Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

‘রহস্য যখন জোব চার্নকের সমাধিতে’ রানা চক্রবর্তী

কলকাতার ‘সেন্ট জন চার্চে’ জোব চার্নকের তথাকথিত সমাধিসৌধটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সম্ভবতঃ সেটির উপরের ফলকে লিখিত কথাগুলোও লক্ষ্য করেছেন। তাতে লেখা আছে -
‘‘D.O.MJobus Charnock, ArmigerAnglus, et nup in hocregno Bengalensi dignissim, A…

 




                              

কলকাতার ‘সেন্ট জন চার্চে’ জোব চার্নকের তথাকথিত সমাধিসৌধটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সম্ভবতঃ সেটির উপরের ফলকে লিখিত কথাগুলোও লক্ষ্য করেছেন। তাতে লেখা আছে -


‘‘D.O.M

Jobus Charnock, Armiger

Anglus, et nup in hoc

regno Bengalensi dignissim, Anglorum

Ageus. Mortalitatis suae exuvias

sub hoc marmore deposuit ut

in spe beatae resurrectionis ad

Christi Judicis adventum obdormirent

Qui postquam in solo non

Suo peregrinatus esset dice.

Reversus est domum suae

aeternitatis decimo die 10th Januarii 1692.’’


সাধারণ কোন মানুষের পক্ষে এই লেখার বিন্দুবিসর্গ বোঝা সম্ভব নয়, কারণ ভাষাটি হল শুদ্ধ ‘ল্যাটিন’। লেখাটির ‘বঙ্গানুবাদ’ করলে যেটা দাঁড়ায়, সেটা হল -


‘‘হে ঈশ্বর মৃতব্যক্তিদের স্মরণে রাখুন

জোব চার্নক নামক যে সজ্জন ইংরেজ-সন্তান

এই সমৃদ্ধ বঙ্গরাজ্যে ইংরেজের প্রতিনিধিরূপে

মহাপ্রয়াণ লাভ করেছেন

তিনি এই মর্মরের তলদেশে সঞ্চিত রেখেছেন

তাঁর নশ্বরতার শেষ-অবশেষ

যা এখানে অপেক্ষায় থাকবে

ন্যায়াধীশ খ্রীস্টের

শুভ-পুনরুত্থানের আশা নিয়ে;

এবং যিনি পরভূমি বিচরণের পর

প্রত্যাবর্তন করেছেন তাঁর শাশ্বত গৃহে

১০ জানুয়ারি ১৬৯২ তারিখে।’’


লেখাটির মধ্যে প্রথমেই যে ভুলটি নজরে আসে সেটি হল ‘সাল’। সালটি হবে ‘১৬৯৩’। সেটি ভুল করে ‘১৬৯২’ লেখা হয়েছিল। কেন না সমস্ত প্রামাণ্য ঐতিহাসিক নথি অনুসারে জোব চার্নক মারা গিয়েছিলেন ১৬৯৩ সালের ১০ই জানুয়ারি তারিখে। জোব চার্নকের সমাধিফলকের উপরে ‘ল্যাটিন’ ভাষায় যে কথাগুলো খোদিত করা হয়েছিল, সেটি রচনা করেছিলেন যাজক ‘জন ইভান্স’। ইনি ১৬৮৯ সালের ৬ই মার্চ তারিখে ‘মাদ্রাজের’ ‘সেন্ট অ্যান গীর্জা’য় জোবের তিন কন্যা ‘মেরি’, ‘এলিজাবেথ’ আর ‘ক্যাথারিন’কে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ‘যাজক ইভান্স’ ছিলেন জোবের সঙ্গী। তিনি বাংলাতেও ছিলেন। তবে তিনি বাংলায় ‘প্রথম যাজক বা পাদ্রী’ ছিলেন না। তিনি বাংলায় আসার বহু বছর আগে ১৫৯৯ সালে মোঘল বাদশাহ ‘আকবরের’ ফরমান বলে ‘পর্তুগীজ’রা ‘ব্যাণ্ডেল চার্চ’ নির্মাণ করেছিল। সেটি হচ্ছে ‘বাংলার প্রাচীনতম চার্চ বা গির্জা’। কাজেই ‘বাংলার প্রথম যাজক’ ‘ইভান্স’ ছিলেন না, ছিলেন কোনো ‘পর্তুগীজ’। ‘হুগলি-যুদ্ধের’ সময় ‘ইভান্স’ সস্ত্রীক জোবের সঙ্গে ছিলেন। ‘হিজলি-যুদ্ধের’ সময়েও ‘ইভান্স’ তাঁর সঙ্গ ছাড়েননি। ‘হিজলি’তে যাওয়ার পথে জোবের সঙ্গে তিনি ‘সুতানুটি’তে কিছুদিনের জন্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ পরে ‘হিজলি’ থেকে পালিয়ে এসে জোব যখন দ্বিতীয় বারের জন্যে ‘সুতানুটি’তে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনও ‘ইভান্স’ সস্ত্রীক জোবের সঙ্গী ছিলেন। জোব ছিলেন ‘কোম্পানির এজেন্ট’, ‘কোম্পানির প্রধান’ আর ‘ইভান্স’ ছিলেন ‘ধর্মীয় গুরু’, ‘ধর্মীয় প্রধান’। ধর্ম ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ‘যাজক’ ছাড়া বলতে গেলে তাঁরা এক পাও এগোতে পারতেন না। ‘ক্যাপটেন হীথ’ যখন ‘লণ্ডন’ থেকে এসে জোব আর তাঁর পারিষদদের জোর করে জাহাজে তুলেছিলেন, তখন ‘ইভান্স’ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সেই জাহাজে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘হীথের’ ওপরে বিলেতের কর্তাদের আদেশ ছিল ‘চট্টগ্রাম’ দখল করে ভারত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং বাণিজ্যিক সুবিধে আদায় করার জন্য। কিন্তু ‘চট্টগ্রাম-যুদ্ধে’ মোঘলদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে হীথ ‘জোব-ইভান্সদের’ নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মাদ্রাজে’ - ৫ই মার্চ, ১৬৮৯ তারিখে। এর ঠিক পরের দিন ‘ইভান্স’ জোবের মেয়েদের খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই দীক্ষাদানের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবক ছিলেন ‘এলিস’। তিনিও ছিলেন ‘ইভান্সের’ মতন জোবের হিতৈষী-বন্ধু। জোবের মেয়েদের ‘ধর্ম মা’ হয়েছিলেন ‘শ্রীমতী সিটন’ আর ‘শ্রীমতী হিথফিল্ড’। তাঁদের দু’জনেরই বাস ছিল ‘মাদ্রাজে’। তাঁরা ছিলেন যথাক্রমে ‘ক্যাপটেন ফ্রান্সিস সিটন’ আর ‘রবার্ট ফ্লিটউডের’ পত্নী। এই সুযোগে ‘ইভান্সের’ কথা আরেকটু বলে নেওয়া যাক। তিনি পরে ‘বাঙ্গোর’ আর ‘আয়ারল্যাণ্ডের’ অন্তর্গত ‘মিথের যাজক’ হয়েছিলেন। তিনি জোবের মেয়েদের দীক্ষাদানের পরে ধর্মের চেয়ে কর্মকেই জীবনে বেশি প্রাধান্য দিতে শুরু করেছিলেন। উচ্চ আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে তিনি এমন কিছু লোকের সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, যাঁরা ছিলেন কোম্পানির বিরুদ্ধ শিবিরের লোক। ফলে শেষপর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু জোবের শত্রু হয়ে উঠেছিলেন! তাই জোব যখন শেষবারের জন্যে ‘মাদ্রাজ’ থেকে ‘সুতানুটি’র পথে সপারিষদ রওনা হয়েছিলেন, তখন তাঁর দুঃসময়ের সঙ্গী বন্ধু ‘ইভান্স’ তাঁর সঙ্গী হতে পারেননি! কর্মক্ষেত্রে যাই হয়ে থাকুক না কেন, ‘ইভান্স’ যে তাঁর পুরনো বন্ধু জোবের প্রতি শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁর ‘কথামালা’, যা তিনি ‘ল্যাটিন’ ভাষায় রচনা করেছিলেন জোবের সমাধিফলকের জন্যে। তবে একটা কথা, ‘ইভান্স’ সত্যিই জোবের ‘সমাধিলিপি’ তৈরি করেছিলেন কিনা সে-বিষয়ে কলকাতা গবেষক ও ঐতিহাসিকদের সন্দেহ আছে।

                               

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় সেই সমাধিমন্দির, যেখানে সমাহিত আছে জোব চার্নকের মরদেহ? কে সেটি নির্মাণ করিয়েছিলেন? কার আমলে সেটি সংস্কার করা হয়েছে? জোবের স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের মরদেহ সেখানে সমাহিত আছে কি? জোব শেষবারের জন্যে ‘সুতানুটি’তে এসে বর্তমান ‘বেনেটোলা’ আর ‘শোভাবাজারের’ মধ্যবর্তী ‘মোহন টুনির ঘাটে’ নেমেছিলেন বলে অনেকে ধারণা করেন। ‘নিমতলা’র ‘আনন্দময়ী কালীমন্দিরের’ কাছে একটি প্রাচীন নিমগাছ ছিল, যেটির নাম থেকে ‘নিমতলাঘাট’ নামটা এসেছে। সেই গাছটার কিছুটা উত্তরে জোব সপারিষদ জাহাজ থেকে নেমেছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, ‘প্রথম ইংরেজ বসতি’টি গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ‘সুতানুটি’ গ্রামেই; আবার কেউ কেউ বলেন, ‘প্রাচীন কলকাতা গ্রামে’, ইংরেজমহলে যেটির পরিচিতি ছিল ‘সুতানুটি’ নামে। ‘কলকাতা’ আর ‘গোবিন্দপুর’ নাম দুটো ইংরেজমহলে তখন ছিল অপরিচিত। ১৭০০ সালের ২৭শে মার্চ পর্যন্ত ইংরেজরা চিঠির মাথায় কেবল ‘সুতানুটি’ লিখতেন, কেন না, ‘কলকাতা’ বা ‘গোবিন্দপুর’ লিখলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বলাই বাহুল্য, সেই ‘সুতানুটি’ ছিল ‘বৃহত্তর সুতানুটি’, যার অন্তর্গত ছিল ‘সুতানুটি’, ‘কলকাতা’ আর ‘গোবিন্দপুর’ নামে তিনখানি গ্রাম। ১৭০০ সালের ৮ই জুন থেকে কোম্পানির চিঠিপত্রে ‘সুতানুটি’র পরিবর্তে ‘কলকাতা’ নামটি লেখা হতে শুরু হয়েছিল। এই ‘কলকাতা’-ও গ্রাম তিনখানির সমষ্টির নাম, যা পরে আরো বিস্তৃত হয়ে ভুবনবিখ্যাত হয়ে ওঠে। তবে বর্তমান ‘কলকাতা’র নাম ‘সুতানুটি’ হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকতো না। কেউ কেউ বলেন, ১৬৯০ সালে জোব চার্নক সপারিষদ আশ্রয় নিয়েছিলেন ‘লালদীঘি’ আর গঙ্গার মধ্যবর্তী জায়গায়, ‘পর্তুগীজদের’ তখনকার বসতি এলাকায়। গবেষকরা বলেন এটাই সঠিক তথ্য। জোবের মরদেহ সমাহিত হয়েছিল তখনকার ‘কলকাতা গ্রামে’। বর্তমান ‘হেস্টিংস স্ট্রীটের’ ‘সেন্ট জন চার্চ ইয়ার্ডের উত্তর-পূর্ব কোণে’ তাঁর সমাধিসৌধটি এখনো বর্তমান আছে। সেই সমাধিসৌধটি আকৃতিতে আট-কোণা। আকারে বিশাল। সেটির চারধারের দেয়ালে খাঁজ কাটা রয়েছে। সেটির মাথার ওপরে আছে ভস্মাধারযুক্ত গম্বুজাকার একটি ঘর। সেটির স্থাপত্যরীতি ‘সারাসেণীয়’। অনেকের মতে, সেটি ‘কলকাতার প্রাচীনতম স্থাপত্য’ অর্থাৎ ইঁটের কাজের নিদর্শন। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে নেওয়া যাক। কিছু গবেষকের বিশ্বাস, কলকাতায় ইংরেজরা আসার আগে ‘পর্তুগীজ’ আর ‘আর্মেনিয়ান’রা বসতিস্থাপন করেছিলেন। তবে জোবের সমাধিফলকটি কলকাতায় তৈরি হয়নি। সেটি আনা হয়েছিল ‘তামিলনাড়ু’র ‘পল্লভরম’ থেকে। সেটি তাঁর সমাধিমন্দিরের গায়ে না থাকলে তাঁর সমাধিটি সনাক্ত করা খুব কঠিন হতো। অবশ্য সেই সমাধিমন্দিরেই যে তাঁর মরদেহ সমাহিত আছে, সেটা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। কারণ ‘সমাধিফলক’টি ছাড়া অন্য কোনো রেকর্ড নেই, কোনো প্রমাণ নেই, কোনো সাক্ষী নেই। কাজেই এই বিষয়ে গবেষক ও ঐতিহাসিকদের সন্দেহ আগেও ছিল, এখনও আছে। আর সন্দেহ না থাকলে ১৮৯২ সালের ২২শে নভেম্বর তারিখে ‘সেন্ট জন চার্চের’ তৎকালীন পাদ্রী ‘এইচ.বি.হাইড’ নিজেই জোবের কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কেন? কবরটি যে-শ্রমিকরা খুঁড়েছিল, তাঁদের নামের উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। ‘হাইডের বিবরণ’ থেকে জানা যায়, ছ-ফুট খোঁড়ার পরে একটি সমতল জায়গা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, যেটির পশ্চিম দিকে আরেকটু খুঁড়তেই একটা অস্থি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এরপর খোড়াখুঁড়ির কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। অস্থিটি দেখে ‘হাইড’ অনুমান করেছিলেন যে, সেটি কোন মৃত ব্যক্তির বাঁ হাতের সামনের অংশ। সেটি রাখা হয়িছিল মৃত ব্যক্তির বুকের ওপরে আড়াআড়িভাবে। অস্থিটি যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেসময় ‘হাইড’ আরো একটি বস্তু আবিষ্কার করেছিলেন। হাইড প্রথমে বস্তুটিকে ভেবেছিলেন একটি পেরেক, যা সচরাচর কফিন বা শবাধারে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পরীক্ষা করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সেটি একটি অস্থিখণ্ড। তিনি অনুমান করেছিলেন, অস্থিখণ্ডটি মৃত ব্যক্তির বাঁ হাতের মধ্যমাঙ্গুলির অংশবিশেষ। সেটিও তিনি যে অবস্থায় ছিল, সে-অবস্থাতেই রেখে দিয়েছিলেন। ‘হাইড’ অনুমান করেছিলেন, মৃত ব্যক্তির সম্পূর্ণ কঙ্কালটি আরো কিছুটা খুঁড়লেই প্রকাশ হয়ে পড়বে। কিন্তু তিনি খোড়াখুঁড়ির পরিবর্তে কবরটি ভরাট করিয়ে দিয়েছিলেন। এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? একজন ব্যক্তির মরদেহ সেখানে সমাহিত আছে, এই তো? কিন্তু সেই ব্যক্তিটি কে? সন্দেহ যখন হয়েছিল, তখন তা নিরসনের জন্যে ‘হাইড’ সেটার শেষ দেখেননি কেন? কেন তিনি জোব চার্নকের নামাঙ্কিত কোনো বস্তু আবিষ্কারের চেষ্টা করেননি? কেন তিনি খননশ্রমিক ছাড়া কোনো সাক্ষী রাখেননি? আর খননশ্রমিকদের নাম-ঠিকানাই বা তাঁর বিবরণে তিনি উল্লেখ করেননি কেন? খননশ্রমিকরা উল্লেখযোগ্য নয় বলে? নাকি অন্য কোনো কারণে? আসলে তাঁর পুরো বিবরণটিই ধোঁয়াশায় মোড়া, রহস্যজনক। এর দ্বারা জোবের সমাধি রহস্যের সমাধান তো হয়ই না, বরং সেই রহস্য আরো বেড়ে যায়। অথচ মজার ব্যাপার হল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘দালাল’ এবং পূজারীরা অন্ধভাবে ‘হাইডের বিবরণ’কেই বেদবাক্য বলে ধরে নিয়েছেন! জোব চার্নককে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতার আসনে বসানোর সম্ভবতঃ সেটাই ছিল প্রথম চেষ্টা। আর সেই চেষ্টা শুরু হয়েছিল জোবের মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পরে!


জোবের ‘সমাধিফলক’টিও রহস্যজনক। কেন না, জোবের মৃত্যু হয়েছিল ১৬৯৩ সালে, অথচ ‘সমাধিফলকের লিপি’ অনুসারে তাঁর মৃত্যুর সন ১৬৯২। তাজ্জব ব্যাপার! ফলকটি যদি তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তৈরি হয়ে থাকবে, তাহলে এত বড়ো ভুল হয় কী করে? পাদ্রী ‘ইভান্সের’ কী পাঁজিজ্ঞান ছিল না? অধিকাংশ গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে সেটি ‘ইভান্সের’ তৈরি ছিল না। জোবের মৃত্যুর বহু বছর পরে যখন তাঁকে ‘কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা’ বানানোর চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, সেসময় সেটি তৈরি করা হয়েছিল। যিনি বা যাঁরা সেটি তৈরি করেছিলেন, জোবের মৃত্যুর সঠিক সনটি তাঁদের জানা ছিল না। তাই তাঁরা আন্দাজে ১৬৯২ সাল বসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বাঘা বাঘা ঐতিহাসিক এবং গবেষকরা ১৬৯২ সালকেই জোবের মৃত্যুর বছর ঘোষণা করে আসছিলেন। ‘রেজা বিবি’র সমাধিফলকটি যেমন রহস্যজনক, জোব চার্নকের সমাধিফলকটিও ঠিক সেরকমই রহস্যজনক। জনশ্রুতি অনুসারে, জোবের স্ত্রীর মরদেহ জোবের সমাধিমন্দিরে সমাহিত আছে। অথচ কোনো ফলকে তাঁর স্ত্রীর নাম নেই। ‘হাইড’ লিখেছিল, ‘‘চার্নক আর তাঁর হিন্দু-স্ত্রী দু’জনেই একই সমাধির মধ্যে শায়িত আছেন কিনা তা নির্ণয় করার কোনো পথ নেই। সমাধিটি যদি আরো গভীরভাবে খোড়া হতো, তাহলে হয়তো তা নির্ণয় করা যেতো। কিন্তু তা নানা কারণে অসম্ভব।’’ জোবের স্ত্রীর মৃত্যুকাল নিয়েও বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক ও গবেষকরা মনে করেন, জোবের মৃত্যুর আগেই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। না হলে জোবের ‘উইলে’ তাঁর স্ত্রীর উল্লেখ নেই কেন? অনুমান করা হয়, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল জোব কলকাতায় আসার কিছুদিন পরেই। জোবের সমাধিমন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল, তাঁর ‘বড়ো জামাই’ ‘চার্লস আয়ারের’ উদ্যোগে, ১৬৯৭-৯৮ সালে। সেটি তৈরি করতে যে টাকা খরচ হয়েছিল, তা তিনি নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলেন, না কী কোম্পানির ঘর থেকে দিয়েছিলেন, সেটা বলা সম্ভব নয়। ১৮৯২ সালে ‘পূর্ত বিভাগ’ (পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট) সেটি মেরামত করেছিলেন। ‘সেন্ট জন চার্চ ইয়ার্ডের’ মধ্যে জোবের সমাধিমন্দিরটি অবস্থিত হলেও সেই চার্চটি তৈরি হয়েছিল জোবের মৃত্যুর অনেক বছর পরে। সেটি আগে ‘পাথুরে গীর্জা’ নামে পরিচিত ছিল। জোবের সমাধিমন্দিরটি গড়ে ওঠার সময় ‘সেন্ট জন চার্চ ইয়ার্ডের’ জমিটি ছিল সম্ভবতঃ একটি রেকর্ড-বহির্ভূত সমাধিক্ষেত্র। যে সব ইংরেজ বাণিজ্যসূত্রে এদেশে এসে জাহাজে বা হাটে-বাজারে মারা যেতেন, তাঁদের সেখানে সমাহিত করা হতো বলে কেউ কেউ মনে করেন। জোব দ্বিতীয়বার এবং শেষবার যখন সপারিষদ ‘সুতানুটি কলকাতা’য় অবস্থান করেছিলেন তখন সেই অঞ্চলটি ছিল ‘ম্যালেরিয়া’ রোগের ঘাঁটি। কাজেই সেসময় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র যেসব কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছিল তাঁদেরও সমাহিত করা হয়েছিল সেই সমাধিক্ষেত্রে। জোব সেই দুই সময় মিলে মোট প্রায় সাড়ে তিন বছর তাঁর দলবল নিয়ে সেখানে ছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে জোবের আগে তাঁর দলের কারোর মৃত্যু হয়নি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কাজেই যাঁদের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁদের সেই সমাধিক্ষেত্রেই সমাহিত করা হয়েছিল। তাছাড়া অনুমান করা হয়, জোবের স্ত্রী এবং তাঁর শিশুপুত্রের মৃত্যুও ঘটেছিল সেই সময়। তাঁর স্ত্রীর কথা একটু আগেই বলা হয়েছে। তাঁর শিশুপুত্রকেও সেই সমাধিক্ষেত্রে, এমনকি জোবের নামে চিহ্নিত সমাধিমন্দিরে সমাহিত করা হয়েছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। জোবের শিশুপুত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর ‘উইলে’। সেই শিশুপুত্রটিকে উইলে মৃত বলা হয়েছিল। তাঁর জন্মের তারিখ সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি। সম্ভবতঃ জোব শেষবার ‘সুতানুটি’তে আসার পরেই তাঁর সেই শিশুপুত্রের জন্ম হয়েছিল। তাহলে জোব গেলেন, তাঁর স্ত্রী গেলেন, তাঁর ছেলে গেল। এবার আসা যাক, তাঁর তিন মেয়ের কথায়৷

                              

জোবের বড়ো মেয়ে ‘মেরি’ মারা গিয়েছিলেন ১৬৯৭ সালোর ১৯শে ফেব্রুয়ারি তারিখে। বাবার সমাধিসৌধের মধ্যেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। বাবার সমাধিফলকের নিচে ‘মেরির সমাধিলিপি’তে ‘ল্যাটিন’ ভাষায় লেখা আছে -


‘‘Partier Jacet

MARIA, JOBI PRIMOGENITA CAROLI

EYRE ANGLORUM HICCE, PRAEFECTI

CONJUX CHARISSIMA, QUAE OBIIT

19 DIE FEBRUARII A. D. 1696 (97).’’


এর বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় - ‘‘তিনি ছাড়া এখানে শায়িতা আছেন জোবের প্রথম কন্যা, ইংলন্ডের চার্লস আয়ারের প্রিয়তমা পত্নী, মেরি, যিনি ১৬৯৬ (৯৭) সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মারা গিয়েছেন।’’ এক্ষেত্রেও সমাধিলিপিতে সালের গণ্ডগোল! ‘১৬৯৭’ হয়েছে ‘১৬৯৬’। একই প্রস্তরফলকে দুই লিপি, দুটি ভিন্ন সময়ে লেখা হয়েছিল। ‘চার্লস আয়ার’ দেশে গিয়েছিলেন ১৬৯৮ সালে, আর ফিরে এসেছিলেন ১৭০০ সালে ‘স্যার’ উপাধি নিয়ে। ‘মেরির সমাধিলিপি’তে ‘আয়ারের’ নামের আগে ‘স্যার’ উল্লেখ করা নেই বলে ১৬৯৮ সালে তিনি দেশে ফেরার আগেই লিপিটি লেখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। তবে এই সমাধিলিপিটিও রীতিমতন রহস্যজনক। জোবের মেজো মেয়ের নাম ছিল ‘এলিজাবেথ’। তিনিও মারা গিয়েছিলেন কলকাতায়। তাঁর মৃত্যুর তারিখ হল - ২রা আগস্ট ১৭৫৩ সাল, পলাশীর যুদ্ধের ঠিক ৪ বছর আগে। তাঁর গোরস্থানটি ঠিক কোথায়, তা এখনো গবেষকদের কাছে অজ্ঞাত। তবে সেটি ‘সেন্ট জন চার্চ ইয়ার্ডে’ নেই। জোবের ছোটো মেয়ে ‘ক্যাথারিন’ মারা গিয়েছিলেন - ১৭০১ সালের ২১শে জানুয়ারি। তাঁর মরদেহ সমাহিত আছে ‘সেন্ট জন চার্চ ইয়ার্ডে’। জোবের ঠিক পাশেই। তাঁর সমাধিলিপি আলাদা, সমাধিলিপির ফলকে ‘ল্যাটিন’ ভাষায় লেখা আছে -


‘‘Hic Jacet

CATHERINE WHITE

Domini Jonathanis White, uxor

dilectissima et Tov Makapitov

Jobi Charnock filia natu minima;

quae primo in partu et actatis

flore annum agens urum de viginte:

Mortem obit hen! immaturam 21 Januarii,

1700/1,

Siste parumper, Christiane Dector,

(Vel quis quis es tandem) et mecum defle

Duram sexus muliebris sortem

Qui per elapsa tot annorum millia

Culpam prim Evae luit Parentis

et lust usque; Dum aeternum stabit

‘In dolore paries filios’ - Genesis III.16’’


এর বাংলা-রূপান্তর হল - ‘‘এখানে শায়িতা আছেন জোনাথন হোয়াইটের প্রিয়তমা স্ত্রী, জোব চার্নকের কনিষ্ঠা কন্যা ক্যাথারিন হোয়াইট, যিনি তাঁর প্রথম সন্তান প্রসবকালে ঊনিশ বছর বয়েসে যৌবনের উন্মেষ-সময়ে অকালমৃত্যু বরণ করেছেন ১৭০০/১৭০১ সালের ২১ জানুয়ারি তারিখে। দাঁড়াও ক্ষণকাল, খ্রীষ্টান পাঠকবর্গ, যাঁরাই হও না কেন তোমরা; এবং আমার মতন নারীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে নারীর দুর্ভাগ্যের জন্যে তোমরা শোক কর, যে নারী হাজার হাজার বছর ধরে তাঁর চলার পথে তাঁর আদিমাতা ইভের পাপের ফল ভোগ করে চলেছে, আর যতদিন শাশ্বত বিধান বজায় থাকবে, তদ্দিন ভোগ করবেই – ‘তোমাকে কষ্টের মধ্যেই প্রসব করতে হবে পুত্রসন্তান’ – জেনেসিস ৩য়, ১৬।’’ এখানেও ‘ক্যাথারিনের’ মৃত্যুবছরের গণ্ডগোল লক্ষণীয়।

পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, জোব চার্নকের সমাধিমন্দিরটি কলকাতার অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য বস্তু। ব্রিটিশ কলকাতার আদিযুগের বহু রহস্য জমা আছে সেটির মধ্যে। সে সব সহজে উদ্‌ঘাটিত হওয়ার নয়। সেগুলো উদ্ঘাটনের জন্যে চাই সাহস, সুযোগ আর সংস্কারমুক্ত মন। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা কে বাঁধবেন?

                           

(তথ্যসূত্র:

১- কলকাতার সৃষ্টি ও জব চার্নক, শ্রী পি টি নায়র।

২- The Job Charnock Riddle, Victor Ghoshe.

৩- কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়।)

                  

No comments