Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

অপ্রকাশিত কালোমানিক’ রানা চক্রবর্তী

‘রঙচটা, তোবড়ানো, মরচেধরা গোটা তিন-চার মাঝারি আকারের টিনের তোরঙ্গভর্তি স্তূপাকার ছিন্ন পাতা, ছোটবড় কিছু খাতা ও নানা মাপের বারোখানা ডায়েরি - এরই মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রেখে গিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্য ও জীবন চর্চার যা-কিছু গোপন …

 





রঙচটা, তোবড়ানো, মরচেধরা গোটা তিন-চার মাঝারি আকারের টিনের তোরঙ্গভর্তি স্তূপাকার ছিন্ন পাতা, ছোটবড় কিছু খাতা ও নানা মাপের বারোখানা ডায়েরি - এরই মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রেখে গিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্য ও জীবন চর্চার যা-কিছু গোপন ও ব্যক্তিগত প্রাথমিক ইতিহাস। রেখে গিয়েছিলেন বলা ভুল হল, বলা উচিত ফেলে গিয়েছিলেন - নিতান্ত অবহেলাভরে ফেলে রাখা তাঁর যাবজ্জীবন রচনার এক সামান্য ভগ্নাবশেষ এ-ভাবেই শেষপর্যন্ত বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য থেকে গিয়েছিল। অনেক কিছুই অবশ্য শেষপর্যন্ত ছিল না। এমনি কত কাগজ ঝাঁট দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ি থেকে কুড়িয়ে উনুন ধরানো হয়েছিল। অমরতার ধারণামাত্রই নশ্বরতার মুখাপেক্ষী; লেখকমাত্রেরই সৃষ্টিশীল ডান হাত তাঁর অসন্তুষ্ট বাঁ হাতের ক্রমাগত আঘাত সয়ে বেঁচে থাকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে হয়তো তা খুব বেশি অসন্তুষ্ট ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত কাগজপত্র অন্ততঃ সে-কথাই বলে। তাঁর সাইত্রিশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক গল্পের প্রায় কোনোটারই সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি অবশিষ্ট নেই, প্রায় কোনো রচনারই সাময়িকপত্রে প্রকাশিত প্রথম পাঠ তিনি সংগ্রহ করে রাখেন নি, কোনো ক্ষেত্রেই সঠিক রচনাকাল নিশ্চিতরূপে জানা যায় না - সামান্য কিছু অলৌকিক ব্যতিক্রম ছাড়া, তাঁর প্রায় সমস্ত রচনার প্রাথমিক পাঠ ও পরবর্তী পাঠান্তর, রচনার প্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতার আকর, তাঁর সচেতন প্রয়াস ও ধারাবাহিক পরীক্ষার লৌকিক চিহ্নগুলি আজ সম্পূর্ণ লুপ্তপ্রায়। এমনকি, সাময়িক-পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাবলীর যে বিপুল অংশ তিনি নিজে গ্রন্থভুক্ত করেন নি, কদাচিৎ কিছু বিক্ষিপ্ত ইতস্ততঃ উল্লেখ ছাড়া, সেই সব অগ্রন্থিত রচনার উদ্ধারের সূত্র পর্যন্ত তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যাননি - বিলুপ্ত পত্রিকাগুলির সঙ্গে আজ তা পাঠকদের কাছে ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এতকিছুর পরেও, অবধারিত বিনাশের জন্যই শেষপর্যন্ত যা থেকে যায় তা তাঁর ওই তছনছ হয়ে থাকা কাগজপত্র - ছিন্নভিন্ন, জীর্ণ প্রায়, পোকা-কাটা, মরিচা মলিন; পাতার পর পাতা গল্প আর গল্পের আরম্ভ আর আরম্ভ, যা কোনোদিন শেষ হয় নি; একই লেখার একাধিক আরম্ভ; দু-এক লাইন থেকে এক-আধ পৃষ্ঠা অসম্পূর্ণ লেখার পর লেখা; একাধিক খাতায় সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ কবিতার খসড়া, কাহিনীর আভাস ও প্রাথমিক চরিত্রপঞ্জি - সেইসব খাতাই আবার ছিল তাঁর দৈনিক সংসার খরচার হিসাব-খাতা, সেখানে কখনো-বা হিসাবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছিল টুকরো দিনলিপি; বিভিন্ন খাতাপত্রে ছড়ানো নানা ইংরেজি গ্রন্থ থেকে প্রয়োজনমতো উদ্ধৃতি, মাঝে-মাঝে ইংরেজিতেই নিজস্ব ভাবনা বা প্রাসঙ্গিক মন্তব্য – বিষয়ের পরিধি অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন, স্বপ্ন ও কবিতাচিন্তা - এরই মধ্যে কালো রঙের একটি বাঁধানো খাতার মলাটের পরের পাতায় নামপত্রের আকারে লেখা ছিল, ‘Artistic Action or Theory of Art’, ঠিক তার নিচে ইংরেজিতে লেখা ছিল লেখকের নাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর সময়কাল, ডিসেম্বর ১৯৪৭; এবং এই সবকিছুর সঙ্গেই খাতার পর খাতা ও বিচ্ছিন্ন কাগজ পত্রে তাঁর চিকিৎসাতীত ব্যাধির কারণ ও প্রকৃতি এবং আরোগ্যের উপায়-সম্পর্কে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান, লেকজীবনের প্রায় সূচনাকাল থেকে যা তাঁকে আমৃত্যু ব্যাপৃত রেখেছিল - চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থাদি থেকে ইংরেজিতে লেখা স্বকীয় সিদ্ধান্ত, ওষুধ ও পথ্য-সম্পর্কে স্বকৃত বিধান - এইসব ও এমনি আরো কত কিছু। খুবই বিস্ময়কর যে, সেই শৃঙ্খলাহীন জটিল সমাহার থেকেই উদ্ধার হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনব্যাপী কবিতার সম্পূর্ণ দু’টি খাতা - যার একটি ছিল তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবনের রচনা, যার কোনো লেখাই তিনি প্রকাশ করেন নি; বৃহদায়তন অপর খাতাটিতে তাঁর পরিণত বয়সের কবিতারও বেশির ভাগ তাঁর জীবিতকালে অপ্রকাশিত ছিল। তাঁর সমগ্রজীবনের কবিতার প্রথম সংগ্রহ - বলা চলে, অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পর্যায় - তাঁর মৃত্যুর প্রায় দেড় দশক পরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ততোধিক বিস্ময়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত কাগজপত্রের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই যেন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও দৈবাৎ রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রথম কয়েকটি উপন্যাসের ভগ্নাংশ প্রায় পাণ্ডুলিপি – কালক্রম অনুসারে উপন্যাসগুলি হল - ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘জীবনের জটিলতা’। সেই পার্থিব অবশেষের মধ্যে নিহিত ছিল ‘দিবারাত্রির কাব্য’ ও ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র প্রাথমিক লিখন; একই সঙ্গে পাশাপাশি 'দিবারাত্রির কাব্য’র সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি পাঠ - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাসের আদিতম রূপ ও পরবর্তী রূপান্তর – সাময়িক পত্রিকার প্রথম মুদ্রিতপাঠ তথা চূড়ান্ত গ্রন্থের সঙ্গে আদি পাণ্ডুলিপির পাঠভেদ প্রায় মৌলিক; উভয় উপন্যাসেরই ভিন্নতর সমাপ্তি, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র সমাপ্তি নিয়ে একাধিক পরীক্ষা - এবং সেই অবশিষ্ট পাণ্ডুলিপি যদিও সমগ্র গ্রন্থদু’টির অতি সামান্য অংশের চেয়ে বেশি কিছু নয়, যদিও তা শোচনীয়ভাবে অসম্পূর্ণ, বিক্ষিপ্ত ও পরস্পর্যহীন কিছু পৃষ্ঠা মাত্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত কাগজপত্রের সঙ্গে আর যা ছিল তা হল তাঁর ব্যক্তিগত লেখা, তাঁর ডায়েরি ও চিঠিপত্র, - প্রধানতঃ ডায়েরি। ডায়েরি বলতে আক্ষরিক অর্থে প্রচলিত ডায়েরি বই - সংখ্যায় সর্বসমেত বারোটি। ডায়েরি-বইয়ের মুদ্রিত সাল অনুযায়ী সময়কাল ছিল ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৬; লেখার তারিখ-অনুসারেও তা-ই ছিল – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র ডায়েরির কালগত সীমা, তাঁর লেখক জীবনের শেষ বারো বছর সময়। ডায়েরির পর ডায়েরি অনেকটাই ছিল সাদা পাতা, তবু লিখিত পাতাও খুব কম কিছু ছিল না। ডায়েরির লিখিত অংশ প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই ভায়েরি বইয়ের মুদ্রিত সাল-তারিখ মেনে লেখা ছিল না - প্রায় সর্বদাই অনিয়মিত, সাল-তারিখের সম্পর্কহীন, যখন যেটা হাতের কাছে তাতেই লেখা হয়েছিল - ১৯৪৫ সালের ডায়েরি-বইয়ে ১৯৫৩’র, বা, একই সঙ্গে ১৯৪৭ ও ১৯৫১-৫২’র ডায়েরি-বইয়ে ১৯৫৫’র তারিখ দিয়ে লেখা হয়েছিল, এমনই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখা শুরু হবার আগে লেখক নিজে তারিখ লিখেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই হাতে-লেখা তারিখ ছিল না। যে-ক্ষেত্রে ছিল না তেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডায়েরি বইয়ের মুদ্রিত তারিখকে লেখার প্রকৃত তারিখ বলে মনে করা চলে না। লিখিত অংশের কোনো প্রসঙ্গ বা আগে-পরের তারিখ থেকে কখনো কখনো অনুমান সম্ভব, কখনো-বা তা-ও কঠিন হয়ে পড়ে। এমনও হয় যে, একই তারিখের লেখা একাধিক ডায়েরি-বইয়ে ছড়ানো, বা একই ডায়েরি বইয়ে ধারাবাহিক কয়েক দিনের লেখার পর আবার আগের কোনো তারিখ দিয়ে লিখেছিলেন। প্রায় কোনো ডায়েরি-বইয়ের লেখাই সেই বিশেষ মুদ্রিত বছরটির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বেশির ভাগ ডায়েরি-বইয়েরই লিখিত অংশের সময়কাল ছিল একাধিক বছর - কখনো কখনো বিক্ষিপ্তভাবেই, তিন, পাঁচ এমনকি সাত বছর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমুদয় ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মতোই এক পরিণত বয়সের কবিতার খাতার শেষ কয়েকটি লিখিত পৃষ্ঠাতেই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেকার সংসার খরচার হিসাবের সঙ্গে তিন দিনের রোজনামচা – মৃত্যুর আট দিন আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যার তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপনের শেষতম বিবরণ তাঁর সেই কবিতার খাতাতেই লিখে রেখেছিলেন। আমাদের সময়কালের বাংলা কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন লেখক, যাঁকে নিয়ে উপকথা রচিত হবার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে বেশি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তবু কোনো উপকথার নায়ক নন। তিনিই আমাদের সাহিত্যের প্রথম ও প্রধান ‘আধুনিক’ ঔপন্যাসিক, কোনো কোনো অর্থে বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ ঔপন্যাসিক, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসগত আধুনিকতায় যার ঐতিহাসিক অবস্থান, এমনকি যাঁর আধুনিকতার তাৎপর্য পর্যন্ত, আজও মূলগত ভাবে অস্পষ্ট থাকে। আটচল্লিশ বছরের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালে ষাটখানি গ্রন্থ ও অসংখ্য অগ্রস্থিত রচনার প্রণেতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতিজীবিত জীবন এমনকি কাহিনী হিসাবেও নিতান্তই নশ্বর ও অকালমৃত।

                              ©️রানা©️

১৬ই এপ্রিল ১৯৫৬ সালে, নিজের অকাল প্রয়াণের কয়েক মাস আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের ডাইরিতে লিখেছিলেন, ‘‘অবস্থা অতি কাহিল। বাজার আনতে দেওয়ার মতো নগদ পয়সা নিজের হাতে নেই।’‌’‌ কপর্দকহীন অবস্থায়, দারিদ্র‌্য আর রোগভোগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কীভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন মানিক তা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। বাংলা সাহিত্যে সদ্য কলম ধরেছেন যে যুবা বা যুবতী - তাঁরাও এ বিষয়ে সম্যক জানেন। আমরা সকলেই জানি। ১৯৩৭ সালে কিরণকুমার রায় সম্পাদিত ‘বঙ্গশ্রী’ (মাসিক ও সাপ্তাহিক) পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যখন মানিক যোগ দিয়েছিলেন তখন তাঁর বেতন ছিল সাকুল্যে ৭৫ টাকা। বিএসসি পরীক্ষায় দু’বার অকৃতকার্য হওয়ার পরে যেহেতু প্রথাগত পড়াশোনাতেও ইতি টেনেছিলেন তাই তাঁর পক্ষে অন্য কোনও ধরনের কাজ করা সম্ভবও ছিল না। দু’টি বিষয়ে মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর অবশ্য মিল ছিল - মদ্যপান আর আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। শোনা যায় যে, অসুস্থ অবস্থায় ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েও তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে মদ্যপান করতেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর নিজের অভাব–অনটন ভুলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘‌‘‌সুকান্তকে স্মরণ করে আমি ‘স্বাধীনতার’ আর্থিক সচ্ছলতা যতদিন না হবে ততদিন ‘পরিচয়ে’ লেখার জন্য যা মজুরি পাই ‘স্বাধীনতা’ তহবিলে জমা দেব।’‌’‌ অতিরিক্ত মদ্যপান কেন করেন তার একটি উত্তর মানিক, সম্ভবতঃ, দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর একটি কবিতায়, যেখানে তিনি লিখেছিলেন,


‘‘‌মানুষ হয়ে মদ কেন সে খায়?

মানুষ যদি মানুষ হয়ে বাঁচার উপায় পায়

অমানুষের মরার মতো মদ সে কভু খায়!’‌’‌


কী নিদারুণ স্বীকারোক্তি! এ এক এমন স্বীকারোক্তি যা বোধহয় পাঠককে বাকরুদ্ধ করে। এখানেই শেষ নয়। শেষ জীবনে মানিক আক্রান্ত হয়েছিলেন দূরারোগ্য মৃগীরোগে। শরীর আর দিচ্ছিল না। তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিলেন, কেবল নিজের রোগের সঙ্গে নয়, চরম দারিদ্রের সঙ্গেও। সেই রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই শুরু করেছিলেন অপরিমিত মদ্যপান। এর মধ্যেই চিকিৎসক বিধান রায়ের পরামর্শে তিনি বিয়ে করেছিলেন, ছেলে–মেয়ে হয়েছিল। নিজের বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর স্ট্রিটে  সকলে মিলে ঠাসাঠাসি করে কোনওমতে থাকতেন। তার মধ্যেই মানিক সৃষ্টি করেছিলেন একের পর এক যুগান্তকারী রচনা। কিন্তু এত লেখালেখি করেও তাঁর সংসার যেন আর চলছিল না। শেষে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন চাকরি নিতে। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। আবার পুরোদমে লেখা শুরু করেছিলেন, সেই সঙ্গে আবার শুরু হয়েছিল তাঁর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই। সেই দারিদ্র যে কী ভয়ংকর তা জানা যায় মানিকের ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা পড়লে। তাঁর স্ত্রী ডলি অর্থাৎ কমলা এক মৃত সন্তানপ্রসব করেছিলেন, আর মানিক ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’ দারিদ্র কী অপরিসীম হলে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে আসে! যা সকলকে বাকরুদ্ধ করে দেয়! ঠিক এমনই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কবি ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়’‌ও। তিনি নিজের কথা হারিয়ে ফেলেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর এক স্বীকারোক্তির সামনে। ‘‌নেয়ারের খাট, মেহ্‌গিনি-পালঙ্ক এবং একটি দুটি সন্ধ্যা’‌য় মানিকের জীবনের শেষ দু’টি দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’‌ লিখেছেন যে, তাঁরা মাত্র কয়েকজনই উপস্থিত ছিলেন মানিককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়; তাঁর ভাষ্যে, ‘‌‘‌সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানিকবাবুর স্ত্রীকে অভিযোগ করে বলেছিলেন: এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন? উত্তরে তাঁকে (কমলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে) হাসতে হয়েছিল। আর তারপর অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন: তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই। মৃত্যুকালে বাংলাদেশ তাকে কি মর্যাদা দিল, তারও প্রমাণ আমরা বাইরের সাতটি মানুষ।’‌’‌ মৃত্যুকালে মর্যাদা না দিলেও মৃত্যুর পরে অবশ্য বাংলাদেশ মানিককে মর্যাদা দিয়েছিল। এমনই ছিল সে মর্যাদার বহর যে, ফুলের ভারে সদ্যপ্রয়াত মানিক শুয়েছিলেন যে পালঙ্কে, তার পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল। সেই ফুলের পাহাড় নিয়েই তো ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়’‌ লিখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত পঙ্‌ক্তিগুলি, ‘‌‘‌ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে।’‌’‌

                              ©️রানা©️

ঠিক কবে ও কিভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘‌মৃগীরোগের’‌ আক্রমণে প্রথম আক্রান্ত হয়েছিলেন, আজ তা নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন। প্রামাণিক তথ্য হিসাবে একমাত্র অবলম্বন তাঁর প্রথম ও শেষ জীবনের দু'টি ব্যক্তিগত চিঠি - সেই দু’টি চিঠিই তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৩৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর, নিজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে লেখা প্রথম চিঠিটিতে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন -  ‘‌‘‌... আমি প্রায় দুই বৎসর হইল মাথার অসুখে ভুগিতেছি, মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া যাই। এ পর্যন্ত নানাভাবে চিকিৎসা হইয়াছে কিন্তু সাময়িকভাবে একটু উপকার হইলেও আসল অসুখ সারে নাই। কয়েকজন বড় বড় ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আমি বুঝিতে পারিয়াছি কেবল ডাক্তারি চিকিৎসার উপর নির্ভর করিয়া থাকিলে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হইবে কিনা সন্দেহ।’‌’‌ অসুখের সম্ভাব্য কারণ প্রসঙ্গে একই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন - ‘‌‘‌আমার যতদূর বিশ্বাস, সাহিত্যক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি নাম করিবার জন্য স্বাস্থ্যকে সম্পুর্ণ অবহেলা করাই আমার এই অসুখের  কারণ। ... এক বৎসর চেষ্টা করিয়া যদি আরোগ্য লাভ না করিতে পারি, তাহা হইলে বুঝিতে পারিব আমার যে অত্যন্ত উচ্চ ambition ছিল তাহা সম্পূর্ণরূপে সফল করিতে পারিব না। আংশিক সাফল্য লইয়াই সাধারণ ভাবে আমাকে জীবন কাটাইতে হইবে। এ ভাবে বাঁচিয়া থাকিবার ইচ্ছা আমার নাই। ...’’ খুবই স্বাভাবিক, তরুণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর লেখকজীবনের প্রতিষ্ঠাপর্বে, তাঁর সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই তাঁর ‘মাথার অসুখের কারণ’ ব’লে মনে করেছিলেন - কারণ, নিতান্ত বেঁচে থাকার চেয়ে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তাঁর কাছে অনেক বড় ব’লে মনে হয়েছিল, এবং তাঁর অসুস্থতার ক্রমান্বয় আঘাতে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষাই সর্বপ্রথম বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই কারণও নিশ্চয় সম্পূর্ণ বা একমাত্র কারণ ছিল না, সেটা ছিল আংশিক ও প্রত্যক্ষ কারণ মাত্র। প্রকৃত কারণ হয়তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবনের এমন কোনো নৈতিক সংকট বা গোপন অপরাধবোধ ছিল, চেতন-অবচেতনের এমন এক মীমাংসাহীন দ্বন্দ্ব ছিল, যা নিজের কাছেও উচ্চারণ করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের সাহিত্য, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্যে’ হেরম্বের জীবনের দ্বন্দ্বময় রূপক, গাঢ় অন্ধকারে দুই হেরম্বের দীর্ঘ ও আত্মক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধ, কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে নিজের স্ত্রীকে ঝুলিয়ে দেবার অতর্কিত স্মৃতি, হেরম্বের ‘অনির্বচনীয় একাকিত্ব’ ও পরবাসী-চেতনা, এইসব ও আরো অনেক কিছু, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের দুঃস্বপ্নপ্রায় গল্পগুলি, লেখকের অবচেতন-জীবনের গভীর কোনো সংকট বা বিপন্ন অভিজ্ঞতারই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু জীবনীগত উপাদান হিসাবে কোনো প্রামাণিক তথ্যের অভাবে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ব্যাধির কারণ ও পরিণাম, তাঁর ব্যক্তিগত চিঠির প্রকাশ্য বিবরণ থেকেই জেনে নিতে হয়। ব্যাধি-প্রসঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় চিঠিটি তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত আগের বছরের লেখা ছিল, তারিখ ছিল - ৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সাল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ব্যক্তিজীবনে তাঁর ব্যাধির পরিণাম ততদিনে অনেক বেশি জটিল হয়ে গিয়েছিল - তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন ইতিমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। একটু বিস্তারিতভাবেই তিনি তাঁর অসুখের ইতিহাস সেই চিঠিতে দিয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘মৃত্যুদণ্ড’ মাথায় নিয়েই তিনি সেই চিঠিখানি লিখেছিলেন - দণ্ডাজ্ঞার ছায়ায় জীবন যদিও বহুবার কেঁপে উঠেছিল, তবু দণ্ডিতের ভূমিকায় সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র জবানবন্দী। সেই চিঠি থেকে জানা যায়, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রভৃতি কয়েকথানি গ্রন্থ রচনাকালে একদিন তিনি অকস্মাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন; তারপর, এক মাস থেকে দু-তিন মাস অন্তর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। তার আগেই তাঁর নিজেরই ভাষায়, ‘‘৪/৫ বছরের প্রাণান্তকর সাহিত্য সাধনা হয়ে গেছে।’’ পরবর্তী ছ-সাত বছর, চিকিৎসকদের হাতে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর রোগের প্রকৃতি ও আরোগ্যের উপায় বিশেষজ্ঞদের কাছেও অজ্ঞাত থেকে গিয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন - ‘‘ইতিপূর্বেই আমি নিজের অর্থ সম্পর্কে ডাক্তারি বই পড়তে সুরু করেছিলাম। খাতা ভর্তি করে সব টুকে রেখেছিলাম - প্রমাণ আছে। ডাক্তারও স্বীকার করেছিলেন এবং ডাক্তারি বই পড়ে আমিও দেখে ছিলাম সেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে: মাঝে মাঝে আমি কেন অজ্ঞান হয়ে যাই তার কারণ আজও চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারে নি!’’ সচেতন জীবনের শুরু থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিজ্ঞানকে তাঁর জীবন ও সাহিত্যের অধীশ্বর ব’লে মেনে নিয়েছিলেন, শারীরিক অস্তিত্বের সংকটকালে সেই বিজ্ঞানের সীমা সেভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ভয়ঙ্কর সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এর পরও থেকে যায় চৈতন্যের অধিকার - শেষনিশ্বাসের আগে যা শেষ হয় না। তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘দীর্ঘকাল চিকিৎসা চালিয়ে অকর্মণ্য মরণাপন্ন হয়ে আমি তখন সিদ্ধান্ত নিই যে নিজেকে আর রোগী ভাবব না।’’ এই সিদ্ধান্ত থেকেই, চিকিৎসার অতীত অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়োজনে, এবং লেখার পক্ষে প্রয়োজনীয় সাময়িক সুস্থতার উপায় হিসাবে, ‘অ্যালকোহল’-এর মতো এক সম্পূর্ণ বিপরীত ও আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বাঁচানোর অসম্ভব পরীক্ষায় রত হয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্বিতীয় ব্যাধি’, তার ‘আসক্তির ইতিহাস’, এভাবেই তাঁর চিকিৎসাতীত অসুখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পর্কিত। একই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন - ‘‘প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। আর ক’মাস বাঁচব এই ভাবনা মাথায় এসেছিল। নিজেকে রোগী না ভেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলাম বলেই রক্ষা পেয়েছিলাম।’’ কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি, যদিও চূড়ান্ত সংকটকালেও তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন যে, তিনি ‘‘সুস্থ সবল সক্রিয় মানুষ’’। তাঁর জীবনের শেষ বছর ১৯৫৫ সালে, তাঁর বিপর্যস্ত শরীর মনের শেষ সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা হয়েছিল প্রথমে ‘ইসলামিয়া হাসপাতালে’, তারপর ‘লুম্বিনী-পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়ে’, কিন্তু শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। ‘মৃগীরোগের’ আক্রমণে বহুবার মৃত্যুকে অতিনিকটে প্রত্যক্ষ ক’রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ বারের মতো আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৯৫৬ সালের ২রা ডিসেম্বর, এবং সম্পুর্ণ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ‘নীলরতন সরকার হাসপাতালে’ নীত হয়ে, ৩ ডিসেম্বর অতি প্রত্যুষে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ সেই শেষ আক্রমণকেই তাঁর মৃত্যুর সাক্ষাৎ কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন। নিজের অসুখ-সম্পর্কে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দ্বিতীয় বা শেষ চিঠিটিতে লিখেছিলেন, তিনি নিজেই একসময় ডাক্তারি বইপত্র পড়া শুরু করেছিলেন ও খাতা ভর্তি ক’রে টুকে রেখেছিলেন - তার প্রমাণ আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত কাগজ পত্রের মধ্যে সেটার বিপুলপরিমাণ প্রমাণ বাস্তবিক থেকে যায় - অসংখ্য ছিন্নভিন্ন পাতা ও একাধিক খাতায়, চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থাদি থেকে সরাসরি ‘নোট’ ছাড়াও, অসুখ-সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অনুসন্ধান ও সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তাঁর ‘ব্যাধি-বিষয়ক অনুশীলন’ তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালের কত খানি সময় তাঁকে আমৃত্যু ব্যাপৃত করে রেখেছিল।

                               ©️রানা©️

লেখকজীবনের প্রথম চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে ক্রমে দেখা দিয়েছিল এমন এক ‘সর্বাত্মক সংকটের অভিজ্ঞতা’, যা তাঁর ব্যক্তিগত সংকটেরই প্রত্যক্ষ পরিণাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তী দশ বছর, তাঁর ব্যক্তিজীবনের সংকট, প্রকৃতপক্ষে, অস্তিত্বের এক সামগ্রিক সংকটকেই অনিবার্য করে তুলেছিল - ‘বাস্তবতার সংজ্ঞা’ পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, ‘জীবনের সংজ্ঞা’ও নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ‘সংজ্ঞা’ যখন লুপ্ত হয়, ‘সংকট’ তখনই দেখা দেয়, আর ‘সংকট’ পুনরায় ‘সংজ্ঞা’কেই আক্রমণ করে। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে এক দ্বন্দ্বময় সম্পর্কে ক্রমেই লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন - ক্রমাগত ‘আত্মবিলোপ’ই হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘আত্মপ্রকাশের’ একমাত্র উপায়। অনন্যোপায় ছিলেন তিনি, একমাত্র ‘আত্মখনন’ ছাড়া নিজেকে আবিষ্কার করার আর কোনো উপায় তাঁর ছিল না - ‘আত্মখনন’ ও ‘আত্মহনন’ তাঁর কাছে সমার্থক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এরই মধ্যে জেগে ছিল শিল্পের প্রতিরোধ। ব্যক্তিজীবনে, মরণাধিক ব্যাধির প্রতিটি আক্রমণের মধ্য দিয়ে এক-একটি মৃত্যু সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল বলেই, লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখার মধ্যেই প্রবলভাবে বেঁচেছিলেন এবং আজও বেঁচে আছেন - তাঁর সৃষ্টিশীলতার বিরামহীন পরীক্ষায় অসুস্থতা ও স্বাস্থ্যের প্রচলিত বিভেদ শেষপর্যন্ত ভেঙে পড়েছিল। অসুস্থতার সঙ্গে তাঁর বাধ্যতামূলক সহাবস্থান থেকেই শুরু হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে ও সাহিত্যে অসুখ ও সুস্থতার এক দ্বন্দ্বময় ‘সম্পর্ক ও সংঘাত’ - তাঁর সৃষ্টিশীলতার মৌলিক রূপান্তর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকজীবনে তাঁর ব্যাধির ভূমিকা তাই তাঁর সংকটের মধ্যেই শেষ হয় না – তাঁর ব্যাধিগ্রস্ত জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে, তাঁর লেখক জীবনের প্রকৃত বিষয় ও ঐতিহাসিক পরিণতি এখনও বাকি থাকে।

                              ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: ডাইরি ও চিঠিপত্র।

২- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অঞ্জন আচার্য, কথাপ্রকাশ (২০১৫)।

৩- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শতবার্ষিক স্মরণ, ভীষ্মদেব চৌধুরী, অবসর প্রকাশনা সংস্থা (২০০৮)।)

                         

No comments