মনের চোখে স্বপ্ন দেখার শক্তি: আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের বিশ্ববিজয়ের কাহিনী— আশিস কুমার পন্ডা
হঠাৎ কেউ যদি আমাদের প্রশ্ন করেন — “পাঁচ বছর পরে তুমি নিজেকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবে?” “কী কী দক্ষতা আয়ত্ত করবে?” “কত টাকা উপার্জন করবে? আমাদে…
মনের চোখে স্বপ্ন দেখার শক্তি: আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের বিশ্ববিজয়ের কাহিনী— আশিস কুমার পন্ডা
হঠাৎ কেউ যদি আমাদের প্রশ্ন করেন — “পাঁচ বছর পরে তুমি নিজেকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবে?” “কী কী দক্ষতা আয়ত্ত করবে?” “কত টাকা উপার্জন করবে? আমাদের বেশিরভাগই তখন এই প্রশ্নগুলোর যুক্তি খুঁজতে খুঁজতে থমকে যাবো। ভবিষ্যত তো অজানা… পাঁচ বছর পরের ছবিটা কি আগে থেকে দেখা যায়? কেউ কি দেখেছেন? কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে একটু শান্ত হয়ে ভাবো—যদি এমন এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের ভিতরেই লুকিয়ে থাকে, যা আমাদের কল্পনার স্বপ্নগুলোকে সঠিক সময়ে হুবহু সত্যি করে ফেলতে পারে? শুনতে অবাক লাগছে তাই না? কিন্তু এই রহস্যময় শক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ হলেন—আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার—অস্ট্রিয়ার এক ছোট্ট গ্রামের এক স্বপ্নবাজ কিশোর, যিনি একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একটি হয়ে উঠেছিলেন।
আর্নল্ড বড় হয়েছিলেন এমন এক গণ্ডগ্রামে, যেখানে সুযোগ ছিল সামান্য, স্বপ্ন ছিল আরও ছোট। বাবা ছিলেন কঠোর পুলিশের কর্মকর্তা— চাইতেন ছেলে বড় হয়ে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে পরে, তারই মতো পুলিশ হোক। সেই গ্রামের মানুষদের কাছে এটাই ছিল এক বিশাল স্বপ্ন। কিন্তু একদিন সবকিছু বদলে গেল। এক দুপুরে আর্নল্ডের চোখ আটকে গেল এক ফিটনেস ম্যাগাজিনের প্রথম পাতায় এক ছবির উপরে। এক নতুন সিনেমায় ‘হারকিউলিস’ চরিত্রে অভিনয় করছেন রেগ পার্ক— সেই সময়ের মিস্টার ইউনিভার্স। পলকহীন চোখে তিনি দেখলেন এক অতিমানবিক অবয়ব—পেশীবহুল দেহ, ফুলে ওঠা বাইসেপ, প্রশস্ত বুক, দৃঢ় চোয়াল, আর চোখে এক অদম্য আত্মবিশ্বাস—যেন শক্তি আর সংকল্পের এক জীবন্ত প্রতীক। সেই মুহূর্তেই আর্নল্ডের ভিতরে কোথাও যেন আগুন জ্বলে উঠল। তার মনে তৈরি হলো কয়েকটি সাহসী স্বপ্ন—“আমি হবো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বডিবিল্ডার। আমি আমেরিকায় যাব। আমি হবো হলিউড তারকা।”
অস্ট্রিয়ার সেই গ্রামের লোকেরা হাসলেন। তারা বডিবিল্ডিং চেনেন না, আর হলিউড তো যেন অন্য এক গ্রহ! কিন্তু আর্নল্ড থামলেন না—তার স্বপ্নের ছবিটাই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চললো। শুরু করলেন পাগলের মতো অনুশীলন — ভোর, রাত, খালি সময়… সবসময় —কখনও নিজের বানানো ওজন দিয়ে, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দৌড়ে, আবার কখনও আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভঙ্গিমা অনুশীলন করে। মনের ভিতরে একেবারে স্পষ্ট ছবির মত ভবিষ্যতের নিজেকে দেখে চললেন।
১৮ বছর বয়সে বাধ্যতামূলকভাবে তাকে যোগ দিতে হলো সামরিক বাহিনীতে। ইউনিফর্ম, শৃঙ্খলা আর কড়া রুটিন তার স্বপ্নকে চাপা দিতে পারলো না। অন্য ক্যাডেটরা যখন আট ঘণ্টার কড়া প্রশিক্ষণের পর বিছানায় ঢলে পড়তেন, আর্নল্ড তার পরেও অতিরিক্ত তিন ঘণ্টা ট্রেনিং করতেন। অন্যরা যখন ভোরে বিছানা ছাড়তে লড়াই করতেন, তিনি ৫টার আগেই পুশ-আপ, চিন-আপ, সিট-আপ শেষ করে ফেলতেন। এরপর এলো তার জীবনের মোড় ঘোরানোর এক সুযোগ। গোপনে সেনাশিবির থেকে পালিয়ে তিনি ‘জুনিয়র মিস্টার ইউরোপ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে জার্মানির স্টুটগার্টে পৌঁছে গেলেন। মঞ্চে আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এমনভাবে প্রদর্শন করলেন—যেন তার সবকিছুই ওই এক মুহূর্তের উপর নির্ভর করছিল। ফলাফল—প্রথম স্থান, আর সেই সঙ্গে খুলে গেল তার ভবিষ্যতের দরজা। তিনি পাড়ি দিলেন তার স্বপ্নের দেশ-আমেরিকায়। এবার লক্ষ্য আরও বড়, আরও কঠোর প্রশিক্ষণ নিলেন। ১৯৭০ থেকে ৭৫— একটানা ছ’বার এবং আবার ১৯৮০-তে জয় করলেন বিশ্বের সেরা বডিবিল্ডার—'মিস্টার অলিম্পিয়া’ খেতাব।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়— এ তো শুধু প্রথম অধ্যায়!
বডিবিল্ডিংয়ের পর আর্নল্ড চোখ রাখলেন হলিউডে। হলিউডে প্রথমে তাকে খোঁচা দেওয়া হতো, কেউ তার উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করলেন, কেউ তার অভিনয় নিয়ে খারাপ সমালোচনা করলেন, এমন কী অনেক চলচিত্র পরিচালক বলেই দিলেন, “তোমাকে দিয়ে অভিনয় হবে না।” কিন্তু আর্নল্ড মনে মনে তাদের বলতেন—“তোমরা আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেওয়ার কেউ নও, আমিই আমার ভবিষ্যত।” শুরুতে, কয়েকটা ছোট ভূমিকায় অভিনয় করলেন, তারপর এল Hercules Goes to New York এবং Conan the Barbarian—আর সেখান থেকেই জন্ম নিলেন অ্যাকশন আইকন আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। এরপর একের পর এক ব্লকবাস্টার ছবি—সব মিলিয়ে ৫১টি ছবিতে অভিনয় করলেন। এর পরেও আর্নল্ড থামলেন না।
২০০৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন, ২০১১ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। চ্যালেঞ্জ ছিল প্রচুর, কিন্তু তার নাম–প্রভাব–পরিশ্রম তাকে রাজনৈতিক মঞ্চেও সফল করল। পরে আবার ফিরলেন সিনেমায়, পাশাপাশি শুরু করলেন সমাজকল্যাণমূলক কাজ, পরিবেশ সচেতনতা ও ফিটনেস প্রচার।
বডিবিল্ডিং থেকে হলিউড, সেখান থেকে রাজনীতি—আর্নল্ড নিজের জীবনকে বারবার নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন। বিশাল দেহ আর শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের কারণেই “অস্ট্রিয়ান ওক”— নামে বিশ্ব তাকে মনে রেখেছে।
ইতিহাস সাক্ষী আছে, আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার একা নন —আরও বহু সফল ব্যক্তি এই রকম অসাধারণ পরিবর্তনের পথে হেঁটেছেন। মুহাম্মদ আলি (বক্সিং), হেনরি ফোর্ড (মোটর গাড়ি), মাইকেল ফেলপ্স (সাঁতার), স্টিভ জবস (হোম কম্পিউটার ও স্মার্টফোন), মাইকেল জর্ডান (বাস্কেটবল), অফ্রা উইনফ্রে (টক শো), এলন মাস্ক (পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট ও ইলেকট্রিক গাড়ি)—এরা সবাই পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন, কারণ তারা এমন এক গোপন শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন, যা আমাদের চোখের সামনেই থাকে কিন্তু আমরা বেশিরভাগই তা বুঝে উঠতে পারি না।
এখন প্রশ্ন হলো—বিশ্বমানের সফল ব্যক্তিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পার্থক্য কোথায়?
আমরা ভাবি সাফল্যের জন্যে চাই স্থির লক্ষ্য, পরিশ্রম, প্রতিভা, ও ধৈর্য। কিন্তু আছে আরেকটি গোপন হাতিয়ার— নিজের ভবিষ্যতকে আগেভাগে মনে মনে দেখার ক্ষমতা। এটা শুধু গল্প নয়; গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর শক্তিশালী কল্পনাকে প্রায় একইভাবে গ্রহণ করে। তাই ভবিষ্যতের সাফল্যকে বারবার কল্পনা করলে মস্তিষ্ক এমন সব নতুন স্নায়ু-সংযোগ তৈরি করে, যা আমাদের লক্ষ্যের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই মানসিক অনুশীলনটিকেই বলা হয় মনের চোখে দেখা (visualisation) — নিজেকে ভবিষ্যতের সফল মুহূর্তে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে আগেভাগে অনুভব করে নেওয়া। খেলাধুলা থেকে ব্যবসা, বিজ্ঞান থেকে শিল্প— সব ক্ষেত্রের সেরা ব্যক্তিরা নিঃশব্দে এই শক্তিকেই কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তুলেছেন।
ভালো খবর হলো—বিশ্বাস আর চেষ্টা থাকলে এটা সবাই করতে পারে। শুরু করা যায় খুব সহজ কয়েকটি উপায়ে—নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী ম্যাগাজিন বা ইন্টারনেট থেকে ছবি কেটে নিজের স্বপ্নগুলোকে চোখের সামনে সাজিয়ে রেখে, বা চোখ বন্ধ করে কোন অডিওর নির্দেশে ধাপে ধাপে কল্পনার জগতে হেঁটে, বা প্রতিদিন সকালে একটি ইতিবাচক বাক্য উচ্চারণ করে সেই কথাটি সত্যি হওয়ার দৃশ্য মনে মনে এঁকে, কিংবা চোখ বন্ধ করে ও মনকে স্থির করে প্রকৃতির শান্ত কোনো দৃশ্য খুব স্পষ্টভাবে কল্পনা করে। এ’সব ছোট অনুশীলন মনের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলে ধীরে ধীরে স্বপ্নকে আরও স্পষ্ট করে তোলে এবং স্বপ্নগুলোকে ধীরে ধীরে বাস্তবের কাছে ঠেলে দেয়।

No comments