Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

অশ্লীল শিল্পীর অশ্লীল কথা’রানা চক্রবর্তী

অধুনা বাংলাদেশের ‘ময়মনসিংহ’র ‘গচিহাটা’র ‘মজুমদারবাড়ি’ কি এখনও আছে? এক সময় সেখানে ছিল সাত আট বিঘা জমি, বসতবাড়ি, ধানের গোলা। সেই ধানের গোলা ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই ছিল জল টল-টল করা একটা পুকুর। সেই পুকুরের পাশে ছিল বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যেই…

 






                                     

অধুনা বাংলাদেশের ‘ময়মনসিংহ’র ‘গচিহাটা’র ‘মজুমদারবাড়ি’ কি এখনও আছে? এক সময় সেখানে ছিল সাত আট বিঘা জমি, বসতবাড়ি, ধানের গোলা। সেই ধানের গোলা ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই ছিল জল টল-টল করা একটা পুকুর। সেই পুকুরের পাশে ছিল বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যেই সেগুলো দুলে উঠত হাওয়ায়। আবহে ভেসে আসত বাঁশের শিরশিরে পত্রালাপ। সকাল থেকে নিঝুম দুপুর জুড়ে এমনটাই চলত। এরই মাঝে গাছগাছালির আলোছায়ার আলপনা গায়ে মেখে বাড়ির বউ-মেয়েরা সেই পুকুরে স্নান সেরে ভিজে কাপড় জড়িয়েই ঘরে ফিরে যেতেন। এটা ছিল সে কালের গ্রাম-বাংলার রোজকার দৃশ্য। এমনকি আজও বাংলার অনেক গ্রামের দৃশ্য। তবু এ নিয়ে কেউ তো সেই ভাবে ছবি আঁকেননি। কিন্তু মজুমদারবাড়ির একমাত্র শিল্পী পুত্রের মাথায় এই বিষয়টা এসেছিল। তাই এক দিন তিনি সময় সুযোগ করে সেই পুকুরধারে তাঁর সদ্য-বিবাহিতা রূপসি স্ত্রী ‘সুধারানী’কে ভিজে কাপড়ে দাঁড় করিয়ে, বসিয়ে নানা বিভঙ্গে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলেছিলেন। উল্লেখ্য যে, তিনি তাঁর ছবি আঁকার প্রয়োজনে ফোটোগ্রাফের সাহায্য নিতেন। কিন্তু তিনি দস্তুর মতো জানতেন যে, ফোটোগ্রাফকে হুবহু ‘কপি’ করাটা কারিগরের কাজ। শিল্পীর নয়। তাই বোধহয় তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘এই পরিদৃশ্যমান জগতে যা দেখব যদি তাই আঁকি তবে তার কি প্রয়োজন?’’ সেই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে তিনি ‘বঙ্কিমচন্দ্রের’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছিলেন। সেই উপন্যাসের ‘রোহিণী’ চরিত্রটি তাঁর মনে সবিশেষ ছাপ ফেলেছিল। আর সেই ‘রোহিণী’ তাঁর বহু ছবিতেই পরবর্তীকালে সচেতন এবং অবচেতন ভাবে ঢুকে পড়েছিল। ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ ‘রোহিণী’ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ’’, সে বিধবা কিন্তু তাঁর ‘‘অধরে পানের রাগ, হাতে বালা, ফিতে পেড়ে ধুতি পরা, আর কাঁধের উপর চারু বিনির্মিতা কালভুজঙ্গিনীতুল্য কুণ্ডলীকৃতা লোলায়মানা কবরী।’’ সে ‘‘ঘাটে উঠিয়া আর্দ্র বস্ত্রে দেহ সুচারুরূপে সমাচ্ছাদিত করিয়া ধীরে ধীরে ঘরে প্রত্যাবর্তন করে’’ ইত্যাদি। একসময় মজুমদারবাড়ির পারিবারিক ফোটো অ্যালবামে ‘মালতী’ লেখা একটি ছবি ছিল। সেই ছবিটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও মজুমদারবাড়ির লোকেদের কোনদিনই চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি যে ছবির সেই সদ্যস্নাতা ‘তন্ময়’ মুখটি ‘মালতী’রই। কিন্তু কে ছিলেন সেই ‘মালতী’ দেবী? চিত্র গবেষকরা পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন যে, তিনি ছিলেন শিল্পীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে, তা হলে ‘সুধারানী’ দেবী কোথায় সেই ছবিতে? সেখানেই ব্যবহার করা হয়েছিল কৌশল। ফোটোশপের কায়দায় শিল্পী তাঁর যুবতী স্ত্রী ‘সুধারানী’র দেহবল্লরিতে ‘মালতী’র লাবণ্যময়ী মুখ জুড়ে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর মানসপ্রতিমা। এর পরেও সেই একই কৌশল ব্যবহার করে বহু ছবি এঁকেছিলেন তিনি। বস্তুতঃ কোনও বিষয়কে চিত্রায়িত করার জন্য তিনি তাঁর ক্যামেরায় তোলা ছবি এবং মডেলকে সামনে রেখে করা ‘লাইফ ড্রয়িং’এর সাহায্য নিতেন ‘রেফারেন্স’ হিসাবে। তিনি তাঁর সাহিত্যপাঠ, জীবনের প্রাত্যহিকতা আর কল্পনাকে একত্রিত করে অবিসংবাদিত নৈপুণ্যে গড়ে তুলেছিলেন সদ্যস্নাতা যুবতীদের সেই সব ‘চিত্র’। শরীর আর মন নিয়ে এক সূক্ষ্ম খেলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর ছবির দর্শকদের। তাঁর তোলা ফটোগ্রাফে সাদা শাড়ি, নবনী-লাঞ্ছিত উজ্জ্বল ত্বক সংলগ্ন হয়ে যে ভাবে যৌবনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করে, ঠিক একই ভাবে, তাঁর ক্যানভাসে চিত্রিত মহিলাটি, তাঁর সামগ্রিক শারীরিক উপস্থিতি সত্ত্বেও, দর্শকদের থেকে আড়াল রচনা করে নেয়। কাঁখে ধরা কলসি থেকে জল পড়ে চলে, আর চার দিকের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রুক্ষেপহীন সদ্যস্নাতা তার চিন্তার গভীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। এ এক ‘আছি’ আর ‘নেই’-এর খেলা। যে নেই তাকে খোঁজো, যা নেই তাকে ভেবে নাও। এই ভেবে নেওয়া থেকেই তাঁর চিত্রিত কাপড়ের আর্দ্রতা যৌনতার চেতনা উদ্রেক করে, কিন্তু একই সঙ্গে সদ্যস্নাতারা দর্শকদের থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন গোপন ক্যামেরায় তোলা ‘ভয়ারিস্টিক’ (voyeuristic) ছবির মতো হয়ে ওঠে। ফলতঃ বহু ক্ষেত্রেই সেই সব ছবির দর্শকরা আজও এক অপরাধবোধে আক্রান্ত হন। এই সমস্ত কারণেই এই শিল্পীর ভিজে কাপড়ের ছবি চির কাল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে। ময়মনসিংহের গচিহাটার ছেলেটি এন্ট্রান্স পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী হবে বলে। সরকারি আর্ট স্কুলে পড়তে পড়তে আবার বিরোধে জড়িয়ে পরেছিলেন। সেই সময়, ইংল্যাণ্ডেশ্বর পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষে কলকাতা শহর সাজাতে নবীন ছাত্রদের সামান্য পয়সা দিয়ে নিয়োগের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে নেমেছিলেন এই শিল্পী ও আরও ক’জন। আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল ‘পার্সি ব্রাউন’ সঙ্গে সঙ্গে নাম কেটে দিয়েছিলেন ধর্মঘটীদের। এরপরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ‘রণদাপ্রসাদ গুপ্ত’র ‘জুবিলি আর্ট অ্যাকাডেমি’তে, তবে সেখানে তাঁর মন ভরেনি। ‘অবনীন্দ্র-শিল্পধারা’ তাঁর অন্বিষ্ট ছিল না, পশ্চিমী অ্যাকাডেমিক রীতিতে দক্ষ হতে চাইছিলেন তিনি, বিশেষ করে মানবদেহ অঙ্কনে। শেষে স্বশিক্ষাই তাঁকে পৌঁছে দিতে পেরেছিল চূড়ান্ত সাফল্যে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ‘বেঙ্গল স্কুলের’ শিল্পীদের রমরমার দিনে সর্বভারতীয় স্তরে এই শিল্পী যে সম্মান অর্জন করেছিলেন, সে কথা আজ বিস্মৃতির আড়ালে। একের পর এক সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে সেরার পুরস্কার, ‘পাটিয়ালার রাজশিল্পী’র মর্যাদার পাশাপাশি ‘কাশ্মীর’, ‘বিকানির’, ‘জয়পুর’, ‘যোধপুর’, ‘ঢোলপুর’, ‘ময়ূরভঞ্জের’ রাজাদের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। ছবি আঁকার সঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব আর্ট’ প্রতিষ্ঠা, সেই প্রতিষ্ঠানের পত্রিকা প্রকাশ, ‘শিল্পী’ পত্রিকা, ‘ইন্ডিয়ান মাস্টার্স’ শিল্পগ্রন্থমালা বাঙালির শিল্পচর্চায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান লক্ষ্যনীয়। আজ সকলের বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া সেই শিল্পীর নাম ‘হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার’।

হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের জন্ম হয়েছিল ১৮৯৪ সালে। পৃথিবী কাঁপানো শিল্পী ‘ভ্যান গঘ’ মারা গিয়েছিলেন তাঁর জন্মের আট বছর আগে। তাঁর জন্মের সময় ভারত বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ‘রাজা রবি ভার্মা’ তখন নিজের শিল্পসৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন আর পরবর্তী সময়ের চিত্রশিল্পী ‘অমৃতা শেরগিল’ তখনও জন্মগ্রহণ করেননি। এসব হিসাব থেকে দেখা যায়, হেমেনের জন্মটা হয়েছিল এক সন্ধিক্ষণে। তখন পশ্চিমে আধুনিক রীতির চিত্রশিল্পীরা তুমুল কাজ করছিলেন আর ভারতে ‘রবি ভার্মা’র হাত ধরে পাশ্চাত্য চিত্রশৈলীর প্রবেশ ঘটেছিল। কিন্তু ‘রবি’র বিষয়বস্তু একেবারে ভারতীয়ই ছিল। তাঁর তুলিতে ভারতের নারী, দেবী, পুরাণের কাহিনী নতুন আঙ্গিকে ধরা দিয়েছিল। ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই শিল্পকলার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নিরাবরণ নারীদেহ। ‘রবি ভার্মা’র কাজে তাই শাড়ির পেছনে নারীর সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ততদিনে ভারতে হাজির হয়ে গিয়েছিল ‘ভিক্টোরিয়ান মোরালিটি’। সেই শৈলীতে নারীদের নানা রূপে আঁকা হলেও তাঁদের শরীরে মোটা, লম্বা পোশাক জুটেছিল। নগ্ন শরীর একেবারে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিল। ১৮৯৬ সালের ৬ই জুলাই ‘ই বি হ্যাভেল’ কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি স্বদেশী চেতনার উন্মেষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলায় চিত্রশিক্ষার মডেল তৈরি করেছিলেন। তাঁর পাশে ছিলেন ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। কিন্তু পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্পের যে বিপুল, দিগন্ত বিস্তৃত বিকাশ, সেটাকে তাঁরা গ্রাহ্যে না নেয়ায় আর্ট স্কুলের অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। পাশ্চাত্য রীতি-কৌশলকে এড়িয়ে শুধু ভারতীয় শিল্পচর্চা, সেটাও আবার ‘ভিক্টোরীয় মোরালিটি’র ছায়ায় - এমন পরিস্থিতিকে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলেরই কিছু ছাত্র মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা বলেছিলেন, পাশ্চাত্যের শিল্পকলা যে উচ্চতায় উঠেছে, সেটার স্পর্শ ছাড়া ভারতে চিত্রচর্চা অর্থহীন। সেই বিরোধের ফলাফল হিসেবে ১৮৯৭ সালে কলকাতায় আরেকটি ‘আর্ট স্কুল’ জন্ম নিয়েছিল - ‘জুবিলি আর্ট একাডেমি’। সেই ধারার নেতৃত্বে ছিলেন ‘রণদাপ্রসাদ গুপ্ত’। চিত্রকলা নিয়ে দুই মতধারার সেই বিরোধের কালেই জন্মেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ। হেমেন্দ্রনাথ, অধুনা বাংলাদেশের ‘কিশোরগঞ্জ’ জেলার ‘গচিহাটা’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ‘দুর্গানাথ মজুমদার’ ‘ময়মনসিংহের আঠারবাড়ি এস্টেটের’ কর্মচারী ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল হেমেনের। কিন্তু সেই ঝোঁককে তাঁর পরিবার কখনও ইতিবাচক চোখে দেখেনি। একটা সময়ে পরিবারের সঙ্গে সেটা নিয়ে তাঁর ঝামেলা বেড়ে গিয়েছিল। হেমেন যখন ‘ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে’র দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বাড়ি ছাড়ার। কারণ ততদিনে শিল্পী হওয়াই হয়ে উঠেছিল তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। তাই তিনি ‘গচিহাটার মজুমদার বাড়ি’ ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় এসে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে তিনি উঠেছিলেন ‘অখিল মিস্ত্রি লেনে’ তাঁর দিদি ‘হৈমলতা’র বাড়িতে। হেমেনের জামাইবাবু ‘রমেশ সোম’ ছিলেন সমঝদার মানুষ, তিনি হেমের শিল্পী হওয়ার আগ্রহটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি হেমেন্দ্রনাথকে ‘অবনীন্দ্রনাথের’ ‘গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে’ ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৯১০ সালের ঘটনা। কিন্তু সেই সরকারি আর্ট স্কুলে দ্রুতই হেমেন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে স্বাধীন শিল্পচর্চা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সেখানে তিনি ইচ্ছামতো তুলি চালাতে পারতেন না। শিল্পী হতে গিয়ে যিনি স্কুলজীবনেই বাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন, সেই স্বাধীন আর ক্ষুব্ধ আত্মার পক্ষে তো সেই বিধিনিষেধ মেনে নেওয়া কখনোই সম্ভব ছিল না। তখনই ১৯১১ সালে দিল্লি দরবার উপলক্ষে আসা পঞ্চম জর্জের সম্মানে সামান্য পারিশ্রমিকে নবীন চিত্রশিল্পীদের ব্যবহারের ঘটনাটি ও সেটা নিয়ে বিক্ষোভের ঘটনাটি ঘটেছিল। ফলে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে তাঁর নাম কাটা যেতে বিশেষ দেরি হয়নি। এর অনেক পরে ‘ভারতীয় চিত্র’ শিরোনামের নিবন্ধে হেমেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “প্রাচীন চিত্র বা মূর্তি দেখিলে তাহাতে ‘ভারতীয় পদ্ধতি’ বলিয়া সনাতন কোনো লক্ষণ বা প্রকাশভঙ্গি ছিল না ...।” তারপরে ‘ভারতীয় কলা’ নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “সর্বাপেক্ষা মিথ্যা ও হাস্যকর ব্যাপার - এই ‘ভারতীয় পদ্ধতি’ শব্দটি। যিনি সর্বপ্রথম এই শব্দটি উচ্চারণ করিয়াছিলেন, তাঁহার মধ্যে সত্বুদ্ধির একান্ত অভাব ছিল। আরো আশ্চর্যের বিষয় এমন অসার কথা দেশের গাত্রে বিলক্ষণ দাগ কাটিয়াছে।” ‘ভারতীয় কলা’ নিবন্ধে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার স্পষ্টতঃ দুটি বক্তব্য রেখেছিলেন। প্রথমতঃ, ‘আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল’ এবং ‘অবনীন্দ্রনাথের’ ‘নব্যভারতীয় শিল্পকলা’; যা ‘গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে’ শেখানো হতো সেটা ছিল ‘অসার’। দ্বিতীয়তঃ, যে কথাটা তিনি স্বীকার করেছিলেন সেটা ছিল, ‘নব্যভারতীয় শিল্পকলা’র যথেষ্ট প্রভাব ছিল তাঁর সমকালীন সময়ে। গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের সেই ‘বদ্ধ কুয়োর ব্যাঙ’ হওয়া হেমেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তাঁর প্রিয় বন্ধু চিত্রশিল্পী ‘অতুল বসু’র পরামর্শে তিনি ‘রণদাপ্রসাদ গুপ্ত’র ‘জুবিলি আর্ট একাডেমিতে’ ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার জুবিলি একাডেমিতে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য শোনা যায় যে আদতে ‘জুবিলি একডেমি’তে হেমেন শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিন বছর। সেখান থেকে পাশ করার পরে হেমেন ও অতুল ছোটখাটো কাজ করে জীবিকা ধারণ করতে শুরু করেছিলেন। সেসব কাজের মধ্যে ছিল থিয়েটারের জন্য চিত্রকর্ম আঁকা, পরিবারের মৃত সদস্যদের ছবি থেকে প্রতিকৃতি এঁকে দেওয়া ইত্যাদি। ১৯১৯ সালে হেমেন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু চিত্রশিল্পী ‘অতুল বসু’, ‘যামিনী রায়’ ও ‘ভবানীচরণ লাহা’কে নিয়ে কলকাতার ‘বিডন স্ট্রিটে’ চালু করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট’ নামের একটি চারুকলা প্রতিষ্ঠান। ১৯২০ সালে সেই প্রতিষ্ঠানের ‘ত্রৈমাসিক জার্নাল’ ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট’ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, শিল্পকে কেবলমাত্র ধনীদের অধিকার থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসা। সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণকারী শিল্পীদের কাজ নিয়ে তাঁরা প্রদর্শনীরও আয়োজন করতেন। ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্টের’ পাঠক বৃদ্ধিতে তাঁরা নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই পত্রিকাটি সাদামাটা কাগজে ছাপা হলেও সেটির নকশায় থাকত আকর্ষণীয় সব আয়োজন। তাতে শিল্প সমালোচনামূলক প্রবন্ধের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খবর, গসিপ, ভ্রমণবৃত্তান্ত, ছোটগল্প, কৌতুকসহ নানা ধরনের লেখা প্রকাশিত হতো। সেই জার্নালের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ‘হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার’, ‘অতুল বসু’ ও ‘যামিনী রায়ের’ চিত্রকর্ম প্রকাশ। ওই পত্রিকায় তাঁদের পুরস্কারজয়ী চিত্রগুলো ‘কালার প্লেটে’ ছাপা হতো। সেই জার্নালেই হেমেনের প্রথম আলোচিত ছবি ‘পল্লী প্রাণ’ প্রকাশিত হয়। এ ‘পল্লী প্রাণ’-এ আজও দেখা যায় জলসিক্ত শাড়ি পরিহিত এক পল্লী নারীকে। সেই ভেজা শাড়িতে নারীকে উপস্থাপনাই হেমেনকে স্বতন্ত্র পরিচয় করে দিয়েছিল। তবে ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট’ জার্নালটি অর্থাভাবে একসময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অমন পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ ও রঙিন ছবিতে পূর্ণ চিত্রশিল্পের কোন পত্রিকা সম্ভবতঃ ভারতে সেটির আগে আর প্রকাশিত হয়নি। এরপর তাঁরা তৈরি করেছিলেন ‘সোসাইটি অব ফাইন আর্টস’, সেটি বেশ সাফল্যের মুখ দেখেছিল। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, সেই সময়টা ছিল ‘স্বদেশী যুগ’, বাংলার শিল্পকলার স্থানীয় ঘরানারই তখন একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। সেটাই ছিল ভারতের প্রথম ‘জাতীয়তাবাদী শিল্প আন্দোলন’। ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এবং তাঁর শিষ্যরা বিভিন্ন শৈল্পিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদ থেকে ‘একাডেমিক’ বা ‘পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণকারীদের’ বিতাড়িত করেছিলেন। তখন ‘পাশ্চাত্য রীতি’ এবং ‘প্রাচ্য রীতি’র দ্বন্দ্ব গুরুতর আকার ধারণ করেছিল। ‘প্রাচ্য রীতি’র বাহকদের মূল কেন্দ্র ছিল ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’, যেটা পরিচালনা করতেন ‘অবনীন্দ্রনাথ’ ও ‘গগনেন্দ্রনাথ’। তাঁরা প্রতিষ্ঠানটির ওপর নিজেদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন এবং সেখান থেকে ‘পাশ্চাত্যপন্থী’ শিল্পীদের তাঁরা বের করে দিয়েছিলেন। লক্ষ্য করার বিষয় হল, ‘অবনীন্দ্রনাথের’ মতো প্রভাবশালী শিল্পীর সামনে থেকেও হেমেন তাঁকে দিয়ে প্রভাবিত না হয়ে স্বতন্ত্র যাত্রাপথ বেছে নিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ‘পাশ্চাত্যপন্থী’ শিল্পীরা কলকাতায় তাঁদের কোন প্রদর্শনী করতে পারছিলেন না, তাই তাঁরা তাঁদের কাজ বাংলার বাইরে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছিলেন। কিন্তু অনেক শিল্পীর আবার সে সামর্থ্য ছিল না। তাই ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের’ আধিপত্যকে খর্ব করতে জন্ম হয়েছিল ‘সোসাইটি অব ফাইন আর্টসের’। সেই সোসাইটি ১৯২১-২২ সালে নিজেদের প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল এবং সেটা ছিল এক বিরাট আয়োজন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘পাশ্চাত্য রীতি’ চর্চাকারী শিল্পীদের এক হাজারের বেশি চিত্রকর্ম নিয়ে কলকাতায় একটা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল।                               

১৯২৪ সালে ‘অতুল বসু’ স্থায়ীভাবে ইংল্যাণ্ডে চলে গেলে হেমেনদের দলটি ভেঙে গিয়েছিল। বিদ্রোহ আর ‘অ্যাক্টিভিজমের’ পরে সেবার হেমেনের পেশাদার শিল্পীজীবন শুরু হয়েছিল। নারীকে কেন্দ্রে রেখে তিনি তাঁর চিত্রকর্মগুলো তৈরি করতে থাকেন। তাতে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় নারীর অবসর এবং তাঁর মনের বিভিন্ন অবস্থা। ‘দিবাস্বপ্নে’ মগ্ন নারীকে নিয়ে তিনি এঁকেছিলেন তাঁর ‘রোজ অর থর্ন’। আজও সেই ছবিটির দিকে একবার তাকালেই হেমেনের দক্ষতা দৃষ্টিগোচর হয়। সেই ছবিতে ভঙ্গির নয়, বরং ভাবের খেলা দেখা যায়। আর ভঙ্গির চেয়ে ভাবকে ফুটিয়ে তোলা যে কঠিন, সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! ছবিতে সিল্ক পরিহিতা নারীর পেছনে থাকা গোলাপ প্রেমের আনন্দ-বেদনাকে প্রকাশ করে। সেই ছবিটি ১৯৩৬ সালে কলকাতায় প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল। এরপরে ১৯৫২ সালে ‘ক্যালিফোর্নিয়া’য় অনুষ্ঠিত দুনিয়ার সেরা সুন্দরীদের পোর্ট্রেট নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে ছবিটি ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল। হেমেনের আঁকা নারীর শরীরে যৌনতার আভাস আছে। ভেজা শাড়ির ওপর ফুটে ওঠা নারীর শরীরের ভাঁজ, বাঁক, পেশি, হাড় - মুগ্ধ নয়নে যেকোনো পুরুষই আজও দেখেন, এমনকি অনেক নারীও হয়ত নিশ্চিতভাবে সেই ছবিগুলোর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না। তবে এখানে আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় আছে। সেটা হল, হেমেনের আঁকা নারীরা কেউই কিন্তু ষোড়শী বা অষ্টাদশী উদ্ভিন্নযৌবনা নন; বরং তাঁরা বেশ প্রাপ্তবয়স্কা এবং মনে হয় বিবাহিতা। হেমেনের আঁকা ‘দ্য উন্ডেড ভ্যানিটি’, ‘ব্লু সারি’, ‘হারমোনি ও ইমেজ’ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। হেমেন নারীর শরীর ও নগ্নতাকে প্রাধ্যান্য দিয়ে আঁকলেও তাঁর কোন ছবিতে নারীকে পূর্ণ নগ্ন চেহারায় দেখা যায় না। তবে তাঁর ছবিতে নারীর গায়ের কাপড় যেন আবরণের চেয়ে প্রকাশেই বেশি সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গে ‘উজ্জ্বলকুমার মজুমদার’ লিখেছিলেন, ‘‘দেহের যে অংশে বসন লেগে আছে এবং যে অংশে বসন লেগে নেই তার মধ্যে রংয়ের শেড এর সূক্ষ্ম তারতম্য এনে যৌবন-লাবণ্যের আভাস দেওয়াতে তাঁর (হেমেন) জুড়ি ছিল না।’’ হেমেন মজুমদার পরপর তিন বছর শিল্প জগতের আভিজাত্যের প্রতীক ‘বোম্বে আর্ট সোসাইটি’ থেকে তিনটি পুরস্কার জিতেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে ১৯২১ সালে ‘স্মৃতি’ শিরোনামের চিত্রকর্মটির জন্য তাঁকে ‘স্বর্ণপদক’ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ১৯২২ সালে ‘বর্ণঝঙ্কার’ এবং ১৯২৩ সালে ‘কর্দমে কমল’ ছবির জন্য হেমেন ‘বোম্বে আর্ট সোসাইটি’ থেকে পুরস্কার জিতেছিলেন। হেমেনের সেই পদকপ্রাপ্তির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় ‘বোম্বে ক্রোনিকাল’ সংবাদপত্রের সাংবাদিক ‘কানহাইয়ালাল ওয়াকিল’ লিখেছিলেন, ‘‘কলকাতার এক হেমেন মজুমদার প্রদর্শনীতে তিনবার প্রথম পুরস্কার জিতেছেন। এটা বোম্বের শিল্পীদের জন্য মর্যাদাহানিকর ... হয় এই জুরি বোর্ড অযোগ্য নয়তো প্রদর্শনীর জন্য জনাব মজুমদার বেশি যোগ্য।’’ সেই পুরস্কারগুলো জেতার পরে স্বাভাবিকভাবেই হেমেনের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলায় বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর আঁকা ছবি ছাপা হতে শুরু করেছিল। ‘বোম্বে’, ‘মাদ্রাজ’, ‘সিমলা’, ‘দিল্লি’সহ আরো অনেক শহর থেকে হেমেনের ছবি প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়েছিল। অনেক বিখ্যাত মানুষ সেই সময় হেমেন্দ্রনাথের ছবি কিনতে শুরু করেছিলেন। জানা যায় যে, ‘ময়ূরভঞ্জের মহারাজা’ ‘পূর্ণচন্দ্র’, দুই বছরে হেমেনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকার ছবি কিনেছিলেন। ১৯২৬ সালে হেমেন মজুমদার তাঁর জীবনের প্রথম আর্থিক সাফল্য পেয়েছিলেন। একটি কমার্শিয়াল ফার্ম বেশ ভালো মূল্য দিয়ে তাঁর একটি ছবির ‘রিপ্রডাকশন রাইটস’ কিনে নিয়েছিল। সেই কোম্পানিটির বার্ষিক ক্যালেন্ডারের অন্যতম আকর্ষণ ছিল হেমেনের আঁকা ছবিটি।

হেমেন ‘স্বল্পবসনা নারী’র চিত্র আঁকিয়ে শিল্পী হিসেবে একই সঙ্গে খ্যাতি ও কুখ্যাতি - দুটোই অর্জন করেছিলেন। হেমেনের চিত্রকর্ম ‘জয়পুর’, ‘বিকানির’, ‘কোটাহ’, ‘কাশ্মীর’, ‘কোচবিহার’, ‘ময়ূরভঞ্জ’, ‘পাতিয়ালা’ এবং অন্যান্য দেশীয় রাজাদের আকর্ষণ করেছিল। তাঁদের মধ্যে ‘পাতিয়ালার মহারাজা’ ‘স্যার ভূপিন্দ্রনাথ সিং’ (১৮৯১-১৯৩৮) ছিলেন সবচেয়ে নিবেদিত। ‘কাশ্মীরের মহারাজা’ ১৯৩১ সালে হেমেনকে ছবি আঁকার জন্য তাঁর দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ‘পাতিয়ালার মহারাজা’ ‘স্যার ভূপিন্দ্রনাথ সিং’ পাঁচ বছরের জন্য মোটা বেতনে হেমেনকে ‘রাজচিত্রকর’ হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি কলকাতায় নিজের একটি স্টুডিও খুলেছিলেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এছাড়া হেমেন মজুমদার কী অর্জন করেছিলেন? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক ‘রানা মিত্র’র লেখা থেকে - ‘‘হেমেন বাঙালি সৌন্দর্যের প্রকার তৈরি করেছিলেন, যা সেকালের বাঙালি জনতাকে সেগুলোর পরিচিত ভাব ও অকপটতার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ছবিগুলো আর্ট স্কুল থেকে পড়ে আসা কোন শিল্পীর আঁকা নৈর্ব্যক্তিক ছবি ছিল না, বরং ছিল অনুভবযোগ্য, শ্বাস নেওয়া জীবন্ত নারী। ভারতীয় শিল্পে নারীচিত্রের ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। কোনমতে গায়ে ফেলে রাখা লাস্যময়ী অপ্সরা, ইয়াকশি থেকে ভারতীয় মন্দিরে দেবী মূর্তি। মন্দিরগাত্রে যৌনকর্মেরও প্রচুর ভাস্কর্য আছে। এসব অকপট দৃশ্য-ভাস্কর্য প্রাচীন সময়ের সাধারণ স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি হয়েছিল, পঞ্চম শতকের কবি কালিদাসের কবিতা-নাটকেও এমন অবাধ দৃশ্যের হাজিরা পাওয়া যায়। হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনের অবসানে শিল্পকলায় নারীর উপস্থাপনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হাজির হয়। মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে ‘অভিজাত/সম্মানিত’ নারী বিবসনা হয়ে আর সামাজিক পরিসরে হাজির হতে পারলেন না। কিন্তু কৃষক সমাজে এই সংস্কৃতির বাধা ছিল না। আবার কেরালার নায়ার সমাজের অভিজাতদের ওপরও এসব নিষেধাজ্ঞার কোন প্রভাব ছিল না, তাঁরা বিশ শতকের শেষভাগেও উন্মুক্ত বক্ষে চলাফেরা করতেন। তুর্কি-আফগান থেকে মোগল আমলে মিনিয়েচার চিত্রকর্মে নগ্ন নারীর দেখা পাওয়া যেত না বললেই চলে। শুধু ব্যতিক্রম ছিল রাজস্থান ও পাহাড়ি মিনিয়েচার। এরপরে পরিস্থিতি একেবারে বদলে যায় ব্রিটিশ রাজের শাসনামলে। উনিশ শতকে খ্রিস্টান মিশনারীরা তাদের বিবেচনায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন অনৈতিক বিষয়ের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা শুরু করে। ভিক্টোরীয় এভানজেলিজমের প্রভাবে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা পোশাক, আচরণের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতাবাদী মনোভাবে গ্রহণ করে - নারীর সজ্জায় যুক্ত হয় ব্লাউজ, পেটিকোট। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পকলায় দেহের উপস্থাপনা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়। ইংরেজরা হিন্দু মন্দিরের নগ্ন ভস্কর্যকে অনুমোদন না করলেও ভিক্টোরিয়ান অ্যাকাডেমিক ন্যুড আর্টকে সম্মান জানাত। ... শাসকরা শালীনতার নতুন ধারণাকে চাপিয়ে দিলেন। শালীনতা বজায় রেখে শরীরের কতটা প্রদর্শন করা যাবে তা নির্দিষ্ট করা হল। পাশ্চাত্য রীতিতে কাজ করা ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী হলেন রাজা রবি ভার্মা (১৮৪৮-১৯০৬)। তিনি নারীর সৌন্দর্য প্রকাশে একটি নতুন ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে নগ্নতা ছিল একেবারেই দুর্লভ। এদিকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে (১৮৭১-১৯৫১) বেঙ্গল স্কুল অব পেইন্টিং ফিগার ড্রইংকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। হেমেন তাঁর আঁকার বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গোসল শেষে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরতে থাকা পল্লী গাঁয়ের কুমারীকে। এতে তিনি ভেজা পোশাকের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠা নারীর শরীরকে উপস্থাপনার সুযোগ পান। অবশ্য হেমেন এসব কাজ করেছিলেন স্টুডিওতে বসে। এজন্য তিনি আলোকচিত্রের সহায়তা নিতেন। এভাবে তিনি ভারতে ফিগার পেইন্টিং এর একটি নতুন রীতি উদ্ভাবন করেন - আধা স্বচ্ছ কাপড়ের ওপর ফুটে ওঠা আবেদনময় মাংসল শরীরের রেখা। রাজা রবি ভার্মার ভাই রাজা ভার্মা এ বিষয়ে প্রথম কিছু কাজ করেছিলেন কিন্তু সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি কিংবা পরবর্তী শিল্পীরা তাঁকে আর অনুসরণ করেননি। এদিকে হেমেন একটি স্বতন্ত্র রীতি তৈরি করেছিলেন এবং তার কিছু অনুসরণকারীও সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। হেমেনকে অনুসরণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাঞ্জাবের ঠাকুর সিং। হেমেন উজ্জ্বল রংয়ের অভিজাত বাঙালি নারীর যৌন আবেদনকে ক্যানভাসে তুলতে আগ্রহী ছিলেন। খুব সম্ভবত তার আঁকা বিভিন্ন নারীচিত্রের প্রেরণা ছিলেন তার স্ত্রী, তবে ছবির মডেলে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে তেমন সাদৃশ্য রাখেননি।’’ হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে তাঁর হাতে লেখা কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো ‘ছবির চশমা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। নামটি তিনি নিজেই লিখে রেখেছিলেন। সেসব লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে হেমেন লিখেছিলেন - ‘‘দুনিয়ার সব বিদ্যারই পরীক্ষা আছে। জহুরী জহর চিনিতে পারে - কাঁচ ও কষ্টিপাথরের সাহায্যে, বিজ্ঞানের দান - অশেষ পরীক্ষারই ফল, সঙ্গীতের পরীক্ষক - নিপুণ শ্রবণেন্দ্রিয়, আর কলাবিদ্যার পরীক্ষক - অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি। দৃষ্টিহীনতায় চশমার ব্যবহার আবশ্যক, তাই ছবির চশমার সৃষ্টি।’’ মানবজীবন-সমাজে শিল্পের গুরুত্ব, অবস্থান নিয়ে হেমেন্দ্রনাথ আলোচনা করেছিলেন। ছবি আঁকায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন তেল রঙ, যা তৎকালের ভারতীয় শিল্পীদের কাছে পাশ্চাত্য রীতি বলে অচ্ছুত ছিল। হেমেনের কথায়, ‘‘... ‘ভারতীয় পদ্ধতি’র দল বলবেন, তৈলচিত্রটা বৈদেশিক সম্ভার, তাহাতে আলেখ্য নির্মিত হইলে তাহা খাঁটি ভারতীয় হয় না ইত্যাদি ... এসব অপযুক্তির কোন মূল্য নাই। ... আমাদের ‘ভারতীয় পদ্ধতিওয়ালাগণ’ বক্তৃতার সময় গোঁড়ামির চরমে যান, কিন্তু পরিধানে সেই মিলের বস্ত্র - মুখে ‘কেপসেটন’ সিগারেট ও বাহনটি হাওয়াগাড়ি। ... অতীত গৌরবের দৃষ্টান্ত যে জাত মুহুর্মুহু দেয় আর বর্তমানে যে পঙ্গু সাজিয়া অজ্ঞতার আড়ালে মুখ লুকাইয়া বসিয়া থাকে; নিজে অক্ষম, দেশের অন্যান্যেরা যদি কিছু আশার আলো আনে তবে সে আলো বৈদেশিক তাহা সনাতন নয়, তাহা রীতিবিরুদ্ধ ইত্যাদি বলিয়া সে আলোকে ফিরাইয়া দিতে বলে তাঁহারা ভণ্ড - তাঁহারা মূর্খ। তাহারা অন্তরে ঠিক জানেন তৈলচিত্র অতি উচ্চাঙ্গের জিনিস।’’ আগেই আলোচনা হয়েছে যে, কীভাবে ‘অবনীন্দ্রনাথের’ মতো প্রভাবশালী মানুষ এবং স্থানীয় রীতির আধিপত্যের সঙ্গে হেমেনকে লড়তে হয়েছিল। খুব সম্ভবতঃ ঔপনিবেশিক শাসনে পাশ্চাত্যের চিন্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার যে দর্শন, সেটা হেমেনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। স্বদেশী রীতি মানতেই হবে - এমন কোনো সংস্কারে তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন না। শিল্পীর স্বাধীনতাকেই হেমেন সবার আগে স্থান দিয়েছিলেন - ‘‘শিল্পী বা কবির কল্পনা যেমন তাহার স্বাধীন চিন্তার ফল তেমনি সেই কল্পনাকে রূপদান করিবার প্রণালী বা পদ্ধতিও তাহার নিজস্ব নৈপুণ্য। বলা বাহুল্য, নানা মুনির নানা মতের ন্যায় প্রত্যেক শিল্পীর অঙ্কন পদ্ধতি অপর যে কেহ অপেক্ষা ভিন্ন। লক্ষ শিল্পীর লক্ষ পদ্ধতি। কবির কাব্যসৃষ্টি যদি হুকুমের অপেক্ষা রাখে তবে সে কাব্য পড়িবার পূর্বেই অপাঠ্য। তেমনি শিল্পী যদি তাহার শিল্প-নির্মাণ-কার্যে আদেশের অধীন হয় তবে সে চিত্র অঙ্কিত না হইলে ক্ষতি কী?’’ তৎকালীন সমাজে চিত্রকর্মের এবং শিল্পীর কদর কেমনতর অবস্থায় ছিল তা পাওয়া যায় হেমেনের লেখায়। নিজেদের দোষগুলোকে হেমেন ক্ষমাহীন বাক্যে উদোম করে দিয়ে লিখেছিলেন - ‘‘আমরা ইংরেজের সঙ্গে মিশিয়া তার সদগুণ যে পরিমাণ গ্রহণ করি কুগুণ সংগ্রহ করি তার দশ গুণ। গরীব হইয়াও আমরা ভাল খেতে না পাইলেও ইংরাজী সভ্যতায় মোটরগাড়ি চড়াটা নকল করিয়াছি। কিন্তু সাহেবের ধৈর্য সাহস ও স্বধর্মপ্রীতি শিখিলাম কৈ? এইখানেই রুচির ও সভ্যতার পরীক্ষা। চিত্রপ্রীতির কথা বলিলেই দেশের সকলে একবাক্যে বলিবে - ‘অতি গরীব  দেশ - ছবি কিনিবার পয়সা কোথায়?’ কিন্তু যে ব্যক্তির ঘোড়ার গাড়ি চড়াও কর্তব্য নয় তিনি কিনিবেন চার হাজার টাকার মোটরকার! অথচ একশত টাকায় এখানে চিত্র কিনিতে উপরের ঐ যুক্তি প্রদর্শন।’’ তিনি ছবি আঁকার কার্য প্রকারণে আলোড়ন তুলেছিলেন শাস্ত্রবিরোধিতায়। জলরঙ নয়, তাঁর ছবি আঁকার মাধ্যম ছিল তেলরঙ। পশ্চিম ইউরোপের ‘ইমপ্রেসনিস্ট’ শিল্পীদের মতো বড়ো ক্যানভাসে তিনি তেলরঙের পৌরুষ দেখিয়েছিলেন। নিসর্গচিত্র নয়। তাঁর বিষয় ছিল মানুষ। মানুষের মুড। মানুষের ভঙ্গিমার কাব্যময়তা। হেমেন্দ্রনাথের কাজের সেই পরিধি কলকাতায় সে সময় বলার মতো একটা ঘটনা ছিল। কারণ তাঁর ছবিতে কোথায় জলরঙ? কোথায় নিসর্গ চিত্র? কিংবা ধর্মীয় শিল্পবোধ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সমসাময়িক ছবির জগতে তাঁকে এক বৈপ্লবিক সংঘর্ষের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। বস্তুতঃ তখনকার দিনে মডেলহীন, উপকরণহীন চিত্রচর্চার কালে দেবদেবীর ছবি আর পাহাড়, নদীর ছবি ছাড়া মানুষ আঁকবেনই বা কী? আর যদি পোর্ট্রেট আঁকতেই হয়, তবে দেশনেতার ছবি কিংবা পরিবারের লোকজনদের ছবি আঁকাই তো ভারতীয়তা? এই ছিল সেদিনের স্বাভাবিক প্রবণতা। আর তার কারণও ছিল বিস্তর। বাংলার চিত্রশিল্প, সাহিত্যে তখন লেগেছিল ইংরাজি ধরণ। ‘ভিক্টোরীয়ান মূল্যবোধ’। বঙ্গীয় সাহিত্যে ‘বায়রন’, ‘শেলি’দের উক্তি। এমনকি ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে ‘বঙ্কিম’ নিজেও শেষ বাক্যে এসে ‘ভিক্টোরীয়ান মূল্যবোধ’-এর শিকার হয়েছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি’ আর ‘শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন’, ‘গুস্তভ ফ্লবেয়রের মাদাম বেভারী’ কিংবা ‘ভলতেয়রের ক্যান্ডিট’ হতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর চিত্রকলায় ১৯০৫ সালে ‘অবনীন্দ্রনাথের’ হাতে সৃষ্ট হয়েছিল ‘ভারতমাতা’। ‘বঙ্কিমের বন্দেমাতরম’–এর মতোই ‘অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা’ দেশোদ্ধারে নিবেদিত মানুষের কাছে আত্মচেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ইংল্যাণ্ডের ‘ভিক্টোরীয়ান মূল্যবোধে’ আঁকা ছবিগুলোর মতো এদেশের শিল্পীরা নারী শরীরের ছবি এঁকেছিলেন। ‘প্রোফাইলে’ নয়, যেখানে শরীরের বিপদজনক ভাঁজগুলো চিহ্নিত হত। সামনা–সামনি, যেন দ্বিমাত্রিক। আর নারী শরীরের মুখ ছাড়া বাকি সবটাই ছিল পোশাক আবরিত। অর্থাৎ কাম–প্রেমহীন ক্যালেন্ডারের দেবী ছবির মতোই অনুভূতিশূন্য করে আঁকা হতে শুরু হয়েছিল নব্যভারতীয় শিল্পবোদের নারী শরীর। অথচ আমাদের দেশের মেয়েরা তখনও ইউরোপীয় মেয়েদের মতো ব্লাউজ, সেমিজ, পেটিকোট পড়তে শেখেননি। তাঁরা জানতেনে না অন্তর্বাসের মাহাত্ম্য। আমাদের গ্রামদেশের মেয়েরা তখন ছিলেন ‘অন্তঃপুরবাসিনী’। তাঁরা যদি কোন বিশেষ কারণে ঘরের বাইরে যেতেন, তখন হয় তাঁদের বাহন হত পালকি, নতুবা ছই ঢাকা গরুর গাড়ি। তখনকার বাংলার গাঁ–দেশে, এমনকি শহর কলকাতায় প্রায় অক্ষরহীন মেয়েরা পথের ধারে বনফুলের মতো বেড়ে উঠতেন। তাঁদের কথা ‘শরৎচন্দ্র’ রাখঢাক করে যেটুকু আমাদের জানিয়েছিলেন, সেটাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক চেষ্টা। তাঁর মতো অত গভীর আর গোপনভাবে কেই বা বাংলার মেয়েদের কথা লিখেছিলেন? হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার ঠিক তেমন করেই তাঁর ছবিতে মেয়েদের, গ্রাম্যবালাদের অমর রেখে গেছেন। বাংলার মেয়েদের ‘যৌনতাবোধ’ (সেক্সুয়ালিটি) তাঁর ছবিতে যেভাবে উঠে এসেছিল, তেমনভাবে তখনকারকালে সেটা অচিন্তনীয়ই ছিল। তাঁর ‘পল্লিপ্রাণ’, ‘স্নানান্তে’, ‘সিক্তবসনা’, ‘সজ্জা সমাপন’, ‘পরিত্যক্তা’, ‘তন্ময়’, ‘সদ্যস্নাতা’, ‘বর্ষা’ এবং আরও বহু বহু ছবিতে পাওয়া যায় প্রাণোদিত সেই ‘যৌনতাবোধ’। যা দর্শনে ‘অশ্লীলতা’ নয়, শিল্প রসিকদের বুকে জন্ম নেয় প্রগাঢ় প্রেম, মায়া। বাংলার ঘরের মেয়ে, যে নাবালিকা বয়সে বাপের ঘর ছেড়ে শ্বশুর ঘরে এসেছে। যৌবন শুরুর আগেই যে একাধিক সন্তানের মা। ভোর থেকে মাঝরাত সংসারের সব কাজ, অকাজের দায়িত্ব সামলানোর ফাঁকে যাঁর মনে ফাঁকি পড়ে গেছে। সেই মেয়ে যখন পুকুরে সদ্য স্নান সেরে এক খণ্ড ভিজে কাপড়ে কাঁখে কলসি নিয়ে খিড়কির দোর দিয়ে বাড়ি ফিরছে তখন আকাশে উল্লাসিত রোদ্দুর, বাতাসে উচ্ছ্বসিত ফুলের গন্ধ। বড়ো স্নিগ্ধ। বড়ো সজল। হেমেনের ছবিতে বড়ো মায়ামায় সেই ‘যৌনতাবোধ’। ‘নব্যভারতীয় শিল্পচর্চার প্যারাডক্স’ হিসেবেই তখন প্রতিভাত হয়েছে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের সৃষ্টি। অথচ, স্নান ও নারী এ দুটো বিষয়কে এক করে ছবি আঁকা হেমেন্দ্রনাথ প্রথম চালু করেছিলেন তা নয়। ইউরোপে নারীর সেই গোপন ও ব্যক্তিগত প্রাত্যহিকী বহুকাল ধরে চিত্রের বিষয় ছিল। ভারতে ‘রাজা রবি বর্মা’ কিংবা ‘বামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়’ও সদ্য স্নানার ছবি এঁকেছিলেন। তবে বিষয় হিসেবে তাঁরা কেউই এমন সত্যনিষ্ঠ অলৌকিক শিল্প সৃষ্টি করতে পারেননি। বোধহয় হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারই ছিলেন প্রথম শিল্পী, যিনি ভারতীয় মেয়েদের একান্ত বস্তুনিষ্ঠ ছবি এঁকেছিলেন। ফলে তাঁর ছবিতে এসেছে নাটকীয়তা। এসেছে নারীর একাকীত্ব। ঘরের বাইরে, কিংবা ঘরের ভেতরে তাঁর ক্যানভাস যখনই কোন নারীর সন্ধান করেছিল, তখনই দেখা গিয়েছিল সেই নারী বিবাহিতা, সংসারি হওয়া সত্ত্বেও একা। তাঁর একাকীত্বই হয়েছিল হেমেন্দ্রনাথের ছবির মূল সুর। হেমেন্দ্রনাথ ‘ইডেন গার্ডেনসে অল ইন্ডিয়া একজিবিশনের’ জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এতেই তাঁর শরীর ভেঙে গিয়েছিল। শেষে ১৯৪৮ সালের ২২শে জুলাই তিনি অকাল প্রয়াত হয়েছিলেন। ‘প্রথা ও শাস্ত্র বিরোধী’ হেমেন্দ্রনাথ অবশ্যই ব্রাত্য ছিলেন ‘নব্যভারতীয় চিত্রকলা’র ভুবনে। তাতে কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি বলেই গবেষকদের বিশ্বাস। কারণ, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার নিজের বিশ্বাসে ছিলেন স্থির। উদ্ভাবনী শক্তিতে ছিলেন দৃঢ়। ছিলেন এক বগ্গা। তাঁর মননে ‘ভারতমাতা’ (আদিতে যাঁর নাম ছিল ‘বঙ্গমাতা’) ছিলেন গাঁ–দেশের একান্ত আটপৌড়ে মেয়েরা। যাঁরা ছিলেন একাকিনী। যাঁদের বুক ফাটলেও মুখ কোনদিনও ফোটে নি।

                                 

(তথ্যসূত্র:

১- হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, অনুরাধা ঘোষ, রাজ্য চারুকলা পর্ষদ।

২- ছবির চশমা, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার।)

                            

No comments