Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: গোড়ার কথা’ রানা চক্রবর্তী

‘কাব্যবিচারে কবির অন্তর্জীবনই মুখ্যস্থান অধিকার করে, বাইরের প্রবহমান ঘটনা বা তথ্যপুঞ্জের দ্বারা কবিচরিতের নিগূঢ় অভিপ্রায়কে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ টেনিসনের জীবনচরিত পড়ে কবিজীবনী সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করেছিলেন -…

 




কাব্যবিচারে কবির অন্তর্জীবনই মুখ্যস্থান অধিকার করে, বাইরের প্রবহমান ঘটনা বা তথ্যপুঞ্জের দ্বারা কবিচরিতের নিগূঢ় অভিপ্রায়কে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ টেনিসনের জীবনচরিত পড়ে কবিজীবনী সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করেছিলেন - “ইহা টেনিসনের জীবনচরিত হইতে পারে, কিন্তু কবির জীবনচরিত নহে। আমরা বুঝিতে পারিলাম না, কবি কবে মানবহৃদয়-সমুদ্রের মধ্যে জাল ফেলিয়া এত জ্ঞান ও ভাব আহরণ কবিলেন এবং কোথায় বসিয়া বিশ্বসংগীতের সুরগুলি তাঁহার বাঁশিতে অভ্যাস করিয়া লইলেন।” রবীন্দ্রনাথ কবিজীবনীর অন্তর্ময়তার দিকটিই বিশেষভাবে নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু কোন কবির বহির্জীবনের ঘটনাকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা যায় না। বাইরের জগৎ কবির ভাবজীবনের উপর অনেক সময় স্থচিরস্থায়ী ছায়া বিস্তাব করে। তাই আধুনিককালের জীবনীলেখকেরা ডায়েরি, চিঠিপত্র প্রভৃতি থেকেও একজন কবির ভাবজীবনের স্বরূপ নির্ণয় করেন। ইংরেজী সাহিত্যের রোমান্টিক কবিদের মধ্যে কীটস সাময়িক ঘটনার দ্বারা সবচেয়ে কম প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা ছাড়া তার জীবন মোটেই ঘটনাবহুল ছিল না। তবু তাঁর কবিচরিত-রচয়িতারা ফ্যানি ব্রাউনের সঙ্গে তার সম্পর্কটির উপরে বিশেষভাবে আলোকপাত করে নতুন তাৎপর্য নির্দেশ করার চেষ্টা করেছেন। আবার এমন কবিও আছেন, যাঁর ব্যক্তি-জীবন ও কাব্য-জীবন অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রথিত - একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির পূর্ণ স্বরূপ উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বায়রন, মধুসুদন প্রভৃতি কবির কথা উল্লেখ করা যায়৷ ‘কবিজীবনী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণীর কবির কথাও উল্লেখ করেছিলেন - “কাব্যকে তাঁহাদের জীবনের সহিত একত্র করিয়া দেখিলে, তাহার অর্থ বিস্তৃততর ও ভাব নিবিড়তর হইয়া উঠে।” কাব্যের বিচিত্র অভিব্যক্তির পক্ষে বহির্জীবনের যে সমস্ত ঘটনাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা কবিচরিত রচনার অনিবার্য উপাদান হয়ে ওঠে। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিচরিত আলোচনা করতে হলে তাঁর ব্যক্তি-জীবনকে উপেক্ষা করা যায় না।


১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে জুলাই (১২৭০ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা শ্রবণ) কৃষ্ণনগরে দ্বিজেন্দ্রলালের জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় কৃষ্ণনগরের দেওয়ান ছিলেন, আর তাঁর মাতা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈতপ্রভুর বংশধর কালাচাঁদ গোস্বামীর ভগিনী। দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্র। দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যক্তি-জীবন ও কবি-জীবনের উপর তাঁর স্বনামধন্য পিতা কার্তিকেয়চন্দ্রের প্রভাব কম নয়। সুকণ্ঠ গায়ক, সুরসিক, তেজস্বী ও উন্নতচরিত্র কার্তিকেয়চন্দ্র তৎকালের কৃষ্ণনাগরিক সমাজে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে (Institution) পরিণত হয়েছিলেন। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘সুরধুনী কাব্যে’ জলাঙ্গী নদীর মুখ দিযে বলিয়েছিলেন -


“কার্তিকেয়চন্দ্র রায় অমাত্য প্রধান,

সুন্দর, সুশীল, শান্ত, বদান্য, বিদ্বান,

স্থললিত স্বরে গীত কিবা গান তিনি,

ইচ্ছা করে শুনি হয়ে উজানবাহিনী।”


কার্তিকেয়চন্দ্র সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ গ্রন্থের আদর্শে ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ নাম দিয়ে কৃষ্ণনগর বাজবংশের একটি প্রামাণিক ইতিহাস রচনা করেছিলেন। তাঁর ‘আত্মজীবনচরিত’ বাংলা সাহিত্যের আত্মচরিত রচনার আদিপর্বের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সেই দুটি গ্রন্থেই তৎকালীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের প্রচুর উপাদান পাওয়া যায়। তা ছাড়া ১২৮৫ সনে তিনি ‘গীতমঞ্জরী’ নামক একধানি স্বরচিত গীতিসংগ্রহও প্রকাশ করেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী কার্তিকেয়চন্দ্র সম্পর্কে বলেছিলেন, “আত্মীয়স্বজন পোষণ, গুণিজনের উৎসাহদান, সাধুতার সমাদর, বিপন্নের বিপদুদ্ধার, এ-সকল যেন তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। এই সকল গুণেই তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতি স্বদেশহিতৈষী, স্বজাতিপ্রেমিক মহাজনগণের বিশেষ সম্মানিত হইয়াছিলেন। ইহার বিষয় বলিতে সুখ হয়, ভাবিলেও মন উন্নত হয়।” (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীম বঙ্গ-সমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী) চরিত্রের আভিজাত্য, তেজস্বিতা, সঙ্গীতানুরাগ প্রভৃতি গুণ দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছিলেন। এই চরিত্রটি সম্মুখে রেখেই দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর দুর্গাদাস-চরিত্র অঙ্কন করেছিলেন৷ ‘দুর্গাদাস’ নাটকের উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, “যাঁহার দেবচরিত্র সম্মুখে রাখিয়া আমি এই দুর্গাদাস-চরিত্র অঙ্কিত করিয়াছি, সেই চিরমারাধ্য পিতৃদেব কার্তিকেয়চন্দ্র রায় দেবশর্মার চরণকমলে এই ভক্তি-পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করিলাম৷” কবি তাঁর পিতার চরিত্রের কথা স্মবণ করে গর্ব অনুভব করতেন। দিলীপকুমার রায় তাঁর পিতৃস্মৃতি সম্পর্কে লিখেছিলেন, “প্রায়ই বলতেন: ‘ওরে, জানিস আমি কার ছেলে? কার্তিক দেওয়ানের।’ বলে বলতেন প্রায়ই: বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন এক বৃদ্ধ এসে তাকে বলেন: ‘দেওয়ানজি, ভয় কি?’ তাতে তিনি বলেছিলেন হেসে: ‘আমার ভয়?’ তাঁর ভয় ছিল না, কেননা জীবনে তিনি সত্যনিষ্ঠ বলে নিজেকে জানতেন।” (উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল, দিলীপকুমার রায়) দ্বিজেন্দ্রলালের শৈশব ও বাল্যকালের পরিবেশটিকে তাঁর সেজদা জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছিলেন - “কৃষ্ণনগরে আমাদের সেই নগর-প্রান্তস্থিত উদ্যান। অস্তগামী সূর্যের আভায় গাছের পাতা রাঙা হইয়াছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখী ক্ষুদ্র গাছে জমিয়া কলরব করিয়া পরস্পরকে সাদর সম্ভাষণ করিতেছে। একটি বালক কখন-বা ফল তুলিতে দুলিয়া দুলিয়া দৌড়িতেছে, কখন বা পাখীর পিছনে ছুটিতেছে। এই ক্ষুদ্র বালক আমাদের দ্বিজেন্দ্র। এখানে দ্বিজেন্দ্রকে দেখুন সৌন্দর্য-পরিবেষ্টিত। সুন্দর ক্ষুদ্র বিহঙ্গগুলি যেমন পুষ্পের মধুপান করিত তেমনি বালক দ্বিজেন্দ্র এই উদ্যান-সৌন্দর্যের মধুপান করিত। অন্যদিকে দ্বিজেন্দ্রের পিতৃদেব সঙ্গীতবিশারদ ছিলেন। ক্ষুদ্র বালকের সঙ্গীতপ্রিয় হৃদয় সেই সঙ্গীতের উচ্ছ্বাসে স্বর্গসুখ অনুভব করিত। ... একদিকে দ্বিজেন্দ্র অন্তর্জগতের ও বহির্জগতের সৌন্দর্যের ক্রোড়ে লালিত, অপর দিকে মনুষ্যকণ্ঠের বাদ্যযন্ত্রের ও বিহঙ্গের ত্রিবিধ সম্মিলিত সঙ্গীতে দ্বিজেন্দ্রলালেব প্রতিভা উদ্বোধিত হইয়াছিল।” (নব্যভারত, আষাঢ়, ১৩২০ বঙ্গাব্দ) দ্বিজেন্দ্রলালের শৈশব ও বাল্যকালের সেই পরিবেশটি তাঁর সাহিত্যিক-জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

                               ©️রানা©️

কার্তিকেয়চন্দ্রের বাসভবনে তখনকার কালের অনেক জ্ঞানী-গুণী ও খ্যাতনামা ব্যক্তি সমবেত হতেন ৷ বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, ভূদেবচন্দ্র, সঞ্জীবচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন, রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অনেকেই কার্তিকেয়চন্দ্রের গুণমুগ্ধ, অকৃত্রিম ও সমপ্রাণ বন্ধু ছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেককেই বালক দ্বিজেন্দ্রলাল মধুসূদন, হেমচন্দ্র প্রভৃতি কবির কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। “মহারাজ সতীশচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি তাঁহার পিতার বন্ধুগণ কৌতূহলী হইয়া দ্বিজেন্দ্রের কবিতা আবৃত্তি শুনিয়া তাঁহাকে কবিতা পাঠে উৎসাহিত করিতেন।” (দ্বিজেন্দ্রলাল, নবকৃষ্ণ ঘোষ) নিতান্ত বালক বয়সেই দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর পিতার সঙ্গীত পদ্ধতি অনুসরণ করবার চেষ্টা করতেন৷ কবিতাপাঠ ও সঙ্গীতচর্চার অনুকূল পরিবেশ তাঁর কাব্যজীবন উন্মেষের সহায়ক হয়েছিল। অল্প বয়সেই তিনি কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন, শুধু তাই নয, তিনি স্বরচিত গানেও সুর-সংযোগ করতেন। পরবর্তীকালে তিনি যে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন, বাল্যকালেই ছিল তার উন্মেষ-লগ্ন। সেই যুগের কথা স্মরণ করে তিনি পরবর্তীকালে লিখেছিলেন, “শৈশব হইতেই গীতিরচনায় আমার আসক্তি ছিল। শৈশব হইতেই প্রকৃতি সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হইয়া গীতিরচনা করিয়া দেবীকে উপহার দিতাম। সে-সব গীত তখন কোন শাস্ত্রতঃ: সুরে গীত হইত না। যখন যে সুর ভাল লাগিত, তখন সেই সুরেই গাইতাম।” (আর্যগাথা, প্রথমভাগ, ভূমিকা) সেকালে কৃষ্ণনগরে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল। সেই পরিবেশের মধ্যমণি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালের পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। কার্তিকেয়চন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে সেই পরিবেশের বর্ণনা করেছিলেন। মার্গসঙ্গীতের সেই অনুকূল পরিবেশের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলালেব সঙ্গীত-মুগ্ধ মনোজীবন গড়ে উঠেছিল। সেকালের কৃষ্ণনগরের সেই সাঙ্গীতিক পরিবেশের বর্ণনা করতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, “... দ্বিজেন্দ্রলালের পিতা কার্তিক দেওয়ানের অনেক গান শুনেছি। তিনি ছিলেন অতি স্থকণ্ঠ ও সঙ্গীত-ব্যিায় সুশিক্ষিত। তিনি বোধ হয় বাঙ্গালা হিন্দী দু-ভাষারই গান গাইতেন কিন্তু কি যে গাইতেন আমার মনে নেই। ... দ্বিজেন্দ্রলালও গাইয়ে বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি সভাসমিতিতে গান গাইতেন ছোকরা বয়সেই। বোধ হয় কণ্ঠসঙ্গীত তাঁর পিতার কাছ থেকেই শিক্ষা করেছিলেন। আরও দু-চার জনের মুখে অতি মিষ্টি গান শুনেছি, তাঁদের নামও মনে আছে।” (আত্মকথা, প্রমথ চৌধুরী) প্রমথ চৌধুরীর সেই স্মৃতিকথা থেকেই কৃষ্ণনগরের মার্গসঙ্গীতচর্চার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায়। সঙ্গীতজ্ঞ পিতার সাহচর্য ও সঙ্গীত সংস্কৃতিময় পরিবেশের অকুণ্ঠ দাক্ষিণ্যে বালক দ্বিজেন্দ্রলালের মনোজীবনের সুপ্ত সম্ভাবনা মুকুলিত হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের ‘কার্তিক-ভবন’ সেকালেব সাস্কৃতিক জীবনের এক মহাতীর্থে পরিণত হয়েছিল। ঊনিশ শতকের মনীষীদের মধ্যে অনেকেই কার্তিক-ভবনে পদার্পণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, নবীনচন্দ্র সেন প্রভৃতি যুগ-নায়কদের সাহচর্য কার্তিকেয়চন্দ্রের পারিবারিক জীবনের উপরও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বালক দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর সঙ্গীতের দ্বারা মহামান্য অতিথিদের পরিতৃপ্ত করতেন।


পিতৃচরিত্র ও কৃষ্ণনগরের সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব ছাড়াও আর একটি বিষয়ও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ৷ ‘সেজদা’ জ্ঞানেন্দ্রলাল রায়, ‘রাঙাদা’ হরেন্দ্রলাল রায় ও ‘রাঙাবৌদি’ মোহিনী দেবীর সস্নেহ লালন ও উৎসাহবাক্য দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যিক প্রতিভাকে পরিপুষ্ট করেছিল। তাঁর তৃতীয় অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রলাল রায়ই তাঁকে ইংবেজী সাহিত্যে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজী ভাষার শিক্ষক। দ্বিজেন্দ্রলালের বড়দা রাজেন্দ্রলাল রায় মেহেবপুর আদালতের পেশকার ছিলেন। স্কুলের ছুটি হলে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর কাছে যেতেন। তিনি ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যে সুপণ্ডিত। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছিলেন, “তিনি এই অতি অল্পকালের মধ্যে আমাকে এমনি আশ্চর্য কৌশলে ও বিচিত্র নৈপুণ্য সহকারে ইংরেজী ভাষায় সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ করিয়া তুলিলেন যে, সেই গোড়ার দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিয়াই আমি অতি অনায়াসে, নিতান্ত অসুস্থ শরীর লইয়া এবং মনোযোগের সহিত বেশীদিন অধ্যয়ন করিতে না পারিয়াও, পরে এম্-এ পরীক্ষায় তবু যা-হৌক একটু সম্মান লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম।” (দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবকুমার রায়চৌধুরী) পরবর্তীকালেও তিনি বলেছিলেন, “বড়দাদা এবং সেঝদাদা আমাকে ইংরাজী সাহিত্যের অভিজ্ঞতা অর্জনে প্রভৃত সাহায্য করিয়াছেন।” (দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবকুমার রায়চৌধুরী) জ্ঞানেন্দ্রলাল সুলেখক ছিলেন। তৎকালীন নানা পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হত। ‘স্থরভি’, ‘পতাকা’, ‘Telegraph’, ‘Bengalee’ প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক রচনার বহু বিচ্ছিন্ন উপাদান দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবন আলোচনার পক্ষে অপরিহার্য। দ্বিজেন্দ্রলালের ভ্রাতা হরেন্দ্রলাল রায় ‘নবপ্রভা’ নামক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনিও লেখক ছিলেন। হরেন্দ্রলালের স্ত্রী মোহিনী দেবীও সুলেখিকা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। পুরাতন পত্রিকার মধ্যে তাঁর পারিবারিক জীবনের স্মৃতিচিত্রগুলিও দ্বিজেন্দ্র-মানস-পরিক্রমার মূল্যবান পাথেয়। কৃষ্ণনগরের বিদগ্ধ পরিবেশ, পিতৃদেবের ঋজু-বলিষ্ঠ চরিতশ্রী ও পারিবারিক জীবনের সাহিত্য-সঙ্গীতময় সুকর্ষিত পরিমণ্ডল দ্বিজেন্দ্রলালেব মনোজীবনকে লালন করেছিল। তাঁর রাঙাবৌদি মোহিনী দেবীও প্রতিভাশালিনী গায়িকা ছিলেন - সাহিত্য ও সঙ্গীতের যুগ্মবেণীবন্ধনে তাঁর মনোজীবন সমৃদ্ধ ছিল। রায় পরিবারের সেই বিদুষী বধূটি পারিবারিক জীবনের উপরে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তার পরিচয় দিয়েছিলেন দিলীপকুমার রায় - “তাই তো এলেন - ঠিক এই সময়ে আমার রাঙা জেঠামহাশয় হরেন্দ্রলাল রায় ভাগলপুর থেকে কলকাতায় ওকালতি করতে। জেঠাইমা ছিলেন বিখ্যাত গায়ক প্রতিভার অবতার ৺সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের বোন চমৎকার কণ্ঠস্বর ছিল তাঁর।” (উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল, দিলীপকুমার রায়) শৈশবে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে হাতেখড়ি হলেও পরবর্তীকালে তিনি বিলিতি গানের অত্যন্ত ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারই নাকি তাঁকে ভারতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ফিরিয়ে এনেছিলেন।

                                ©️রানা©️

ছাত্র হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। কিন্তু একাধিক বার দুরারোগ্য ব্যাধি হওয়ার ফলে তিনি পরীক্ষায় আশানুরূপ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। তবুও এম্-এ পরীক্ষায় তিনি ইংরেজী সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্য জীবনের ইতিহাসে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। সেখান থেকেই তাঁর কবিত্ব-প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল। মাত্র বারো বছর বয়সেই তিনি কবিতা ও গান বচনা শুরু করেছিলেন। এই সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “১২ বৎসর বয়ঃক্রম হইতে আমি কবিতা ও গান রচনা করিতাম। ১২ হইতে ১৭ বৎসর পর্যন্ত রচিত আমার গীতগুলি ক্রমে ‘আর্যগাথা’ নামক গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়। তখন কবিতাও লিখিতাম। কিন্তু তখন কোনো কবিতা প্রকাশিত হয় নাই। কেবল ‘দেওঘরে সন্ধ্যা’ নামক মৎপ্রণীত একটি কবিতা ‘নব্যভারত’-এ প্রকাশিত হয়।” (নাট্যমন্দির, শ্রাবণ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ) ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে ‘আর্যগাথা’ (প্রথম ভাগ) প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গ্রন্থেব প্রকৃতি ও দেশপ্রেমের কবিতাগুলি উচ্চপ্রশংসা৷ লাভ করেছিল। প্রায় সেই সব সময়েই তৎকাল-প্রচলিত প্রথম শ্রেণীর মাসিক পত্রিকা ‘নব্যভারত’, ‘আর্যদর্শন’, ‘বান্ধব’ প্রভৃতিতে তাঁর কয়েকটি কবিতা এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ‘আর্যগাথা’ (প্রথম ভাগ) প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রায় দশ বছর তাঁর অন্য কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয় নি। অবশ্য বিলাত যাওয়ার আগে তাঁর কিছু লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বিলাত যাত্রা করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বিলাত-যাত্রা একটি সাধারণ ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যিক জীবনের পক্ষে বিলাত প্রবাসের ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যমূলক। তিনি তাঁর প্রবাসী জীবনের অভিজ্ঞতাকে ‘বিলাতপ্রবাসী’ নাম দিয়ে ‘পতাকা’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের অগ্রজদ্বয় জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় ও হরেন্দ্রলাল রায় কলকাতা থেকে ‘পতাকা’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সেই পত্রাবলী দ্বিজেন্দ্রলালের গদ্য রচনার একটি মূল্যবান নিদর্শন। পরবর্তীকালের নাটকের গদ্য সংলাপের সঙ্গে সেই গদ্যরচনাটি মিলিয়ে পড়লে দ্বিজেন্দ্রলালের গদ্যরচনার একটি সমগ্র পরিচয় পাওয়া যায়। লেখকের ব্যক্তিত্বও সেই রচনাগুলির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। নিপুণ পর্যবেক্ষণশক্তি, হাস্যপরিহাসপ্রবণতা, বাগ্‌বৈদগ্ধ্য, স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রীতি, চারিত্রিক তেজস্বিতা প্রভৃতি ব্যক্তি ও সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলালের অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য সেই পত্রাবলীতে উদ্ঘাটিত হয়েছে। তথ্যের দিক থেকেও রচনাগুলি মূল্যবান। ইংরেজদের পারিবারিক জীবন, গৃহজীবন, সামাজিক আচার-আচরণ, গ্ল্যাডস্টোন-শাসিত ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক জীবন ও অন্যান্য বহু জ্ঞাতব্য তথ্য সেই গ্রন্থে সংকলিত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের ইংল্যান্ডের জীবনচর্যার কয়েকটি সুন্দর খণ্ডচিত্র আন্তরিকতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। সেই চিঠিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় কথা হল রচয়িতার ভাবজীবনের আন্তরিক প্রকাশ। সেই আবেগকম্পিত ভাবত্রই পত্রগুলিকে একটি ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করেছে। তরুণ মনের কৌতূহল, বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য, বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা ও আত্মমুগ্ধ ভাবাকুলতা চিঠিগুলিতে সাহিত্যিক রস সঞ্চারিত করেছে।


দ্বিজেন্দ্রলালের বিলাত-প্রবাসের মধ্যে দুটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, কারণ দ্বিজেন্দ্র-সাহিত্য আলোচনার পক্ষে সেই দু’টি প্রসঙ্গের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিলাত-প্রবাসকালে তিনি বিলিতি সঙ্গীত শিখেছিলেন। সিসিটার কলেজে দ্বিজেন্দ্রলালের সহাধ্যায়ী বঙ্গবাসী কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ গিরিশচন্দ্র বসু লিখেছিলেন, “তারপর সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই জানিতে পারিলাম, দ্বিজু একজন Embryo (কোরক) কবি; - ইতিপূর্বে ‘আর্যগাথা’ রচিয়া স্বদেশের কবিজগতে প্রবেশলাভ করিয়া আসিয়াছেন৷ গীতবাদ্যেও যে তাঁহার বিশেষ অনুরাগ তাহাও শীঘ্রই প্রকাশ পাইল। একদিন কথার কথায় গল্পচ্ছলে তিনি বলিলেন - যাঁহার কাছে তিনি গান শিথিতে আরম্ভ করিয়াছেন সে রমণীটি তাঁহার নাকি সুরের সংস্কার ও ভরাট গলার চর্চা করার জন্য তাঁহাকে বহুবার বিশেষ অনুরোধ করিয়াছেন। সেই অনুরোধের পরিণামে, পরে যে কি ফল ফলিয়াছিল তাহা আজ বঙ্গবাসী কাহারও অজ্ঞাত নাই ৷ যিনিই তাঁহার গান একবার শুনিয়াছেন তিনিই জানেন দ্বিজুর গল্প কিরূপ ভরাট ছিল এবং পরে তাঁহার সুরের সঙ্গে অণুমাত্র নাকের সংশ্রব ছিল না।” (দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবকুমার রায়চৌধুরী) ইউরোপীয় সঙ্গীতচর্চা পরবর্তীকালে গীতিকার ও সুরকার দ্বিজেন্দ্রলালেব উপর গভীর প্রভাব বিস্তৃত করেছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের বিলাত-প্রবাসকালের আব-একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ‘Lyrics of Ind’ নামক ইংবেজী কাব্যের প্রকাশ। তিনি পরবর্তীকালে আর কোনো ইংরেজী কাব্য প্রকাশ করেন নি। কিন্তু সেই কাব্যে ও তাঁর প্রতিভাব গীতিধর্মিতা ও সুগভীব স্বদেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। ইংরেজী ভাষায় রচিত হলেও সেই কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে তাঁর পরবর্তীকালেব বাংলা কবিতা ও গানের একটি আত্মিক সম্পর্ক আছে। পাশ্চাত্য কাব্য ও নাটকের যে সুগভীর আকর্ষণ তাঁর হৃদয়ে অতকাল সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সেই কাব্যে। পরবর্তীকালে দ্বিজেন্দ্রলাল সেই কাব্য সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য - “বাল্যাবধি কবিতা ও নাটকপাঠ আমার অত্যন্ত আসক্তি ছিল। এত অধিক ছিল যে বিদ্যাভ্যাসকালে বায়রনেব Manfred Childe Herold-এর দুই canto এবং মেঘদূত ও উত্তবচরিতের কাব্যাংশ আমি মুখস্থ করিয়াছিলাম৷ বিলাতে গিয়া ক্রমাগত Shelley পড়িতাম এবং তথ্য হইতে প্রত্যাগত হইয়া ক্রমাগত Wordsworth ও Shakespeare বার বাব পড়িতাম৷ ... বিলাতে গিযা ইংরাজীতে কবিতা লিখিতে আরম্ভ করি এবং সেই কবিতাগুলি একত্রিত করিয়া স্যার এডুইন আনল্ডকে উৎসর্গ করিবার অনুমতি চাহি এবং তৎসঙ্গে কবিতাগুলির পাণ্ডুলিপি পাঠাই। তিনি কাবতা প্রকাশ সম্বন্ধে আমাকে উৎসাহিত করিয়া পত্র লেখেন ও সে কবিতাগুলি তাঁহাকে উৎসর্গ কবিবার অনুমতি সাগ্রহে দান করেন। তখন সেই কবিতাগুলিকে Lyrics of Ind আখ্যা দিয়া প্রকাশ কবি।” (নাট্যমন্দির, শ্রাবণ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ) কাব্যটি দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ প্রবণতা ও পরিহাস রসিকতাই যে দ্বিজেন্দ্র-প্রতিভার সবটুকু নয়, সেই কাব্যেই তার প্রমাণ পাওয়া ষায় ৷ ‘আর্যগাথ্য’ (প্রথম ভাগ) কাব্যে যার অস্পষ্ট ও অপরিস্ফুট প্রকাশ, সেই কাব্যে তারই রূপ সুস্পষ্ট ও পূর্ণতর হয়ে উঠেছিল। আত্মমগ্নতা ও আত্মভাব বিভোরতা প্রবাসী কবিচিত্তকে স্মৃতি-বেদনায় ব্যাকুল করে তুলেছিল,


“When Nature sleeps in Night's soft arms,

The heavens with starry rapture glow,

Sad visions flit across my sight,

The dreams of days-long long ago.”


স্মৃতি-রোমাঞ্চিত কবি-মনের অকুণ্ঠ আন্তরিকতা সেখানে কাব্যরূপ পেয়েছিল।

                            ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীম বঙ্গ-সমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী।

২- উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল, দিলীপকুমার রায়।

৩- নব্যভারত, আষাঢ়, ১৩২০ বঙ্গাব্দ।

৪- দ্বিজেন্দ্রলাল, নবকৃষ্ণ ঘোষ।

৫- আর্যগাথা, প্রথমভাগ, ভূমিকা।

৬- দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবকুমার রায়চৌধুরী।

৭- আত্মকথা, প্রমথ চৌধুরী।

৮- নাট্যমন্দির, শ্রাবণ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ।

৯- দ্বিজেন্দ্রলাল, রথীন্দ্রনাথ রায়।)

                       

No comments