ঘড়ির কাঁটা তখনও বেলা দু’টোর ঘরে পৌঁছয়নি। যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়বেন তিনি, যাঁর জন্য প্রহর গোনা জঙ্গলমহলের! বিশালাকার একটা ধামসা আর মাদল নাগাড়ে বাজছিল। তাঁকে স্বাগত জানাতে তৈরি সাঁওতাল, মুণ্ডা আর শবর জনজাতির লোকশিল্পীরা। মাদলে…
ঘড়ির কাঁটা তখনও বেলা দু’টোর ঘরে পৌঁছয়নি। যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়বেন তিনি, যাঁর জন্য প্রহর গোনা জঙ্গলমহলের! বিশালাকার একটা ধামসা আর মাদল নাগাড়ে বাজছিল। তাঁকে স্বাগত জানাতে তৈরি সাঁওতাল, মুণ্ডা আর শবর জনজাতির লোকশিল্পীরা। মাদলের বোলে কোমর দুলছিল রংবেরঙের শাড়ি পরিহিতা, মাথায় অজানা বাহারি ফুল গোঁজা আদিবাসী রমণীদের, নৃত্য পরিচালনায় রাজ্যের মন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা। কোভিড বিধি মেনে ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামের বাছাই করা দর্শক-শ্রোতার জমায়েত থেকে স্লোগান উঠল—‘জঙ্গলমহল রিনিজ লাউড়িয়ৌ মানতানি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সাগুন দারাম’ (জঙ্গলমহলের রূপকার মমতা ব্যানার্জি স্বাগতম)। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে মঞ্চের নীচে লোকশিল্পীদের মাঝে এলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাদল-ধামসার রব তখন গগনভেদী।
দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ লোকশিল্পীদের লাস্য উপভোগ করলেন। এবার সটান শিল্পীদের সঙ্গে এক সারিতে। বীরবাহার কানে কিছু একটা বললেন মুখ্যমন্ত্রী। ছুটে গিয়ে বীরবাহা নিয়ে এলেন ঐতিহ্যবাহী ‘পানজি শাড়ি’। সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন জেলাশাসক জয়শী দাশগুপ্ত। শাড়ির উপর জড়িয়ে নিয়ে কোমর কষলেন মমতা। হাত ধরলেন বীরবাহা আর এক আদিবাসী রমণীর। বাদ্যযন্ত্রের বোলে পা মেলালেন দেশের ‘ফায়ার ব্র্যান্ড লেডি’। মোদি-শাহ, রাজনীতি, পেগাসাস, মসনদে হ্যাটট্রিক কোথায় কী! জঙ্গলমহলের সঙ্গে একাত্ম অগ্নিকন্যা, ৩০,বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের টালিচালার বাসিন্দা। অভাবনীয় সে দৃশ্য মুঠো ফোনে বন্দি করার হুড়োহুড়ি শুরু হল। চিত্র সাংবাদিকদের ক্যামেরারা শাটার যেন থামছিলই না।
কয়েক মিনিটের সেই বিহ্বলতা কাটিয়ে দশর্ক-শ্রোতার নজর ফের মমতার দিকে। বিশালাকার সেই ধামসার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী। হাততালিতে ছন্দ মেলাচ্ছিলেন। এবার সটান বাদ্যযন্ত্রীর কাছে। ধামসায় বোল উঠছিল যে দু’টো কাঠের টুকরোয়, চেয়ে নিলেন তা। ধামসা বাজাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার উচ্ছ্বাসের সিংহগর্জন, করতালির শব্দে কান পাতা দায়। ধীর পায়ে আরও একটু সামনে এগিয়ে গেলেন। এক শবর শিল্পীর কাছ থেকে চেয়ে নিলেন ঝুমঝুমি। কিছুক্ষণ বাজালেন সেটাও। বিশ্ব আদিবাসী দিবসে ভুমিপুত্র-কন্যাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে মুখ্যমন্ত্রী এবার সটান মঞ্চে। সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই নায়ক সিধো-কানহোর প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে মাইক্রোফোন হাতে মুখ্যমন্ত্রীর উদাত্ত আহ্বান—জয় জোহার। গলা মেলাল গোটা সভাস্থল।
বিশ্ব আদিবাসী দিবসের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে সংবর্ধিত হলেন জঙ্গলমহলের বিশিষ্ট সমাজকর্মী, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক, কৃতী পড়ুয়া আর লোকশিল্পীরা। মমতা ঘোষণা করলেন, আদিবাসীদের উপাসনাস্থল মাঝিথানগুলির জন্য পাট্টা দেওয়ার কাজ শুরু হচ্ছে। তার জন্য এরকম ১৭৬টি জায়গা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। মাঝিথানের পুজারীও পাবেন মাসিক এক হাজার টাকা ভাতা। অলচিকিতে পড়ানোর জন্য তৈরি হচ্ছে শতাধিক স্কুল। তেমনই ১১টি স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও অলচিকি হরফের বই পড়ানো হবে। একের পর এক ঘোষণায় স্টেডিয়ামে করতালির সমুদ্র গর্জন। মুখ্যমন্ত্রী যখন মঞ্চের নীচে লোকশিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় সারছিলেন, এক আদিবাসী যুবক আব্দার ছিল, একটি আবৃত্তি শোনাতে চান মুখ্যমন্ত্রীকে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে তাঁকে সে সুযোগ করে দেন মমতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ভারততীর্থ’ আবৃত্তি করে শোনান ওই যুবক। বাহবা পেয়েছেন সবার কাছ থেকে। আর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন—বাঘা বাঘা আবৃত্তিকারকে ঘোল খাইয়ে দেবেন জঙ্গলমহলের এই যুবক।
No comments