Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

দেবদাসী প্রথা

মনে করা হয় যে এই দেবদাসী প্রথা 600 খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল। এই প্রথায় নবযুবতী কুমারী মেয়েদের ধর্মের কারনে দেবতার সাথে বিয়ে দিয়ে মন্দিরে দান করে দেওয়া হতো। ... দেবতার সাথে বিয়ে দেওয়া এই প্রকার মহিলাগণকেই দেবদাসী বলা হতো।…

 







মনে করা হয় যে এই দেবদাসী প্রথা 600 খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল। এই প্রথায় নবযুবতী কুমারী মেয়েদের ধর্মের কারনে দেবতার সাথে বিয়ে দিয়ে মন্দিরে দান করে দেওয়া হতো। ... দেবতার সাথে বিয়ে দেওয়া এই প্রকার মহিলাগণকেই দেবদাসী বলা হতো। দেবদাসী গণ মন্দিরের দেখাশোনা, পূজার সামগ্রী জোগাড় তথা মন্দিরে নৃত্য, গীত পরিবেশন করতো।এই প্রথায় নবযুবতী কুমারী মেয়েদের ধর্মের কারনে দেবতার সাথে বিয়ে দিয়ে মন্দিরে দান করে দেওয়া হতো। কিন্তু কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এই প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রায় 300 খ্রী: পূ: রচিত, এর থেকে প্রমাণ হয় দেবদাসী প্রথা এর অনেক আগে থেকেই ছিল। মনে করা হয় গৌতম বুদ্ধের সময় থেকেই এই প্রথা শুরু হয়েছিল। কিন্তু গুপ্ত আমলে ভারতবর্ষে সর্বাধিক দেবদাসী দেখা যায়।


দেবতার সাথে বিয়ে দেওয়া এই প্রকার মহিলাগণকেই দেবদাসী বলা হতো। দেবদাসী গণ মন্দিরের দেখাশোনা, পূজার সামগ্রী জোগাড় তথা মন্দিরে নৃত্য, গীত পরিবেশন করতো। মহাকবি কালীদাস রচিত মেঘদূতম্ কাব্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।


মনে করা হয় যে দেবদাসী প্রথা চরম ব্যভিচারের কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। মন্দিরের পুরোহিত ও বিশেষ অতিথিগণ দেবদাসীদের শারীরিক শোষণ করতো বলে মনে করা হয়। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক এই ব্যভিচারের মতবাদকে অস্বীকার করেন।


প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে দেবদাসী সাত প্রকারের ছিলো।


১/দত্তা - যে মন্দিরে ভক্তিভাবের কারনে স্বেচ্ছায় দেবতার সেবায় নিজেকে অর্পণ করতো তাদের দত্তা বলা হতো। এদেরকে দেবীর মর্যাদা দেয়া হতো।


২/বীকৃতা - যে অর্থের পরিবর্তে নিজেকে বিক্রি করে দিত। এরা মন্দির পরিষ্কারের কাজ করতো।


৩/ভৃত্যা - যে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য মন্দিরে নৃত্য, গীত পরিবেশন করতো।


৪/ভক্তা - এরা নিজের বাড়িতেই থাকতো মন্দিরে কাজের উদ্দেশ্যে যেত।


৫/হৃতা - রাজরাজারা এদেরকে অন্য রাজ্য থেকে হরণ করে মন্দিরে দিন করে দিত। এরা প্রকৃত পক্ষেই দাসী ছিলো।


৬/অলংকারা - রাজরাজাগণ সর্বগুন সম্পন্ন যেসব নারীগণকে মন্দিরে উপহার দিত তাদের অলংকারা বলা হতো।


৭/নগরী - বিধবা এবং আশ্রয়হীন মহিলারা আশ্রয়ের জন্য মন্দিরে নিজেকে অর্পণ করতো। এদেরকে নগরী বলা হতো।


দেবদাসীর অর্থ মন্দিরের সেবিকা, বর্ধিত অর্থে মন্দিরাঙ্গনের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা। এই রীতি আসলে "ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি" (Sacred prostitution)-র পর্যায়ে পড়ে। ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ যৌন সংগম করে নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কাজে যে ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী বা ধর্মীয় পতিতা। দেবদাসীরা ঈশ্বরের সেবিকা। তাদের অতীতে বলা হতো "কলাবন্তী" বা যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণি তাদেরকে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করত। তাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রদীপে তেল ঢালা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-নৃত্য করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস দেওয়া। অবশ্য এইসবেরও মধ্যে ছিল, পুরোহিতদের শয্যাসঙ্গিনী, যৌন লালসার শিকার হওয়া।গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ 


তবে, প্রচলিত অর্থে "পতিতা" বলতে যা বোঝায়, এরা কিন্তু তা ছিলোনা। কারণ 'পতিতা' শব্দের অভিধানিক অর্থ 'অর্থের বিনিময়ে যে দেহদান ব্যবসায় লিপ্ত '। এরা পতিতা নয় তিনটি যুক্তিতে- প্রথমত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা অর্থের বিনিময়ে মন্দিরে দেহদান করত না। দ্বিতীয়ত, এরা সামাজিক বিধান মেনেই মন্দিরে সমবেত হত এবং সর্বোপরি,মন্দির থেকে দেহদান করে বেরিয়ে এসে নির্বিবাদে সমাজে মিশে যেত ও কারও স্ত্রী , কারও মা হয়ে সুখে জীবন অতিবাহিত করত।


শুধু ভারতেই নয়, এর শুরুটা বেশ পুরানো। প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মকে উপজীব্য করে গড়ে তোলা হয় এ প্রথা। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার কোনো সু্যোগই হাতছাড়া করতো না। এই প্রাচীনতম প্রথার তিনটি প্রকারভেদ লক্ষ্য করা গেছে। প্রথম ক্ষেত্রে, যৌবনোদ্গমের পর কুমারী অবস্থায় তাদের মন্দিরে যেতে হত আদিরসের প্রথম পাঠ নিতে, মাত্র এক রাতের জন্য। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, তাদের মন্দির চত্বরে বেশ কিছুদিন যৌনজীবনের আদি পাঠ নিয়ে অভ্যস্ত হতে হত, স্থানভেদে কোথাও কয়েক সপ্তাহ, কোথাও বা কয়েক মাস। দুটি ক্ষেত্রেই মন্দির থেকে ফিরে তারা বিবাহ করত। সমাজে কারোর কোন আপত্তি থাকত না। তৃতীয় ক্ষেত্রে, কুমারী মন্দিরে যেতো ঠিকই কিন্তু আর ফিরে আসতো না, সারাজীবনের জন্য তারা দেবদাসী হয়ে যেতো।


প্রথম প্রথাটির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় হেরোডোটাস-এর বর্ণনায়। ব্যাবিলনের মাইলিট্টা-র মন্দির প্রসঙ্গে ইতিহাসকার লিপিবদ্ধ করেছেন, ব্যাবিলনীয়দের মধ্যে একটা লজ্জাকর প্রথা আছে। ব্যাবিলনের প্রতিটি রমণীকে জীবনে একবার অন্তত মন্দিরে উপস্থিত হতে হবে এবং মন্দিরের অলিন্দে সার দিয়ে বসতে হবে। অজানা অচেনা পুরুষদল ঐ অলিন্দ দিয়ে পদচারণা করবার অবকাশে রমণীদের ভিতর এক একজনকে পছন্দ করে তার কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলে দেবে। কে দিল ,তা ফিরে দেখবার অধিকার মেয়েটির নেই। যে তাকে পছন্দ করল তার হাত ধরে মেয়েটিকে চলে যেতে হবে মন্দিরচত্বরের বাইরে নিভৃতনিকুঞ্জে। সেখানে সেই অপরিচিতকে সন্তষ্ট করার মাধ্যমেই মেয়েটি রতিদেবীর প্রাপ্য অর্ঘ্য মিটিয়ে দেবে৷ তারপর সে ফিরে যাবে নিজের সংসারে সংসারধর্ম করতে। ঐ প্রথম রাতের পর আর কোনভাবেই মেয়েটিকে সতীত্ব থেকে টলানো যাবে না। তবে, হেরোডোটাস কিন্তু খোলাখুলি বলেননি, ব্যাবিলনের রমণীরা কি কুমারী অবস্থায় মন্দিরে আসত নাকি জীবনের যে কোন পর্যায়ে আসত।


কিন্তু ফিনিশীয় সভ্যতার হেলিওপোলিস এর মন্দিরে সমবেত হত শুধুমাত্র অক্ষতযোনি কুমারীর দল। তারা তাদের কৌমার্যদান করে বিবাহিত জীবন যাপনের অনুমতি লাভ করত। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে সিরিয়ার মন্দিরেও এই প্রথা দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগের প্রারম্ভে সম্রাট কনস্ট্যানটাইন সেই মন্দিরটি ধূলিসাৎ করে সেখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করে এ প্রথা রদ করিয়েছিলেন।


গ্রীসের ইতিহাসে দেবদাসীর উল্লেখ পাই নানাভাবে। চিরতরুণ সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী নিযুক্ত ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর পূর্বে ও পরেও সর্বত্র সূর্যদেবের দেবদাসী নিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রীসের মন্দিরবালাদের বলা হত Hierodule। এদের দেখা যেত গ্রীসের প্রতিটি দেবমন্দিরেই। গ্রীস সভ্যতার পর রোমান সভ্যতাতে দেবদাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরদাসীরা যে কার্যত পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করতেন সে সম্বন্ধে ইতিহাস বহুবিধ তথ্য প্রমাণ দিয়েছে। এই দেবদাসীদের সাথেই রাজনটী ও নগরনটীদের আবির্ভাবের কথা জানতে পারা যায়। তবে দেবদাসী ও নগরনটীরা সকলেই যে ক্রীতদাসী ছিলেন না এর পিছনে কতগুলো ধারণা দেখানো যায়, তা হল ক্রীতদাসীদের কোন রকম সামাজিক বা নৈতিক অধিকার ছিল না। এদের কোন রকম সম্মান বা স্বাধীনতা ছিল না। অপরদিকে, নগরনটীদের সম্মান আর প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। এই নগরনটীদের গ্রীসে Hataera বলা হত। এদের গৃহে দেশের জ্ঞানী গুণীরা আসতেন। নানা বিষয়ে, আলাপ আলোচনা করতেন এবং এদের মতামত শোনা হত অর্থাৎ সমাজে এদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের পত্নী থিওডোরা নিজে একজন Hataera ছিলেন। দেবদাসীদের সম্মানিত অস্তিত্বের প্রমাণ থাকলেও তারা Hataera-দের সমতুল্য ছিল না কারণ তাদের আশেপাশে সর্বদা ধর্মের বাতাবরণ থাকত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিকবিজয়ী অ্যাফ্রোডাইটি দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার হিসেবে দান করেন। কোরিন্থ শহরেও দেবী অ্যাফ্রোডাইটির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ঐ মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।


দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বালি, জাভা, সুমাত্রা, থাইল্যান্ড ও মায়ানমারেও দেবদাসীদের বিপুল সমাবেশ ছিল। দক্ষিণ আমেরিকার ইন্‌কা সভ্যতার ইতিহাসে দেবদাসীদের উল্লেখ আমরা পাই। ইনকা সম্রাটরা সকলেই ‘সূর্যের সন্তান’ বলে পরিচিত ছিল। এদের ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। ইন্‌কা রাজ্যে সূর্যের মন্দির তত্ত্বাবধানের কাজ করতেন পুরোহিতগণ। সুন্দরী মেয়েদের অল্প বয়সেই বেছে নিয়ে Cuzco বা শিক্ষালয়ে নিয়ে যাওয়া হত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হয় স্বয়ং রাজার উপপত্নী হতো অথবা "সূর্যকুমারী" রূপে মন্দিরবাসিনী হতো।এদের কাজ ছিল পুরোহিত, রাজা ,রাজবংশীয় পুরুষদের মনোরঞ্জন এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম।


আর্মেনিয়া অথবা পারস্যে হতভাগিনীদের প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত দেবদাসীর ভূমিকায় বন্দিনী হয়ে থাকতে হত। একাধিক পুরুষ কর্তৃক দীর্ঘকাল ধর্ষিত না হলে মুক্তি ছিল না। সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এবং রাজারাজড়ার দলও নিজ নিজ কন্যাকে ঐ রতি মন্দিরে প্রেরণ করতে বাধ্য ছিলেন। সেখানে একাধিক অপরিচিত পুরুষকে দেহদানে ধন্য করে স্ত্রীলোকেরা পুরোহিতের অনুমতিপত্র হাতে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে আসতেন। বলা বাহুল্য ,তাঁদের বিবাহ হত এবং ঐ দৈহিক দেবপূজার জন্যে কেউ তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখতেন না।


দেবদাসী প্রথার ব্যাপক প্রচলন হয় অষ্টম শতাব্দীতে, পুন্ড্রবর্ধন নগরে। পুন্ড্রবর্ধন নগরের দেবদাসীরা বিলাসী এবং কামাচারপূর্ণ জীবনযাপন করত। তাদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাৎস্যায়ন তাঁর "কামসূত্র" গ্রন্থে সমসাময়িক ভারতে দেবদাসীদের সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। দেওপাড়ায় প্রাপ্ত তাম্রফলক অনুযায়ী বিজয় সেন এবং ভট্ট ভবদেব তাদের মন্দিরে শত শত দেবদাসী নিয়োগ করেছিলেন। রামচরিত এবং পবনদূত গ্রন্থে দেবদাসীদের জীবনযাত্রার সপ্রশংস বর্ণনা দেওয়া আছে। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে এইরকম দেবদাসী অথবা নাচের মেয়ের উল্লেখ পাই, যারা তৎকালীন উজ্জয়িনী নগরের ‘মহাকাল মন্দিরে’ নাচ (ভারতনাট্যম) পরিবেশন করত। সেইসঙ্গে কোণারকের সূর্য মন্দির‚ দক্ষিণ ভারতের অন্য মন্দির-সহ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে শিকড় বিস্তার করে এই প্রথা। একাদশ শতকের দক্ষিণ ভারতে অন্যতম বিখ্যাত নরপতি চোল বংশের রাজারাজ। তার এক তাম্রশাসনের বক্তব্য, রাজারাজ তাঞ্জোরের মন্দিরে সুশিক্ষিতা চারশ’ "তেলিচ্চেরি পেণ্ডুগাল" বা মন্দির-কন্যা দান করেছেন। তাদের জন্য মন্দিরের চারপাশে উত্তম বাসগৃহ নির্দিষ্ট হয়েছে। এজন্য তাদের কোন কর দিতে হয় না।


দক্ষিণ ভারতে ‘দেবদাসী’ বলা হলেও উত্তরভারতে এই রীতির নাম ছিল ‘মুখি’। এই প্রথা যখন প্রচলিত হয়, তখন প্রথা এবং প্রথার সঙ্গে জড়িত দেবদাসীদের অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হত। তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, জমি বরাদ্দ থাকত। তারা হয়ে ওঠে মন্দিরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের নাচ-গান ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল দেবতাদের আরাধনা। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিজেদের কন্যাকে উৎসর্গ করতেন দেবদাসী হওয়ার জন্য। বয়ঃসন্ধির আগেই করা হত উৎসর্গ। তারা যেন ভালো দেবদাসী হয়ে উঠতে পারে তাই ছোটবেলা থেকেই নিতে হত নাচ গানের কঠোর প্রশিক্ষণ। কন্যা উৎসর্গ করার রীতি দক্ষিণ ভারতে ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ নামে পরিচিত। ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ মানে দেবতার সঙ্গে বিয়ে এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ এর অর্থ নিজেকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা। ইতিহাসখ্যাত নরপতি কৃষ্ণদেব রায়ের বিজয়নগর পরিভ্রমণের বিবরণেও(১৫২০-২২ সাল) উঠে এসেছে দেবদাসীদের বৃত্তান্ত। কৃষ্ণদেব রায় যখন রাইচুর অভিযানে যাত্রা করেন তখন তার বাহিনীতে নাকি সাত লাখ তিন হাজার পদাতিক, বত্ৰিশ হাজার ছয় শ’ অশ্বারোহী ছিল। এই বিরাট বাহিনীর সঙ্গে প্রমোদ-কন্যা দেবদাসীও ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। কিন্তু এক ব্যাপারে কৃষ্ণদেব রায় রীতিমত সদাচারী ছিলেন বলা চলে। তার অন্দরে রানীদের বারো হাজার দাসী এবং সহচরী থাকলেও বিজয়নগর অধিপতির পত্নী ছিল মাত্র বারোজন। বলা অনাবশ্যক, তার পূর্বসূরীরা সবাই কিন্তু এমন সদাচারী নরপতি ছিলেন না।


তবে, এটি ছিল প্রথম দিকের অবস্থা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সম্মানের উৎসর্গ আর এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। বোঝা গেল‚ পাথরের বিগ্রহকে উপেক্ষা করে মানুষই ভোগ করতে পারে ‘দেবদাসীকে’। পুরোহিতদের অবক্ষয় আর যৌন-লালসার কারণে মেয়েদের কেনা বেচা শুরু হল। এমনকি লুঠ করে পর্যন্ত নিয়ে আসা হত। আর এর পেছনে দারিদ্র্যতা মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতো। হতদরিদ্র ও নীচু জাতের মা বাবা’রা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুবতী হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। সেখানে প্রথমে কুমারী মেয়েদের নামমাত্র মূল্যে নিলাম করা হত। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভগবানকে উৎসর্গের নামে কল্পিত দেবতার সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকত মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। দেবতার সঙ্গে বিয়ের পর গরিব ঘরের সেই মেয়ে হয়ে যায় দেবদাসী বা যোগিনী। আক্ষরিক অর্থে সেবাদাসী বা যৌনদাসী। এরপর সারা জীবন আর অন্য কোনো পুরুষ মেয়েটিকে আর বিবাহ করতে পারত না। নামমাত্র খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরেই কাটাতে হয় তাদের জীবন। যৌন লালসার শিকার হতে হয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে অন্যান্য পুরুষদের। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেবদাসীদের আগমন ঘটায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় শ্রেণি। যাকে দেবতার জন্য উৎসর্গ করা হত‚ তিনি "দত্তা", লুঠ করে আনা হলে তিনি "হ্রুতা", কেনাবেচা করা হলে সেই মেয়ে "বিক্রিতা"‚ কেউ নিজেই নিজেকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করলে তিনি "ভক্ত দেবদাসী"‚ অলঙ্কারসহ কাউকে উৎসর্গ করা হলে তিনি "সালঙ্কারা", আর যদি কেউ দেবদাসী হয়ে নিয়মিত পারিশ্রমিক পেতেন‚ তিনি "গোপীকা" বা "রুদ্রাঙ্গিকা"।


কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রতেও দেবদাসীদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর স্পষ্টভাবে বলেন যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে তাদের এবং সেসঙ্গে বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে গর্ভধারণ ও পুনঃপ্রজননের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়। মধ্যযুগীয় লৌকিক বিবরণ থেকে জানা যায়, গুজরাটের চার হাজার মন্দিরে দেবদাসী ছিল কুড়ি হাজার,অনেক জায়গায় এদের নাচনি বলা হতো।


সে সময়ের রাজারা নিজ স্ত্রী বাদে রক্ষিতা রাখাটা প্রায় নিয়ম করে ফেলে। এসব দেবদাসীদের কাউকে পছন্দ হলে, রাজারা চাইলেই তাকে নিজের করে নিয়ে আসতে পারতেন। নিঃসন্তান কোনো দম্পতির যখন বাচ্চা হত না তখন খোঁজ পড়ত দেবদাসীর। তাদের পছন্দ অনুযায়ী দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।


ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ. এন. ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরীব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলোতে সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি।


ইংরেজ আমলেও ছিল এই প্রথার অস্তিত্ব। ইংরেজ রাজ-পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য তৎকালে চেষ্টার কোন ক্রটি ছিল না। দেশে তখন চলতি প্রবাদ—"খুলক-ই-খুদা, মুলুক-ই-সিরকার, হুকুম-ই-সাহিবান আলিসান" অর্থাৎ নরকুল ঈশ্বরের, মাটি সরকারের, আর ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় তা সব সাহেবদের। ১৭৯১ সনে কর্ণাটকের নবাব মাদ্রাজের লাট-বাহাদুরকে ভোজের পরে নাচ সহযোগে আপ্যায়ন করেছিলেন। সার গ্রান্ট ডাফ-এর সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় ভারতীয় নর্তকীরা ও দেবদাসীরা অতিথির আবাহন করেছিলেন পশ্চিমী গীতবাদ্যে।


আধুনিক যুগেও ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতের কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে আড়াই লাখ মেয়ে নিয়োগ করা হয়। নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে অতি প্রচলিত। ঊনবিংশ শতকের সূচনায় ফ্রান্সিস বুকানন নামে এক ইংরেজ অভিযাত্রী দক্ষিণ ভারতে আসেন। তিনি লিখে গেছেন, ‘কাঞ্চিপুরমের মন্দিরে দেবদাসী আছে কমপক্ষে একশ’। বিখ্যাত ভারতশাস্ত্রবিদ স্যার মনিয়ের উইলিয়ামস তাঞ্জোর মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন গত শতকের শেষ দিকে । তখনও সেখানে ছিলেন ১৫জন দেবদাসী।


প্রথাটি যে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর, তা আস্তে আস্তে মানুষ বুঝতে পারে। ১৯০৬ থেকে ৭ সালের দিকে ভারত সরকারকে পতিত মেয়েদের রক্ষা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সনদে সঁই করতে হয়। এই সনদের ফলেই দেবদাসীও আলোচনায় চলে আসে। ১৯১২ সালে পুরানো দিনের ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলে হঠাৎ নতুন ধরনের বিল উত্থাপিত হয়। তাও একটি নয়, পরপর তিনটি। তিনটির আবেদন একই– “দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ চাই”। ভারত সরকার জনসাধারণের ধর্মানুভূতি নিয়ে তখন বেশ সতর্ক ছিল। তাদের মতামত ছিল এ প্রথার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে জড়িত। তাই কোনো আইন প্রণয়নের আগে সেখানকার অভিমত জানা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত সরকারকে দায়িত্ব দেয়া হল তাদের জনগণের এ ব্যাপারে কি মতামত তা জানতে। তাদের পাঠানো মতামতের ভিত্তিতে ১৯১৩ সনে নিযুক্ত হলো কেন্দ্রীয় সিলেক্ট কমিটি। তারা রিপোর্ট জমা দেয় পরের বছর মার্চে। সেপ্টেম্বরে উত্থাপিত হয় সরকারি বিল কিন্তু ভাগ্য দেবদাসীদের খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি। ‘বিল’ ভাল করে জানাজানি হতে না হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মন্দিরের অঙ্গণের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র তখন সরকারের জন্য অনেক জরুরি। দেবদাসীকে নাচের আসরে ছেড়ে তারা লড়াইয়ে মনোযোগ দিলেন।


কয়েক বছর পরে আবার আলোচনায় আসে দেবদাসী। ডাঃ হরিসিং গৌর মাদ্রাজ বিধানসভায় ১৯২২ সনে তাদের সম্পর্কে আইন দাবি করে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯২৭ সনে কেন্দ্রীয় পরিষদে একই প্রস্তাব পেশ করলেন রামদাস পানতুলু। দু’জনের প্রস্তাবই গৃহীত হলো কিন্তু আইন পাস হলো না কোথাও। সরকার পক্ষ কখনো সংশোধিত প্যানেল কোড দেখালেন তো কখনো সারদা আইনের (১৯২৭) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তখন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এই প্রথার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করে বলেছিলেন– "কেউ কি দেখাতে পারেন হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান?" কোনো শাস্ত্রজ্ঞ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। একই প্রশ্ন তুলেছেন গান্ধীজিও, দক্ষিণভারত ভ্রমণে এসে তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন।


অবশেষে দেবতার নামে নারীদের ‘উৎসর্গ' করার কুপ্রথা ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয় না। পরবর্তীতে, ২০১৫ সালে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে কর্ণাটক রাজ্যকে এই প্রথা তুলে দিতে নির্দেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এ প্রথা নিয়ে অভিযোগ করে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব রাজ্যই আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম। তাও সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় আজও রয়েছে অন্ততপক্ষে ৩৫ হাজার দেবদাসী৷ এদের মধ্যে যৌবন-উত্তীর্ণ অনেকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা শোচনীয়৷ এদের অনেকেই আজ রাস্তার ভিখারি৷ রূপ-যৌবন হারানোর পর, এদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই – না মন্দিরে, না ধনীদের ঘরে।

অর্থাৎ ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির অধঃপতন হতে

শুরু করে বুদ্ধ সংস্কৃতির অবসানের পর কারণ

বুদ্ধ সংস্কৃতি বা জীবন বোধ ছিল

সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির যুক্তিগ্রাহ্য পরিণতি।


                  (সংগৃহীত)

No comments