Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বুলেট না বাংলা?’ রানা চক্রবর্তী

‘বর্তমান প্রজন্মের বাংলাভাষীদের কাছে ‘ভাষা আন্দোলন’ মানে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। ‘ভাষা শহিদ’ - ‘বরকত’, ‘জব্বার’, সঙ্গে ‘ফাংশন’ - ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ...’’। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল ‘ঢাকা’য় ঘটিয়েছিল তদানীন্ত…

 




বর্তমান প্রজন্মের বাংলাভাষীদের কাছে ‘ভাষা আন্দোলন’ মানে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। ‘ভাষা শহিদ’ - ‘বরকত’, ‘জব্বার’, সঙ্গে ‘ফাংশন’ - ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ...’’। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল ‘ঢাকা’য় ঘটিয়েছিল তদানীন্তন ‘পূর্ব-পাকিস্তানের উর্দুভাষী প্রশাসন’। স্বাধীন ভারতে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে ‘রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী’ উদযাপনের সময়ে ‘বাংলাভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা’র জন্য ‘আসামের বরাক উপত্যকা’য় তদানীন্তন ‘কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী’ ‘বিমলাপ্রসাদ চালিহা’, অহিংস নিরীহ বাংলা ভাষা ‘সত্যাগ্রহীদের’ ওপর গুলি চালিয়ে ১১ জনকে খুন করেছিলেন। সেই হত্যালীলা শুরুর আগে ভারতের তৎকালীন ‘প্রধানমন্ত্রী’ ‘জওহরলাল নেহরু’ ‘দিল্লি’ থেকে ‘গৌহাটি’ উড়ে এসেছিলেন ‘মুখ্যমন্ত্রী’ ‘বিমলাপ্রসাদ চালিহা’র সঙ্গে জরুরি বৈঠক করতে। তারপরেই ‘ভাষা সত্যাগ্রহীদের’ ওপর গুলি চালানো হয়েছিল কোনওরকম সতর্ক না করেই। ‘সত্যাগ্রহীদের’ ‘ছত্রভঙ্গ’ করার চেষ্টাও করা হয়নি। গুলি চালানো হয়েবহিল ‘সত্যাগ্রহীদের’ ‘চোখে’, ‘রগে’, ‘বুকে’, ‘তলপেটে’, ‘যৌনাঙ্গে’। ‘সত্যাগ্রহীদের’ তরফে কোনওরকম প্ররোচনা ছিল না। কোনও ‘হিংসাত্মক ঘটনা’ ঘটেনি। সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করার মতো কোনও কাজও ‘সত্যাগ্রহীরা’ সেদিন করেননি। তাঁরা শুধু ‘শিলচর’ স্টেশনে বসে ‘সত্যাগ্রহ’ করছিলেন। আচমকা করা গুলিতে এখানেই লুটিয়ে পড়েছিলেন ‘বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে’ ‘একমাত্র মহিলা শহিদ’ ১৬ বছর বয়সী ‘কমলা ভট্টাচার্য’। তাঁর বাঁ চোখে গুলি করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে এ এক দুরপনেয় কলঙ্কজনক ঘৃণ্য অধ্যায়। স্বাধীন ভারতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে’র ‘বাংলাভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার’ সেই আন্দোলন ও তার এগারোজন শহিদের কথা ভারতবাসী তো দূরস্থান পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালিদের কয়জন জানেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে - সেই শহিদরাও বিস্মৃতপ্রায়। ‘সব্যসাচী দেব’ তাঁর ‘ভাষা’ কবিতায় লিখেছিলেন -


“তোমাদের আছে নিজের একটা ভাষা

১৯ শে মে আর ২১ শে ফেব্রুয়ারি

আমরা কেবল দূর হতে হাততালি

দিয়ে বলে আসি সজ্জিত আন বাড়ি।”


২০১৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ‘বর্তমান’ সংবাদপত্রে (৩০ বর্ষ, ৭৬ সংখ্যা, শনিবার, ৯ ফাল্গুন ১৪২০ বঙ্গাব্দ) এক বিশেষ নিবন্ধে ‘কাজি মাসুম আখতার’ লিখেছিলেন - “... মাতৃভাষা নিয়ে এপার বাংলা কতটা গর্বিত? মাতৃভাষা বাংলার অস্তিত্ব বা সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকদের বন্দুকের সামনে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিউরদের মতো তরুণরা। ভাষার জন্য এমন আত্মবলিদান বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। আমাদের অনেকের জানা নেই বাংলাভাষার জন্য রক্তপাত এই ভারতভূমিতেও ঘটেছে। তবে তা বাঙালির পীঠস্থান গর্বের কলকাতাতে নয়। সুদূর অসমের শিলচরে বরাক উপত্যকায়। সেই অমর এগারোজন শহিদের স্মরণ করার কৃতজ্ঞতাও আমাদের নেই। বাংলা ভাষা যাঁদের হাতে ফুলে ফলে সুসজ্জিত হয়ে বিকশিত হয়েছিল সেই, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দদের কি আমরা সত্যিই শ্রদ্ধা করি? করলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা রইলাম।” ‘কাজি মাসুম আখতার’ পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের কাছে এর জবাব আজও পাননি। স্বাধীন ভারতের সরকারের গুলিতে নিহত ১১ জন বাংলা ভাষা শহিদ আজও ‘অজানিত’, ‘উপেক্ষিত’, ‘অবজ্ঞাত’। পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিরা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে কেঁদে ভাসান, ধুমধাম করে ‘ভাষা দিবস’ পালন করেন। কিন্তু ১৯ মে’র ভাষা আন্দোলন দু-একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ছাড়া স্মরণে আসে না। এক ফোঁটা চোখের জলও ১১ জনের জন্য ফেলা হয় না। কেন ‘বরাক উপত্যকায়’ বাংলাভাষা নিয়ে অমন প্রাণঘাতী জীবনপণ করা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল সেই ইতিহাসও আজকের প্রজন্মের কাছে অজানা। বর্তমান প্রজন্মের কেউ খোঁজ রাখেন না ‘বরাকের ভাষা আন্দোলন’ কেন গুরুত্বপূর্ণ।

                             ©️রানা©️

‘আসামের’ একটি ছোট জেলা হল ‘কাছাড়’। সেই জেলার ‘জেলা সদর’ হল ‘শিলচর’। ইংরেজ আমলে ‘কাছাড়’ ছিল ‘ঢাকা কমিশনারের অধীন’। দেড়শো বছর আগে বাংলাভাষী ‘কাছাড় জেলা’কে ‘সিলেটের’ সঙ্গে ‘আসাম প্রদেশের’ সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। ফলে ‘আসামের’ সঙ্গে তখন ‘কাছাড়ের’ সম্পর্ক ছিল শুধু রাজনৈতিক ও প্রশাসনের। ভৌগোলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্রে ‘কাছাড়’ ছিল বাংলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে’ ‘কাছাড়’কে ‘আসামের’ সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় ‘কাছাড়ের’ সাংস্কৃতিক জগতে দুর্ভাগ্যের মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। কারণ ‘বরাক উপত্যকায়’ শতকরা ৯০ জন ছিলেন বাঙালি। ১৮৩৮ থেকে ১৮৭৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ‘কাছাড়ে’ সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা। তাঁদের জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ‘আসামের’ সঙ্গে। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে ‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি’ ‘অসমিয়া’ ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছিল। ‘গোপীনাথ বরদলুই’ ঘোষণা করেছিলেন ‘আসাম’ কেবলমাত্র ‘অসমিয়াদের’ জন্য, সেখানে শুধু ‘অসমিয়া’ ভাষাতেই সমস্ত কাজকর্ম করা হবে। এরপরে শুধুমাত্র ‘গোয়ালপাড়া’ জেলাতেই ২৫০টি ‘বাংলা মাধ্যম স্কুলের’ মধ্যে ২৪৭টি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এতেই শেষ হয়নি। ১৯৬০ সালে ‘আসামে’ ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের নামে ‘বাঙালি নিধন’ শুরু হয়েছিল। ৪৮ দিন ধরে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি ‘জেনোসাইড’-এ হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করে হলেও তেমন কোনও প্রতিবাদ কোথাও হয়নি। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘শ্রীযুধাজিৎ’ লিখেছিলেন, ‘মেখলা পরা মেয়ে’ নামক এক উপন্যাস যা ‘কংগ্রেস সরকার’ নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করেছিল। ‘কাছাড়ের’ ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল জোর করে বাঙালিদের ওপর ‘অসমিয়া’ ভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে। ‘আসাম বিধানসভা’য় ‘মুখ্যমন্ত্রী’ ‘বিমলাপ্রসাদ চালিহা’ সর্বস্তরে একমাত্র ‘অসমিয়া’ ভাষা চালু করার উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সালের ১০ই অক্টোবর ‘ভাষা বিল’ উত্থাপন করেছিলেন। ২৪শে অক্টোবর ‘বিধানসভা’য় সেই ‘ভাষা বিল’ পাশ হয়েছিল যাতে একমাত্র ‘অসমিয়া’ ভাষাতেই রাজ্যের সর্বত্র সমস্ত কাজ কর্ম করতে সকলকে বাধ্য করা হয়েছিল। ‘করিমগঞ্জ’ (উত্তর) কেন্দ্রের তৎকালীন বিধায়ক ‘রণেন্দ্রমোহন দাস’ সেই ‘বিলের’ প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘‘এক-তৃতীয়াংশের ভাষা দুই তৃতীয়াংশের ওপর জোর করে চাপানো হচ্ছে কারণ বরাক উপত্যকার তিনটি জেলা কাছাড়া করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির আশি শতাংশের মাতৃভাষা বাংলা। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত ১৯৫৬ সালের রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের প্রস্তাবের পরিপন্থী - যেখানে বলা হয়েছে যদি একটি রাজ্যে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ একই ভাষায় কথা বলে তবে সেটি একভাষী রাজ্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। কাছাড়ের ক্ষেত্রে এই যুক্তি অগ্রাহ্য করা হল।’’


বাংলাভাষীরা ‘বরাক উপত্যকা’র মুখের ভাষা কেড়ে নেবার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি, ‘ভাষা বিলের’ প্রতিবাদে ‘জন সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে’। গঠিত হয়েছিল ‘গণ সংগ্রাম পরিষদ’। সেই পরিষদের উদ্যোগে একই বছরের এপ্রিল মাসের এক পক্ষকাল ধরে প্রতিবাদ পদযাত্রা চলেছিল বাংলাকে ‘আসামের’ অন্যতম ‘রাজ্যভাষা’ হিসেবে গণ্য করার জন্য। সরকার বাংলাভাষার স্বীকৃতির দাবি জানবেন কি না সেজন্য ‘চরমপত্র’ দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ১৯৬১ সালের ১৩ই এপ্রিলের মধ্যে সরকারকে জবাব দিতে হবে। পরিস্থিতি ক্রমেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল। বাংলা ভাষাকে ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল ‘শিলচর’, ‘হাইলাকান্দি’, ‘বদরপুর’, ‘রামকৃষ্ণ নগর’ ও অন্যত্র। তবে ‘সদর শহর’ ‘শিলচরে’, আন্দোলনের তীব্রতা ছিল বেশি। স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সর্বত্র ‘অহিংস সত্যাগ্রহ পিকেটিং’ শুরু হয়েছিল। ওদিকে ‘চরমপত্রের’ সময়সীমা শেষ হবার পরে ‘করিমগঞ্জে’ এক জনসম্মেলনে ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’ নেতা ‘রবীন্দ্রনাথ সেন’ ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলা ভাষাকে ‘আসাম সরকার’ ‘সরকারি ভাষার স্বীকৃতি’ না দিলে ১৯শে মে সকাল থেকে সন্ধ্যা ‘সম্পূর্ণ হরতাল’ দিয়ে ‘শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ শুরু হবে। ১৯শে মে ১৯৬১ সালে, ভোর থেকে ‘পিকেটিং’ শুরু হয়েছিল। শহর জুড়ে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী টহল দিচ্ছিল। ১৮ই মে রাতেই আন্দোলনের সাথে যুক্ত বাঙালি নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। ‘শিলচর’ স্টেশনে ‘সত্যাগ্রহীরা’ ‘পিকেটিং’ শুরু করেছিলেন। ফলে সকাল পাঁচটা চল্লিশের ট্রেন ছাড়তে পারেনি। ‘আসাম সরকার’ আগেভাগেই সেখানে ‘আসাম রাইফেলস’, ‘সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স’, ‘মাদ্রাজ রেজিমেন্টের’ সৈন্যদের মোতায়েন করে রেখেছিলেন। বেলা দুটো পর্যন্ত ‘সত্যাগ্রহ’ শান্তিপূর্ণভাবেই চলেছিল। সৈন্যরা বসে গল্পগুজব করছিলেন।বলা হয়েছিল আর কিছুক্ষণ পরেই ‘রেল অবরোধ’ উঠে যাবে। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং মারণলীলার প্রত্যক্ষদর্শী ‘সুমিত্রা ঘোষ’ লিখেছিলেন, ‘‘১৯শে শে মে দুপুরবেলা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহার সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে গৌহাটিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। উনি পৌঁছানোর সামান্য সময় পরেই বিনা প্ররোচনায় শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু হল। কার নির্দেশ ছিল সেটা?’’ সাত মিনিটে ‘সতেরো রাউন্ড গুলি’ চালিয়েছিল ‘রেজিমেন্টের সৈন্যরা’, বুলেটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন ষোলো বছরের ‘স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থী’ ‘কমলা ভট্টাচার্য’, ঊনিশ বছরের ছাত্র ‘শচীন্দ্র পাল’, ‘কাঠমিস্ত্রি’ ‘চণ্ডীচরণ সূত্রধর’, সদ্যবিবাহিত ‘বীরেন্দ্র সূত্রধর’, চায়ের দোকানের কর্মী ‘কুমুদ দাস’, বেসরকারি সংস্থার কর্মী ‘সত্যেন্দ্র দেব’, ব্যবসায়ী ‘সুকোমল পুরকায়স্থ’, ‘সুনীল সরকার’, ‘তরণী দেবনাথ’, রেলকর্মচারী ‘কানাইলাল নিয়োগী’ এবং আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসা ‘হিতেশ বিশ্বাস’। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন’ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে, সেখানে ১৯শে মে-র বাংলাভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ। সরকারি মদতে সেই হত্যালীলার তেমন কোনও প্রচার ও প্রতিবাদ ভারতের অন্যরাজ্যে দেখা যায়নি। তখন ‘সংবাদ মাধ্যম’ ও ‘সামাজিক মাধ্যমের’ এত প্রভাব ছিল না। তাই সবই ‘ধামাচাপা’ পড়ে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের এক সংবাদপত্রে একটা ‘কার্টুন’ ছাপা হয়েছিল। ‘কাছাড়ের’ ধানের ক্ষেত্রে বাংলাভাষার ফসল ফলে আছে। চাষি ‘বিমলাপ্রসাদ চালিহা’ লাঙলে দুই ক্রুদ্ধ ষাঁড় - প্রশাসন ও ‘গোর্খা রেজিমেন্ট’ জুড়ে বাংলাভাষার খেত তছনছ করছেন। বিপ্লবী ‘উল্লাসকর দত্ত’ তখন ‘শিলচরবাসী’ ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। তবুও রোগসজ্জা থেকে তিনি শহিদদের উদ্দেশ্যে মালা পাঠিয়েছিলেন। কবি ‘মনীশ ঘটক’ ‘শিলচরে কমলা ভট্টাচার্যের মায়ের কান্না’ কবিতায় লিখেছিলেন -


‘‘আমরা তো কেউ জহরলালের কোন অনিষ্ট করিনি

কল্পনাতেও অশুভ চিন্তা মনে কেউ কভু ধরিনি

তবে কেন তিনি গৌহাটি এসে এসব কাণ্ড করালেন 

ঘাতক পাঠিয়ে শিলচরে কেন মারণ নিশান ওড়ালেন?’’


‘শিলচরে’ ১১ জন ‘বাঙালি ভাষা আন্দোলনকারী’কে খুন করার পরে ‘ভাষা আন্দোলন’ স্তব্ধ হয়ে যাবে বলে ‘আসাম সরকার’ মনে করেছিলেন। নিহত বা আহতদের গায়ে লাগা গুলির অবস্থান থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে খুন করার উদ্দেশ্যেই তাঁদের উপরে গুলি চালানো হয়েছিল - ‘ছত্রভঙ্গ’ করার জন্য নয়। সেই ঘটনার পরে ‘ভাষা আন্দোলন’ প্রবলবেগে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘মনীশ ঘটক’ লিখেছিলেন -


‘‘যে ভাষায় মাকে প্রথম ডেকেছি সে ভাষা আমার দেবতা

কথা কইবার অধিকার তাতে নেবই আমরা নেব তা,

নেহরু-ফকরু-চালিহার দলে বলে-বুলেট না বাংলা

জান দেব তবু জবান দেব না করুক না যত হামলা।’’ 

                             ©️রানা©️

বাঙালিদের ‘ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন’ স্তব্ধ হচ্ছে না দেখে ‘চালিহা প্রশাসন’ বাঙালিদের ওপরে ব্যাপক দমনপীড়ন ও ধরপাকড় শুরু করেছিলেন। একমাস ধরে দণ্ডনীতির ব্যাপক প্রয়োগ করা হয়েছিল। ‘অহিংস সত্যাগ্রহীদের’ ওপরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় ‘আসাম সরকার’ কালিমালিপ্ত হওয়ায় ‘গৌহাটি হাইকোর্টের’ তৎকালীন ‘প্রধান বিচারপতি’ ‘জি মেহরোত্রা’র নেতৃত্বে একটি ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল। সেই ‘তদন্ত কমিশন’ ‘রিপোর্ট’ জমা দিলেও তা আজও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি নিহতদের পরিবারগুলিও কোন ক্ষতিপূরণও পাননি। ‘শিলচর নাগরিক সমিতি’র আহ্বানে ‘এন সি চট্টোপাধ্যায়ের’ নেতৃত্বে একটি ‘বেসরকারি তদন্ত দল’ ১৯৬১ সালের ৩১শে মে থেকে ৩রা জুন পর্যন্ত ‘শিলচর’ ও ‘করিমগঞ্জে’ ‘গুলি চালনার তদন্ত’ করতে গিয়েছিল। সেই ‘তদন্ত কমিটি’তে ‘সিদ্ধার্থশংকর রায়’, ‘স্নেহাংশু আচার্য’, ‘রণদেব চৌধুরি’র মতো প্রখ্যাত ‘ব্যারিস্টার’রা ছিলেন। তাঁরা ‘তদন্তে’ আন্দোলনকারীদের দিক থেকে কোনও ‘প্ররোচনা’ দেখতে পাননি যাতে গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি হতে পেরেছিল। নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ‘প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ’, ‘ত্রিগুণা সেন’ ও ‘ত্রিদিব চৌধুরি’র মতো তৎকালীন ‘রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ’। শেষে তৎকালীন ‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’ ‘লালবাহাদুর শাস্ত্রী’র মধ্যস্থতায় ১৭ই জুন আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ‘বরাক উপত্যকা’য় এক প্রতিনিধিদল ‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু’ ও ‘লালবাহাদুর শাস্ত্রী’র সঙ্গে বৈঠক করলেও তাঁরা বাংলা ভাষা নিয়ে কোনও সমাধান বা আশ্বাস দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ‘শাস্ত্রী-ফর্মুলা’ অনুযায়ী ‘ভাষা আইনে’ ‘মহকুমা পরিষদ’ সংক্রান্ত ‘একটি বিতর্কিত ধারা’ বাতিল করা হয়েছিল। তার ফলে ‘বরাক উপত্যকা’য় ‘পঠনপাঠন ও সরকারি কাজকর্মে’ ‘বাংলাভাষার ব্যবহার’ নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গিয়েছিল। ‘শিলচর’ স্টেশনকে ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামকরণ করার জন্য ‘স্মারকলিপি’র উত্তরে ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ ‘‘আবেগ ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে’’ এই যুক্তি দেখিয়ে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছিল।


‘শিলচরের ভাষা আন্দোলন’ কি পুরোপুরি ব্যর্থ বা জয়ী হয়েছিল? ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ২০১৪ সালের ১০ই সেপ্টেম্বরে ‘বরাকে বাংলা’ নামে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছিল - ‘‘বাংলা ভাষার দাবিতে দীর্ঘকালের আন্দোলন জয়যুক্ত হল। আসাম সরকার আজ জানাল, ‘পিএলসি ১৪/২০১১/৩৯’ নির্দেশিকায় বরাক উপত্যকায় অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য করার যে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হল। এই প্রত্যাহার আদেশ এখন থেকেই বলবৎ থাকবে। গতকালই বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের স্মারকলিপির জবাবে কাছাড় জেলার ডেপুটি কমিশনার গোকুলমোহন হাজারিকা জানিয়েছেন সরকারি কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেছেন, বাংলাই বরাকে সরকারি ভাষা।’’ লেখাটি শেষ করা যাক কবি ‘মনীশ ঘটকের’ লেখা ‘শিলচরের কমলা ভট্টাচার্যের মায়ের কান্না’ সম্পূর্ণ কবিতাটি দিয়ে -


‘‘সে যে বলে গেল জান দেব

ভাত বেড়ে রেখো, ফিরে এসে খাবো, না এলেও মাগো ভেবো না।

যেতে দিই নাই ছোট মঙ্গলীকে যদিও নাছোড়বান্দা

দিদিগত প্রাণ ছিল ছুঁড়িটার তিলে তিলে দেয় প্রাণটা। 

বড় অনটন অভাব দৈন্য ভরা এই ছোটো সংসার

মেজো বেনুবালা স্বামী কী জিনিস পায়নি সুযোগ জানবার।

অল্প বয়সে হয়েছে বিধবা শুকোয়নি আজো আঁখিজল 

কমলিকে খুন করেছে স্টেশনে দুঃসংবাদে সে পাগল। 

আমরা তো কেউ জওহরলালের কোনও অনিষ্ট করিনি 

কল্পনাতেও অশুভ চিন্তা মনে কেউ কভু ধরিনি।

তবে কেন তিনি গৌহাটি এসে এসব কাণ্ড করালেন, 

ঘাতক পাঠিয়ে শিলচরে কেন মরণ নিশান ওড়ালেন?

দু’চোখের মণি কমলি আমায় বলেছিলো

‘মাগো এইবার ম্যাট্রিক দিয়ে টাইপ শিখবো

করবো প্রচুর রোজগার

আসবে সুদিন দেখে নিও তুমি দুঃখ তোমার ঘুচাব 

যতটুকু পারি দিদি মঙ্গলীর চক্ষের জল মুছাব।’

ভাষা বিদ্রোহে যোগ দিতে মেয়ে চলে গেল রেল ষ্টেশনে 

জেদি মঙ্গলা সাথে সাথে গেল বারণ তখন কে শোনে।

ফিরে এলো নাকো শুধু একজন আরেক জনাও যায় যায়।

ওদেরি মা আমি - মুছলাম চোখ আমার কি সাজে হায় হায়।

যে ভাষায় মাকে প্রথম ডেকেছি সে ভাষা আমার দেবতা 

কথা কইবার অধিকার তাতে – নেবই আমরা নেব তা 

নেহরু-ফকরু-চালিহার দল বলে - ‘বুলেট না বাংলা?’ জান দেব তবু জবান দেব না, করুক না যত হামলা।’’

                                ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- বর্তমান, ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল।

২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ই সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল।

৩- বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন যুগে যুগে, মোহাম্মদ মাহ্‌ফুজউল্লাহ।)

                           ©️রানা চক্রবর্তী©️

No comments