জ্যোতি বসু (৮ জুলাই, ১৯১৪ - ১৭ জানুয়ারি, ২০১০) একজন ভারতীয় বাঙালি রাজনীতিবিদ। তিনি সিপিআই (এম) দলের সদস্য। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা তেইশ বছর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই ছিলেন ভার…
জ্যোতি বসু (৮ জুলাই, ১৯১৪ - ১৭ জানুয়ারি, ২০১০) একজন ভারতীয় বাঙালি রাজনীতিবিদ। তিনি সিপিআই (এম) দলের সদস্য। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা তেইশ বছর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই ছিলেন ভারতের দীর্ঘতম মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী।[১] এছাড়াও ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিআই(এম) দলের পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন।[২][৩]
ছাত্রাবস্থায় উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে গিয়ে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন বসু। ১৯৪০ সালে গ্রহণ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের প্রাদেশিক আইনসভায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি রূপে নির্বাচিত হন। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হন বসু। ড. বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বে তিনি হন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের পর বসু যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) দলে। ১৯৬৭ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ জুন শপথ নেন পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নাম বিবেচিত হলেও, তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করেন। টানা ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করে অবসর নেন বসু। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর শাসনকাল সাফল্য ও ব্যর্থতায় মিশ্রিত। তবে বিলেত-ফেরত বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের প্রতিনিধি বসু ছিলেন এক অবিসংবাদী জননেতা ও নিজের দল এবং দলের বাইরেও এক বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
জীবনী[সম্পাদনা]
প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]
ডাক্তার নিশিকান্ত বসু ও হেমলতা বসুর তৃতীয় সন্তান জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুলাই কলকাতার ৪৩/১ হ্যারিসন রোডস্থ (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) বাসভবনে।[৪] তাঁর প্রকৃত নাম ছিল জ্যোতিরিন্দ্র বসু; ডাক নাম ছিল গনা। জ্যোতি বসুর যখন জন্ম হয়, তখন নারায়ণগঞ্জ ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমা। ১৯৮০-র দশকে নারায়ণগঞ্জকে পৃথক একটি জেলায় উন্নীত করা হয়। ঢাকা শহর থেকে সরাসরি বাসে সোনারগাঁও মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ড নেমে রিকশা অথবা স্কুটারে বারদী যাওয়া যায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পিতা নিশিকান্ত ছিলেন এক প্রথিতযশা ডাক্তার এবং মা হেমলতা ছিলেন এক গৃহবধূ।[৫] ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতামাতা ওল্ড হিন্দুস্তান বিল্ডিং-এর (বর্তমান ফুটনানি চেম্বার) একটি ভাড়াবাড়িতে উঠে আসেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতারই ৫৫এ হিন্দুস্তান রোডস্থ নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন তাঁরা। বসু পরিবারের আদিনিবাস ছিল ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের ঢাকা জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদী গ্রামে।)[ক]
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ছয় বছর বয়সে ধর্মতলার লোরেটো স্কুলে ভর্তি হন বসু। এই সময় নিশিকান্ত বসু পুত্রের নামটি সংক্ষিপ্ত করে রাখেন জ্যোতি বসু।[৬] লোরেটোর কিন্ডারগার্টেনের পাঠক্রমটি ছিল চার বছরের। কিন্তু একটি "ডাবল প্রোমোশন" পাওয়ায় বসু তিন বছরেই এই পাঠক্রম সমাপ্ত করেন। প্রথম শ্রেণি থেকে লোরেটো পুরোদস্তুর বালিকা বিদ্যালয়। কিন্তু সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে না পেরে আরও এক বছর লোরেটোতেই মেয়েদের সঙ্গে এক বছর পড়েন বসু। এরপর ১৯২৫ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এই স্কুল থেকেই সিনিয়র কেমব্রিজ (নবম শ্রেণি) পাস করেন তিনি। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক (অনার্স) সহ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি। জানা যায়, কলেজে পিছনের বেঞ্চে বন্ধু রহমানের সঙ্গে বসতে পছন্দ করতেন তিনি।[৭]স্নাতক সম্পন্ন করার পর ১৯৩৫ সালে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার্থে তিনি যুক্তরাজ্যে গমন করেন। এই সময় পিতার ইচ্ছায় তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতেও অবতীর্ণ হন; তবে উত্তীর্ণ হতে পারেন নি। কিন্তু ব্যারিস্টারি পড়া অব্যাহত থাকে। লন্ডনে অবস্থানকালে সেখানকার ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে গড়ে ওঠা লন্ডন মজলিশের তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক। কথিত আছে, ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগে হ্যারল্ড ল্যাস্কির বক্তৃতা শুনতে যেতেন তিনি। ইংল্যান্ডে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হন তিনি। বিশিষ্ট কমিউনিস্ট দার্শনিক ও লেখক রজনী পাম দত্ত কর্তৃক কমিউনিস্ট মতাদর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন বসু। মিডল টেম্পলে ব্যারিস্টারি পাঠ ও যোগ্যতা অর্জনের পর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।[৮]
কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতির জন্য নাম লেখালেন। পিতার আগ্রহে বাসন্তী ঘোষের সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হলো অচিরেই। কিন্তু অল্পদিন পরেই স্ত্রী বিয়োগ হয়। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মাতার মৃত্যু হলো। পরবর্তীতে বিয়ে হয় কমল বসুর সঙ্গে, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে।[৯]
রাজনৈতিক কর্মজীবন[সম্পাদনা]
জ্যোতি বসু: জীবনপঞ্জি ১৯১৪-২০১০[দেখান]
তার বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন ডাক্তার। দুই জ্যাঠামশাই ওকালতি করতেন। রাজনীতির সঙ্গে এ পরিবারের তেমন সংযোগ ছিল না। তবে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা ছিল।[১০] ১৯১৩-১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক নিশিকান্ত বসুর বারদির বাড়িতে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করেছিলেন। এখানে অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন। পুলিশের খানা-তল্লাশীর সময় জ্যোতি বসুর মা তার শাড়ীর ভাঁজে অস্ত্রটি লুকয়ে রেখেছিলেন। এই যোগসূত্র জ্যোতি বসুর মধ্যে জাগিয়ে তোলে দেশপ্রেম; একসময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে ফেলে। ১৯৩০ দশকের শুরুর দিকে গান্ধিজীর অনশনের সময় একদিন তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে। এ সময়ই অক্টরলোনি মনুমেন্টে (শহীদ মিনার ময়দান) সুভাষ বসুর ভাষণ শুনতে গেলেন খদ্দর পরে। সেদিন পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে তার মনে পলায়নের পরিবর্তে মোকাবেলার অনুভূতি জেগে উঠেছিল। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, "সেটাই বোধহয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ।"[১১]
লন্ডনে আইন পড়তে এসে রাজনীতিতে তার দীক্ষা হয়। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে আইন পড়তে পড়তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, আইন নয় রাজনীতিই হবে জীবনের ব্রত। তখন বিশ্বে ফ্যাসীবাদী অভ্যূত্থান শুরু হয়েছে। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ। লন্ডন স্কুল ইকনমিক্সে হ্যারল্ড লাস্কির বক্তৃতা শুনতে শুনতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে পড়তেন। এসময় কার্ল মার্কস দাস ক্যাপিটাল এবং এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ইত্যাতি পড়তে শুরু করলেন। সে সময় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে আইন পড়তে এসেছিলেন মার্কসবাদে দীক্ষিত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ভূপেশ গুপ্ত। ভূপেশ গুপ্ত এবং স্নেহাংশুকান্ত আচার্যর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হলো কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট বিটেনের সঙ্গে। রজনী পাম দত্ত, বেন ব্রাডলি, হ্যারি পলিট প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তাকে উজ্জীবিত করেছিল প্রবলভাবে। মজলিশের সদস্য হিসেবে নানা দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলেন। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস-এর পুনসংর্গঠনে নিযুক্ত করলেন নিজেকে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯৩৮-এ লন্ডনে এলে তার সংবর্ধনা আয়োজনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। নেহরুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই জ্যোতি বসু তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে জানিয়ে দেন তারা ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নেহরু জবাব দিয়েছিলেন, 'আগে ভারতবর্ষ স্বাধীন হোক পরে সমাজতন্ত্রের কথা ভাববো'। এসময় নেতাজী সুভাষ বোসও লন্ডনে এসেছিলেন। তার ভাষণ জ্যোতি বসুর বিশেষ ভালো লেগেছিল। সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন দেশে ফিরে তিনি রাজনীতি করতে চান। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মিডল টেম্পল থেকে বার অ্যাট ল হয়ে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে জ্যোতি বসু দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলেন। আর রাজনৈতিক জীবন শুরু হলো শ্রমিক নেতা হিসাবে।[১২]
বিরোধী রাজনীতি[সম্পাদনা]
১৯৪৬ সালে মাত্র বত্রিশ বছর অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু। এই সময় থেকেই আইনসভায় বিরোধী নেতার ভূমিকা পালন করতে থাকেন বসু। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামপন্থীরাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পূর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেভাগা আন্দোলন ও বঙ্গবিভাগ নিয়ে আইনসভায় বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, বন্দীমুক্তি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত আন্দোলনের পুরোভাগে থাকেন জ্যোতি বসু। এই সময় একাধিকবার বিভিন্ন কারণে কারারুদ্ধও হতে হয় বসু সহ তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতাদের।[১৩]
প্রথম নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা[সম্পাদনা]
১৯৪০-এর দশকে জলপাইগুড়ি শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে দোমহনিতে[১৪] রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন জ্যোতি বসু। এখানকার কৃষক ও চা শ্রমিকদের সংগঠন তৈরি ও তেভাগা আন্দোলনেও তার অবদান ছিল। দোমহনি থেকেই বেঙ্গল আসাম রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা বসু ১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় কংগ্রেসের হুমায়ুন কবিরকে মাত্র আট ভোটে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন বসু।[১৫] এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি মোট তিনটি আসন পেয়েছিল। জ্যোতি বসুর সঙ্গে দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন অপর কমিউনিস্ট নেতা রতনলাল ব্রাহ্মণ।[১৬][১৭]
বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভা (১৯৪৬-৪৭)[সম্পাদনা]
১৯৪৬ সালের ১৪ মে নবগঠিত প্রাদেশিক আইনসভার প্রথম বৈঠক বসে। এই দিন রাজবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে জ্যোতি বসু একটি মুলতুবি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। পরে সেই মুলতুবি প্রস্তাব পুনর্বিচারের জন্য অস্থায়ী স্পিকার ডি গ্ল্যাডিং-এর নিকট আবেদন জানান, কিন্তু গ্ল্যাডিং এই প্রস্তাব গ্রহণে অসম্মতি জানান।[১৮]
জুলাই মাসে বাজেট অধিবেশন বসলে প্রথমেই বন্দী মুক্তির প্রসঙ্গে আইনসভা সোচ্চার হয়। জ্যোতি বসু পুনরায় এই প্রসঙ্গে একটি মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করলে স্পিকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ জানতে চাইলে, মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কিছু বলতে যান। বসু উত্তরে বলেন যে তিনি স্পিকারের রুলিং মেনে চলবেন, মুখ্যমন্ত্রীর নয়। কংগ্রেসের কিরণশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ সদস্য বসুকে সমর্থন করেন এবং বাইরে অপেক্ষমাণ হিন্দু-মুসলমান ছাত্র শোভাযাত্রার কাছে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ জানান। এই নিয়ে বিধানসভায় বেশ উত্তেজনা হয়।[১৯] সোহ্রাওয়ার্দী এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৫ অগস্টের মধ্যে রাজবন্দীদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। বন্দীরাও মুক্তি পান। উল্লেখ্য, এই বন্দীমুক্তির ব্যাপারে জ্যোতি বসু ও কমিউনিস্ট পার্টিই মূলত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং আইনসভায় তারা কংগ্রেসের সহায়তাও পেয়েছিল।[২০]
এই বাজেট বক্তৃতায় জ্যোতি বসু পাটশিল্প, কয়লাশিল্প ইত্যাদির রাষ্ট্রায়াত্ত্বকরণ এবং জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের সুপারিশ করেন।[২১] আসাম প্রদেশে মুসলিম অনুপ্রবেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বসু বলেন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের ফলেই দরিদ্র মুসলমানগণ বাস্তুভিটে ত্যাগ করে আসামে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এইজন্য জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের পাশাপাশি ভূমিহীনদের মধ্যে জমিবণ্টন ও শিল্পবিকাশ ত্বরান্বিত করে বাস্তুত্যাগ বন্ধ করার জন্যও সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আবেদন জানান তিনি।
৬ অগস্ট আইনসভায় প্রবেশের পথে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সামসুদ্দোহা কর্তৃক নিগৃহীত ও পরে গ্রেফতার হন বসু। কিরণশঙ্কর রায় স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অবিলম্বে যথোচিত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়। স্পিকারের নির্দেশে সোহ্রাওয়ার্দী সামসুদ্দোহাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। সোহ্রাওয়ার্দী এ নিয়ে তদন্তেরও নির্দেশ দেন। আইনসভায় দলমত নির্বিশেষে সকল সদস্যই পুলিশের এ হেন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্পিকারও পুলিশের এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।[২২]
রাজনৈতিক জীবন ১৯৪৭-১৯৬৪[সম্পাদনা]
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শাসনের অবসান হলো, স্বাধীন হলো ভারত। স্বাধীনতা লাভের উৎসব শেষ হলে নতুন উদ্যমে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন জ্যোতি বসু। কমিউনিস্ট পার্টির নতুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি বা 'পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি' গঠন করা হলো - জ্যোতি বসু এ কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হলেন। ২১শে নভেম্বর পুনর্গঠিত পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভার অধিবেশন। এ সময় এসপ্ল্যানেডে মিছিলের ওপর লাঠি চালালো পুলিশ, নিক্ষেপ করলো কাঁদানে গ্যাস। কংগ্রেস আবির্ভূত হলো জনগণের শত্রু হিসেবে। এ সময় 'পশ্চিম বঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা আইন' নামে একটি জনবিরোধী প্রণয়ন করা হয়। জ্যোতি বসু এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এই কালা কানুনের বিরূদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেন তিনি। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে মার্চ তারিখে কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। পরদিন জ্যোতি বসুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলো। প্রেসিডেন্সী জেলে শুরু হলো জ্যোতি বসুর প্রথম কারাজীবন। তিন মাস পর মুক্তি পেলেন তিনি। কারামুক্ত হয়ে আবার রেলওয়ে ট্রেড ইউনিয়নের কাজে মনোনিবেশ করলেন তিনি। বম্বে যাওয়ার পথে ট্রেনে উঠে পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করলো। আলিপুর কোর্টে জামিন মিললো না; তাকে যেতে হলো আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। তবে অচিরেই খালাস পেলেন তিনি। ৫ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ আলিপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বীরেন্দ্রনাথ বসুর কন্যা কমল বসুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন তিনি। বিয়ের পর তিন মাস পুরো হওয়ার আগেই আবার তাকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিল পুলিশ। তাকেঁ এবার আত্মগোপন করে থাকতে হলো, ছদ্মবেশ নিয়ে পথে বেরুতেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। হেবিয়াস কর্পাস করে হাইকোর্টের আদেশে ১৯৫১তে মুক্তি পেলেন তিনি। মুক্তি পেযে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্সংগঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জ্যোতি বসু। ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। তেলেঙ্গানায় কারাগারে আটক রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য দিল্লী গিয়ে নেহরুর সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। ১৮ই জানুয়ারি ১৯৫২'র বিধানসভার নির্বাচনে বরাননগর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে জিতে গেলেন জ্যোতি বসু। এবার বিধানসভায় তিনি বিরোধী পক্ষের নেতা মনোনীত হলেন। বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক আইনের বিরূদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থান নিয়ে অটল ছিলেন। ১৯৫৩-এ কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন তিনি। পার্টি সংগঠনের দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেক।
রাজনৈতিক জীবন ১৯৬৪-১৯৭৭[সম্পাদনা]
১৯৬০-এর দশকে জ্যোতি বসুর ওপর বেশ কয়েক বার হামলা হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে মে দিবসের আগের দিন বরাননগরে এক শ্রমিক সমাবেশে যাওয়ার পথে কংগ্রেসী পতাকা হাতে একদল সন্ত্রাসী তার গাড়ীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৩য় সাধারণ নির্বাচনের প্রচারের কাজে কাকদ্বীপ যাওয়ার পথে শতখানেক লোক তার পথ আগলে হামলা করে। ১৬ ফ্রেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি বরাননগর এলাকা থেকে ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জিকে পরাজিত করে বিধানসভার সদস্য হলেন; বিধানসভায় বিরোধীয় দলীয় নেতাও হলেন তিনি।[২৩]
১৯৬২'র ২০শে জুন চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হলে সারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নেমে আসে নির্যাতন। কালীঘাটে কুশপুত্তিলিকার দোকানে জ্যোতি বসুর কুশপুত্তলিকা বিক্রয় হতো। তাকে "চীনের দালাল", "দেশদ্রোহী" ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে রাস্তায় সেগুলো পোড়ানো হতো। গোয়েন্দা পুলিশ সর্বত্র অনুসরণ করতো তাকে। যুদ্ধ স্থায়ী হলো মাত্র ১৪ দিন; কিন্তু ইত্যবসরে জ্যোতি বসুকে এক কাকডাকা ভোরে গ্রেপ্তার করে টানা ১ বছর কারাবন্দী করে রাখা হলো। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯৬৫-৬৬ এ খাদ্য আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, ট্রামভাড়াবৃদ্ধি আন্দোলনে উত্তাল এক সময়। এ সময় জ্যোতি বসুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৬'র ১৪ মার্চ তিনি মুক্তি পেলেন।[২৪]
ইতিমধ্যে পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেস সম্পর্কে জনগণের মোহভঙ্গ হয়েছে। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪র্থ সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব হলো। গঠিত হলো অ-কংগ্রেসী কোয়ালিশন সরকার। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ জ্যোতি বসু দ্বিতীয় বারের মতো পশ্চিম বঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। শুরু হলো ট্রেজারী বেঞ্চের জীবন; শুরু হলো বুর্জোয়া রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বামপন্থী সরকার পরিচালনার সংগ্রাম। জ্যোতি বসুর মূল পুঁজি তার নেতৃত্বের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে জ্যোতি বসু পুনর্বার বরাননগর থেকে নির্বাচিত হলেন, আবার বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলো; জ্যোতি বসু আবারো উপ মুখ্যমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র দায়িত্ব পেয়ে তিনি পুলিশকে "জনগণের বন্ধু" হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা এবং যুক্তফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখা এই দ্বিবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে পথ চলতে হচ্ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নকশাল আন্দোলন। অজয় মুখার্জিকে হারিয়ে জ্যোতি বসু নির্বাচিত হলেন। মাত্র তের মাসের মাথায় ২১শে মার্চ ১৯৭০ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হয়।[২৫]
৯ই মার্চ ১৯৭১-এ অনুষ্ঠিত হলো মধ্যবর্তী নির্বাচন। কিন্তু রাজনীতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। সরকার গঠন হতে না-হতেই জারী করা হলো রাষ্ট্রপতির শাসন। পরবর্তী নির্বাচন ১১ মার্চ ১৯৭২। জ্যোতি বসুর ভাষায় "বাহাত্তরের নির্বাচনটা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের এক নির্লজ্জ প্রহসন। ... আমি সেদিন আমার নির্বাচনী এলাকা বরাননগরে ঢুকতেই পারিনি।"[২৬] এসময় প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ বৈরী। অভিযোগ আছে জালিয়াতির মাধ্যমে শিবপদ ভট্টাচার্য জিতে গেলেন। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি বিধান সভা বর্জন করে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল বেছে নিল।
১৯৭৭ পর্যন্ত কয়েকটি বছর দুঃসময়ের কাল। এরই মধ্যে ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিলেত ভ্রমণ করলেন জ্যোতি বসুর। লন্ডনে নানা সভা-সমিতি করে তিনি সফর করলেন বেলজিয়াম, জার্মানি, হল্যান্ড প্রভৃতি কয়েকটি দেশ। ভারতে তখন নানা সমস্য। একদিকে খাদ্যঘাটতি, অন্যদিকে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কলহ। পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাদীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানা পুলিশী কার্যক্রম। এছাড়া জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে গণআন্দোলন চলছে। ১২ই জুন ১৯৭৫ তারিখে নির্বাচনী বিধি ভাঙ্গার দায়ে ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ বাতিল করে দেয় এলাহাবাদ হাই কোর্ট। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জুন সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। জ্যোতি বসু জনসমর্থনের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যেতে লাগলেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ১৯৭৭-২০০০[সম্পাদনা]
১৬ই মার্চ ১৯৭৭-এ অনুষ্ঠিত লোকসভার নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিধ্বস পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে জনতা দল সরকার গঠন করলো। প্রধানমন্ত্রী হলেন মোরারজি দেশাই। পশ্চিম বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনেও সার্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখা গেল। সাতগাছিয়া থেকে প্রতিদ্বন্দীতা করে জ্যোতি বসু নির্বাচিত হলেন। তার দল সিপিআই-এম পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলো। পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হলো বামফ্রন্ট সরকার ; মুখ্যমন্ত্রী হলেন জ্যোতি বসু। বামফ্রন্টের ৩৬ দফা কর্মসূচীর ওপর জোর দিলেন তিনি। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে দেশ শাসনের দর্শন ব্যক্ত করলেন জ্যোতি বসু: "আমরা রাইটার্স বিল্ডিং থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করব না, আমরা আমাদের কর্মসূচী রূপায়ণ করব মাঠ আর কারখানা থেকে, জণগণের সহায়তা নিয়ে, কারণ এরাই আমাদের ক্ষমতার উৎস।" ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠান তার একটি প্রধান অর্জন। এছাড়া গ্রামীণ বাংলায় ভূমিসংস্কারও একটি বিরাট সাফল্য। ১৯৭৯-এর গোড়ার দিখে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেন।ঐ একই বছর তার শাসনামলে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি অঞ্চলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুদের উপর সংঘটিত হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, যা মরিচঝাঁপি গণহত্যা নামে পরিচিত।১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের লোকসভার নির্বাচনে জিতে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় এলেন। কেন্দ্রের অসহযোগতিা সত্ত্বেও জ্যোতি বসু সরকার পরিচালনা করে গেলেন দৃঢ়তার সাথে। তার সাফল্য পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ের পথ সুগম করে দিল।
অবসর জীবন[সম্পাদনা]
২০০০ সালের ২৮ জুলাই সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলাকালীন হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন জ্যোতি বসু। তাকে প্রথমে ভর্তি করা হয় রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে; পরে নিয়ে যাওয়া হয় অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসে। চিকিৎসার পর পরদিন সন্ধ্যায় ছাড়া পান বসু। ১৫ অগস্ট নিজেই জানান ১৫ সেপ্টেম্বরের পর অবসর নিতে চলেছেন তিনি। তবে পার্টির চাপে অবসরের তারিখ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। ৩ নভেম্বর শেষ বারের মতো পশ্চিমবঙ্গ সচিবালয় মহাকরণে আসেন বসু। ৫ নভেম্বর রাজারহাট নিউটাউনে একটি আবাসিক ভবনের অনুষ্ঠানে যান; এটিই ছিল তার জীবনের শেষ সরকারি অনুষ্ঠান। একটানা ৮৫৪০ দিন মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার পরিচালনার পর ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিদায় সংবর্ধনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেন বসু।[১৪]
৭ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বন্যাত্রাণে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের দাবিতে দিল্লির বিঠলভাই প্যাটেল হাউসে ধরনায় বসলেন বসু। ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, এইচ. ডি. দেবেগৌড়া, রাবড়ি দেবী, প্রফুল্ল মহন্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রাজ্য বামফ্রন্ট কমিটির উদ্যোগে জ্যোতি বসুর সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হল। ১২ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি শহরে অনুষ্ঠিত হল সংবর্ধনা সভা। উল্লেখ্য, এই শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে দোমহনিতে রেলশ্রমিক আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমেই তিনি প্রথম বার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামে নেমেছিলেন। ২০০১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্যপদ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে বিধানসভার সঙ্গে বসুর ৫৫ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হল। বিধানসভায় বসুর শেষ বার্তা ছিল ‘প্রশংসা বিষবৎ, নিন্দা অমৃতসমান’।[১৪] তবে অবসর গ্রহণের পরও বিধাননগরের মুখ্যমন্ত্রী আবাস ইন্দিরা ভবনেই তার আজীবন বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়।
২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর উত্তর বঙ্গ সফরে যান বসু। ২৪ ডিসেম্বর যান সিঙ্গাপুর সফরে। ২০০৫ সালের ২৩ জুলাই বাথরুমে পড়ে গিয়ে আহত হন বর্ষীয়ান এই নেতা। এই বছরই নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-এর অষ্টাদশ পার্টি কংগ্রেস জ্যোতি বসুকে দলের পলিটব্যুরো সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করে। যদিও বসু নিজে শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই পদটি থেকে অব্যহতি চেয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পুণরায় বার্ধক্যের কারণে দলীয় পদ থেকে অব্যহতি চান। কিন্তু সেই সময় তার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট জানিয়েছিলেন, ২০০৮ সালের পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত তারা বসুকে দলীয় পদে চান। তারপর এই কংগ্রেসেই তার অনুরোধ বিবেচনা করা হবে।[২৭] ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ঊনবিংশ পার্টি কংগ্রেসে বসুকে আর পলিটব্যুরোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। যদিও তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পলিটব্যুরোর বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেওয়া হয়।[২][৩] ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করতে চাইলে তা গ্রহণে অসম্মত হন বসু।[১৪] ২০০৬ সালের ১৪ নভেম্বর আবার বাড়িতে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পান তিনি।
২০০৭ সালের ১৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জ্যোতি বসুকে সাম্মানিক ডি. লিট. সম্মান প্রদান করে। ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বাড়িতে পড়ে গিয়ে কপালে ও মাথায় আঘাত পান বসু। ৭ সেপ্টেম্বর ভর্তি হন হাসপাতালে। ১২ নভেম্বর আবার বাড়িতে পড়ে গিয়ে আহত হন বসু। ৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার প্রাক্তন ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা এসে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ২০০৯ সালের ১৩ মে বাথরুমে পড়ে গিয়ে বাঁ পায়ে আঘাত পান বসু। জুন মাসে নির্বাচনী সাফল্যের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ১২ জুলাই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন অ্যাডভান্সড মেডিকেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (আমরি হসপিটাল)। সেবার সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বসু।[১৪]
জীবনাবসান[সম্পাদনা]
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি বসু বিধাননগরের অ্যাডভান্সড মেডিকেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (আমরি হসপিটাল) ভর্তি হন।[২৮][২৯] ১৬ জানুয়ারি তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে এবং তার একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যেতে থাকে।[৩০][৩১] সতের দিনের দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ১১টা ৪৭ মিনিটে জ্যোতি বসুর জীবনাবসান হয়।[৩২] তার দেহের সৎকার হয়নি - তিনি তার চোখ দান করে গেছেন; তার মরদেহ ব্যবহৃত হবে মেডিক্যাল কলেজের গবেষণায়। তার মৃত্যু উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ জানুযারী ২০১০ সোমবার সরকারি ছুটি পালিত হয়। ২০ জানুযারী তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
সমালোচনা[সম্পাদনা]
বিভাগোত্তর ভারতে অতুলনীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী রাষ্ট্রনায়ক জ্যোতি বসুর জীবনের প্রকৃত অর্জন কী এ নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাট থেকে কংগ্রেসকে তিনি কেবল উৎখাতই করেন নি, পরবর্তী তিন যুগে কংগ্রেসের প্রভাব তিনি বহুলাংশে খর্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কথা সত্য যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে স্থিতিশীল করত: কর্দমমুক্ত করতে সক্ষম হন। তবে আপাদমস্তক মার্ক্সবাদী জ্যোতি বসুর পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি নাগাড়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার পরিচালনা করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রে তাঁর নেতৃত্বের সাফল্য কী সে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। তাঁর শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখ করবার মতো কোনো অর্জন নেই এমন ইঙ্গিতও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁর আমলে পশ্চিমবঙ্গে স্থিতাবস্থা বিরাজ কররেও তেমন কোনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেনি।[৩৩]
সম্মাননা[সম্পাদনা]
তাঁর মৃত্যুর পর বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে বাংলাদেশে ২০১ সদস্যবিশিষ্ট "কমরেড জ্যোতি বসু স্মরণে নাগরিক পর্ষদ" গঠন করা হয়।[৩৪]
No comments