Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

মহর্ষি হওয়ার আগে’ রানা চক্রবর্তী

‘১৭৩৯ শকের ৩রা জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার, ইংরাজী ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের ১৫ই মে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পৈত্রিক জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের বড় ছেলে। দেবেন্দ্রনাথের আর দুইজন ছোট ভাই ছিলেন - ‘গিরীন্…

 






১৭৩৯ শকের ৩রা জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার, ইংরাজী ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের ১৫ই মে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পৈত্রিক জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের বড় ছেলে। দেবেন্দ্রনাথের আর দুইজন ছোট ভাই ছিলেন - ‘গিরীন্দ্রনাথ’ ও ‘নগেন্দ্রনাথ’। দেবেন্দ্রনাথের শৈশব সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তাঁর স্বরচিত জীবনচরিত তাঁর আঠারো বছর বয়সের সময় থেকে আরম্ভ হয়েছে। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সকলেই বয়সে তাঁর চেয়ে ছোট হওয়ায় তাঁর ছেলেবেলার কথা কারও কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তাঁর আত্মচরিতের গোড়ায় তিনি নিজের শৈশব সম্বন্ধে যেটুকু লিখেছিলেন, তা থেকে জানা যায় যে, তাঁর পিতামহী, ‘রামলোচন ঠাকুরের স্ত্রী’র কাছে তিনি মানুষ হয়েছিলেন। তাঁর সেই পিতামহী অতিশয় ধর্মশীলা স্ত্রীলোক ছিলেন। তাঁর কাছে যে দেবেন্দ্রনাথ মানুষ হয়েছিলেন এবং ছেলেবেলায় আর কোন লোকের প্রভাব যে তাঁর উপরে তেমন করে পড়েনি - এই কথাটি একেবারে সত্যি। জন্মাধিকারসূত্রে তিনি কি পেয়েছিলেন বা না পেয়েছিলেন, তার চেয়েও এটা অনেক বড় কথা। ছেলেবয়সে ধর্মের আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠবার জন্যই দেবেন্দ্রনাথের তরুণ মনে ধর্মনিষ্ঠার সংস্কার একেবারে দৃঢ়রূপে মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর নিশ্বাসপ্রশ্বাস, শয়নভোজন, খেলাধূলার ভিতর দিয়ে ধর্মনিষ্ঠার ভাব তাঁর অন্তরের মধ্যে বসে গিয়েছিল। তাঁর দিদিমাসম্বন্ধে স্বরচিত জীবনচরিতে তিনি লিখেছিলেন, “দিদিমা আমাকে বড় ভালবাসিতেন। শৈশবে তাঁহাকে ব্যতীত আমিও আর কাহাকে জানিতাম না। আমার শয়ন, উপরেশন, ভোজন সকলই তাঁহার নিকট হইত। তিনি কালীঘাটে যাইতেন, আমি তাঁহার সহিত যাইতাম। তিনি যখন আমাকে ফেলে জগন্নাথ ক্ষেত্রে ও বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন, তখন আমি বড়ই কাঁদিতাম। ধৰ্ম্মে তাঁহার অত্যন্ত নিষ্ঠা ছিল। তিনি প্রতিদিন অতি প্রত্যুষে গঙ্গাস্নান করিতেন এবং প্রতিদিন শালগ্রামের জন্য স্বহস্তে পুষ্পের মালা গাঁথিয়া দিতেন। কখনো কখনো তিনি সংকল্প করিয়া উদয়াস্ত সাধন করিতেন - সূর্যোদয় হইতে সূর্য্যের অস্তকাল পর্য্যন্ত সূর্য্যকে অর্ঘ্য দিতেন। আমিও সে সময়ে ছাতের উপরে রৌদ্রেতে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে থাকিতাম এবং সেই সূর্য্য অর্ঘ্যের মন্ত্র শুনিয়া শুনিয়া আমার তাহা অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। ‘জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং। ধ্বান্তারিং সর্বপাপরং প্রণতোঽস্মি দিবাকরং॥’ দিদিমা এক এক দিন হরিবাসর করিতেন, সমস্ত রাত্রি কথা হইত এবং কীর্ত্তন হইত; তাহার শব্দে আমরা আর রাত্রিতে ঘুমাইতে পারিতাম না। তিনি সংসারের সমস্ত তত্ত্বাবধারণ করিতেন এবং স্বহস্তে অনেক কার্য্য করিতেন। তাঁহার কার্য্যদক্ষতার জন্য তাঁহার শাসনে গৃহের সকল কার্য্য সুশৃঙ্খলরূপে চলিত। পরে সকলের আহারান্তে তিনি স্বপাকে আহার করিতেন। আমিও তাঁহার হব্যিান্নের ভাগী ছিলাম। তাঁহার সেই প্রসাদ আমার যেমন স্বাদু লাগিত, তেমন আপনার খাওয়া লাগিত না। তাঁহার শরীর যেমন সুন্দর ছিল, কার্য্যেতে তেমনি তাঁহার পটুতা ছিল, এবং ধর্ম্মেতেও তেমনি তাঁহার আস্থা ছিল। কিন্তু তিনি মা-গোঁসায়ের সতত যাতায়াত বড় সহিতে পারিতেন না। তাঁহার ধর্ম্মের অন্ধবিশ্বাসের সহিত একটু স্বাধীনতাও ছিল। আমি তাঁহার সহিত আমাদের পুরাতন বাড়ীতে গোপীনাথ ঠাকুর দর্শনার্থে যাইতাম। কিন্তু আমি তাঁহাকে ছাড়িয়া আসিতে ভালবাসিতাম না। তাঁহার ক্রোড়ে বসিয়া গবাক্ষ দিয়া শান্ত ভাবে সমস্ত দেখিতাম।” এই সামান্য একটুখানি বর্ণনা পড়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়ীর যে পারিবারিক ছবিটি মনে জেগে ওঠে, তাতে একটি চমৎকার সরল শ্রী আছে। তাতে ঐশ্বর্য্যের কোন গন্ধ নেই। দেবেন্দ্রনাথের জন্মের সময় দ্বারকানাথ ঠাকুর লক্ষ্মীর বর লাভ করেন নি - সবে ষোড়শোপচারে লক্ষ্মীর পূজার আয়োজন করছিলেন মাত্র। তবু মনে হয় যে, দ্বারকানাথের ঐশ্বর্য্যের সময়েও সেকালের অন্তঃপুরের সেই সরল গার্হস্থ্য গ্রাম্য শ্রীটি নষ্ট হয়নি৷ জোড়াসাঁকোর যে বাড়ীতে পরে ‘গিরীন্দ্রনাথের বংশধর ‘গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ও ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ বাস করতেন, সেটাই দ্বারকানাথ ঠাকুরের বৈঠকখানাবাড়ী ছিল। সেটা তখনকার হাল-ফ্যাশানে তৈরি হয়েছিল, এবং মূল্যবান আসবাব ও সজ্জায় সাজানো ছিল। তাঁর প্রমোদভবন ছিল বেলগাছিয়ার ভবনে। জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক বাড়ী নিজের প্রাচীন শ্রীসৌন্দর্য্য রক্ষা করে চলছিল। ‘রবীন্দ্রনাথ’ নিজের ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়ী যেমন দেখেছিলেন, তাঁর পিতার বাল্যকালে সেই বাড়ীর চেহারা ঠিক তেমন না হলেও একেবারেই যে অন্যরকমের ছিল একথা মনে হয় না। তার কারণ হল, ‘রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছিলেন যে, তাঁর ছেলেবেলাতেও “সহর এবং পল্লী অল্প বয়সের ভাই-ভগিনীর মত অনেকটা এক রকম চেহারা লইয়া প্রকাশ পাইত।” রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার জোড়াসাঁকোর বাড়ীর দোতলার দক্ষিণপূর্ব কোণের ঘরের জানালার নীচেই একটা ঘাট-বাঁধানো মস্ত পুকুর ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “তাহার পূর্ব্ব ধারের প্রাচীরের গায়ে প্রকাণ্ড চীনাবট এবং দক্ষিণধারে নারিকেলশ্রেণী ছিল। ... বাড়ীর ভিতরে যে বাগান ছিল ... তাহার মাঝখানে ছিল একটা গোলাকার বাঁধানো চাতাল। ... উত্তর কোণে একটা ঢেঁকিঘর ছিল, সেখানে গৃহস্থালির প্রয়োজনে মাঝে মাঝে অন্তঃপুরিকাদের সমাগম হইত। ... আমাদের বাড়ীর উত্তর অংশে আর একখণ্ড ভূমি পড়িয়া আছে, আজ পৰ্য্যন্ত ইহাকে আমরা গোলাবাড়ী বলিয়া থাকি। এই নামের দ্বারা প্রমাণ হয়, কোনো এক পুরাতন সময়ে ওখানে গোলা করিয়া সম্বৎসরের শস্য রাখা হইত।” বাড়ীর ভিতরে আর একটা পুকুর ছিল বলে শোনা যায়; বাড়ীর একজন কাজের লোক সেখানে ডুবে মারা যাওয়ার পরে সেই পুকুরটা ভরাট করে ফেলা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, তাঁদের শিশুকালে ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না বললেই হয় এবং মোটের উপরে তখনকার জীবনযাত্রা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সাদাসিধা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর কালের কোন প্রাচীন লোকের কাছে গল্প করেছিলেন যে, তাঁর যখন তিন বছর বয়স, তখন তিনি একটা ছোট মোড়ার উপরে দাঁড়িয়ে ঘরের কপাটের আগল খুলতেন, সে কথা তাঁর বেশ মনে পড়ে। আর বেতের কুন্‌কিতে করে সকালে মুড়িমুড়কি প্রভৃতি গ্রাম্য জলখাবার খেতেন। অতএব দ্বারকানাথের পরিবার বিখ্যাত ধনী পরিবার হলেও সেকালের জীবনযাত্রার সরল ব্যবস্থাগুলি পুরুষানুক্রমে সেই পরিবারে যে চালু ছিল, সেটা স্পষ্টই দেখতে পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথের দিদিমার কথা যেটুকু তিনি লিখে গিয়েছেন, তা থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণেও পাওয়া যায় যে, বাড়ীর ভিতরে সেকালের গৃহস্থালির ব্যাপার অত্যন্ত সাদাসিধা ছিল। সেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ চলত। ‘দ্বিজেন্দ্রনাথ’ জানিয়েছিলেন যে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতি তাঁর মনে অত্যন্ত অস্পষ্ট। কেবল তাঁর মনে ছিল যে, দ্বারকানাথের ঐশ্বর্য্যের আমলে টাকার তোড়া গুণে না নিয়ে ওজন করে নেওয়া হত। এত টাকা! এবং গাড়ীঘোড়া ও লোকজনের সমাগমে বৈঠকখানাবাড়ী গমগম করত। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলার একটি ঘটনা একদিন তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী ‘সৌদামিনী দেবী’কে বলেছিলেন। ঘটনাটি হল - যখন তাঁর পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, তখন ঠাকুরঘরে একদিন গিয়ে তিনি দেখেছিলেন যে, সেই ঘরে কেউ নেই, কেবলমাত্র সিংহাসনের উপরে শালগ্রাম শিলাটি ছিল। তিনি সেই শিলাটিকে আস্তে আস্তে তুলে নিয়ে বাইরে এসে মাটিতে গড়িয়ে মনের আনন্দে খেলা করছিলেন - ওদিকে পূজারী ব্রাহ্মণ এসে দেখেছিলেন যে, সিংহাসনে ঠাকুর নেই। ঠাকুর কে নিয়ে গেল বলাতে বাড়ীতে মহাহুলস্থূল বেঁধে গিয়েছিল। চারদিকে খোঁজ করতে করতে একজন এসে দেখেছিলেন যে, বালক দেবেন্দ্রনাথ শালগ্রাম শিলা নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে খেলা করছেন। সেই খবর দিতেই বাড়ীর সব মেয়েরা ছুটে এসে তাঁকে বলেছিলেন – “দেবেন্দ্র! এ কি সর্বনাশ! ঠাকুরকে লইয়া খেলা! কি মহা বিপদই না জানি ঘটিবে!” শেষে আবার অভিষেক করে ঠাকুরকে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। তারপরে বালকের যাতে কোন অনিষ্ট না হয় সেজন্য শান্তি-স্বস্ত্যয়নের ধূম পড়ে গিয়েছিল। যাঁরা মহাপুরুষদের জীবনে অল্প বয়সেই মহত্ত্বের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় বলে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এই ঘটনা পড়ে যে খুব পুলকিত হয়ে উঠবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাছে এটা নিছক ছেলেমানুষির ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলে মনে হবে না। শালগ্রাম শিলা নিয়ে খেলা করে থাকলেও দিদিমার প্রভাবে এবং বাড়ীতে সবসময় তাঁকে পূজা-পার্বণ ও ব্রতোপবাসাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখে ছেলেবয়সেই দেবেন্দ্রনাথের মনে দেবতার প্রতি একান্ত ভক্তির সঞ্চার হয়েছিল। ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠার পর তাঁকে কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি যে অভিনন্দন দিয়েছিলেন, তার জবাবে তিনি লিখেছিলেন, “প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শাল গ্রামশিলার অর্চ্চনা দেখিতাম, প্রতিদিন যখন বিদ্যালয়ে যাইবার পথে ঠন্ঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীকে প্রণাম করিয়া পাঠের পরীক্ষা হইতে উত্তীর্ণ হইবার জন্য বর প্রার্থনা করিতাম, তখন মনের এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রামশিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভূজা সিদ্ধেশ্বরী।”

                                ©️রানা©️

দেবেন্দ্রনাথের অল্প বয়সেই তাঁর পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুর ঘরেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, পারসী - এই চারটি ভাষা তাঁকে পড়তে হত এবং একটু বড় হলে ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ব্যায়াম ও সঙ্গীতাদিও শিক্ষা করতে হত। যাঁরা ইতিহাস সচেতন তাঁরা সকলেই জানেন যে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে রামমোহন রায়ের পরম বন্ধুত্ব ছিল। হিন্দুকলেজ স্থাপনে দ্বারকানাথ একজন প্রধান উদ্যোগী হলেও নিজের ছেলেকে তিনি হিন্দুকলেজে ভর্তি না করে রামমোহন রায়ের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। রামমোহন রায়ের সেই স্কুল খোলার একটু ইতিহাস আছে – সেটা এখানে বলা দরকার। রামমোহন রায় যখন ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে কলিকাতায় এসে স্থায়ী ভাবে বাস করতে শুরু করেছিলেন, তখন এদেশের লোককে ভাল রকম করে ইংরাজী শিক্ষা দেবার জন্য একটা ভাল বিদ্যালয় খোলার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছিলেন। এর চৌদ্দ বছর আগে, ‘ডেভিড হেয়ার’ নামে একজন ঘড়ির ব্যবসায়ী স্কচ্ ভদ্রলোক এদেশে এসেছিলেন। তিনি সুশিক্ষিত না হলেও, তাঁর আশ্চর্য্য বদান্যতা ও সহৃদয়তার সাহায্যে তিনি এদেশের লোকের মন আকৃষ্ট করেছিলেন। রামমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব জমে গিয়েছিল। হেয়ার ও রামমোহন রায়ের চেষ্টায় একটা ভাল ইংরেজি কলেজ খোলার প্রস্তাব তখনকার সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ‘স্যার হাইড্‌ইষ্ট’ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মুস্কিল হয়েছিল রামমোহন রায়কে নিয়ে। তিনি কলেজ কমিটিতে থাকবেন শুনে অনেক পৌত্তলিক হিন্দু ভদ্রলোক সেই কলেজের সঙ্গে কোন সংস্রব রাখবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। রামমোহন রায় সে কথা শোনামাত্র কমিটির সভ্যপদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারী হিন্দু কলেজ বা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপরে রামমোহন রায় নিজেই একটা ইংরাজী স্কুল খুলেছিলেন। সেটার ব্যয়ভার রামমোহন রায় সম্পূর্ণরূপে নিজেই বহন করতেন। ‘নৃপেন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ‘রমাপ্রসাদ রায়’, ‘ক্ষেত্রমোহন চট্টোপাধ্যায়’, ‘মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘শ্যামাচরণ দে’ - প্রভৃতি কয়েকজন রাজার স্কুলের প্রথম ছাত্র ছিলেন। সেই স্কুলেই দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “রামমোহন রায় নিজে গাড়ী করিয়া আমাকে লইয়া গিয়া আপনার ইস্কুলে ভর্তি করিয়াছিলেন। রাজার সঙ্গে যাইবার সময়, আমি বিমুগ্ধ চিত্তে রাজার সুন্দর গম্ভীর, ঈষৎ বিষাদমিশ্রিত মুখের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া ইস্কুলে গিয়াছিলাম।” ছেলেবেলায় দেবেন্দ্রনাথ যে তাঁর পিতার সঙ্গ খুব বেশি পেতেন, সেটা মনে হয় না। তাঁর সাতাত্তর বছর বয়সে তিনি ‘উমেশচন্দ্র দত্ত’কে একদিন গল্প করেছিলেন যে, ছেলেবেলায় স্কুল থেকে ফিরে বাবার বৈঠকখানার চারদিকে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। বৈঠকখানায় ঢুকতে তাঁর ইচ্ছা হত, অথচ তিনি সাহস পেতেন না। একদিন তাঁর পিতা নিজেই তাঁকে বলেছিলেন, “তুই ছুটে ছুটে বেড়াস্ কেন, বৈঠকখানার ভিতরে বসতে পারিস্ না?” তবুও তাঁর ভরসা হত না। তারপরে এক সময় হঠাৎ সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন যে ভিতরে বেশ ফুলের তোড়া, বৈঠকখানাটি নানা সুন্দর জিনিস দিয়ে সাজানো। তখন থেকে তাঁর বৈঠকখানায় বসবার অধিকার হয়েছিল। সেইখানে বসে অভিধান দেখে তিনি পড়া শিখতেন। এই গল্প করে তিনি উমেশচন্দ্রকে বলেছিলেন, “এখন সে বাবা নাই, আদত বাবা ছুটাছুটি ছাড়িয়া তাঁর ঘরে বসিতে বলিয়াছেন। বেশ লাগিতেছে।” চৌদ্দ বছর বয়সে দেবেন্দ্রনাথ, ‘নৃপেন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ‘রমাপ্রসাদ রায়’ প্রভৃতি সতীর্থের সঙ্গে হিন্দুকলেজে প্রবেশ করেছিলেন। হিন্দুকলেজের ভিতরে তখন এক ঘোর সামাজিক বিপ্লবের সূত্রপাত হচ্ছিল। ‘হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিয়ো’ নামে এক প্রতিভাবান ফিরিঙ্গি যুবক ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে হিন্দুকলেজের চতুর্থ শ্রেণীর সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর অপূর্ব পাণ্ডিত্য, মনীষা ও হৃদ্যতার জন্য ছাত্রদের মন একেবারে দখল করে নিয়েছিলেন। তিনি শুধু পাঠ্য বই পড়াতেন না; দীপশিখা থেকে যেমন দীপ জ্বলে, তেমনি তাঁর মননশীলতার দিয়ে ছাত্রদের স্বাধীন মননশক্তিকে তিনি জাগিয়ে দিতেন। ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে, ডিরোজিয়োর বাড়ীতে - সব সময়ে আলাপ-আলোচনায়, তর্ক বিতর্কে ছাত্রদের সঙ্গে সেই অধ্যাপকের এক অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ যোগ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লবের সময়ে এবং তার কিছু আগে ইউরোপে ‘হিউম’, ‘রুশো’, ‘ভল্টেয়ার’, ‘ভল্‌নি’, ‘ডিডিরো’, ‘কন্দর্সে’ প্রভৃতির দ্বারা চিন্তারাজ্যে যে মহাবিপ্লব জেগেছিল, সেটা অনেকেই জানেন। ধর্ম কিছু নয়, সমাজ কিছু নয়; ধর্ম ও সমাজ বহুকাল ধরে মানুষকে যে সব সুদৃঢ় সংস্কারের জালে বেঁধেছিল, সেটার বাঁধন না ছিঁড়লে মানুষের মুক্তি নেই - এই ভাবের একটা বিদ্রোহ তখন সমস্ত ইউরোপকে তোলপাড় করেছিল। সেই ফরাসী বিপ্লবের ঢেউ এদেশকেও নাড়া দিয়েছিল। ডিরোজিয়ো সেই বিপ্লবের মন্ত্রে তাঁর ছাত্রদের দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি তাঁদের নিয়ে ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন্’ (Academic Association) নামের একটা সভা তৈরি করেছিলেন। তাতে ‘রসিককৃষ্ণ মল্লিক’, ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘রামগোপাল ঘোষ’, ‘রাধানাথ শিকদার’, ‘দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়’, ‘রামতনু লাহিড়ী’, ‘শিবচন্দ্র দেব’, ‘হরচন্দ্র ঘোষ’ প্রভৃতি উৎসাহী সভ্যরা ছিলেন। সেই সভায় স্বাধীনভাবে সামাজিক বিষয়ের বিচার চলত এবং সেটার ফলে ছাত্ররা নিজের দেশকে, দেশের ইতিহাসকে, সমাজকে, ধর্মকে, সব রীতিনীতিকে নির্বিচারে ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছিল। অথচ সেই ছাত্ররা পরে সকলেই বড় হয়ে এক একদিকে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন - তাঁদের নাম বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তার মানে ডিরোজিয়ো তাঁর মনীষার সোনার কাঠি ছুঁয়ে দিয়ে তাঁদের ভিতরকার সুপ্ত মনুষ্যত্বটিকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সমাজের প্রথাগত আচারগত গতানুগতিক জীবনযাপনের আদর্শকে তাঁরা কোনমতেই স্বীকার করে নিতে পারেননি। সেই জন্য যে সব কাজ সমাজের চোখে অত্যন্ত ঘৃণ্য অনাচার বলে গণ্য ছিল, সেই সব কাজেই ডিরোজিয়োর ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। যেমন - পৈতা ত্যাগ, গোমাংস ভক্ষণ, মদ্যপান, ইত্যাদি। এর কুফল যে ফলে নি সেটা বলা চলে না। কিন্তু এর ভিতরকার ভাবটা ছিল বিদ্রোহের ভাব-প্রথা ও আচার পালনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। সেই সমাজবিদ্রোেহ ও স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ যদি সেই সময়ে দেখা না দিত, তবে বিশ্ব সাহিত্য, বিশ্ব-ইতিহাস, বিশ্ব-দর্শন, বিশ্ব-রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতির যে জোয়ার ইংরেজিশিক্ষার ভিতর দিয়ে এসে এদেশের গ্রাম্যতার জীর্ণসংস্কারভারে আচ্ছন্ন রুদ্ধ চিত্তস্রোতের মধ্যে কলোচ্ছাস জাগিয়েছিল, সেটা আর কখনই সম্ভব হত না। এর ফলে এদেশে আমরা ‘মাইকেলের’ কবি-প্রতিভা; ‘রামগোপাল ঘোষ’, ‘হরিশ মুখার্জি’ প্রভৃতির রাষ্ট্রনৈতিক বুদ্ধিনৈপুণ্য; ‘শিবচন্দ্র দেব’, ‘রামতনু লাহিড়ী’র মত বলিষ্ঠ চরিত্র পেয়ে এক নতুন যুগের সিংহদ্বার উদ্ঘাটিত করতে পেরেছি। আমাদের দেশ গ্রাম্যসভা থেকে বিশ্বসভায় আসন পেয়েছে। অবশ্য রামমোহন রায় হিন্দুকলেজের শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে খুশি ছিলেন না। তার কারণ হল, ‘ডেভিড্ হেয়ার’ বা ‘মেকলে’ বা ‘ডিরোজিয়ো’র মত পাশ্চাত্য শিক্ষাই এই দেশের সব রকমের উন্নতির নিদান হবে, এমন মুগ্ধ ধারণা রামমোহন রায়ের মত লোকের থাকতেই পারে না। ১৮২৩ খৃস্টাব্দে রামমোহন রায় ‘লর্ড আমহার্স্ট’কে ইংরাজী শিক্ষার প্রবর্ত্তন-তরফে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে তিনি বেদান্ত প্রভৃতি শাস্ত্র-শিক্ষাকে নিন্দা করেছিলেন - অথচ তিনি নিজেই সেই বেদান্ত দর্শনের ভাষ্য বাংলায় প্রকাশ করেছিলেন। রামমোহন রায় পরিষ্কার বুঝেছিলেন যে, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোকে আমাদের ধর্মশাস্ত্রকে আমরা না পড়তে পারলে, কোন কালেই সেটার নিত্য তত্ত্ব এবং খণ্ডকালের হিসাবেও সেটার নিগূঢ় তাৎপর্য্য আমরা ধরতে পারব না। তখনই জীবনের হিসাবে তত্ত্বের মূল্য যাচাই না করে শুদ্ধ তর্কের হিসাবে সেটার মূল্য কষবার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাবে। আমাদের দেশে সেই চেষ্টা কি দেখা দেয় নি? রামমোহন রায় তাই পশ্চিমের দিকে দেশের মুখ ফিরিয়েছিলেন যাতে দেশের দিকেই সেই মুখখানা ভাল করে ফেরে। ‘হেয়ার’, ‘মেকলে’ বা ‘ডিরোজিয়ো’র মত তিনি স্বপ্নেও মনে করেন নি যে হিন্দুসভ্যতার মধ্যে শিখবার জিনিস কিছুই নেই, যা কিছু আছে সেটা পশ্চিমের সভ্যতার ভাণ্ডারে। গল্প আছে যে, হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছু পরে একজন লোক তাঁর কাছে এসে গল্প করেছিলেন যে, অমুক ব্যক্তি আগে ছিল ‘Polytheist’, তার পর সে হয়েছিল ‘Deist’, এখন সে ‘Atheist’ হয়েছে। রামমোহন তাঁকে হেসে বলেছিলেন, “ইহার পর বোধ হয় সে beast হইবে।” ধর্মশিক্ষা বাদ দিয়ে বিদ্যাশিক্ষা (Secularisation of Education) রামমোহন রায় কখনই কল্যাণকর বলে মনে করতেন না। অন্যান্য বিদ্যা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যাতে ধর্মশিক্ষাও থাকে, সে জন্য তিনি নিজে যেমন একটি স্কুল খুলেছিলেন, তেমনই খৃষ্টান মিশনারী ডফসাহেবকে একটি স্কুল খুলতে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “প্রতিদিন ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা-পূর্ব্বক বিদ্যালয়ের কার্য্য আরম্ভ হয়, দেখিয়া তিনি অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করিতেন।” যে কোন ধর্মশাস্ত্র হোক না, ছাত্ররা ধর্মালোচনা করতে শিখুক এবং অন্যান্য শিক্ষাকে সেই বড় শিক্ষার অঙ্গীভূত বলে জানুক, এটাই ছিল রামমোহন রায়ের শিক্ষার আদর্শ। বেদান্তের অনুরাগী বলে তিনি প্রাচীন কালের তপোবনের শিক্ষার মত বিদ্যামন্দিরে ‘অপরাবিদ্যা’ ও ‘পরাবিদ্যা’ - এই দুয়েরই যেন চর্চা হয়, সেটাই চাইতেন। হিন্দুকলেজের ধর্মহীন নাস্তিকতার শিক্ষা সেই জন্য তাঁকে অত্যন্ত কষ্ট দিত। আগেই বলা হয়েছে যে, দেবেন্দ্রনাথের যখন চৌদ্দ বছর বয়স, তখন তিনি হিন্দুকলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ‘রমাপ্রসাদ রায়’, ‘তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী’ প্রভৃতি ছিলেন তাঁর সহপাঠী। ডিরোজিয়ো তখন যে ক্লাসে পড়াতেন, তার নিচের ক্লাসে দেবেন্দ্রনাথ ভর্তি হয়েছিলেন। হিন্দুকলেজের ছাত্রদের বিপ্লবে কলেজ কমিটির হিন্দুসভ্যগণ বিশেষ বিচলিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা অবশেষে ডিরোজিয়োর নামে সত্যমিথ্যা নানা অভিযোগ এনে তাঁকে পদচ্যুত করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের হিন্দু কলেজে প্রবেশের চার মাস পরেই ডিরোজিয়ো হিন্দুকলেজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ডিরোজিয়োর সংসর্গলাভ দেবেন্দ্রনাথের ভাগ্যে মোটেই ঘটেনি।

                             ©️রানা©️

দেবেন্দ্রনাথ হিন্দুকলেজে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যান্ত পড়েছিলেন। এখানে বোধ হয় বলা দরকার যে, তখনকার হিন্দু কলেজকে এখনকার সময়ের হাই স্কুলের মত মনে করলে ভুল হবে। ‘রাজনারায়ণ বসু’ তাঁর আত্মচরিতে হিন্দুকলেজের প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের যে তালিকা দিয়েছিলেন সেটাকে এখনকার ‘বি.এ.’ পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তকের তালিকা বলে স্বচ্ছন্দে চালানো যেতে পারে। সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী পৰ্য্যন্ত পড়ে থাকলে তাঁর শিক্ষা যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছিল বলতে হবে। তাছাড়া তখন সাহিত্যবিভাগ (Arts Course) এবং বিজ্ঞান বিভাগ (Science Course) আলাদা ছিল না। প্রথম শ্রেণীর ছাত্রদের যেমন ‘শেক্সপিয়র’, ‘মিল্টন’ পড়তে হত, তেমনই ইতিহাস - পড়তে হত, এবং ‘ক্যালকুলাস্’, ‘মেকানিক্‌স্’ প্রভৃতি কঠিন গণিতের চর্চাও করতে হত। দেবেন্দ্রনাথ বোধ হয় চৌদ্দ বছর বয়স থেকে যোল কি সতেরো বছর পর্য্যন্ত হিন্দুকলেজে পড়েছিলেন। কলেজের সতীর্থদের সঙ্গে যে তাঁর বিশেষ অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ হয়েছিল, এমন কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। ডিরোজিয়োর শিষ্যদলের সঙ্গে তাঁর কোন ঘনিষ্ঠতাই হয়নি। আগেই বলা হয়েছে যে, ডিরোজিয়োর শিষ্যরা দেশের ধর্ম, সমাজ, শাস্ত্রসাহিত্য, সবকিছুকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার নেশায় অবজ্ঞা করতেন। নাহলে ‘পাব্লিক ইন্সট্রাকশন কমিটি’তে যখন শিক্ষা সম্বন্ধে মন্তব্য লিখিতে গিয়ে ‘মেকলে’ এমন অদ্ভুত কথা লিখে বসেছিলেন যে, ইউরোপীয় লাইব্রেরীর এক তাক্ গ্রন্থে যা আছে, সমস্ত ভারতবর্ষের ও আরব দেশের সাহিত্যে সেটা নেই, তখন ডিরোজিয়োর শিষ্যের দল সেই সুর ধরে তাঁর সমর্থন করতে যাবেন কেন? পণ্ডিত ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ ঠিকই লিখেছিলেন, “তদবধি ইঁহাদের দল হইতে কালিদাস সরিয়া পড়িলেন, শেক্সপিয়র সেস্থানে প্রতিষ্ঠিত হইলেন; মহাভারত, রামায়ণাদির নীতির উপদেশ অধঃকৃত হইয়া Edgeworth’s Tales সেই স্থানে আসিল; বাইবেলের সমক্ষে বেদবেদান্ত, গীতা প্রভৃতি দাঁড়াইতে পারিল না। নব্য বঙ্গের তিন প্রধান দীক্ষা গুরুর হস্তে তাঁহাদের দীক্ষা হইয়াছিল। প্রথম দীক্ষাগুরু ডেভিড্ হেয়ার, দ্বিতীয় দীক্ষাগুরু ডিরোজিয়ো, তৃতীয় দীক্ষাগুরু মেকলে। তিনজনই তাঁহাদিগকে একই ধুয়া ধরাইয়া দিলেন; প্রাচীতে যাহা কিছু আছে তাহা হেয় এবং প্রতীচীতে যাহা আছে তাহাই শ্রেয়ঃ। এই অতিরিক্ত প্রতীচ্য-পক্ষপাতিতার ঝোঁকে বঙ্গসমাজ বহুকাল চলিয়া আসিয়াছে।” সৌভাগ্যক্রমে দেবেন্দ্রনাথ দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; সুতরাং তাঁর পক্ষে দেশীয় রীতিনীতি, পোষাকপরিচ্ছদ, আহারবিহার বিসর্জন দিয়ে বিদেশীয় অনুকরণ করতে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। তার পর ছেলেবেলা থেকে তাঁর পিতামহীর শিক্ষা ও প্রভাব তাঁকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু এই সব কিছুর উপরে মনে হয়, রামমোহন রায়ের আদর্শ তাঁকে ঐ বিপ্লবের স্রোতে ভেসে যেতে দেয়নি। রামমোহন রায়ের কাছে তিনি যে ছেলেবেলা থেকে শিক্ষা পাবার সুযোগ লাভ করেছিলেন, সেটা ছিল তাঁর জীবনের পক্ষে একটা মস্ত ব্যাপার। সেই রামমোহন রায়ের সম্বন্ধে তাঁর বাল্যস্মৃতি তিনি কয়েকজন বন্ধুর কাছে এক সময়ে বলেছিলেন। ‘নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়’ লিখিত ‘রামমোহন রায়ের জীবনচরিতে’ সেগুলো উদ্ধৃত আছে। বোধ হয় এখানে সেটা পুনরুল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কারণ দেবেন্দ্রনাথের বালক বয়সে অমন একজন মহাপুরুষের প্রত্যক্ষ প্রভাব তাঁর মনের উপরে কতটা পড়েছিল, সেটা তাঁর নিজের মুখ থেকে শোনার একটা আনন্দ আছে। দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন - “আমি মাণিকতলায় রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যানবাটিকাতে প্রায়ই গমন করিতাম। হেদুয়ার নিকটস্থ রাজা রামমোহন রায়ের ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। রাজার পুত্র রমাপ্রসাদ আমার সহিত এক শ্রেণীতে পাঠ করিতেন। প্রায় প্রতি শনিবার বিদ্যালয়ের ছুটি হইলে পর, আমি রমাপ্রসাদের সহিত রাজাকে দেখিতে যাইতাম। রাজার উদ্যানে একটি বৃক্ষের শাখায় একটা দোলনা ছিল। রমাপ্রসাদ এবং আমি উহাতে দুলিতাম। কখনও কখনও রাজা আসিয়া আমাদের সহিত যোগ দিতেন। আমাকে কিছুক্ষণ দোলাইয়া, তিনি দোলনার উপর উঠিয়া বসিতেন এবং আমাকে দোল দিতে বলিতেন।” এই জায়গায় উপস্থিত ভদ্রলোকেরা দেবেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, “তখন আপনার বয়স কত ছিল?” দেবেন্দ্রনাথ তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “তখন আমার বয়স কত ছিল ঠিক বলিতে পারি না। তখন আমি স্কুলের বালক চিলাম, তখন আমার বয়স আট কিম্বা নয় বৎসর হইবে। রাজা আমাকে ভাল বাসিতেন। আমার যখন ইচ্ছা রাজার নিকট যাইতে পারিতাম। কখনও কখনও পূর্বাহ্নে তাঁহার আহারের সময় যাইতাম। তিনি সচরাচর উক্ত সময়ে মধু দিয়া রুটি খাইতেন। একদিন প্রাতঃকালে তাঁহার আহারের সময়ে মধু দিয়া রুটি খাইতে খাইতে তিনি আমাকে বলিলেন, ‘বেরাদার, আমি মধু ও রুটি খাইতেছি, কিন্তু লোকে বলে আমি গোমাংস ভোজন করিয়া থাকি।’ কোন কোন দিন আমি রাজার স্নানের সময়ে তাহার বাটিতে যাইতাম। তাঁহার স্নান বড় চমৎকার ছিল। তিনি স্নানের পূর্ব্বে সমস্ত শরীরে অধিক সর্ষপতৈল মর্দন করিতেন। তাঁহার শরীরে তেল গড়াইয়া পড়িত। তিনি বলবান্ পুরুষ ছিলেন। তাঁহার বক্ষস্থল প্রশস্ত ছিল। তাঁহার মাংসপেশী সকল শক্ত ছিল। তৈলমর্দিত অনাবৃত দেহ, কটিদেশের চতুষ্পার্শে একখণ্ড বস্ত্রমাত্র, তাঁহার এই প্রকার মূর্তি দেখিয়া বালক বলিয়া আমার মনে ভীতিসঞ্চার হইত। এই প্রকার বস্ত্র পরিধান করিয়া বলপূর্বক পদ নিক্ষেপ করিতে করিতে তিনি উপর হইতে নীচে নামিয়া আসিতেন। সংস্কৃত, পারসী ও আরবী ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করিতে করিতে তিনি একটি প্রকাণ্ড জলপূর্ণ টবে ঝম্প প্রদান করিতেন। এই টবে তিনি এক ঘণ্টার অধিক কাল থাকিতেন। এই সময়ে তিনি ক্রমাগত তাঁহার প্রিয় কবিতা সকল আবৃত্তি করিতেন। স্পষ্ট বোধ হইত, তিনি এই সকল ভাবে মগ্ন হইয়া গিয়াছেন। তিনি অতিশয় ভাবের সহিত যে সকল কবিতা আবৃত্তি করিতেন আমি তাহা কিছুই বুঝিতে পারিতাম না। আমার এখন বোধ হয় উহাই রাজার উপাসনা ছিল। রাজার পালিতপুত্র রাজারাম বড় দুষ্ট ছিল। রাজার সহিত অনেক প্রকার দুষ্টামি করিত। কিন্তু রাজা কিছুতেই তাঁহার প্রতি বিরক্ত হইতেন না। বাস্তবিক আমি এ পৰ্য্যন্ত যত লোক দেখিয়াছি, রাজা রামমোহন রায়ের ন্যায় সুমিষ্ট মেজাজের লোক দেখি নাই। একদিবস মধ্যাহ্নে আমি রাজার বাটিতে গমন করিলাম, রাজা তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। রাজারাম আমাকে ডাকিয়া বলিল, ‘একটা তামাসা দেখিবে তো এস।’ আমি তাঁহার সহিত গমন করিলাম। রাজারাম ধীরে ধীরে রাজার শয্যার নিকটে গমন করিল, এবং হঠাৎ রাজার বক্ষঃস্থলের উপর ঝম্প দিয়া পড়িল। রাজা জাগ্রত হইলেন এবং ‘রাজারাম’ ‘রাজারাম’ বলিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। একদিন রমাপ্রসাদের সহিত আমি রাজার বাটিতে গমন করিয়াছিলাম। তাঁহার ঘরে একখানি খাট ছিল। আমরা তাঁহার নিকটে যাইবামাত্র তিনি রমাপ্রসাদকে তাঁহার প্রিয় সংস্কৃত সঙ্গীত ‘অজরমশোকং জগদালোকং’ গান করিতে বলিলেন। রমাপ্রসাদ বড় লজ্জায় পড়িলেন। তিনি গান করিতেও পারেন না, আবার তাঁহার পিতার আজ্ঞা অগ্রাহ্যও করিতে পারেন না। তিনি আস্তে আস্তে খাটের নীচে গিয়া বসিলেন এবং তথায় করুণাব্যঞ্জক স্বরে গান আরম্ভ করিলেন, ‘অজরমশোকং জগদালোকং’। ... রাজা মধ্যে মধ্যে আমাদের বাড়ীতে আসিতেন। আমার পিতা রাজাকে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতেন। তিনি অল্প বয়সে দেশের প্রচলিত ধর্ম্মে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু রাজার সহিত আলাপ পরিচয় হওয়াতে প্রচলিত ধর্ম্মে তাঁহার অবিশ্বাস হইয়াছিল। কিন্তু রাজা যে ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার করিয়া ছিলেন তিনি কখনও তাহা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিতে পারেন নাই। যখন রাজার সহিত তাঁহার প্রথম পরিচয় হইয়াছিল, তখন আমার পিতা প্রতিদিন প্রাতঃকালে পুষ্পাদি লইয়া দেবতার পূজা করিতেন। তিনি প্রকৃত ভক্তির সহিত পূজা করিতেন। কিন্তু পূজার অপেক্ষাও রাজার প্রতি তাঁহার ভক্তি অধিক হইয়াছিল। কখনও কখনও এমন হইত যে, তিনি পূজায় বসিয়াছেন, এমন সময়ে রাজা তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিতেন। রাজা আমাদের গলিতে প্রবেশ করিবামাত্র আমার পিতার নিকট সংবাদ যাইত যে, তিনি আসিতেছেন। আমার পিতা তৎক্ষণাৎ পূজা হইতে উঠিয়া রাজাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিতেন। রাজার বন্ধুদিগের উপরে তাঁহার এই প্রকার প্রভাব ছিল। ... তোমরা দেখিতেছ যে, আমার পিতার কথা না বলিয়া, আমি রাজার কথা বলিতে পারি না। রাজার সম্বন্ধীয় আমার স্মৃতি আমার পিতার স্মৃতির সহিত জড়িত। আমি আশা করি, তোমরা ইহাতে কিছু মনে করিবে না। ... আমাদের বাটিতে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে আমি একবার রাজাকে নিমন্ত্রণ করিতে গিয়াছিলাম। আমি আমার পিতামহের প্রতিনিধিস্বরূপ গিয়াছিলাম। চলিত প্রণালী অনুসারে আমি রাজাকে বলিলাম, রামমণি ঠাকুরের বাড়ীতে আপনার দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ। রাজা ব্যগ্রভাবে উত্তর করিলেন, ‘আমাকে পূজার নিমন্ত্রণ?’ সেই স্বর আমি এখনও যেন শুনিতেছি। তিনি আমার উপর বিরক্ত হন নাই। আমার প্রতি তিনি সর্ব্বদাই প্রসন্ন থাকিতেন। রাজা আশ্চর্য্য হইয়াছিলেন যে, তিনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ করিতেছেন, অথচ লোকে ইঁহাকে দুর্গোৎসবে নিমন্ত্রণ করিয়া থাকে। যাহা হউক, রাজা বুঝিলেন যে, ইহা সামাজিক ব্যাপার মাত্র। তিনি আমাকে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদের নিকট যাইতে বলিলেন৷ প্রচলিত পৌত্তলিকতায় রাধাপ্রসাদের কোন আপত্তি ছিল না। সুতরাং তিনি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন এবং আমাকে কিছু মিষ্টান্ন ও ফল খাইতে দিলেন। ফলের কথা বলাতে আমার স্মরণ হইল যে, রাজার মাণিকতলার বাগানে অনেক উত্তম উত্তম ফলের গাছ ছিল। এই সকল ফলের লোভে আমি অনেক সময়ে সেখানে যাইতাম। আমি নিচুফল অতিশয় ভাল বাসিতাম। আমি সেখানে অনেক সময়ে নিচুফল খাইতে যাইতাম। যখন রাজা দেখিতেন যে, আমি বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসের ভীষণ রৌদ্রতাপে উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছি, তিনি আমাকে ডাকিয়া বলিতেন ‘বেরাদার, এখানে এস, তুমি যত নিচু চাও আমি দিব। রৌদ্রে বেড়াইতেছ কেন?’ তখন তিনি মালীকে আমার জন্য সুপক্ক নিচু সকল আনিতে বলিতেন। ... আমার স্মরণ হয়, রাজা একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আমি মাংসাহার করি কি না? তিনি আমাকে বলিলেন যে, তুমি তোমার পিতাকে বলিয়ো যে, প্রতিদিন তোমার আহারের সময়ে তোমাকে কিছু মাংস দেওয়া হয়। রাজা বলিতেন যে, বৃক্ষমূলে জলসেচন করা আবশ্যক; নতুবা বৃক্ষ যথোপযুক্তরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। এই দেহের সম্বন্ধেও সেই প্রকার; বাল্যকাল হইতেই দেহকে উপযুক্ত আহার দেওয়া প্রয়োজ ৷ রাজা আপনার শরীরকে অত্যন্ত যত্ন করিতেন। শরীরকে পরমেশ্বরের মূল্যবান দান বলিয়া মনে করিতেন। ... রাজার এমন এক শক্তি ছিল, যদ্দ্বারা তিনি সকল প্রকার লোককে আকর্ষণ করিতে পারিতেন। আমার উপরে তাঁহার এক নিগূঢ় প্রভাব ছিল। আমি তখন বালক ছিলাম, সুতরাং তাঁহার সহিত কথোপকথনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমার উপরে তাঁহার মুখের এমন এক আকর্ষণ ছিল যে, আমি আর কাহারও মুখ দেখিয়া কখনও সেরূপ আকৃষ্ট হই নাই। ... আমি প্রায়ই রাজার গাড়িতে রাজার সহিত যাইতাম। তখন রাজার সহিত আমার প্রায়ই কোনও কথাবার্তা হইত না। আমি তাঁহার সম্মুখে বসিয়া, তাঁহার সুন্দর মুখ দর্শন করিতাম। রাজার সহিত গাড়িতে বেড়াইবার সময়ে, আমি প্রায়ই রাজার বিষয়ে চিন্তাতে মগ্ন থাকিতাম। রাস্তায় কি হইতেছে, সে বিষয়ে কিছু জানিতে পারিতাম না। আমি পুত্তলিকার ন্যায় স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতাম৷ কেবলই রাজাকে দেখিতাম। আমার হৃদয় এক প্রকার গভীর ও অবর্ণনীয় ভাবে পরিপ্লুত হইত। স্পষ্টই বুঝা যায় যে, রাজার সহিত আমার কোন নিগূঢ় সম্বন্ধ ছিল। ... আমি তোমাদিগকে বলিয়াছি যে, আমি তাঁহাকে দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণ করিতে গেলে, কি হইয়াছিল। তিনি কেমন বলিলেন, ‘আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?’ তিনি যখন এই কয়েকটি কথা বলিয়াছিলেন, ভাবেতে তাঁহার মুখ উজ্জ্বল হইয়াছিল। আমার জীবনে চিরকাল উহার আশ্চর্য্য প্রভাব রহিয়াছে। তাঁহার কথাগুলি আমার পক্ষে গুরুমন্ত্রস্বরূপ হইয়াছিল। তাহা হইতেই আমি ক্রমে পৌত্তলিকতা ত্যাগ করিলাম। ঐ কথাগুলি এখনও যেন আমার কানে বাজিতেছে। আমার এই দীর্ঘ জীবনে ঐ কথাগুলি আমার নেতাস্বরূপ হইয়াছে। ... ব্রাহ্মসমাজ সংস্থাপিত হইলে পর, আমি মধ্যে মধ্যে লুকাইয়া তথায় যাইতাম। তখনও বিষ্ণু গান করিতেন। বিষ্ণুর এক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। তাঁহার নাম কৃষ্ণ। রামমোহন রায়ের সমাজে বিষ্ণুর সহিত কৃষ্ণ একত্রে গান করিতেন। গোলাম আব্বাস নামক একজন মুসলমান পাখোয়াজ বাজাইতেন। ‘বিগতবিশেষং’ গানটি রাজার অতি প্রিয় ছিল। বিষ্ণু ঐ সঙ্গীতটি মধুর স্বরে গান করিতেন। ... তিনি আমাকে কখনও কথা কহিয়া উপদেশ দেন নাই। তখন আমি বড় ছোট ছিলাম। তাঁহার নিকট হইতে উপদেশ লইবার সময় হয় নাই। তথাচ আমি তোমাদিগকে বলিয়াছি যে, আমার উপরে তাঁহার এক নিগূঢ় প্রভাব ছিল। ... ইংলণ্ডে গমন করিবার সময়ে রাজা আমার পিতার নিকটে বিদায় লইতে আসিলেন। আমাদের বাড়ীর সকলে এবং আমাদের অনেক প্রতিবেশী, রাজাকে দেখিবার জন্য আমাদের সুপ্রশস্ত প্রাঙ্গণে একত্র হইয়াছিলেন। আমি তখন সেখানে ছিলাম না। তখন আমি সামান্য বালক। তথাচ রাজা আমাকে দেখিতে ইচ্ছা করিলেন। তিনি আমার পিতাকে বলিয়াছিলেন যে, আমার হস্তমর্দ্দন না করিয়া তিনি এদেশ পরিত্যাগ করিতে পারেন না। আমার পিতা আমাকে ডাকাইয়া আনিলেন। তখন রাজা আমার হস্তমর্দ্দন করিয়া ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন। রাজা যে সস্নেহে আমার হস্তধারণ করিয়াছিলেন, তাহার প্রভাব ও অর্থ তখন বুঝিতে পারি নাই। বয়স অধিক হইলে উহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছি। ... যখন রামমোহন রায়ের মৃত্যু সংবাদ আসিল, তখন আমি আমার পিতার নিকটে ছিলাম। আমার পিতা বালকের ন্যায় ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। আমারও অতিশয় শোক হইয়াছিল। যদিও রাজার সহিত আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না, যদিও তিনি আমাকে কোন উপদেশ দেন নাই, তথাচ তাঁহার মুখশ্রী এবং চরিত্র আমার হৃদয়ে গভীরভাবে অঙ্কিত হইয়াছিল। আমি তাঁহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলাম।”

                             ©️রানা©️

ছেলেবয়সে রামমোহন রায়ের চরিত্রের ছাপ বালক দেবেন্দ্রনাথের মনে মুদ্রিত হয়েছিল বলেই দেশের শিক্ষিত সাধারণ যখন পশ্চিমের ধর্ম, সমাজ, রীতিনীতি সমস্তকেই আদরে বরণ করে নিয়েছিলেন এবং দেশকে আঘাত করতে শুরু করেছিলেন, তখন তিনি একাকী দেশের প্রাচীন সভ্যতার দিকে মুখ ফিরিয়েছিলেন। তখন তিনি প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে শক্ত করে হাল ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। পাশ্চাত্য শাস্ত্রসাহিত্য ছেড়ে প্রাচ্য শাস্ত্র সাহিত্যের আলোচনা দেশময় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। রামমোহন রায়ের পরে তিনি যদি সেই কাজে না লাগতেন, তবে দেশের শিক্ষিত লোক যে খৃষ্টান হয়ে গিয়ে সমাজে এক প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা ঘটাত, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। সবই ভাঙত, কিছুই গড়ত না। ডিরোজিয়োর শিষ্যরা তাঁদের দীক্ষাগুরুর কাছ থেকে ভাঙার শক্তি লাভ করেছিলেন, গড়বার শক্তি পান নি। সেই সৃজনী শক্তি দেবেন্দ্রনাথের জন্য অপেক্ষা করে ছিল।

                                 ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

২- পিতৃস্মৃতি ও অন্যান্য রচনা, সৌদামিনী দেবী।

৩- আত্মজীবনী, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৪- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী।

৫- রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

৬- মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী।)

                           

No comments