Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জীবিতকালেই তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল সিনেমা .. সুভাষচন্দ্র বসু'কে নিয়ে লিখেছিলেন ক‍ৌশলী কবিতা ..

বাংলা ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৩ই বৈশাখ (ইং ১৮৮১ সাল) বীরভূম জেলার নলহাটী থানার শিমলান্দি গ্রামে মামারবাড়ীতে 'দাদাঠাকুরে'র জন্ম। তাঁর আসল নাম শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। অবশ্য 'পণ্ডিত' তাঁর পূর্ব-পুরুষের পাওয়া উপাধি। কথাশিল্পী লেখক…

 




বাংলা ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৩ই বৈশাখ (ইং ১৮৮১ সাল) বীরভূম জেলার নলহাটী থানার শিমলান্দি গ্রামে মামারবাড়ীতে 'দাদাঠাকুরে'র জন্ম। তাঁর আসল নাম শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। অবশ্য 'পণ্ডিত' তাঁর পূর্ব-পুরুষের পাওয়া উপাধি। কথাশিল্পী লেখক শরৎচন্দ্রের মতো তাঁরও পদবি হ'ল চট্টোপাধ্যায়। যদিও তাঁর পূর্বপুরুষের মতো তিনিও নামের শেষে 'পণ্ডিত' লিখতেন। পরবর্তী সময়ে এই শরৎচন্দ্র পণ্ডিত হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় 'দাদাঠাকুর'।

দাদাঠাকুরের যখন দুই বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা হরিলাল পণ্ডিত মারা যান; আর যখন তাঁর সাত বছর বয়স, তখন তাঁর মা তারাসুন্দরী দেবী মারা যান। ফলে দাদাঠাকুর বড় হতে থাকেন কাকার কাছে, মুর্শিদাবাদের দফরপুর গ্রামে। সেইসময় কাকা ছিলেন ১৯ বছরের অবিবাহিত যুবক। কিন্তু ভাইপো'কে মানুষ করার জন্য কাকা রসিকলাল পণ্ডিত আজীবন বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। যেকারণে দাদাঠাকুর তাঁর কাকা'কে 'বাবা' বলে ডাকতেন। তিনি তখন কলেজে পড়ছেন, তখন কাকা তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন ১১ বছরের প্রভাবতী দেবীর সাথে। তাঁদের বিয়ের চার-পাঁচ বছর পরই (১৯০৪ সালে) কাকা রসিকলাল পণ্ডিত মারা যান।


দাদাঠাকুর ছোট থেকেই ছিলেন দুষ্টু প্রকৃতির। যে কারণে কাকা'র কাছে মাঝেমধ্যেই খেতেন উত্তম-মধ্যম। কাকার শেখানো পথে দাদাঠাকুরের চরিত্র তৈরি হ'ল দৃঢ়, সাহসিক ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি ছিলেন রসিক ও রসস্রষ্টা, তেজস্বী ও স্পষ্টবক্তা। জন্মগত তিনি ছিলেন রসিক মনের অধিকারি। কবিত্ব ছিল তাঁর সহজাত। মুখে মুখে কবিতা তৈরি করা, রঙ্গ-ব্যঙ্গ করার অদ্ভুত ক্ষমতা বিধাতা তাঁকে দিয়েই পাঠিয়েছিলেন। জীবনে কখনও কারুর অনুগ্রহ চাননি, অর্থও নয়, অন্নও নয়, না ভগবানের কাছে, না মানুষের কাছে। সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাতে কথা বলতেন, নিমেষে বানাতেন কবিতা। কথা নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্মৃতি ছিল সজাগ।

কাকার শেখানো পথে আজীবন জুতোই পরেননি কোনওদিন। স্কুলে গেছেন খালি পা, কলেজে গেছেন খালি পা, কলকাতায় থেকেছেন ঘুরেছেন খালি পা, দিল্লীতে গিয়েছিলেন তাও খালি পা। গায়ে একটা সাদা থান ধুতি ও সুতির চারদ, বগলে ছাতা - এই ছিল তাঁর চিরাচরিত পোষাক। ১৯০৩ সালে দফরপুরে 'পণ্ডিত প্রেস' স্থাপন করে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। এরপর গ্রামের জমিদারের আচরণে বিদ্রোহ করে ১৯১১ সালে তিনি রঘুনাথগঞ্জে এসে বসবাস করেন। ১৯১৪ সালে তাঁর 'জঙ্গিপুর সংবাদ' নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর কিছু বছর পরে তিনি কলকাতায় আসেন। ১৯২২ সালে কলকাতায় তাঁর ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকা 'বিদূষক' ও ' দা'ঠাকুরের বোতল পুরাণ' প্রকাশিত হয়। এই সব পত্রিকা তিনি নিজেই লিখতেন, নিজেই ছাপাতেন আবার নিজেই রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন। দাদাঠাকুর সরাসরি সাহায্য নেবেন না, তাই পরিচিতদের দেবার জন্য পঞ্চাশ কপি 'বিদূষক' সংখ্যা একাই কিনতেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধুর অনুরোধে তিনি কলকাতা'কে নিয়ে রচনা করেন বিখ্যাত 'কলকাতার ভুল' গান, যার প্রথম দুলাইন- 

'মরি হায়রে কলকাতা কেবল ভুলে ভরা, সেথায় বুদ্ধিমানে করে চুরি বোকায় পড়ে ধরা।' 

এছাড়া 'টাকার অষ্টোত্তর শত-নাম', 'ভোটামৃত কীত্তন' এইরকম বহু ব্যঙ্গাত্মক ছোট বই লিখেছিলেন। সে সব বইতে কখনও তিনি নিজের নাম 'শ্রীশরচ্চন্দ্র দেবশর্মা' লিখেছেন, কখনও আবার 'শ্রীশরৎচন্দ্র পণ্ডিত' বা 'দাদাঠাকুর' বা শুধু 'দা'ঠাকুর' লিখেছেন।


দাদাঠাকুরের সারাজীবন জুড়েই রয়েছে অসংখ্য হাস্য-কৌতুক, সে সব কিছু বর্ণনা করা এই ছোট্ট জায়গায়ে সম্ভব নয়। শুধু দু-তিনটি মাত্র উল্লেখ করলাম, তার মধ্যে একটি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে।


একবার দাদাঠাকুর যখন স্কুলে পড়েন তখন .. ..  ঘটনা হ'ল তাঁর এক সহপাঠিকে কদিন ধরে তিনি অতিষ্ঠ করছিলেন এক প্রশ্ন করে করে। শেষে একদিন বন্ধুটি হেডস্যারের কাছে নালিশ করে বলে, স্যার আমাকে শরৎ উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করছে। কী প্রশ্ন করছে জিজ্ঞাসা করাতে বন্ধুটি বলে, শরৎ শুধু প্রশ্ন করছে 'তোর শ্বাশুড়ি তোকে কী নামে ডাকবে?' আসলে বন্ধুটির নাম ছিল 'প্রাণনাথ' ..

এরপর কী ঘটেছিল তা সহজেই অনুমেয় ..


আরেকবার .. কলকাতা বেতারকেন্দ্রে। দাদাঠাকুর কলকাতার রেডিও অনুষ্ঠান 'পল্লিমঙ্গল আসর' ও 'ছোটদের বৈঠক' দুটি অনুষ্ঠানে পনেরো বছর ধরে যুক্ত ছিলেন। একদিন দাদাঠাকুর অনুষ্ঠান শেষে কেন্দ্র থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন আর যুবক বয়সের রামকুমার চট্টোপাধ্যায় কেন্দ্রে ঢুকছেন ..  যুবক রামকুমার দাদাঠাকুরকে দেখে তাঁকে প্রণাম করেন। দাদাঠাকুর রামকুমারের পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেন, 'হ্যাঁ ভাই তোমার নাম কি, তুমি কী করো?' উত্তরে রামকুমার নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, 'আজ্ঞে আমি গাই।' তখন দাদাঠাকুর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'তা তুমি দিনে ক সের দুধ দাও?' রামকুমার ভয়ে ভয়ে বলেন, 'আমি দুধ দেবো কি করে?' দাদাঠাকুর হেসে বলেন, 'ঐ যে তুমি বললে 'আমি গাই' তাই .. আসলে গাই গরুই তো দুধ দেয়' ..

দাদাঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহভাজন ও প্রিয় ব্যাক্তি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু দাদাঠাকুর সামনাসামনি এলেই সুভাষচন্দ্র খুব সজাগ থাকতেন। কারণ কোন কথার সূত্র ধরে দাদাঠাকুর যে কি রসিকতা করে বসবেন, তা বিলক্ষণ জানতেন সুভাষচন্দ্র বসু। একদিন দাদাঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে বলেন, 'দেখো সুভাষ, আমার মনে হয় তুমিই বিদেশীদের তাড়াবে।' সুভাষচন্দ্র হেসে বলেন, 'কি করে বুঝলেন, দেশে আরো অনেক নেতাই আছেন।' দাদাঠাকুর বলেন, 'তা অবশ্য আছে .. তবে তোমার ঠোক্করটাই ইংরেজদের তাড়াবে। কারণ তোমার নামের প্রথমে 'সু' আবার শেষে 'সু' .. এই দুই জুতোর ধাক্কা ওরা সামলাতে পারবে না .. ওরা পালাবে।'


প্রিয় সুভাষের জন্মদিনে দাদাঠাকুর কৌশলে এক কবিতা লিখেছিলেন, যা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৩-১-৪৬ তারিখে। এই কবিতায় একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে গান্ধী দ্বারা সুভাষের বহিষ্কার বা বামেদের বেইমানি - কোনওটাই দাদাঠাকুর মেনে নিতে পারেন নি। কবিতা -


মনের মানুষ অনেক পেয়েছি শুনেছি অনেক দেখেছি কত ।


মাতামাতি করি যা তা করিয়াছি গতানুগতিক লোকের মত ।।


আজীবনকাল বাজী দেখাইল বাজীকর দল সাফাই হাতে ।


অসুস্থ করিল বসুমতী মায়ে অসুর স্বভাব চোর ডাকাতে ।।


এ ভাতরভূমি শোভার আধার অভাব এদেশে ছিল না কিছু ।


বিষ ঢালি এতে শেষ করিবারে পাষণ্ড দল লাগিল পিছু ।।


সুচতুর যত কুচক্রী-কপট সূচ হয়ে ঢুকে হইল ফাল ।


ইন্দ্রজালবলে চন্দ্রদেব সাজি কেন্দ্রমাঝে পশে রাহুর পাল ।।


অবরুদ্ধ নর সব নিজগৃহে ধীবরের জালে যেমন মীন ।

অসুবিধা ভোগে বসুধা মাঝারে অসুখী মানব অধীন দীন ।।

--- এবার কবিতার ২, ৮ ও ১৪ নম্বর অক্ষরকে উপর থেকে নিচে বরাবর লম্বালম্বি যোগ করে দেখুন, 'নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু' লেখাটি পাবেন। এখানে শুধু দশ লাইন আছে, সম্পূর্ণ কবিতাটি বত্রিশ লাইনের। যার যোগফল হয় - 'নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু জনম লভিল ধরায় আজি গঠন করিতে আজাদ হিন্দ'। (সম্পূর্ণ কবিতা পাইনি)

আজ ১৩ই বৈশাখ (বাং১২৮৮ বঙ্গাব্দে; ইং ১৮৮১) দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জন্মদিন আবার এই ১৩ই বৈশাখ (বাং ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে; ইং ১৯৬৮) তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। দাদাঠাকুর'কে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম ও অনেক অনেক ভালোবাসা। (দ্বিতীয় সংস্করণ)

জয় হিন্দ্

-সোমনাথ.সিংহ@s.sinha

তথ্যসূত্র: @অদ্বিতীয় হাস্যরসিক দাদাঠাকুর - শতদল গোস্বামী; @দাদাঠাকুর- নলিনীকান্ত সরকার; @সেরা মানুষ দাদাঠাকুর - নির্মলরঞ্জন মিত্র



No comments