নিঃশব্দে চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার বিধান রায়
রাত ১১টায় দূর্গাচক মহকুমা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।গতকাল রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের নাট্যজগতের এক অজেয় যোদ্ধা, শতকরা একশো ভাগ বধির ন…
নিঃশব্দে চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার বিধান রায়
রাত ১১টায় দূর্গাচক মহকুমা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।গতকাল রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের নাট্যজগতের এক অজেয় যোদ্ধা, শতকরা একশো ভাগ বধির নাট্যকর্মী ও পরিচালক বিধান রায়। যাঁর জীবন ছিল নাটকের প্রতি অক্ষয় ভালোবাসা আর অমোঘ সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় কাব্য। দু’ই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামসহ সমগ্র অঞ্চলের নাট্যপ্রেমীদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আপনজ একজন অভিভাবকের মতো। তাঁর এই অকাল প্রয়াণে নাট্যজগতে যেন এক অপূরণীয় শূন্যতা নেমে এসেছে।
১৯৫৬ সালে মেদিনীপুর সদর হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন বিধান রায়। পিতা রমণীমোহন রায় ছিলেন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের কর্মী এবং মাতা সবিতা দেবী। মেদিনীপুর কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন তিনি। কর্মসূত্রে হলদিয়ায় চলে আসেন এবং সেখানেই নাটক ও শিল্পের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। হলদিয়ার সুতাহাটা বাজারে ‘আঁকালেখা’ নামে তাঁর নিজস্ব শিল্পকর্মশালা ছিল। বধিরতা তাঁকে কখনো থামাতে পারেনি। ১৯৭০-এর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে নাটক মঞ্চস্থ করা ছিল চরম সাহসের কাজ। তাঁর নাট্যদল বহুবার দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। খড়্গপুরের উদয়সংঘ মঞ্চ থেকে ফেরার পথে চৌরঙ্গী মোড়ে বেদম প্রহার, মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর স্মৃতি মঞ্চে বা বটতলার মুক্তমঞ্চে ‘সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা’ নাটকের সময় হামলা, মারপিট ও গালাগালি সত্ত্বেও নাটক থামেনি। জনসমর্থনে নাটক চলেছে জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে ‘কালো রোডেশিয়া’ (৪০০তম মঞ্চায়ন), ‘সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা’, ‘মড়া’, ‘কালো ভূতের বজ্জাতি’, ‘সূর্য তৃষ্ণা’, ‘ম্যাজিশিয়ান মিস্টার ফক্স’, ‘এই সময়’, পথনাটক ‘এক মোহনার বাঁশি’, ‘আবীরে রাঙানো প্রভাত’ প্রভৃতি। ‘কালো রোডেশিয়া’য় ৬৫ জন শিল্পীর পরিশ্রমের ফলে এটি মাইলফলক স্পর্শ করে। এই নাটকেই তাঁর ১১ মাসের পুত্র যীশু রায়কে অভিনয়ে নামান, কিন্তু হলদিয়ার যুব উৎসবে অসাবধানতায় মারাত্মক আঘাত পেয়ে যীশু প্রাণ হারায়। এই অকালমৃত্যু তাঁর জীবনকে তোলপাড় করে দেয়।
তবু থেমে থাকেননি। ‘ম্যাজিশিয়ান’ নাটকে মাথায় ছুরি ঢুকে গেলেও রক্ত ঝরতে ঝরতে সংলাপ বলে গেছেন—মহিষাদলের দর্শকরা সেই দৃশ্য দেখেছেন। কলকাতার শিশির মঞ্চ, মিনার্ভা, মোহিত মঞ্চ, ব্যারাকপুরের সুকান্ত সদনসহ চব্বিশ পরগনার বহু মঞ্চে তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। নিজের হাতে আঁকা পোস্টার ও ব্যানারের শৈল্পিকতা নাট্যপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে।
নাটকের জন্য একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন—২০০৪, ২০০৫, ২০১৪, ২০১৬-১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সম্মান, শ্রেষ্ঠ নাট্যপরিচালকের খেতাব, হলদিয়া উৎসবে দু’বার ‘নাট্যরত্ন’, মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি ও বজবজ পৌরসভা থেকে শ্রেষ্ঠ শিল্পী-নাট্যকারের সম্মান। বর্তমানে ‘সমস্যা নাট্য গোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার ছিলেন তিনি। অভিজিৎ-এর সাহায্যে স্কুলে শিশুদের নাটক শেখাতেন। নিজের কথায়, “নাটক আমার রক্তে। জীবনের পরম প্রিয় সন্তানকে নাটকের জন্য হারিয়েছি। নাটক আর ছবিতেই সমাহিত হতে চাই।”
বিধান রায়ের অবদান চিরস্মরণীয়। তাঁর প্রয়াণে নাট্যজগত হারাল এক অজেয় যোদ্ধাকে। তাঁর স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। তাঁর একটা ডায়েরি ছিল। দেখা হলেই বলতেন, এখানে কিছু লিখে রাখো। কত কী লিখতাম। হে জাদুকর। ভালো থেকো। বিধান বাবুর বিধেই আত্মার শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই হলদিয়া বন্দর পত্রিকা পরিবারের তরফ থেকে।

No comments