Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

মধ্যযুগের ভারতে নারীর রূপসজ্জা’ রানা চক্রবর্তী

‘‘মুসলমান শাসকদের সমকালীন’ ভারতবর্ষকে আমরা সাধারণতঃ ‘মধ্যযুগ’ বলে থাকি৷ কিন্তু ‘প্রাচীনযুগের’ নিঃশেষ সমাপ্তির পরেই যে ‘মধ্যযুগের’ শুরু হয়েছিল, তা নয়। কোন বিশেষ রীতি রেওয়াজ ওভাবে শুরু বা শেষ হয় না, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে। এখ…

 





‘মুসলমান শাসকদের সমকালীন’ ভারতবর্ষকে আমরা সাধারণতঃ ‘মধ্যযুগ’ বলে থাকি৷ কিন্তু ‘প্রাচীনযুগের’ নিঃশেষ সমাপ্তির পরেই যে ‘মধ্যযুগের’ শুরু হয়েছিল, তা নয়। কোন বিশেষ রীতি রেওয়াজ ওভাবে শুরু বা শেষ হয় না, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে। এখানে বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য বড় বেশি৷ নতুন রীতিনীতিকে যত সহজে গ্রহণ করা হয়, পুরনো রীতিকে তত সহজে বর্জন করা হয় না, অর্থাৎ এখানে থেকেই যায় সব কিছু। সেইজন্যই ‘অজন্তার গুহাচিত্রে’ দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের সাজপোশাকের একত্র সমাবেশ। এই ‘মধ্যযুগেই’ ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের চরমোৎকর্ষ দেখা দিয়েছিল৷ সাধারণতঃ সব দেশেই বিজিত বিজয়ীর অনুকরণ করে। শোনা যায়, ‘আর্য নারীদের’ উন্মুক্ত বক্ষ দেখে ‘দ্রাবিড় নারীরা’ লজ্জায় লুকিয়ে ফেলেছিলেন তাঁদের ‘কঞ্চুলিকা’। সব দেশেই দেশের রাজা রানীর সাজসজ্জার অনুকরণ করেন অভিজাত সমাজ, অভিজাতদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষ। বহুদিনের ব্যবধানে সবাইকে এক সময়ের বলে মনে হয়। ভারতে আসা লুণ্ঠনকারী বিদেশী রাজারা যখন এদেশেই শাসক হয়ে বসেছিলেন তখন তাঁরাও ‘বর্ণাঢ্য ভারতীয় সাজসজ্জা’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুসলমান শাসকরা ভারতে আসার আগেই ‘চীন ও পারস্যের বস্ত্রশিল্পের’ সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং ঐ দুটি দেশের বস্ত্রশিল্প চরমোৎকর্ষ লাভ করেছিল বহু পূর্বেই। কিন্তু ‘ধর্মীয় অনুশাসন’ মেনে মুসলমান শাসকরা যে পোশাক পরতেন সেগুলো ছিল সাদাসিধে, ঘোর রঙের এবং মোটা সুতি বস্ত্রের। তাতে না ছিল নকশা, না ছিল রঙ। সেই পোশাক অবশ্যই ‘যুদ্ধক্ষেত্রের উপযোগী’ ছিল। মেয়েরাও পরতেন একরঙা ‘পেশওয়াজ’ ও ‘পাজামা’। ভারতে এসে ‘রাজস্থানের মেয়েদের’ মতো তাঁরাও ‘ওড়না’র ব্যবহার শুরু করেছিলেন। প্রথমে এই ‘ওড়না’ বা ‘দোপাট্টা’ আকারে খুব ছোট ছিল, পরে ক্রমশই বড় হয়েছে। এই ‘ওড়না’র ক্রমবিবর্তনই বোধহয় ভারতীয় পোশাকের জগতে সবচেয়ে বড় বিস্ময়৷ সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে ‘হারেমের’ কথা বলা যাক। মুসলমানেরা ‘রাজ অন্তঃপুর’কে বলতেন ‘হারেম’; যতদূর মনে হয়, ‘হারেমে’ কড়াকড়ি বা পাহারা দেবার কঠোর ব্যবস্থার চল্ ছিল। হিন্দু রাজাদের সমযয়ে রানী বা ‘পুরাঙ্গনারা’ সত্যিই সম্পূর্ণ ভাবে অন্তরালবাসিনী ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে ‘রাজপুত রাজাদের অন্তঃপুর বা রাওলা’র ‘পর্দা’ এবং কড়াকড়ি ‘মুঘল হারেমের’ মতোই যে ছিল সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। সেই ব্যবস্থা বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে নারীদের রক্ষা করবার জন্যে রাজারা নিজেরাই নিয়ম করেছিলেন, না কী, শাসকদের রীতি-রেওয়াজের অনুকরণে অন্তঃপুরে ‘পর্দা’র চল হয়েছিল, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে দেখা যায় যে, ‘মুঘল হারেমে’ ‘রাজপুত রাজকন্যারা’ আসতেন ‘বেগম’ হয়ে – ভিন্ন রুচি ও ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে। ‘হারেমের’ প্রাঙ্গণে ‘তুলসীগাছ’ রোপণের ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায় তাঁরা নিজের নিজের ধর্মাচরণে যেমন বাধা পাননি তেমনি বাধা পাননি নিজস্ব সংস্কৃতির অনুশীলনে। ‘হারেমে’ তাঁরা এনেছিলেন ‘রাওলার রঙ ও ঔজ্জ্বল্য’। নিশ্চয় তাঁদের বর্ণাঢ্য ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি’, ‘ওড়না’ মুগ্ধ করেছিল একরঙা ‘পেশওয়াজ’ ও ‘পাজামা’ পরা ‘বেগমদের’। অনেকে বলেন, ‘রাজস্থানের’ প্রকৃতি এত রুক্ষ বলে ‘রাজপুতানী’র অঙ্গে এত রঙ। যাঁদের দেশের প্রকৃতি হরিৎ-শ্যামল, ফুলে-ফলে রঙিন, সে দেশের মেয়েরা পরেন ‘সাদা শাড়ি’। এখনও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ‘রাজস্থানে’ রঙের ব্যবহার বেশি। তবে এখন আর কোন রাজ্যই পিছিয়ে নেই। যাক সে কথা।

                              ©️রানা©️

‘রাজপুত রাজাদের’ পোশাকের মধ্যে ‘কোমরবন্ধ’ বা ‘পটকা’র সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘বাদশাহ’ এবং ‘শাহজাদারা’। এবং তাঁরাও ‘রাজপুতদের’ দেখাদেখি ‘সূক্ষ্ম জরির কাজ করা পটকা’ ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। ‘জাহাঙ্গীরের’ সময়ের রকমারি নকশার ‘কোমরবন্ধ’ পাওয়া গেছে। সেই ‘পটকা’ ‘রাজপুত মেয়েরা’ও ব্যবহার করতেন ‘ঘাগরা’র সঙ্গে। ‘পটকা’ শুধু যে ‘বেল্টের’ কাজ করত তা নয়, তাঁদের কোমরটিকেও সরু রাখতে সাহায্য করত। মুসলিম সমাজে প্রথমদিকে ‘চিত্রিত পোশাক’ পরার ‘ধর্মীয় নিষেধ’ ছিল। তাঁরা ছবি আঁকতেন না কোন জীবিত বস্তু বা ব্যক্তির। সেজন্যে ‘কোরানের হরফগুলি’ সুন্দর করে চিত্রিত করা হত, বোনাও হত। অপরদিকে ‘চীনে’ ছিল কাপড়ের ওপর ‘সুতো’ বা ‘জরি’ দিয়ে ছবি আঁকার চল্। এছাড়া ছিল নানারকমের ‘ডোরা দেওয়া কাপড়’৷ ‘পারস্য’ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষেরা ‘ডোরা দেওয়া কাপড়ের জামা কিংবা পাজামা’ তৈরি করতেন, ‘পাগড়ি’ জাতীয় ‘শিরস্ত্রাণ’ও তৈরি করতেন। ভারতে হিন্দুদের মধ্যে সব জিনিসেরই প্রচলন ছিল - ‘ডোরা’, ‘নকশা’, ‘ছবি’, ‘অলঙ্কারের’ মতো ‘জড়োয়া সোনা-রুপোর ফুল’ বসানো ছাড়াও তাঁদের ঝোঁক ছিল ‘বস্ত্রের সূক্ষ্মতা’র ওপর। ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ার জন্যেও প্রাচীন যুগে ভারতীয়রা ‘পাতলা কাপড়’ পছন্দ করতেন। নতুন যে কোন জিনিসকে পরম সমাদরে গ্রহণ করার মতো উদার মন ও সুন্দরকে চিনে নেবার মতো শিল্পসম্মত দৃষ্টিও ভারতীয় নারীর সাজসজ্জাকে উন্নততর করতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে। ‘মুঘল আমলের’ আগে এবং পরে সাধারণভাবে ‘ইসলাম ধর্মাবলম্বী বেগমদের’ পোশাকে ‘ডোরা কাটা সিল্ক’ ও ‘মসলিনের’ প্রাধান্য চোখে পড়ে। পুরনো আমলের আঁকা ছবিতে দেখতে পাওয়া যায় যে ‘হারেমের মেয়েরা’ পরতেন ‘সাদা পাজামা’ ও ‘আঁটসাট কুর্তা’। সেই ‘কুর্তা’র নিচের দিকটা ‘আধুনিক কামিজের’ মতো সমান ছিল না - চারটে বা ছ’টা কোণ থাকত তাতে, অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখাত সেগুলি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই পোশাক ছিল সাধারণ মেয়েদের পোশাক। ছবিতে দেখা যায়, পরিচারিকা সেইরকম ‘কুর্তা’ পরে ‘সুরা’ পরিবেশন করছেন। ভৃত্যদের পোশাকেও সেই কোণ চোখে পড়ে। এমনকি সেই পোশাক ‘রাজস্থানে’ও দুর্লভ ছিল না। গবেষকদের যতদূর মনে হয়, সেই পোশাকটিতে ‘ভারতীয় রীতি’র সঙ্গে ‘পারসীক রীতি’র মিশ্রণ ঘটেছিল। ‘কুর্তা’র সেই কোণের সঙ্গে দেখা যেত ইংরেজি ‘ভি’-এর মত গলা, এবং সেখানে থাকত ‘জরি বা সামান্য সুতোর কাজ’। ‘মুসলমান শাসকদের পোশাকে’ বহুদিন পর্যন্ত কোন ‘নকশা’ ছিল না। কিন্তু ‘বেগমদের পোশাকে’ পরিবর্তন এসেছিল দ্রুতভাবে। এবং সেই সময় থেকেই বস্ত্রশিল্পের, বিশেষ করে ‘কিংখাবের’ প্রভূত উন্নতি দেখা দিয়েছিল। সেই ‘খানদানী’ ব্যাপার আজও চলে আসছে ‘বেনারসী’র জগতে। সেখানে এখনও ‘তসবীর’, ‘লহরিয়া’, ‘চারখানা’, ‘খানজুরি’, ‘ডোরিয়া’, ‘সালাইদার’, ‘মোটরা’, ‘ইলায়েচা’, ‘সঙ্গী’, ‘বুলবুলচশম’, ‘চশমানকশা’, ‘আড়িবেল’, ‘খাজুরিবেল’, ‘পানবুটি’, ‘ফুল বুটি’, ‘কলগাবুটা’, ‘শিকারগাহ’, ‘গুলদাউদি’, ‘চিনিয়াপট মখমলী’, ‘বুটি মানাতাশি’, ‘জামেয়ার বুটি’, ‘ফর্দি বুটি’, ‘পাংখা বুটি’, ‘আসরফি বুটি’, ‘জালি কী তুরঞ্চ বুটি’, ‘বুটা ঝাড়দার’, ‘মেহরাব’, ‘তনছই’, ‘ভাসকট’, ‘আড়াগুঞ্জর’, ‘গুলবদন’, ‘বেলদার’, ‘কাঙ্গুরী’, ‘ফুলোয়ার’ প্রভৃতি নামের ছড়াছড়ি। এই নামগুলো মনে পড়িয়ে দেয় ‘বেনারসী শিল্পের’ বিশেষ একটা জগৎকে। সে জগটা শুধু ‘নকশার জগৎ’ নয়, বস্ত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদেরও জগৎ। ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর’ এবং ‘সম্রাজ্ঞী নূরজাহান’ দু’জনেই ছিলেন শিল্পপ্রেমিক। ‘নূরজাহান’ নিজেই ছিলেন শিল্পী। সূক্ষ্ম কারুকাজ করতে পারতেন কাপড়ের ওপর। অনেক নকশা নাকি তাঁরই আবিষ্কার। আসলে ‘নূরজাহান’ ভারতীয় নারীর পোশাকে এনেছিলেন নতুনত্ব ৷ অবশ্য তিনি ‘হারেমে’ ‘পারসিক প্রভাব’টিকে পুরোমাত্রায় বজায় রাখতে চেয়েছিলেন; তবে সেটা বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। প্রথমদিকে ‘হারেমের’ মেয়েরা ‘কিংখাব’ ব্যবহার করতেন না। ‘একরঙা’ বা ‘ডোরাকাটা’ ‘জামা ও পাজামা’র ওপরে তাঁরা পরতেন মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম ‘মসলিনের পেশওয়াজ’। ‘কিংখাব’ জিনিসটা নারীদের পোশাকের উপকরণ হিসেবেও ছিল বেমানান। সেটা ছিল ভারী এবং জরির কাজের জন্য কিছুটা কর্কশ৷ এছাড়া ভারতীয় মেয়েরা পরতেন গা ভর্তি সোনা রুপোর অলঙ্কার। তাই তাঁদের পোশাকে সোনার ফুল রুপোর পাতার বাহারের প্রয়োজন কী! দুইয়ে মিলে রূপ খুলত না, গয়না-পোশাক দুই-ই মাঠে মারা যেত। তাই ‘কিংখাবের অঙ্গরাখা’ পরতেন পুরুষেরা। মুঘল সম্রাটেরা - ‘জাহাঙ্গীর’, ‘শাহজাহান’ ও ‘ঔরঙ্গজেব’ তিন জনেই ছিলেন ‘কিংখাবের’ সমঝদার। ‘ঔরঙ্গজেব’ পছন্দ করতেন নানা ধরনের ‘মসলিন’, বিশেষ করে কাজকরা ‘জামদানী মসলিন’। ‘আবরোয়া নয়নসুখ’ ও ‘জামদানী’ও সেই সময়েই উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। ‘চিকন কাপড়ে’ও দেখা গিয়েছিল নানা বৈচিত্র্য। ভারতীয় নারীদের মধ্যে জুতো পরার চল্ খুব বেশি ছিল না। যদিও ‘বেলুরের’ দু-একটি ‘মদনিকা’র পায়ে দেখা যায় ‘হাই-হিল হাওয়াই চটি’র মতো পাদুকা। ‘হারেমবাসিনীরা’ সকলেই জুতো পরতেন, সেই জুতোর সামনেটা ছিল কারুকাজ করা ঢাকা, পিছনের দিকটা ছিল কারুর ঢাকা আবার কারুর বা চটির মতো খোলা। তাঁদের জুতোর কারুকাজ করা অংশে ‘কিংখাবের’ ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ‘পারসীক নারীরা’ ‘ওড়না’ ব্যবহার করতেন কিনা সেই বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হয়ত রুমালের মতো ছোট ‘ওড়না’র ব্যবহার তাঁরা জানতেন। সেটার পরিবর্তে তাঁদের মাথায় উঠেছিল ‘টুপি’। তবে ভারতীয় নারীরা টুপি পরতেন না, ‘মুকুট’ পরতেন রানীরা। মুসলমান সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েরই ‘টুপি’ পরার চল্ ছিল। ‘বেগমদের’ ‘টুপি’ও তৈরি হত মহার্ঘ ‘জরির ফুলদার কিংখাব’ দিয়ে, তাতে বসানো হত ‘দামী জহরৎ’ ও ‘মুক্তো’। মুঘল ‘হারেমে’ ‘টুপি’র ওপরে বাঁদিকে ‘বোতাম’ বসানো হত। ভারতে এসে মুঘল অন্তঃপুরের নারীরা দেখেছিলেন ‘কাঁচুলি’, ‘ঘাগরা’ ও ‘ওড়না’ পরা সুবেশা ‘রাজপুতানী’দের। তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই পোশাকটির সুন্দর সাবলীলতায়। প্রথমে ‘রাজপুতানী’দের, বিশেষ করে ‘কাংড়া অঞ্চলের’ মেয়েদের ‘পটকা’ এবং পরে তাঁদের ‘কাঁচুলি’ ও ‘ওড়না’টিও ‘হারেমবাসিনীরা’ গ্রহণ করেছিলেন। ‘নূরজাহানের’ ছবিতে দেখা যায় যে তাঁর পরনে ‘ডোরাকাটা পাজামা’র ওপরে থাকত ‘হ্রস্ব জামা’, যা ‘কাঁচুলি’ ও ‘কুর্তা’র সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এবং ‘মসলিনের পেশওয়াজ’। ‘হারেমবাসিনী’ যেমন ‘টুপি’ বা ‘তাজ’ পরতেন, সেটি গ্রহণ করেছিলেন ‘রাজস্থানের’ কোন কোন ‘রাওলার নারীরা’। ‘বুঁদী’র রাজকন্যারা ‘লম্বা টুপি’ পরতেন৷

                             ©️রানা©️

শিল্পানুরাগিণী ‘নূরজাহান’ ছিলেন অনেকগুলি কাপড় ও নকশার আবিষ্কর্ত্রী। তিনি একে একে প্রবর্তন করেছিলেন ‘পাচতোলিয়া ওড়না’, ‘দুদামী পেশওয়াজ’, ‘বাদলা’ বা ‘এক ধরনের কমদামী জরি’, ‘কিনারি’ বা ‘লেস’, ‘আতর ই জাহাঙ্গিরী’, ‘নূরমহালী কিংখাব’ এবং আরও কত কী। ‘নূরজাহান’ পোশাকের ওপর সূক্ষ্ম কাজ পছন্দ করতেন। অনেকের মতে ‘চিকনের নকশা’ও তাঁরই আবিষ্কার। তা যদি না-ও হয়, তিনিই যে সেই শিল্পটির প্রভূত উন্নতি করেছিলেন তাতে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। ‘বেগমদের’ বিয়ের সাজ তৈরি হত জমকালো ‘কিংখাব’ দিয়ে। ‘নূরজাহান’ স্থির করেছিলেন, বিয়ের সময় সকলেই ‘জমকালো জরির পোশাক’ পরবেন। আহা গরীবদেরও তো ইচ্ছে করে একদিনের জন্যে ‘বাদশা-বেগম’ হতে! সেই এক দিনটি তাঁদের জীবনে আর কবে হতে পারে বিয়ের দিনটি ছাড়া! সম্রাজ্ঞীর খেয়াল! তাঁর কোন অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁর দাসীরা? প্রতিদিন যাঁরা তাঁকে সাজিয়ে দিতেন, তাঁরা সাজবেন না! কিন্তু ‘কিংখাবের’ পোশাক ছিল বড় দামী। গরীবরা সেটা পরবেন কি করে? ভেবে চিন্তে ‘নূরজাহান’ নিজেই একটা নকশা তৈরি করে ফেলেছিলেন। ‘ফাঁকা’র ওপর ‘জমকালো’। যে সব নকশা খুব সূক্ষ্ম নয়, অথচ পুরো জমিটা ভরে থাকত, সেটাকে বলা হত ‘ফাঁকার কাজ’। ‘নূরজাহানের’ পরিকল্পনা মতো সেই কাপড় বুনতে সময় কম লাগত, দেখতে ঝলমলে হলেও পরিশ্রম কম বলে সেগুলোর দামও ছিল কম। সেই নতুন জরির পোশাকের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নূরমহালী’। ‘নূরজাহান’ নিজের পরিচারিকা ও তাঁদের কন্যাদের বিয়েতে উপহার দিতেন ‘নূরমহালী’ পোশাক। সেই পোশাক তৈরি করতে তখনকার দিনে খরচ পড়ত পঁচিশ টাকা, মতান্তরে পঁচিশ মোহর বা একশো টাকা। আজও সেই রীতি আমাদের দেশে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ‘নূরজাহানের’ সেই সঙ্কল্প ভারতীয় নারীর পোশাকে নিয়ে এসেছিল এক নতুন দিগন্ত। ইতিপূর্বে ‘বিয়ের সাজ’ বলে আলাদা কিছু ছিল না। ‘রাজ্যশ্রী’র বিয়ের বড় মাপের আয়োজনের কথা ‘বাণভট্ট’ লিখেছিলেন কিন্তু সেই সাজপোশাকের স্তূপ থেকে ‘রাজ্যশ্রী’র ‘রক্তিম পট্টবস্ত্র’টিকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়নি, বরং ‘ভারতীয় সনাতন রীতি’ অনুযায়ী বিয়ের সাজ ছিল সাদা এবং সেখানে ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তে পবিত্র ও সুন্দরেরই প্রাধান্য ছিল। এখানেই মধ্যযুগের সাজের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন ‘নূরজাহান’। এরপর থেকে ‘বিয়ের কনের সাজ’ মানেই ‘জমকালো জড়োয়ার প্রাচুর্য’।

                              ©️রানা©️

এই প্রসঙ্গে ‘অভিজাত ঘরের মুসলমান মেয়েরা’ ‘বিয়ের সাজে’ কেমন সাজতেন সেটার একটা নিখুঁত বিবরণ ‘আন্না হ্যারিয়েট লিউনাউসের’ বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। ‘আন্না’ ভারতে এসেছিলেন খ্রীস্টিয় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ‘খানদানী পরিবারের সাবেকী ধারা’ পুরোমাত্রায় বজায় ছিল। ‘লিউনাউসের’ নিজের ভাষায়, ‘‘... she wore a purple silk petticoat embroidered with a rich border of scattered bunches of flowers, each flower formed of various gems, while the lines and stems were of embroidered gold and silk threads. The bodice was of the same meterial as the petti coat, the entire vest being marked with circular rows of pearls and rubies. Hair was parted in the Greek style and confined at the back in a graceful knot bound by a fillet of a gold. On her forehead rested a beautiful flashing star of diamonds. Her slippers, adorned with gold and seed pearls, were open at the heads showing her henna-tinted feet and curved up in front towards the instep, while from her head flowed a delicate kincauli scarf woven from gold thread, of the finest texture and of a transperant, sunbeam like appearance. This was draped round her person and concealed her eyes and nose revealing only the mouth and chin ...’’ নারীসুলভ আগ্রহ ও ঔৎসুক্য নিয়ে লেখিকা বধূটির সাজ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁর লেখা বর্ণনার মধ্যে সবার আগে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল ‘জাঁকজমকের প্রাচুর্য’। ‘মুঘলযুগের আড়ম্বর’ যেন পরবর্তীকালের নারীদের সাজসজ্জাকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছিল। একই সঙ্গে সব কিছুকে ‘সোনাদানা’, ‘রঙ’, ‘কারুকাজ’ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার সেই প্রবণতা ‘হিন্দুযুগে’ ছিল না। নববধূটির পরণের ‘বেগুনি-লাল ঘাগরা’, লেখিকা যেটাকে ‘পেটিকোট’ বলেছিলেন, সেই ‘কুর্তা’ বা ‘কাঁচুলি’তে ‘জরি’র সঙ্গে ‘জড়োয়া পাথর’ বসানো হয়েছিল, ‘কাঁচুলি’তে ছিল ‘মুক্তোর সারি’; নববধূর চুলে, কপালে, এমনকি জুতোতেও ছিল ‘সোনা’ এবং মাথার উপরে ছিল স্বচ্ছ সোনালী রঙের ‘ওড়না’ - এগুলো সব মিলে যা সৃষ্টি করেছিল তাতে ছিল না একটুও অবসর। অথচ কোন কিছুর অভাব চোখে পড়ে না, এবং সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সৌন্দর্য নির্ণয়ের পথে প্রধান অন্তরায়। বস্তুতঃ এরপর থেকেই নারীর সাজসজ্জায় ‘প্রাচুর্যের ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গবেষকদের যতদূর মনে হয়, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে’ নারী কিছুটা নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে শুরু করেছিলেন সেই সময় থেকে। একই সঙ্গে স্বামীকে ‘সপত্নী’দের হাত থেকে রক্ষা করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করবার বাসনাও তাঁদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল। বস্তুতঃ, নারীসমাজের সেই অবস্থা যে ‘হিন্দুযুগে’ও ছিল না তা কিন্তু নয়, কিন্তু ‘হারেম সংস্কৃতি’তে এর বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে। তাছাড়া মুঘলরা সকলেই ছিলেন ‘আড়ম্বরপ্রিয়’। তাঁদের ‘সাজসজ্জার আড়ম্বর’ তৎকালীন অভিজাত সমাজে গৃহীত হয়েছিল ‘ফ্যাশান’ হিসেবে। সেই ‘ফ্যাশনে’ সর্বপ্রথম প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘রাজপুত নারীরা’, পরে সেই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল ‘গুজরাট’ ও অন্যান্য সব অঞ্চলে।


(ক্রমশঃ)

                               ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- Indian dress: A brief history, Charles Louis Fabri, Orient Longman.

২- Dress and ornaments in ancient India, Indu Prabha Pandey, Bharatiya Vidya Prakashan.

৩- আবরণে অভরণে ভারতীয় নারী, চিত্রা দেব।)

                          

No comments