Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

গোবিন্দপুর ও সুতানুটির ইতিকথা’ রানা চক্রবর্তী

ইংরেজরা ‘সাবর্ণ চৌধুরী’দের কাছ থেকে যে তিনখানি গ্রাম কিনেছিল, সেগুলোর অবস্থান ছিল পাশাপাশি, গঙ্গার ধার বরাবর। সেই তিনখানি গ্রামের নাম ছিল - ‘সুতানুটি’, ‘কলকাতা’ আর ‘গোবিন্দপুর’। তখন সেগুলোর সীমানা ছিল এইরকম - বর্তমান ‘বাগবাজার’ থ…

 






                            

ইংরেজরা ‘সাবর্ণ চৌধুরী’দের কাছ থেকে যে তিনখানি গ্রাম কিনেছিল, সেগুলোর অবস্থান ছিল পাশাপাশি, গঙ্গার ধার বরাবর। সেই তিনখানি গ্রামের নাম ছিল - ‘সুতানুটি’, ‘কলকাতা’ আর ‘গোবিন্দপুর’। তখন সেগুলোর সীমানা ছিল এইরকম - বর্তমান ‘বাগবাজার’ থেকে ‘বড়বাজার’ পর্যন্ত ছিল ‘সুতানুটি’, ‘বড়বাজার’ থেকে ‘এসপ্ল্যানেড’ পর্যন্ত ছিল ‘কলকাতা’, আর ‘এসপ্ল্যানেড’ থেকে ‘হেস্টিংস’ পর্যন্ত ছিল ‘গোবিন্দপুরের’ অবস্থান। এদের পূর্ব দিকে ছিল ‘লবণ হ্রদ’, ‘চৌরঙ্গীর জঙ্গল’। আর পশ্চিম দিকে ছিল ‘গঙ্গা’। জোব চার্নক কলকাতায় আসার আগেই গ্রাম তিনটির অস্তিত্ব যখন ছিল, তখন ধরে নেওয়া যায় সেখানে মানুষের বসবাসও ছিল। ইংরেজরা নিশ্চয়ই মানববর্জিত কোন গ্রাম কেনেনি। সেই গ্রাম তিনটিতে মানুষ বাসের প্রমাণ ছিল ‘লালদীঘি’র পাশে অবস্থিত ‘সাবর্ণদের কাছারিবাড়ি’টি, যেটি কোম্পানি ভাড়া নিয়েছিল নিজেদের অফিস খোলার জন্য। কাছারি যেহেতু ছিল, খাজনাও সেহেতু আদায় হতো। যাঁদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হতো, তাঁরাও নিশ্চয়ই সেই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। লক্ষ্য করার বিষয় হল, কাছারিবাড়িটির অবস্থান ছিল কলকাতা গ্রামে। সেটিই ছিল সেই অঞ্চলের একমাত্র পাকাবাড়ি। গ্রাম তিনখানির মধ্যে কলকাতাই ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। কেননা, ‘বিপ্রদাসের মনসাবিজয়’ এবং ‘মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে’ কলকাতার উল্লেখ থাকলেও সুতানুটি বা গোবিন্দপুরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাবর্ণদের আরাধ্য দেবতা ‘শ্যামরায়ের’ বিগ্রহ মন্দির স্থাপিত ছিল সেই কলকাতা গ্রামে। লালদীঘির পাশে কাছারিবাড়িটির চৌহদ্দির মধ্যে ছিল সেটার অবস্থান। দোলোৎসবের সময় সেখানে এত বিপুল পরিমাণ রঙ ব্যবহৃত হতো, যে রঙে লালদীঘির জল পর্যন্ত লাল রঙের হয়ে যেতো, এবং যা বিক্রি করার জন্যে ‘লালবাজারে’ একটি অস্থায়ী বাজার পর্যন্ত বসাতে হতো! বলাই বাহুল্য, সেই লালবাজারের অবস্থানও ছিল তখনকার কলকাতা গ্রামে। ‘কাছারিবাড়ি’, ‘শ্যামরায়ের বিগ্রহ মন্দির’, ‘লালদীঘি’, ‘লালবাজার’ - এসব থেকে প্রমাণিত হয় কলকাতা গ্রামটি সুতানুটি আর গোবিন্দপুরের তুলনায় প্রাচীন তো ছিলই, প্রাচীন ঐতিহ্যেরও অধিকারী ছিল। সেই সময়ের কলকাতা গ্রাম নিয়ে অনেক গবেষণা ও লেখালেখি হলেও, অন্য দুটি গ্রাম - গোবিন্দপুর ও সুতানুটি নিয়ে তেমন বিস্তারিতভাবে কোথাও আলোচনা করা হয়নি। অথচ সেই গ্রাম দুটির ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। তাই এই লেখার মূল আলোচ্য বিষয় হল, অতীতের গোবিন্দপুর ও সুতানুটি গ্রাম। কলকাতা গ্রামের পত্তন কবে হয়েছিল তা জানা না গেলেও গোবিন্দপুরের পত্তন নিয়ে ইতিহাসে একাধিক কাহিনী জানা যায়।                      

প্রথম কাহিনীটি হল - কেউ কেউ বলেন, গোবিন্দরাম মিত্রের নাম থেকে গোবিন্দপুর গ্রামটির নামকরণ হয়েছিল। গোবিন্দরামের জন্ম হয়েছিল কুমারটুলির বিখ্যাত মিত্রবংশে। আসলে তিনিই ছিলেন সেই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ক্ষমতার জোরে তিনি প্রবাদ-পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। পুরনো কলকাতার একটি ছড়ায় পাওয়া যায় -


‘‘আমীর চাঁদের দাড়ি

বনমালী সরকারের বাড়ি।

হুজরীমলের কড়ি

গোবিন্দরাম মিত্রের ছড়ি৷৷’’


মতান্তরে ছড়াটি এরকম -


‘‘গোবিন্দরামের ছড়ি

উমিচাঁদের দাড়ি।

নকুধড়ের কড়ি

মথুর সেনের বাড়ি৷৷’’


গোবিন্দরাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন সতেরো শতকের শেষ দিকে। তিনি ছিলেন কলকাতার ‘ডেপুটি গভর্নর’ বা ‘শহর কোতোয়াল’। সাহেববা তাঁকে বলতেন ‘ব্ল্যাক জমিদার’। কেউ কেউ বলেন, তাঁর কার্যকাল ছিল ১৭২০-১৭৫২ সাল, মতান্তরে ১৭২০-৫০। আবার এমনও দেখা যায়, ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই পদে বহাল ছিলেন। তবে শেষেরটিই ঠিক। গোবিন্দরামের আদিনিবাস ছিল ব্যারাকপুরের নিকটবর্তী কোনো একটা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল ‘রত্নেশ্বর মিত্র’, আর পিতামহের নাম ছিল ‘হংসেশ্বর মিত্র’। ১৬৮৬-৮৭ সালে তিনি পিতা-মাতার সঙ্গে কুমারটুলিতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। তখনকার দিনে কলকাতার কালেক্টরই ছিলেন কলকাতার জমিদার। হলওয়েল ছিলেন সেরকম একজন জমিদার। প্রত্যেক জমিদারের অধীনে থাকতেন একজন করে এদেশী সহকারী। তাঁদেরই বলা হতো ‘ব্ল্যাক-ডেপুটি’ বা ‘কালা-জমিদার’। গোবিন্দরাম ব্ল্যাক-ডেপুটি হয়েছিলেন ‘হলওয়েলের’ আমলে। গোবিন্দরাম ম্যাজিস্ট্রেট আর কালেক্টর উভয়ের কাজেই সাহায্য করতেন। এদেশী লোকেদের বিচারের ভার প্রায় তাঁর ওপরেই ন্যস্ত ছিল। সেই কারণে লোকে তাঁকে ভয় করতো। তাছাড়া তিনি ছিলেন বেশ টাকাপয়সাওয়ালা লোক। সেই টাকাপয়সা তিনি রোজগার করেছিলেন নানা উপায়ে। কেননা, কেবলমাত্র মাস মাইনের টাকায় ১৬৫ ফুট উঁচু নবরত্ন মন্দির তৈরি করা এবং আমিরি চালে জীবনযাপন করা তাঁর পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হয়নি। যতদূর জানা যায়, গোবিন্দরামের মাইনে খুবই কম ছিল। জমি-বিলি এবং সেই সংক্রান্ত কাজকর্মের তদারকির সময় অনেক টাকা-পয়সা তাঁর হাতে আসতো। গোবিন্দরামের প্রকৃতিও ছিল দুর্দান্ত। তাঁর নামে নাকি বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খেতো! আগেই বলা হয়েছে, গোবিন্দরামের ‘বস’ বা ওপরওয়ালা ছিলেন হলওয়েল। জমিদারির সমস্ত কাগজপত্র থাকতো গোবিন্দরামের কাছে। হলওয়েল একবার তাঁর কাছে জমিদারির কাগজপত্র চেয়ে পাঠালে তিনি তাঁকে সটান বলে পাঠিয়েছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্টের আদেশ ছাড়া তিনি কাউকে কিছু দেখাতে পারবেন না। হলওয়েলকে যে তিনি বিশেষ পরোয়া করতেন না, এ থেকেই সেটা বোঝা যায়। হলওয়েল আর গোবিন্দরামের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ১৭৫২ সালে। সেই সময় হলওয়েল গোবিন্দরামের বিরুদ্ধে কাউন্সিলের কাছে তহবিল তছরূপের অভিযোগ এনেছিলেন। তখন গোবিন্দরাম বলেছিলেন, তাঁর আগে যাঁরা ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন, তাঁরা সবাই তাঁর মতন সুবিধে ভোগ করে গিয়েছিলেন; তাঁর মতন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর পক্ষে সামান্য মাইনের টাকায় কখনোই পদমর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব নয়। গোবিন্দরামের আগে ‘নন্দরাম সেন’ ছিলেন কলকাতার ‘ব্ল্যাক-জমিদার’ বা ‘ডেপুটি কালেক্টর’। তিনি ডেপুটি হয়েছিলেন ‘কলকাতার প্রথম কালেক্টর’ ‘রালফ শেলডনের’ আমলে। তাঁর কার্যকাল ছিল ১৭০০ সাল থেকে ১৭০৬ সাল পর্যন্ত। তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিল ঘুষ এবং তহবিল তছরূপের দায়ে। নন্দরামের চাকরি গিয়েছিল ‘বাউচার’ সাহেব ১৭০৬ সালে কালেক্টর হবার পরে। সেই ঘটনার পরবর্তী কয়েক বছর ডেপুটি নেওয়া বন্ধ থাকার পরে ১৭২০ সালে গোবিন্দরাম ঐ পদ অলংকৃত করেছিলেন। ১৭৫২ সালে তিনি পদত্যাগ করলে হলওয়েল তাঁকে জমিদারির হিসেব দাখিল করতে বলেছিলেন। কিন্তু গোবিন্দরাম তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, আগেকার সব কাগজপত্র ১৭৩৭ সালের বন্যায় ভেসে গিয়েছে এবং তার পরের কাগজপত্র উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে! ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলে গোবিন্দরাম কোম্পানির পক্ষ নিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে কারাবাস ভোগ করতে হয়েছিল। পরে নবাবের অধীনে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় এদেশী ব্যক্তিদের যে ক্ষতি হয়েছিল, তা মিটিয়ে দেওয়ার জন্যে যে-কমিশন গঠিত হয়েছিল, গোবিন্দরাম ছিলেন সেই কমিশনের অন্যতম কমিশনার। এরপরে গোবিন্দরাম লবণ ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৭৭৩ সাল। এরপরে তাঁর সম্বন্ধে আর কিছু ইতিহাসে জানা যায় না। এখন দেখা যাক, গোবিন্দরামের নাম অনুসারে গোবিন্দপুর গ্রামটির নামকরণ হয়েছিল কিনা ৷ ঐতিহাসিক তথ্যাদি থেকে জানা যায়, গোবিন্দরাম ১৬৮৬-৮৭ সালে যখন ব্যারাকপুর থেকে কুমারটুলিতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তার আগে থেকেই গোবিন্দপুর গ্রামটি বর্তমান ছিল। বলাই বাহুল্য, ১৬৮৬-৮৭ সালে গোবিন্দরাম ছিলেন নিতান্তই শিশু। তিনি কুমারটুলিতে এসেছিলেন পিতামাতার সঙ্গে। ১৬৯৮ সালে ইংরেজরা যখন সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতা - এই গ্রাম তিনখানি কিনেছিল, তখনও তিনি নাবালক ছিলেন। কাজেই গোবিন্দরাম মিত্র গোবিন্দপুর গ্রামের পত্তন করেছিলেন কিংবা তাঁর নাম অনুসারে গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ হয়েছিল, এই তত্ত্ব আজগুবি মত ছাড়া আর কিছুই নয়।

                                ©️রানা©️

দ্বিতীয় কাহিনী অনুসারে, শেঠ-বসাকদের গৃহদেবতা গোবিন্দের নাম থেকে গোবিন্দপুর গ্রামটির নামকরণ হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। শেঠ-বসাকদের কথা বলতে গেলেই এসে যায় ‘সপ্তগ্রাম’ বা ‘সাতগাঁ’র কথা। কেন না, তাঁদের আদিনিবাস ছিল সাতগাঁয়। বর্তমান হুগলি জেলার অন্তর্গত মগরা থানার মধ্যে সাতগাঁর অবস্থান। হুগলি শহরের উত্তরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপরে গ্রামটি অবস্থিত। ‘সরস্বতী নদী’র খাত পড়ে সেই গ্রামের ডান দিকে। অনেক আগে গঙ্গার প্রধান প্রবাহ বয়ে যেতো সরস্বতীর পথে। তখন সাতগাঁ ছিল বাংলা তথা পূর্ব ভারতের একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। বন্দর হিসাবেও সেটি সুখ্যাত ছিল। সেটির সুখ্যাতি বজায় ছিল ১১ শতক থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত। ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সাতগাঁর গুরুত্ব কমতে শুরু করেছিল। কেন না, সরস্বতী নদী সেই সময়ের আগে থেকেই মজে যেতে শুরু করেছিল। ফলে ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সেই পথে বড় বড় বাণিজ্যতরী যাতায়াতে বাধা পেতো। তখন থেকেই সাতগাঁর দেশী-বিদেশী বণিকরা সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়ার তোড়জোড় করেছিলেন অন্য কোনো সুবিধাজনক জায়গায়। শেঠ-বসাকরাও পিছিয়ে থাকেননি। সেই সময় সাতগাঁকে পেছনে ফেলে ‘ব্যাটরা’ হয়ে উঠেছিল প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সেখানকার বাণিজ্যে অংশ নেওয়ার জন্য শেঠ-বসাকরা উঠে এসেছিলেন গোবিন্দপুর গ্রামে। ব্যাটরার প্রাচীন নাম ছিল ‘বেতোর’। ‘মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে’ পাওয়া যায় -

‘‘কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা

বেতোরেতে উত্তরিল অবসান বেলা।

বেতাই-চণ্ডীকা পূজা কৈল সাবধানে

ধনন্তগ্রাম থানা সাধু এড়াইল বামে।’’


‘বিপ্রদাস পিপলাইয়ের’ ‘মনসাবিজয়ে’ও ‘বেতোর’ বা ‘বেতোড়ের’ উল্লেখ পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছিল -


‘‘পূর্বকূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা

বেতোড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।

স্নান তর্পণ করি কৈল ইস্টিপূজা

পূজিল বেতাইচণ্ডী চাঁদো মহারথা।’’


দুই কাব্যের দুই নায়ক, ‘ধনপতি’ এবং ‘চাঁদ’। দু’জনেই ছিলেন ‘সওদাগর’। দু’জনেই ভাগীরথীর ওপর দিয়ে বাণিজ্যতরী নিয়ে বাণিজ্যযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। এবং আশ্চর্যজনকভাবে দু’জনেই ‘বেতোরে’ নেমে ‘বেতাইচণ্ডী’র পুজো করেছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, ‘বিপ্রদাস’ এবং ‘মুকুন্দরামের’ আমলে ‘বেতোর’ এবং সেখানকার ‘চণ্ডী’ বেশ বিখ্যাত ছিল। বেতোর বা ব্যাটরার অবস্থান বর্তমান হাওড়া স্টেশনের প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে। গঙ্গা-আদিগঙ্গার সংযোগস্থলের উল্টোদিকে আছে ‘বেতাকীর খালের মোহানা’। এই খালটি সেখানে গঙ্গায় এসে পড়েছে। এরই আরেক নাম ‘বেতড়ার খাল’। সেই খালপথে অতীতে ফিরিঙ্গী-বণিকরা সাতগাঁয় যাওয়া-আসা করতেন। ১৫৭০ সালে ‘ফ্রেডরিক সিজার’ নামে একজন পর্যটক বেতোরের খালে চড়া পড়তে দেখেছিলেন। খালটি মজে গেলে বণিকরা গঙ্গাপথে যাতায়াত করতেন। ‘বেতাইচণ্ডীর পুজো’ উপলক্ষে ‘ব্যাটরা’য় আগে মেলা বসতো বলেও জনশ্রুতি আছে। ব্যাটরা ছেড়ে আবার গোবিন্দপুরে ফিরে আসা যাক। সাতগাঁ থেকে শেঠ-বসাকরা যে গোবিন্দপুরে বসতি উঠিয়ে এনেছিলেন, একথা অনেকেই স্বীকার করেন। সাতগাঁর ‘বসকা-দীঘি’ বসাকদেরই কীর্তি ছিল। তখন তাঁদের পদবী ছিল ‘বসক’। এর ফারসী রূপ হল ‘বুসাখ’। ‘বসক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অর্থকরী’। আবার ‘বুসাখ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘সৌরভময় শাখা’। সেটি ছিল মোঘলদের দেওয়া উপাধি। বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটি যেখানে অবস্থিত, আগে সেখানেই ছিল বসাকদের বাসস্থান। তাঁদের কুলদেবতা গোবিন্দের মন্দিরটিও সেখানে ছিল বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। শেঠ-বসাকরা কবে গোবিন্দপুরে এসেছিলেন, সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন ১৬ শতকে, কেউ বলেন ১৭ শতকে, আবার কেউ বলেন ১৮ শতকে। খুব সম্ভব তাঁরা গোবিন্দপুরে এসেছিলেন ১৬ শতকের শেষ বা ১৭ শতকের গোড়ার দিকে। শেঠ-বসাকদের সম্বন্ধে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, তা অনেকটা এরকম - শেঠ এবং বসাক পৃথক পদবী, পৃথক বংশ। প্রথমে শেঠরা এসেছিলেন গোবিন্দপুরে। গোবিন্দজী ছিলেন তাঁদেরই গৃহদেবতা। গোবিন্দপুরে সেই দেবতার মূর্তি তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাতগাঁ থেকে তুলে এনে। বসাকরা ছিলেন শেঠদের পাল্টি ঘর। তাঁরাও ছিলেন শেঠদের মতন ধনী। তাঁদেরও ছিল শেঠদের মতন সুতিকাপড়ের ব্যবসা। পেশায় উভয়েই ছিলেন ‘তন্তুবণিক’। বৈবাহিক কাজের সুবিধের জন্যে শেঠরা বসাকদের নিয়ে এসেছিলেন গোবিন্দপুরে। উভয় গোষ্ঠী মিলে বর্তমান শহিদমিনারের কাছে গড়ে তুলেছিলেন একটি তাঁতশালা। জঙ্গল কেটে চাষবাসও শুরু করেছিলেন। সুতানুটির হাটটি তাঁরাই পত্তন করেছিলেন। বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটি নির্মাণের সময় শেঠ-বসাকদের গোবিন্দপুর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। দুর্গটির নির্মাণকাল ১৭৫৭-১৭৭৩ সাল। সেসময় তাঁরা গোবিন্দজীর মূর্তিটি বড়োবাজারে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গোবিন্দজীর মূর্তি-মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বৈষ্ণবচরণ শেঠের’ বাড়ির উত্তর কোণে। শেঠ-বসাকদের মধ্যে পাঁচজন ব্যক্তি বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁরা হলেন - ‘শোভারাম বসাক’, ‘বৃন্দাবন বসাক’, ‘কৃষ্ণচন্দ্র বসাক’, ‘যদুবিন্দু শেঠ’ এবং ‘বৈষ্ণবচরণ শেঠ’। যদুবিন্দু এবং বৈষ্ণবচরণ ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। ‘বাঁশতলা লেনে’ রাধাকান্তের যে-মূর্তি-মন্দির অবস্থিত আছে, সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যদুবিন্দু। সেই মূর্তিটি প্রথমে ছিল বিষ্ণুপুরের রাজাদের গৃহদেবতা। বৈষ্ণচরণ গঙ্গাজল পাঠাতেন দ্বারকানাথ এবং সোমনাথের মন্দিরে। মুখঢাকা পাত্র করে। সেই পাত্রের মুখে আঁকা থাকতো তাঁর নামের মোহর। সেই মোহর ছিল বিশুদ্ধতার প্রতীক। শেঠ-বসাকরা ছিলেন গোবিন্দপুরের আদিবাসিন্দা এবং তাঁদের গৃহদেবতা গোবিন্দজীর নাম অনুসারে গ্রামটির নাম হয়েছিল গোবিন্দপুর, এই কাহিনীর প্রচারের জোর যতটা ছিল, তথ্যের জোর ততটা ছিল না। শেঠ-বসাকরা যে কলকাতার পুরনো বাসিন্দা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁরা যে সাতগাঁ থেকে উঠে এসে গোবিন্দপুরে বসতি গড়েছিলেন, এটাও মানতে আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি রয়েছে তাঁদের গোবিন্দজীর নাম অনুসারে গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ হয়েছিল এবং তাঁরাই সেই গ্রামের পত্তন করেছিলেন - একথা মানতে। ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে এটা আজ সুস্পষ্ট যে, শেঠ-বসাকরা গোবিন্দপুর আসার আগেও গোবিন্দপুর গ্রামটি ছিল, আর সেই গ্রামের নামটিও গোবিন্দপুর ছিল।

                               ©️রানা©️

তৃতীয় কাহিনী অনুসারে গোবিন্দপুরের নামকরণ নিয়ে আরেকটা কাহিনী আছে। সেই কাহিনী শুরু করার আগে ‘দত্তবংশমালা’থেকে একটু উদ্ধৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিটি সংস্কৃতে লেখা এবং পড়তে বিরক্তিকর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তথ্যের প্রয়োজনে সেটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। উদ্ধৃত অংশটির রচয়িতা ছিলেন ‘কেদারনাথ দত্ত’। রচনার পঞ্চম অধ্যায়ের শেষ অংশে বলা হয়েছিল -


‘‘... শ্রীরামশরণো জ্যেষ্ঠো গোবিন্দ মধ্যমস্তথা।

কনিষ্ঠঃ শ্রীহরিশ্চৈবং কুলাচার্য্যৈর্বিচারিতং৷৷৩৮৷৷ 

বিষয়ণাং বিভাগেষু তেষাং বৈরং পরস্পরং।

অভবৎ স্বল্পকালে তৎ সবিপ্লাবনং পরং৷৷৩৯৷৷ 

গোবিন্দশরণস্ত্যক্তবা স্বগৃহেবিষয়াদিকং। 

লেভেতোড়ল্মালাৎ কাৰ্য্যং ভূমিদানাদিকৰ্ম্মষু৷৷৪০৷৷ 

তোড়ল্মলস্তু কৃপয়া মানসিংহনৃপায় সঃ।

অর্পয়ামাস গে বিন্দং জ্ঞাত্বা কাৰ্য্যক্ষমংহি তং৷৷৪১৷৷ 

গোবিন্দস্য স্বকার্য্য্যেষু তুষ্টো রাজা মহামতিঃ। আকবরাজ্ঞয়া ভূমিং দদৌ তং গৌড়মণ্ডলে৷৷৪২৷৷

গঙ্গাপূর্বতটে রম্যে কালিকাপীঠসন্নিধৌ। 

গোবিন্দশরণশ্চক্রে গোবিন্দপুরপত্তনং৷৷৪৩৷৷

সচ বিজ্ঞবরো দত্তঃ লক্ষ্বাচ বিপুলং ধনং।

রাজকার্য্যে তথান্যত্র স্বীয়গ্ৰামংসমাগতঃ৷৷৪৪।।

করালবদনীং কালীমচ্চয়িত্বা যথাবিধি।

সম্পূজ্য সজ্জনান্ বিপ্ৰান্নবাপ বিপুলংযশঃ৷৷৪৫৷৷

তত্ত্ববায়াদিকান্ শূদ্রান্ সমানীয় সুদূরতঃ।

স্থাপয়ামাস ধৰ্ম্মাত্মা গোবিন্দ পুরসীমণি৷৷৪৬৷৷

কায়স্থান্ ব্রাহ্মণান্ বৈদ্যান্ নবশাখাদিকান্নপি।

বরয়ামাস যত্নেন স্বীয়গ্রাম বিবৃদ্ধয়ে৷৷৪৭৷৷

শ্রীদুর্গামণ্ডবং স্থাপ্য শারদীয়ার্চ্চনং তথা।

বোধনেন নবম্যাদি কল্পেন সমকল্পয়ৎ৷৷৪৮৷৷

পিতামহাজ্ঞয়া সোপি সৰ্ব্বগার্হস্থ্যকৰ্ম্মষু।

গোস্বামিভ্যো দদৌ মালাং সজ্জনেভ্যো মহামতিঃ৷৷৪৯৷৷

সাত্ত্বিকেন বিধানেন দেবী পূজাদিকৰ্ম্মষু।

পন্থাদিবধকাৰ্য্যঞ্চ নিষিদ্ধং তেন সাধুনা৷৷৫০।।

শ্রীরামশরণস্তস্মিন্নান্দুলনগরে বসন্।

চতুর্ধরী রাজকার্য্যমকরোৎ বহু্যুত্নতঃ৷৷৫১৷৷

ত্যক্ত্বান্দুলং হরির্গত্বা বরদানগরং ততঃ।

বান্ধবৈবসতিং চক্রে মূঢ়াগাছা প্ৰদেশকে৷৷৫২৷৷

ইতি শ্রীদত্তবংশে কেষাঞ্চিদ্দত্তানান্দুলগ্রাম 

পরিত্যাগোনাম পঞ্চমোজধ্যায়ঃ।’’


এই কাহিনী অনুসারে গোবিন্দপুরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘গোবিন্দশরণ দত্ত’ এবং তাঁর নামেই গ্রামটির নামকরণ হয়েছিল। গোড়া থেকেই ঘটনাটা বলা যাক। গোবিন্দশরণের আদিনিবাস ছিল ‘আন্দুলে’। সেখানকার দত্তবংশের আদিপুরুষের নাম ছিল ‘দেবদাস দত্ত’ ওরফে ‘তেকড়ি’। ‘তেকড়ি’ সেখানে পাকাবাড়ি, মন্দির ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন। কীর্তিমান পুরুষ ছিলেন তিনি। পুরস্কার স্বরূপ ‘চৌধুরী’ উপাধি লাভ করেছিলেন তিনি। ‘বালি’তেও ‘তেকড়ি’র একটি বাড়ি ছিল। সেখানে বাস করতেন তাঁর মা। তাঁর পুত্র ‘রত্নাকর’ও সেই বাড়িতে তাঁর পিতামহীর সঙ্গে থাকতেন। বালিতে থাকার সময়েই তিনি অর্থাৎ ‘রত্নাকর’ নাকি লাভ করেছিলেন কিংবদন্তীর ‘পরশমণি’, যার সাহায্যে তিনি বিশাল ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছিলেন। রত্নাকরের পরশমণিপ্রাপ্তির গল্পটি আজগুবি হলেও তিনি যে প্রভূত ধনরত্নের অধিকারী ছিলেন সেটা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। রত্নাকরের পুত্রের নাম ছিল ‘কামদেব’। ‘কৃষ্ণানন্দ’ ছিলেন কামদেবের পুত্র। কৃষ্ণানন্দের ছিলেন দুই পুত্র। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ‘কন্দর্পরাম’কে বিষয় সম্পত্তির ভার দিয়ে তিনি ‘পুরুষোত্তমে’ গমন করেছিলেন। সেখানে তিনি ‘আন্দুলমঠ’ নামে একটি ‘বৈষ্ণবমঠ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কন্দর্পরামের ছিলেন তিন পুত্র। যথা – ‘রামশরণ’, ‘গোবিন্দশরণ’ এবং ‘হরিশরণ’। কন্দর্পরামের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্রদের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে লাঠালাঠি বেধে গিয়েছিল। বড়ো ভাই ‘রামশরণ’ বিষয়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন ‘গোবিন্দশরণ’ আর ‘হরিশরণ’কে। ফলে মেজো আর ছোটো বাড়িছাড়া হতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছোটো ভাই গিয়েছিলেন ‘মুড়াগাছা পরগণা’র ‘বরদা’ নামক গ্রামে। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন তিনি। আর মেজো এসেছিলেন গোবিন্দপুরে। ‘গোবিন্দশরণ’ ছিলেন কর্মঠ পুরুষ। তিনি ‘রাজা টোডরমলের’ অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৫৮৪ সাল। ‘টোডরমল’ সেসময় ‘বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা’র ‘জমি জরিপ এবং খাজনার বন্দোবস্ত’ করার জন্যে বঙ্গদেশে এসেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে পরে ‘গোবিন্দশরণ’ জায়গীররূপে লাভ করেছিলেন গোবিন্দপুর গ্রামটি। গোবিন্দশরণ গোবিন্দপুরে এসে বসবাস শুরু করার পর থেকেই বহু গণ্যমান্য ধনী লোক সেখানে এসে বসতিস্থাপন করেছিলেন। গ্রামটি ছিল জলবেষ্টিত। গ্রামের উত্তরে ছিল ‘বাদা-গঙ্গার খাল’, দক্ষিণে ছিল ‘আদিগঙ্গা’ বা ‘গোবিন্দপুরের খাল’, পূর্বে ছিল ‘চৌরঙ্গীর জলা-জঙ্গল’ আর পশ্চিমে ছিল ‘গঙ্গা’। ফলে গ্রামটি ছিল সুরক্ষিত, অনেকটা গড়ের মতন। সেজন্যে সেই গ্রামকে কেউ কেউ বলতেন ‘গড়-গোবিন্দপুর’। গ্রামটির অদূরে কালীঘাটের অবস্থান ছিল বলে হিন্দুদের সেখানে বাস করার আরেকটি আকর্ষণ ছিল। বসবাসের একটি ভৌগোলিক সুবিধাও ছিল। ‘সরস্বতী নদী’ মজে যাওয়ায় গঙ্গার মূলপ্রবাহ এসময় বইতে শুরু করেছিল ‘হিজলির খাল’ দিয়ে। প্রাচীন ‘বাদররসা’ থেকে ‘সাঁকরাইল’ পর্যন্ত সেই খাল বিস্তৃত ছিল বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন খালটির নাম ছিল ‘নিমকির খাল’। ‘বাদররসা’ হচ্ছে গোবিন্দপুরের প্রাচীন নাম। এর সামনে গঙ্গার ওপর ছিল একটি চড়া। সেই চড়ার সামনে থেকে ‘সাঁকরাইল’ পর্যন্ত বিস্তৃত খালটি গিয়ে পড়েছিল ‘সরস্বতী নদী’তে। ‘হিজলি’ থেকে ‘লবণ’ আনার জন্যে বা অন্য প্রয়োজনে সেই পথে নৌকো যাতায়াত করতো। সেই পথে ‘উড়িষ্যা’তেও যাওয়া হতো বলে জনশ্রুতি আছে। ১৫০৯ সালে ‘চৈতন্যদেব’ যখন ‘উড়িষ্যা’য় গিয়েছিলেন, তখন তিনি সেই পথেই গিয়েছিলেন। ‘নিত্যানন্দ’ও সেই পথে ‘আন্দুল’ হয়ে ‘উড়িষ্যা’য় গিয়েছিলেন। ১৫৯৪-১৬০৬ সালে লেখা ‘মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে’ও ‘হিজলির পথ’ অর্থাৎ খালের উল্লেখ পাওয়া যায়। গঙ্গার মূলপ্রবাহ সরস্বতীর পথ ছেড়ে হিজলির খালপথে বইতে শুরু করেছিল সম্ভবতঃ ১৫২০ থেকে ১৫৩০ সালের মধ্যে। প্রাচীন তথ্য থেকেই প্রমাণ হয় গোবিন্দশরণ গোবিন্দপুরে আসার আগেই গ্রামটি ছিল এবং তখন সেটির নাম ছিল ‘বাদররসা’। ‘কবিরামের’ ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ গ্রন্থেও এই তত্ত্বের সমর্থন পাওয়া যায়। কবিরাম’ বলেছিলেন - ‘‘গোবিন্দ দত্ত নামক এক রাজা গঙ্গাসাগর তীর্থ হইতে ফিরিবার সময় কালী তাহাকে স্বপ্নে আহ্বান করিয়া ‘বাদররসা’ নামক আপনার নিকটস্থ স্থানে বাস করিতে আদেশ করেন। গোবিন্দ দত্ত তথায় মৃত্তিকা মধ্যে বিপুল অর্থ প্রাপ্ত হইয়া গৃহাদি নির্মাণ করেন এবং অপরাপর কায়স্থ ব্রাহ্মণ নবশাখাদি সর্বজাতিকে আহ্বান করিয়া নিজ নামে গ্রামের নামকরণ করিয়াছিলেন।’’ (বিশ্বকোষ) ‘কবিরাম’ ছিলেন ‘যশোরেশ্বর প্রতাপাদিত্যের’ সমসাময়িক। ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ১৬ শতকে, যখন ‘প্রতাপাদিত্য’ জীবিত ছিলেন। গ্রন্থটিতে লেখা হয়েছিল -


‘‘প্রতাপাদিত্য ভূপস্য যশোর ভূমিপ পশ্য চ।

গঙ্গাবাস স্থলো রাজন্ ইদানীং বৰ্ত্ততে৷৷’’


অর্থাৎ ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ গ্রন্থ অনুসারে গোবিন্দপুরের পত্তনকাল হল ষোড়শ শতাব্দী। পত্তনকারীর নাম ‘গোবিন্দ দত্ত’। এই ‘গোবিন্দ দত্ত’র সঙ্গে ‘গোবিন্দশরণ দত্ত’কে মেলাতে গেলে বলতে হয় গোবিন্দশরণও ছিলেন প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক। টোডরমল জমি জরিপের ব্যবস্থা করেছিলেন ১৫৮৪ সাল নাগাদ। প্রতাপাদিত্য তখন জীবিত ছিলেন। আবার গোবিন্দশরণ সেই টোডরমলের অধীনেই চাকরি করেছিলেন। কাজেই ‘দিগ্বিজয় প্রকাশে’র ‘গোবিন্দ দত্ত’ ও ‘দত্তবংশমালা’র ‘গোবিন্দশরণ দত্ত’ একই ব্যক্তি হওয়া সম্ভব, যদিও দুই গোবিন্দের গোবিন্দপুরে বসতিস্থাপনের কারণ ছিল ভিন্ন। তবে ‘গোবিন্দ দত্ত’ নিজের নাম অনুসারে গ্রামটির নামকরণ করেছিলেন, এই যুক্তি অভ্রান্ত নাও হতে পারে।


গ্রামটির প্রাচীন নাম যে ছিল ‘বাদররসা’, সেটা আগেই বলা হয়েছে। ‘বাদর’ কথাটি ‘বাদা’ থেকে এসেছে, না ‘বাঁদর’ থেকে এসেছে, সেটা বলা কঠিন। কেউ কেউ বলেন, গোবিন্দপুর যেহেতু সুন্দরবন-বাদা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সেটার তিন দিকে ছিল জল, সেহেতু সেই জায়গার নাম ছিল ‘বাদাররসা’। আসলে মানুষের নামকরণের মতন গ্রামের নামকরণও অনেক সময় সামঞ্জস্যহীন হয়। ‘বাদররসা’ এবং ‘গোবিন্দপুর’ নামও আকস্মিকভাবে এসে যেতে পারে। গোবিন্দশরণ দত্ত ‘বাদররসা’য় আসার আগেও সেখানে অনেক ‘গোবিন্দ’ বাস করে থাকতে পারেন। ‘গোবিন্দ’হীন হিন্দু-গ্রাম কিংবা শহর আজও তো আমাদের চোখে বড়ো একটা পড়ে না। তাছাড়া ‘দেব-গোবিন্দ’ তো আছেনই। কাজেই কোন ‘গোবিন্দ’ থেকে ‘গোবিন্দপুর' নাম হয়েছিল, সেটা এখন বলা মুশকিল। কাজেই ‘শেঠ-বসাকদের গোবিন্দজী’র কিংবা ‘গোবিন্দরাম মিত্র’ বা ‘গোবিন্দশরণ দত্ত’র নাম থেকে ‘গোবিন্দপুরের’ নামকরণ হয়েছিল বলে যেসব গল্প চালু আছে, সেগুলি নিছকই গল্প। সেগুলির একটিকেও ঐতিহাসিক সত্যি বলে গ্রহণ করা চলে না। গোবিন্দপুরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং ব্যাটরার হাটে বেচাকেনার সুবিধের জন্যই গোবিন্দপুরে ধনী ব্যবসায়ীরা বসবাস শুরু করেছিলেন। সেখানকার আদিবাসিন্দারা ছিলেন কৃষক এবং ধীবর। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার যে-কোনো গ্রামে এই সম্প্রদায়ের মানুষের সন্ধান আজও পাওয়া যাবে। আজও কলকাতায় তাঁদের ঘরের মেয়ে-বউরা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে জীবিকা অর্জন করে থাকেন। কাজেই কৃষক এবং ধীবরদের কথা বাদ দিয়ে কেবল ‘শেঠ-বসাক-দত্ত-মিত্র’দের ‘গোবিন্দপুরের প্রথম বাসিন্দা’ হিসেবে ইতিহাসে চালানোর কারণ কি? কৃষক-ধীবরদের হয়ে কেউ কিছু বলার নেই বলে?

এবার আসা যাক ‘সুতানুটি’ গ্রামটির পত্তনের কাহিনীতে। জোব চার্নক যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তিনি সুতানুটির মাটিতেই অবতরণ করেছিলেন। ‘সাতগাঁ’ এবং ‘ব্যাটরা’র পরে সুতানুটির হাটের জন্ম হয়েছিল। বাণিজ্যে সাতগাঁ এবং ব্যাটরার জায়গা ১৬৯০ সালের মধ্যে দখল করে নিয়েছিল সুতানুটি। বর্তমানে যে জায়গাটাকে ‘হাটখোলা’ বলা হয়, হাট বসতো সেখানেই। ‘সুতিবস্ত্র’ এবং ‘সুতোর নুটি’ - সেই হাটের প্রধান পণ্যদ্রব্য ছিল। অনেকে বলেন, সেই হাটটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেঠ-বসাকরা। ‘শোভারাম বসাকের হাট’ বলে কেউ কেউ সেটিকে অভিহিত করেছিলেন। বাস্তবে সুতানুটি গ্রামটি কলকাতার অনেক পরে গড়ে উঠেছিল। কেননা, ‘মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্য’ এবং বিপ্রদাসের ‘মনসাবিজয়ে’ কলকাতার উল্লেখ থাকলেও সুতানুটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুতানুটির হাটটি যে শেঠ-বসাকরাই বসিয়েছিলেন, তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ১৫৯৪-১৬০৬ সালে রচিত ‘কবিকঙ্কণের’ ‘চণ্ডীকাব্যে’ পাওয়া যায় -


‘‘ধালিপাড়া মহাস্থান কলিকাতা কুচিনান

দুই কূলে বসাইয়া বাট।

পাষাণে রচিত ঘাট দুকূলে যাত্রীর নাট

কিঙ্করে বসায় নানা হাট৷৷’’


কেউ কেউ অনুমান করেন, ‘চণ্ডীকাব্যে’ যে-হাটের কথা বলা হয়েছিল, সেটা আসলে ব্যাটরা এবং সুতানুটির হাট। হতেই পারে, সুতানুটির ‘হাটখোলা’তেও তখন হাট বসতো, যদিও জায়গাটির নাম তখনো সুতানুটি হয়নি। ‘হাটখোলা’ কথাটির অর্থ হচ্ছে খোলা জায়গায় বসা হাট। মুক্ত আকাশের নিচেই গ্রাম্য হাট বসে থাকে। অর্থ অনুসারে হাটের নাম ‘হাটখোলা’ হয়েছিল বলে ধরে নিলে সমস্ত গ্রাম্য হাটের নামই ‘হাটখোলা’ হতে হয়। তবে হাটখোলার হাটকে কেন্দ্র করে জনবসতি নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছিল। শেঠ-বসাকরা গোবিন্দপুরে আসার আগেই সম্ভবতঃ হাটখোলার অস্তিত্ব ছিল। শেঠ-বসাকরা গোবিন্দপুরে বসতি গড়ার কিছু পরে বা আগে ‘চণ্ডীকাব্য’ লেখা হয়ে থাকতে পারে। তাতে হাটের কথা উল্লেখ থাকলেও সেটা সুতানুটির হাট কিনা সেটা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। গোবিন্দপুরে আসার পর শেঠ-বসাকরা বর্তমান শহিদমিনারের কাছে তাঁতশালা নির্মাণ করে বস্ত্র উৎপাদন করতেন। সেই বস্ত্র তাঁরা হাটখোলার হাটে বিক্রি করতেন। অন্যান্য তন্তুজীবী এবং বস্ত্রব্যবসায়ীরাও এখানে আসতেন বেচাকেনা করতে। ফলে হাটখোলা হয়ে উঠেছিল সুতিবস্ত্র এবং সুতোর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সম্ভবতঃ তখন থেকেই জায়গাটি সুতানুটির হাট নামে পরিচিত হয়েছিল, তার আগে পর্যন্ত সেটি হাটখোলা নামেই পরিচিত ছিল। কাজেই শেঠ-বসাকরাই সুতানুটির হাটের পত্তন করেছিলেন, ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে একথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আগেকার দিনে নদীপথ ছিল মালপত্র আনা-নেওয়ার প্রধান পথ। কাজেই নদীর ধারে কয়েকটি গ্রামের মাঝখানে সাধারণতঃ সেই হাট বসতো। নদীর এপার-ওপার দু’পারের লোকেরাই সেই হাটে বেচাকেনা করতে আসতেন। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই উপযুক্ত স্থানে সেই হাট গড়ে তুলতেন। হাটখোলার হাটটিও খুব সম্ভব ওভাবেই গড়ে উঠেছিল। পরে শেঠ-বসাকরা সেখানে বেচাকেনা করতে আসায় হাটটি সুতিবস্ত্রের হাট হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। সুতানুটির পত্তন সম্বন্ধে ইংরেজরা যা লিখে গিয়েছিলেন, সেটা ছিল শেঠ-বসাকদের কাছ থেকে তাঁদের শোনা কথা। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সুতানুটি নামকরণ সম্বন্ধে যেসব কিংবদন্তী আছে, সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক। কেউ বলেছেন ‘ছত্র-লাঠি’ অর্থাৎ ছাতার লাঠি বা বাঁট থেকে ‘সুতালুটি’, তা থেকে পরে সুতানুটি হয়েছিল। আবার কেউ বলেছেন, ‘নুটি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘গাঁট’, যাতে সুতো জড়ানো থাকে। ‘সুতোর গাঁট’ থেকে ‘সুতোনুটি’ বা সুতানুটি হয়েছিল। আবার কিছু গবেষকের মতে, ‘ছত্র’ হচ্ছে ‘সামিয়ানা’। সেটির নিচে প্রসাদ বিতরণ করা হতো। তাই জায়গাটির নাম প্রথমে হয়েছিল ‘ছুতানুটি’, পরে সেটা থেকে নাম হয়েছিল সুতানুটি। আসলে সুতানুটির নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে, ঠিক গোবিন্দপুরের মতন। ঐতিহাসিকরা সেই বিষয়ে যা বলেছেন, তা তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যাপার। তবে সুতিবস্ত্রের এবং সুতোর হাট থেকে হাটখোলার নাম বদলে গিয়ে সুতানুটির হাট হয়েছিল, এই ব্যাখ্যাই সাধারণের কাছে সহজবোধ্য। ইংরেজরা সুতানুটিতে আসার আগে সেখানকার হাটটি যে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল, ইংরেজ লেখকদের লেখাতেও তা স্পষ্ট করে বোঝা জসি। গোবিন্দপুর যেমন বসবাসের পক্ষে ভালো জায়গা ছিল, সুতানুটি তেমনি ছিল ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে ভালো জায়গা। কেবল শেঠ-বসাকরাই যে জায়গাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা নয়, জোব চার্নকও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। চার্নকের বক্তব্য ছিল - ‘‘চারিদল শেঠ ও বসাকেরা সপ্তগ্রামের অধঃপতনের সূচনা দেখিয়া গোবিন্দপুরে বসবাস করেন। তাঁহারা প্রথমে বেতোড়ের বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। বেতোড়ের অধঃপতনের পর সুতানুটির হাট প্রতিষ্ঠিত হয়।’’ ‘উইলসনের’ ‘আর্লি অ্যানালস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল - ‘‘বিদেশের বাজার এই জায়গাটির প্রতি এদেশী ব্যবসায়ী-বণিকদের, বিশেষ করে শেঠ-বসাক পরিবারকে আকৃষ্ট করে। ফলে তাঁরা তৎকালীন দ্রুত ধ্বংসোন্মুখ সপ্তগ্রাম ছেড়ে গোবিন্দপুরে এসে বসতিস্থাপন করেন এবং কলকাতার উত্তর দিকে সুতানুটির হাটের পত্তন করেন।’’ ওদিকে ‘হ্যামিলটন’ সাহেব লিখেছিলেন - ‘‘চাঁদপাল ঘাটের দক্ষিণের বনভূমি, যেটি পরে পরিষ্কার করা হয়, সেটি এবং খিদিরপুরের মধ্যে ছিল দুটি গ্রাম, যাদের অধিবাসীদের নিয়ে আসেন এখানকার প্রাচীন বাসিন্দা শেঠরা। এই শেঠরা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। তাঁরা কলকাতাকে নগরে পরিণত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেন।’’ জোব চার্নক সুতানুটিতে আসার আগে গোবিন্দপুর ছিল বর্ধিষ্ণু গ্রাম, সুতানুটি ছিল বড়ো বাণিজ্যকেন্দ্র এবং কলকাতায় ছিল জমিদারের কাছারিবাড়ি। সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদেরও বেশির ভাগ অংশ ছিলেন কৃষিজীবী। ‘তন্তুজীবী’দের সংখ্যাও নগণ্য ছিল না। ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষও সেই অঞ্চলে বাস করতেন। তখনকার অধিবাসীদের মূল দ্বন্দ্ব ছিল দুটি - (১) জমিদার বনাম কৃষক এবং (২) মালিক বনাম শ্রমিক। তাঁতশিল্পের মালিক শেঠ-বসাকদের কথা আগেই বলা হয়েছে। ‘তাঁতশিল্প’ই ছিল আদিকলকাতার ‘আদিশিল্প’ এবং ‘তাঁতশ্রমিক’রা ছিলেন কলকাতার ‘আদিশ্রমিক’। তাই সেই অঞ্চলে তখন যে বহু ‘তাঁতশ্রমিক’ বাস করতেন, তা বলাই বাহুল্য।

(তথ্যসূত্র:

১- কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, বিনয় ঘোষ।

২- The Early Annals of the English in Bengal, Charles Robert Wilson.

৩- কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়।

৪- কমলকুমার: কলকাতা পিছুটানের ইতিহাস, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়।

৫- তিন শতকের কলকাতা, নকুল চট্টোপাধ্যায়।

৬- কী করে কলকাতা হলো, পূর্ণেন্দু পত্রী।)

                        

No comments