Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বাবা লোকনাথের জীবনী কথা

আজ থেকে ২৯১ বৎসর পূর্বে ১১৩৭ বঙ্গাব্দের ১৮ই ভাদ্র (১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে আগষ্ট) জন্মাষ্টমী তিথিতে কলকাতা থেকে কিছু দূরে তৎকালীন যশোহর জেলা আর বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চৌরশী চাকলা নামক গ্রামে তি…

 



আজ থেকে ২৯১ বৎসর পূর্বে ১১৩৭ বঙ্গাব্দের ১৮ই ভাদ্র (১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে আগষ্ট) জন্মাষ্টমী তিথিতে কলকাতা থেকে কিছু দূরে তৎকালীন যশোহর জেলা আর বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চৌরশী চাকলা নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামনারায়ণ ঘোষাল এবং মায়ের নাম কমলাদেবী। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান।


পিতা রামনারায়ণ তাঁর শিবপ্রসাদ নাম রাখেন এবং মা কমলা আমার যাদুমণি নাম দিলেন। পার্শ্ববর্তী গ্রাম (কাঁকড়া) কচুয়া গ্রামে বাস করতেন ভগবান গাঙ্গুলী নামে ভারতবর্ষের নামকরা এক পণ্ডিত। এগারো বছর বয়সেই উপনয়ন শেষে গুরু ভগবান গাঙ্গুলীর কাছে একমাত্র বন্ধু বেণীমাধব সহ তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গুরু ভগবান গাঙ্গুলীই তাঁর নাম রাখেন লোকনাথ।


এরপর গৃহত্যাগ করেন লোকনাথ। লোকনাথ, বেণীমাধব ও ভগবান গাঙ্গুলী পদযাত্রা শুরু করেন। বিভিন্ন গ্রাম শহর নদ-নদী জঙ্গল অতিক্রম করে প্রথমে কালীঘাটে এসে যোগ সাধনা শুরু করেন। কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে কিছুদিন অবস্থান করলেন। ব্রহ্মচার্য পালনের মধ্য দিয়ে ত্যাগের সাধনায় ব্রতী হয়ে সিদ্ধির জগতে পা বাড়ালেন লোকনাথ ও বেণীমাধব। এরপর কঠিন সাধনায় অতিবাহিত করেন প্রায় ৪০ বছর। এই রূপে গুরুর আদেশে বিভিন্ন স্থানে যোগ সাধনা ও ব্রত করে শেষ পর্যন্ত লোকনাথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন।


গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম ও অষ্টাঙ্গ যোগের কিছু শিক্ষা দেন। এরপর লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী কাশীতে আসেন। বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবের বয়স তখন ৯০ আর গুরুর বয়স ১৫০। গুরু ভগবান গাঙ্গুলীর দেহত্যাগের সময় চলে আসায় তিনি তার দুই শিষ্যকে নিয়ে আসেন ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কাছে। তখনও দুই শিষ্যের যোগশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী তাঁর দুই প্রিয় শিষ্যকে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর উপর অর্পণ করে যোগবলে দেহরক্ষা করেন। তাঁদের পরবর্তী শিক্ষা দেন কাশীর সচল শিব ত্রৈলঙ্গ স্বামী।


বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব প্রায় ২০ বছর কাটান ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সঙ্গে তাঁর আশ্রমে। তাঁদের শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর দুই সাধক একদিন বাবা ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সাথে পরিব্রাজক রূপে বেরিয়ে পড়েন, আরব, ইসরাইল, পারস্য, আফগানিস্তান, ইউরোপ। অবশেষে তারা আসেন মহা ভারতের হিমালয়ে।


সম্পূর্ণ অনাবৃত্ত দেহে হিমালয়ের দুর্গম পথ ভ্রমণ করেছেন তিন সাধক। কৈলাসের মানস সরোবর তুষার রাশি পেরিয়ে হেঁটে এলেন সাইবেরিয়াতে। এখানে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না। অন্ধকারময় পথ। দীর্ঘপথ হেঁটে এলেন মহা চীন দেশে। চীনের সীমান্ত পথে প্রহরীরা তাদের আটক করেন। অলৌকিক শক্তি দেখে প্রহরীরা তাদের ছেড়ে দেন।


এ মহাতীর্থ হিমালয়ের শৃঙ্গগুলো অতিক্রমকালে তিব্বত থেকে বদ্রীনাথ পাহাড়ে এসে কয়েকদিন অবস্থান করেন। সেখানে বাঘিনীর বাচ্চাদের দেখাশোনা করেছিলেন বাবা লোকনাথ। এরপর ত্রৈলঙ্গ স্বামী ফিরে আসেন কাশীধামে। ত্রৈলঙ্গ স্বামী বলেছেন, 'লোকনাথ হল আমার হৃদয়ের অংশ, সে তো ক্ষেপা শিব'।


বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব তিব্বত থেকে অরুনাচল, অরুনাচল থেকে আসাম এ আসেন। এখান থেকেই লোকনাথ ও বেণীমাধব বিভক্ত হয়ে যান। আসামেই থেকে যায় বেণীমাধব। এখানেই ১৪০ বছরের বন্ধুত্বের চিরবিদায় হয়। লোকনাথ বাবা চলে আসেন চন্দ্রনাথ পাহাড় (সীতাকুন্ডু), চট্টগ্রামে।


চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান কালে দাবানলের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে থেকে মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণকে উদ্ধার করে রক্ষা করেন লোকনাথ বাবা। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নিজে ঐ ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেছেন -- "আমি ও বারদীর ব্রহ্মচারী মহাশয় এক সময়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে কিছুকাল একসঙ্গে সাধন - ভজন করছিলাম। সেই স্থানে একদিন হঠাৎ চারিদিকে দাবানল জ্বলে উঠল। পশু পাখি, কীটপতঙ্গ আগুনে দগ্ধ হতে লাগল। উত্তাপ আর সহ্য করা যায় না। আমাদের কুটিরের প্রায় দু'শো (২০০) হাত নীচে সমতলভৃমি ছিল। প্রথমে দেখি একটা প্রকান্ড সাপ। সাপটি লাফ দেওয়ার পরই অদৃশ্য হল। পরে একটা বাঘও ঐরূপ করল। তারপর ব্রহ্মচারী মহাশয় 'বম্ বম্' শব্দ উচ্চারণ করতে করতে আমাকে পিঠে করে দুইশত হাত নীচে লাফিয়ে পড়লেন। আমরা একটু আঘাত পাইনি।"


সীতাকুন্ডু থেকে বাবা লোকনাথ চলে আসেন কামাখ্যা হয়ে ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে। সেখানেই পরিচয় হয় বারদী নিবাসী ডেঙ্গু কর্মকারের সাথে। এই ডেঙ্গুর সাথেই বাবা লোকনাথ আসেন বারদী। ডেঙ্গু জোর করে বাবাকে নিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জ এর বারদীতে।


বারদীর বিখ্যাত জমিদার পরিবার বাবার কৃপা লাভ করে ধন্য হয়েছিল। পরবর্তীকালে মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন নারায়নগঞ্জ এর বারদী আসেন, তখন বাবা লোকনাথকে দেখে চিনতে পারেন। বুঝতে পারেন, ইনিই তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। এরপর সারা ভারত এবং বাংলাদেশে বাবা লোকনাথের অসামান্য যোগশক্তির কথা প্রচার করে বেড়ান মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। তখন থেকেই মানুষ বাবা লোকনাথ সম্পর্কে জানতে পারেন।


বারদী মেঘনা নদীর তীরে শ্মশান ভূমিতেই বাবার আশ্রম কুটির। এখানে থেকে দিব্য কৃপা বর্ষিত হচ্ছে। কায়মনে বাবার কাছে যে যা প্রার্থনা করেন, তাই পান। বাবা কাউকে কৃপা থেকে বঞ্চিত করেন না। এভাবে একটু সময়ের ব্যাবধানেই বাবার আশ্রম তীর্থভূমিতে পরিণত হয়। কোন এক সময় ভাওয়ালের মহারাজ বাবার অনুমতি নিয়ে বাবার ফটো তুলে রাখেন। যে ফটো বর্তমান ঘরে ঘরে পূজিত হয়।


বারদীর আশ্রমের কাছেই এক বৃদ্ধা, নাম কমলা। সম্বল বলতে এক গরু ছাড়া কিছুই ছিল না। দুধ বিক্রি করে দিন চালাতেন। লোকমুখে বাবা লোকনাথের প্রশংসা শুনে এক বাটি দুধ নিয়ে বাবাকে দেখার জন্য চলে আসেন। বাবা লোকনাথ তাঁকে মা বলে ডাকে কাছে টেনে নেন। লোকনাথ বাবা তাঁকে “মা” ডাকতেন বলে পরবর্তীতে তিনি ‘গোয়ালিনী মা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি লোকনাথ বাবার আশ্রমেই কাটান।


এই ভাবে দিব্য লীলা করবার পর – একদা বাবা ঠিক করলেন তিনি এই দেহ রাখবেন। ইতিমধ্যে কাশীতে ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ২৮০ বৎসর বয়স অতিক্রম করার পর পৌষ মাসের শুক্লা-একাদশীর দিন ত্রৈলঙ্গ স্বামী নিজ ইচ্ছায় মহাসমাধি যোগে ইহলীলা সংবরণ করেছেন। মহাপ্রয়াণের কয়েকদিন আগে ভক্তদের কাছে প্রশ্ন করে বসেন “বল দেখি, দেহ পতন হলে কিরূপ সৎকার হওয়া ভাল ?” এবং ভক্তদের অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করার নির্দেশ দান করেন। বাবা লোকনাথ ১৯শে জ্যৈষ্ঠে দেহ ত্যাগ করবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।


সেবার ১৯শে জ্যৈষ্ঠ ছিল রবিবার। বাবাকে শেষ দর্শন করার জন্য ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ (১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের ১লা জুন) রবিবার শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে সকাল হতে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয় বারদীর আশ্রমে। দুঃখভারাক্রান্ত মনে গোয়ালিনী মা বাল্যভোগ তৈরি করে নিজ হাতে শেষ বাল্যভোগ খাইয়ে দেন লোকনাথ বাবাকে।


ভক্তদের কান্না শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা বলেন -- 'ওরে তোরা চিন্তায় এত কাতর হচ্ছিস কেন ? আমি কি মরে যাব ? কেবল আমার জীর্ণ দেহটা পাত হবে। আমি যেমন আছি, ছিলাম তোদের কাছে ঠিক তেমনই থাকব। আমার মৃত্যু নেই। ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে আমাকে একটু আদর করে ডাকলেই দেখবি তোদের কত কাছটিতেই আছি। এখন তোদের কথা শুনছি, কৃপা করছি তখনও শুনব, দেখিস ডাকলেই কৃপা পাবি। একথা মিথ্যা হবে না। আরে আমি যাবই বা কোথায় ? সর্বভূতের অস্তিত্বে যে আমিই বিরাজ করছি। তোরা আত্মনিষ্ঠ হয়ে ভক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চল। তোদের বাধা দেবে কে ? তোরা যে আমারই সন্তান। আমার সন্তানের উপর কারো শাসন চলবে না। আমি উপদেশ করছি না এ আমার আদেশের স্থল। তোরা আমায় ছাড়া নস, এই ভাবটি ভূলিস না। আমি তোদের মধ্যেই আছি, তোদের মধ্যেই থাকব। আমি নিত্য, আমি অবিনাশী।'


প্রসাদ ভক্ষণ হওয়ার পর সকল ভক্তদের খাবার গ্রহনের নির্দেশ দিয়ে বাবা কাষ্ঠাসনে হেলান দিয়ে মহাযোগে বসেন। বাল্যভোগ প্রসাদে পরিণত হওয়ার পর ভক্তগন মহাআনন্দের সথে তা ভক্ষণ করিল। বাবার আদেশে সেদিন আশ্রমের সবাই বেলা ৯ টার মধ্যে ভোজন সারলেন।


এরপর সবাই নির্বাক অবাক হয়ে অশ্রু সজল চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন বাবার দিকে কখন বাবার মহাযোগ ভাঙ্গবে। কিন্তু বাবার ঐ মহাযোগ আর কখনও ভাঙ্গেনি। শেষ পর্যন্ত ১১ টা ৪৫ মিনিটে দেহ স্পর্শ করা হলে দেহ মাটিতে পড়ে যায়। ভক্তগণ কাঁদতে থাকে উচ্চস্বরে এবং বাবার শরীর মন্দির থেকে তুলে এনে বিল্বতলে রাখা হয়। শোকের ছায়া নেমে আসে বারদী আশ্রমে। সমবেত কন্ঠে তখন উচ্চারিত হয় -- "জয় বাবা লোকনাথ - জয় বারদীর ব্রহ্মচারী"। দেহ সৎকারের জন্য আনা হয় থরে থরে ঘৃত ও চন্দন। বাবার কথা মত বাবার দেহ আশ্রমের পাশে চিতায় রেখে দাহকৃত সমাপ্ত হয়। এই ধরাধাম থেকে চলে গেলেন লোকনাথ বাবা। কিন্তু রেখে গেলেন বাবার পূর্ণ স্মৃতি। আর রেখে গেলেন বাবার অমর বাণী -- 'রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও আমিই রক্ষা করিব'।


No comments