Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ইতিহাস বাড়ির কথা

২০১৫ তে প্রথমবার ইতিহাস বাড়ি ঘুরে দেখার সুযোগ পাই। কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয়/Indian Museum। যা আমার কাছে শুধুই ইতিহাস বাড়ি। বেশ কিছু সংগ্রহালয় দেখেছি। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেও অনেক বার গিয়েছি। কিন্তু আজ থেকে ছ'বছর আগে ইতিহাস বাড়িকে…

 




 



২০১৫ তে প্রথমবার ইতিহাস বাড়ি ঘুরে দেখার সুযোগ পাই। কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয়/Indian Museum। যা আমার কাছে শুধুই ইতিহাস বাড়ি। বেশ কিছু সংগ্রহালয় দেখেছি। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেও অনেক বার গিয়েছি। কিন্তু আজ থেকে ছ'বছর আগে ইতিহাস বাড়িকে সেই প্রথম ঘুরে দেখার স্মৃতি আজো অমলিন। ২০১৪ তে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস চিন্তা বইটি পড়তে গিয়ে তাঁর লেখা 'ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম' শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ার পর ভারতীয় সংগ্রহালয় দেখার আগ্রহ প্রবলতর হয়। প্রবেশমূল্যের সাথে পঞ্চাশ টাকার (ছবি তোলার জন্য) টিকিট কেটে ঢুকে পড়েছিলাম ভারতীয় সংগ্রহালয়ে। ঘন্টা দুয়েক পর বের হলাম এক অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে। সেই ভালো লাগা আজো একই রকম আছে। প্রতিবার নতুন করে দেখি, জানার চেষ্টা করি আপ্রাণ। আর সমৃদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসি। এতোবার দেখেও যেন ইতিহাস বাড়িকে সম্পূর্ণ রূপে দেখা হয়ে ওঠে না। তাই সংগ্রহালয়ের সুদৃশ্য ভবন ও এর অমূল্য সংগ্রহগুলোর টানে আবার যেতে হয়। 

কলকাতার গর্ব চৌরঙ্গীর ভারতীয় সংগ্রহালয়। যা শুধুমাত্র ভারতেরই নয়, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রথম পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহালয়। প্রাচ্য বিদ্যা চর্চাকারী প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যরা প্রথম একটি সংগ্রহালয় স্থাপনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এই মর্মে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে আবেদন করা হয়। প্রথম দিকে এই আবেদন খারিজ করা হলেও পরবর্তীতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৮১৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে এর দ্বিশতবর্ষ উদযাপিত হয়েছে। ১৯১১ থেকে ১৯১৭ সাল অবধি ভারতীয় সংগ্রহালয়ের সহকারী অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য তিনি এম.এ. পড়াকালীন এতে সহকারী পদে নিয়োগ পান। ১৯১৪ সালে ভারতীয় সংগ্রহালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়ে ভারতবর্ষ পত্রিকায় তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, কার্য পদ্ধতি ও বিভিন্ন সংগ্রহের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। এসময় তিনি এই সংগ্রহালয়ের সহ অধ্যক্ষ পদে কর্মরত থাকায় তাঁর দেয়া বিবরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

রাখালদাস 'ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম' শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেন, "বিগত ৩রা, ৪ঠা মাঘ কলিকাতা মিউজিয়ামের শতবার্ষিক উৎসব শেষ হইয়া গিয়াছে। এক শত বৎসর পূর্বে ---১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে এই মিউজিয়াম স্থাপিত হইয়াছিল। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে স্যর উইলিয়াম জোন্স 'এশিয়াটিক সোসাইটি' নামক সভা স্থাপন করিয়াছিলেন, এবং তাহার ত্রিশ বৎসর পরে এশিয়াটিক সোসাইটির চেষ্টায় সভাগৃহে ভারতবর্ষের, এমন কি সমগ্র এশিয়া খণ্ডের, প্রথম মিউজিয়াম স্থাপিত হইয়াছিল। এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনের পর হইতে উক্ত সভার সদস্যগণ সময়ে সময়ে যথাসম্ভব জীব-জন্তুর মৃতদেহ, ভূগর্ভে প্রাপ্ত জীবাশ্ম এবং প্রত্নতত্ত্ব-সংক্রান্ত দ্রব্যাদি উপহার প্রদান করিতেন। সর্ব প্রথমে প্রাচীন সুপ্রিমকোর্টের গৃহে এশিয়াটিক সোসাইটির অধিবেশন হইত এবং উপহারপ্রাপ্ত দ্রব্যাদি সেই গৃহেই রক্ষিত হইত। স্যর উইলিয়াম জোন্স যতদিন ভারতবর্ষে ছিলেন, ততদিন এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য স্বতন্ত্র গৃহ নির্মাণের কোন চেষ্টাই হয় নাই। কিন্তু, ১৭৯৬ সালে সুপ্রিমকোর্টের গৃহে সভার অধিবেশন অসম্ভব হওয়ায়, নূতন গৃহনির্মাণের চেষ্টা আরম্ভ হয়। সদস্যগণের অর্থ-সাহায্যে 'চৌরঙ্গী ও পার্কস্ট্রিটের' সংযোগস্থলে নূতন-গৃহ নির্মিত হয়, এবং এশিয়াটিক সোসাইটির দ্রব্যাদি ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্ট ভবন হইতে নূতন-গৃহে আনয়ন করা হয়। সুপ্রিমকোর্ট-ভবনই বর্তমান সময়ে কলিকাতা মিউজিয়ামের সুপারিন্টেন্ডেন্টের বাস-গৃহে পরিণত হইয়াছে।"

১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে মিউজিয়ামের মাত্র দুটি বিভাগ ছিল; ১. প্রত্নতত্ত্ব ও মানবতত্ত্ব, ২. ভূতত্ত্ব ও জীবতত্ত্ব। ১৯১০ সালে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম সংক্রান্ত নতুন আইন পাস হয়ে মিউজিয়ামের পাঁচটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠিত হয়; ১. প্রাণী ও মানবতত্ত্ব, ২. ভূতত্ত্ব, ৩. শিল্পতত্ত্ব, ৪. কৃষি ও উদ্ভিদতত্ত্ব, ৫. প্রত্নতত্ত্ব। ১৯১৬ সালে Geological Survey of India -র অনুদানে প্রাণীতত্ব ও ১৯৪৫ সালে Anthropological Survey of India -র অনুদানে নৃতত্ত্ব বিভাগটি চালু হয়। নৃতত্ত্ব বিভাগটি নিয়ে বর্তমানে এই সংগ্রহালয়ে মোট ছয়টি বিভাগ রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তপসিলে এই সংগ্রহালয়কে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনে এই সংগ্রহালয় পরিচালিত হয়ে আসছে। 

এই সংগ্রহালয়ের প্রসঙ্গে আচার্য্য যদুনাথ সরকারের একটি কথা মনে পড়ছে। আচার্য্য যদুনাথ তাঁর অভিভাষণে বলেছিলেন, কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় সংগ্রহালয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তি। ভারত সরকার তা একদিনের নোটিশে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করতে পারে। কিন্তু 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' ও 'বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর' বাংলার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। এদের কেউ বাংলা থেকে স্থানান্তরিত করতে পারবে না। তাই বঙ্গবাসীরা যেন এর সংগ্রহের জন্য প্রত্ন ও শিল্প দ্রব্যাদি দান করেন। .......... আচার্য্যের এই কথা আংশিক ভাবে সত্য। কারণ দিল্লীতে জাতীয় সংগ্রহালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় সংগ্রহালয় থেকে সিন্ধু সভ্যতার মূল্যবান নিদর্শনসমূহ সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে আমি অনেক খূঁজে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ দুটি মানুষের কঙ্কালের মাথা (একটি চার ও অন্যটি সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো) দেখতে পেয়েছিলাম। যদিও এক সময় এখানে সিন্ধু সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছিল। এখন আর নেই। তবুও ভারতীয় সংগ্রহালয় নিজের অবস্থানেই রয়েছে। একে স্থানান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই। এখনো এই সংগ্রহালয়ের সংগ্রহে যা আছে, তা ভারতের আর কোনো সংগ্রহালয়ে নেই। ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার বাঙালী শিল্পী সুরজিৎ  দাসের হাতে গড়া ডাইনোসরের মডেল, বিখ্যাত ভারহুত স্তূপের অবশেষ, প্রাচীন মুদ্রার মূল্যবান সংগ্রহ, বৌদ্ধ মূর্তির বিবর্তন, অশোক স্তম্ভের স্তম্ভশীর্ষ, অসংখ্য খোদিত শিলালিপি, গান্ধার ও মথুরা শিল্পের অনন্য কিছু নিদর্শন, আর সেই বিখ্যাত মিশরীয় মমি। 


মিশরীয় নিদর্শনের কক্ষে রাখা মমিটির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। মমির সংরক্ষণে এদেশীয় জলবায়ু একদমই উপযোগী নয় তাই সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো মিশরীয় নারীর মমিটির মুখের একটা বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও মিশরীয় মমি বলে কথা। তাই এই ছোট কক্ষে ভীড় হয় বেশি। অবশ্য কক্ষের বাইরে রাখা মিশরীয় সিংহমানবের মূর্তি অনেকেই খেয়ালই করেন না। এই মূর্তি কিন্তু আসল। মিশর থেকে আনা।

প্রতিবার ভারহুত স্তূপের কক্ষ দিয়ে দেখা শুরু করে শেষ করি মিশরীয় মমির কক্ষে। বইয়ের পাতা উঠে আসা সব নিদর্শন। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতকে দেখার এতো বৃহৎ পরিসর খুব কম সংগ্রহালয়েই আছে। ইতিহাস, ঐতিহ্যে আর পুরাতত্ত্বে তাই ভারতীয় সংগ্রহালয় অনন্য। বিশ্বের বৃহত্তম সংগ্রহালয় সমূহের মধ্যে এই সংগ্রহালয় বিশিষ্ট স্থানের দাবিদার। 

আন্তর্জাতিক সংগ্রহালয় দিবস ২০২১

তথ্যসূত্র: ইতিহাস চিন্তা - রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,

               যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার।

No comments