ আসিলেন, রাত্রিকাল কোথায় কি পাব, ভাল করিয়া খাওয়াতে পারি নাই। অনেক বলিলাম একবেলা থাকিয়া, খাওয়া দাওয়া করিয়া যাও। তিনি কিছুতেই রহিলেন না, বলিলেন, আজ কোন মতে থাকিতে পারিব না; সন্ধ্যার পরই অমুক গ্রামের জমিদারের বাটিতে একটা বিবাহ করিতে হইবেক; পরে অমুক দিন, অমুক গ্রামের হালদারের বাটীতেও বিবাহের কথা আছে; সেখানেও যাইতে হইবেক। যদি সুবিধা হয়, আসিবার সময় এই দিক দিয়া যাইব। এই বলিয়া ভোর ভোর চলিয়া গেলেন। স্বর্ণকে বলিয়াছিলাম, ত্রিপুরা ও কামিনীকে ডাকিয়া আন, তারা জামাইয়ের সঙ্গে খানিক আমোদ আহ্লাদ করিবে। একলা যেতে পারব না, বলিয়া ছুঁড়ী কোন মতেই এল না। এই বলিয়া সে ঐ দুই কন্যার দিকে চাহিয়া বলিলেন, এবার জামাই এলে মা তোরা যাস ইত্যাদি। এইরূপে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি বেড়াইয়া জামাতার আগমনবার্তা কীর্তন করেন। পরে স্বর্ণমঞ্জরীর গর্রসঞ্চার প্রচার হইলে, ঐ গর্ভ জামাতাকৃত বলিয়া পরিপাক পায়।’’ এবার পড়ুন ‘কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ তাঁর ‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসে কি বলেছেন - ‘‘পরম কুলীনের পরমা কুলীন কন্যা হিসাবে সন্ধ্যা বলল - আমি বামুনের মেয়ে নই। ... আমার মা আমাকে সম্প্রদান করতে বসেছিলেন। এমন সময় মৃত্যুঞ্জয় ঘটক দু’জন লোক সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হল। বলল, তোমরা শোন, এই যাকে তোমরা পরম কুলীন প্রিয় মুখুজ্যে বলে জান সে বামন নয়, মিহির নাপিতের ছেলে। তারপর মৃত্যুঞ্জয় ঘটক গঙ্গাজলের ঘটটা ঠাকুরমার সামনে বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বলুন সত্যি কিনা? বলুন ও কার ছেলে? মকুন্দ মুখুজ্যের না হীরা নাপিতের? আমার সন্ন্যাসিনী ঠাকুরমা মাথা হেঁট করে রইলেন। কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারলেন না। একজন তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সে তাদের গ্রামের লোক। বলল, আট বছর বয়সে ঠাকুরমার বিয়ে হয়, তারপর দশ-পনের বছর পরে একজন এসে জামাই মুকুন্দ মুখুজ্যে বলে পরিচয় দিয়ে বাড়ি ঢোকে। পাঁচ টাকা আর একখানা কাপড় নিয়ে সে দুদিন বাস করে চলে যায়। তারপর থেকে লোকটা প্রায়ই আসত। ঠাকুরমা খুব সুন্দরী ছিলেন – আর সে টাকা নিত না। তারপর যখন সে একদিন হঠাৎ ধরা পড়ে গেল, তখন বাবা জন্মেছেন। তারপর লোকটা বলল, ও কুকাজ সে নিজের ইচ্ছায় করেনি, তার মনিব মুকুন্দ মুখুজ্যের আদেশেই করেছে। একে বুড়ো মানুষ, তারপর পাঁচ-সাত বছর বাতে পঙ্গু, তাই অপরিচিত স্ত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ভার তার ওপর দিয়েছিল। হিরু নাপিত ঐ বামনের পরিচয় মুখস্থ করে, একটা উপায় তৈরি করে রাখে। তখন থেকে যা কিছ রোজগার করে অর্ধেক ভাগ পায়। আরো দশ-বারো জায়গা থেকে সে এমনি করে প্রভুর জন্য রোজগার করে নিয়ে যেত।’’ এই কদর্য উদাহরণগুলোই প্রমাণ করে দেয় যে ‘কৌলীন্য প্রথা’র জন্য ও বহুবিবাহের ফলে কি ভাবে তৎকালীন হিন্দু সমাজ রসাতলে চলে গিয়েছিল। কি ভাবে বাংলার হিন্দু ঘরের মেয়েদের জীবন নরকে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ‘কৌলীন্য প্রথা’ নিরোধের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন ‘রামনারায়ণ তর্করত্ন’ ও ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’। যদিও ‘বিধবা বিবাহ’ বৈধ করবার জন্য ‘পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা’ সফল হয়েছিল (১৮৫৬ সালের ১৫ নম্বর আইন দ্বারা), কিন্তু ‘কৌলীন্য প্রথা’ নিরোধের জন্য তাঁর ‘নিরলস প্রচেষ্টা’ ফলবতীর্ণ হয়নি। ‘তৎকালীন সরকার’ এ সম্বন্ধে কোন আইন প্রণয়ন করেন নি। তবে তখন সফল না হলেও, সেই কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর যে লড়াই তখন চালিয়েছিলেন, সেটা তাঁর আগে কেউ করেননি। আর তিনি সেই প্রতিবাদের কাজটি করেছিলেন বলেই, তাঁর মৃত্যুর ৬৫ বছর পরে, ১৯৫৬ সালে বহুবিবাহের হাত থেকে নারীরা মুক্তি পেয়েছিলেন। নারীদের নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেবার জন্য বিদ্যাসাগরকে যে যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছিল, তার জন্য ভারতের নারীদের তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্যি যে, বিধবাবিবাহ ও বর্ণপরিচয় প্রসঙ্গে তাঁর কথা আমরা মনে রাখলেও, বহুবিবাহ রোধে ঋণ-জর্জরিত ও অসুস্থ অবস্থায় তাঁর লড়াই আমরা ভুলে গিয়েছি। কেমন ছিল বিদ্যাসাগরের সেই লড়াই? সেই লড়াইতে কারা তাঁর সঙ্গ দিয়েছিলেন? বহুবিবাহের কি কি কুফল বিদ্যাসাগর লক্ষ্য করেছিলেন? বহুবিবাহ বিষয়ে তাঁর কি মন্তব্য ছিল? কেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বহুবিবাহ রোধ করার জন্য তাঁর সঙ্গ দেননি? - এসব প্রশ্নের উত্তর ও বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ রোধের প্রচেষ্টার চাপা পড়া ইতিহাসকে বিস্তারিত জানতে হলে আপনাদের অবশ্যই পড়তে হবে কলিকাতার কালকথা বইটি। এই বইতে বিদ্যাসাগরের সেই ইতিহাস বিস্মৃত লড়াই, সেই কুপ্রথা ও তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার কথা বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।


কলিকাতার কালকথা — রানা চক্রবর্তী। দাম—৪০০টাকা। প্রিবুকিং ডেট - ২৩/৮/২১-৩/৯/২১

প্রিবুকিং এ থাকছে স্পেশাল ২৫ শতাংশ ছাড় ও লেখকের সাক্ষর। 

প্রিবুকিং লিঙ্ক—https://pathokbandhu.com/details/5489

প্রিবুকিং সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় হোয়াটসঅ্যাপ করুন - ৭৪৩৯১১২৬৬৫ নম্বরে। (লিঙ্ক সরাসরি না খুললে কপি করে ব্রাউজারে পেস্ট করে খুলুন; অথবা, যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি দেওয়া হয়েছে, তাতে যে কোন নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ করে বইটি অর্ডার করতে পারেন; অথবা, ৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে, সরাসরি কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের লালমাটি প্রকাশনী থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন।)

যাঁরা বাংলাদেশে বইটি সংগ্রহ করতে চাইছেন, তাঁরা যে কোন নম্বর থেকে +8801674121221 নম্বরে whatsapp করে যোগাযোগ করুন। এটি Indo Bangla Book Shop-এর whatsapp নম্বর। আগামী মাসে বইটি বাংলাদেশে পেয়ে যাবেন। তবে এখন থেকেই ওই নম্বরে নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করাতে হবে।

No comments