পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ফুলের গবেষণাগার বা হাব গড়ে তোলা সহ ৯ দফা দাবীতে ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ীদের জেলা দপ্তরে স্মারকলিপি পেশসংবাদদাতা-নারায়ণ চন্দ্র নায়ক : পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ফুলের একটি গবেষণাগার বা হাব গড়ে তোলা সহ ৯ দফা দাবীতে প…
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ফুলের গবেষণাগার বা হাব গড়ে তোলা সহ ৯ দফা দাবীতে ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ীদের জেলা দপ্তরে স্মারকলিপি পেশ
সংবাদদাতা-নারায়ণ চন্দ্র নায়ক : পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ফুলের একটি গবেষণাগার বা হাব গড়ে তোলা সহ ৯ দফা দাবীতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে আজ জেলা শাসক ও হর্টিকালচার দপ্তরে ডেপুটেশন ও স্মারকলিপি পেশ করা হয়। অতিরিক্ত জেলা শাসক(উন্নয়ন) নেহা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জেলা হর্টিকালচার দপ্তরের সহ অধিকর্তা অঞ্জন দাস স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন,সমিতির সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র নায়ক,বিশ্বনাথ ভক্তা,দেবব্রত কোলে,দিলীপ প্রামাণিক,পরিমল মাইতি,ইন্দ্রজিৎ কোলে প্রমুখ।
নারায়ণ চন্দ্র নায়ক বলেন,পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সারা রাজ্যের ফুলচাষের মানচিত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জেলার কোলাঘাট-পাঁশকুড়া-শহীদ মাতঙ্গিনী-তমলুক সহ বেশ কয়েকটি ব্লকে ফুল ও বাহারি পাতার চাষ হয়। জেলায় রজনীগন্ধা-গাঁদা-বেল-জুঁই-পদ্ম-চন্দ্রমল্লিকা-গোলাপ-দোপাটি- অপরাজিতা-জবা সহ বিভিন্ন মরশুমি ফুল ও বিভিন্ন ধরনের বাহারি পাতার চাষ হয়। পাঁশকুড়া ব্লকে 'করণ' নামে একটি ফুলের চাষ হয়,যা পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও হয় না। একটা সময় পাঁশকুড়ার গোলাপ এবং চন্দ্রমল্লিকা ভিন রাজ্যের পাশাপাশি অন্যদেশেও রপ্তানি হোত। পাঁশকুড়া ব্লকের ক্ষীরাই স্টেশন সংলগ্ন দোকান্ডা এলাকায় কাঁসাই নদীর ভেতরে দু পাশের চরে ব্যাপক মরশুমি ফুলের চাষ হওয়ার কারনে যা 'ফুলের উপত্যকা' হিসাবে বর্তমানে রাজ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে শীতের মরশুমে ওই স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। জেলায় রয়েছে-দেউলিয়া ও কোলাঘাটে দুটি বড় ফুলের বাজার। কোলাঘাট ফুলবাজারটি রাজ্যের দ্বিতীয় এবং দেউলিয়া ফুলবাজারটি তৃতীয় ফুলবাজার হিসাবে পরিচিত। এছাড়াও পাঁশকুড়া ব্লকে পাঁশকুড়া-কেশাপাট-গোঁসাইবেড়-পঞ্চমদুর্গা-যশোড়া-নস্করদিঘী সহ আরো কয়েকটি ছোট ফুলের বাজার রয়েছে।
অন্যদিকে কোলাঘাট ফুলবাজার বসে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের কোলাঘাট স্টেশনের ডাউন এক নম্বর প্লাটফর্মের নীচে খাদের এক কোণে মাত্র ১৪৬৯ বর্গ মিটার এলাকায়। রেল দপ্তর প্রতি চাষীর কাছ থেকে ১০ টাকা,ফুলব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২৫ টাকা ও দোকানদারদের কাছ থেকে ৪০ টাকা করে 'ফেরিওয়ালা' টিকিট বাবদ অর্থ আদায় করলেও বাজারে নেই তেমন কোন পরিষেবার ব্যবস্থা। এই বাজারটি বসে ভোর তিনটে থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত। বাজারটিতে দুই মেদিনীপুর জেলা ছাড়াও হাওড়া জেলার প্রায় তিন থেকে চার হাজার ফুলচাষী ফুল বিক্রির কারণে আসেন।
দেউলিয়া ফুলবাজার বসে ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে। জাতীয় সড়কের পাশেই ছোট্ট একটি ভাড়া করা জায়গায় কয়েকজন ফুলের আড়তদার বসে। বাজারটিতে দুই মেদিনীপুর জেলা ছাড়াও হাওড়া জেলার দুই থেকে তিন হাজার ফুলচাষী ফুলবিক্রির কারণে আসেন। এই বাজারটি বসে ভোর তিনটে থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত। জাতীয় সড়কের ধারে বাজারটি বসার কারণে নিয়ত দুর্ঘটনার কবলে পড়ত ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ীরা। সে কারণে ওখানকার চাষী-ব্যবসায়ীদের দাবী ছিল,বাজারটি রাস্তা সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী স্থানে সরানোর। ওই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে তৎকালীন জেলাশাসক ডাঃ রশ্মি কমলের উদ্যোগে কোলাঘাট ব্লক অফিসে ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ী এবং আড়তদারদের নিয়ে বৈঠক করে ওই বাজার থেকে আনুমানিক ৫০০ মিটার দূরে ন্যাশনাল হাইওয়ের খাদ ভরিয়ে বাজারটি স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত হয়। সেইমত ওই স্থানে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহযোগিতায় একটি নতুন ফুলবাজার গড়ে তোলা হয়েছে। যা গত দু বছর আগে নির্মাণকার্য শেষ হলেও আজো চালু হয়নি।
নারায়ণবাবু আরো বলেন,পাঁশকুড়া ব্লকের নারান্দায় একটি ছোট হিমঘর সহ সরকারি ফুলবাজার রয়েছে। লকডাউন পিরিয়ড থেকে হিমঘরের যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাওয়ার কারণে হিমঘরটি বন্ধ থাকলেও গত ১লা ডিসেম্বর থেকে সেই হিমঘরটি আবার নবরূপে চালু হয়েছে।
এছাড়াও তমলুক ব্লকের একটি বিরাট অংশে অ্যাসপ্যারাস,বটলব্রাশ,ঘোড়াপাম প্রভৃতি নানা ধরনের বাহারিপাতার চাষ হলেও ব্লকে নেই কোন ওই পাতা বিক্রির বাজার। ওই চাষ সংশ্লিষ্ট রাধামনিতে হর্টিকালচার দপ্তরের একটি অব্যবহৃত পান বাজারের শেড রয়েছে। এলাকার বাহারি পাতাচাষীরা ওই মার্কেট শেডটিতে পাতা বিক্রির বাজার হিসাবে চালু করবার দাবী জানালেও আজও তা চালু হয়নি।
এ জেলার প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক পরিবার ফুলচাষকে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। অথচ ওই ফুলচাষীরা বেশিরভাগই এখনো মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে মূলতঃ সার ও কীটনাশক ঔষধ কোম্পানিগুলির এজেন্ট বা দোকানদারদের পরামর্শেই ঐ চাষ করে। বর্তমানে জেলায় হর্টিকালচার দপ্তরের জেলা অফিস থাকলেও ব্লকগুলিতে নেই,ওই অফিসের শাখা অফিস বা হর্টিকালচারিষ্টের উপস্থিতি। ফুল আজও কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা "কৃষিপণ্য" হিসাবে স্বীকৃত নয় বলে,বন্যা সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষের ব্যাপক ক্ষতি হলেও ফুলচাষীরা পায় না কোন ক্ষতিপূরণ বা বিমার সুযোগ। এছাড়াও চাহিদা অনুসারে উৎপাদন যখন বেশি থাকে,বেশিরভাগ চাষী ফুল ফেলে দিতে বাধ্য হয়। এ জেলার ফুল ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে সুষ্ঠুভাবে পাঠানোর জন্য নেই রেল ও বিমানে 'কোটা' পদ্ধতি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফুলচাষী ও ফুলব্যবসায়ীদের উপরোক্ত সমস্যা নিরসনে আজকের স্মারকলিপি মারফত জেলার নবনিযুক্ত জেলা শাসক শ্রী ইউনুস ঋষিন ইসমাইল মহাশয়কে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।
প্রস্তাবগুলি হোল-
১) ফুলকে "অর্থকরী কৃষিপণ্য" হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লেখার পাশাপাশি চাপ সৃষ্টির জন্য রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ যাহাতে বন্যা সহ সমস্ত রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফুলচাষীরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা ফসলবিমার সুযোগ পেতে পারে।
২) জেলার ফুলচাষ সংশ্লিষ্ট অন্তত একটি স্থানে সমস্ত রকম সুবিধাযুক্ত ফুলের গবেষণাগার বা 'হাব' নির্মাণ।
৩) জেলার ফুলচাষ সংশ্লিষ্ট সমস্ত ব্লকগুলিতে হর্টিকালচারিষ্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
৪) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফুল পাঠানোর জন্য রেল ও বিমানে "কোটা" পদ্ধতি চালু করার জন্য চিঠি লেখার পাশাপাশি চাপ সৃষ্টির জন্য রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ।
৫) নষ্ট হয়ে যাওয়া ফুল থেকে সুগন্ধি,ভেষজ রঙ,আবির সহ সমস্ত রকম উপজাত সামগ্রী তৈরীর বন্দোবস্ত।
৭) জেলার দেউলিয়া বাজার সংলগ্ন পানশিলায় সরকারি উদ্যোগে নির্মিত ফুলবাজারটি অতি সত্বর চালু সহ ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের দেউলিয়ায় বন্ধ হয়ে থাকা আন্ডারপাস নির্মাণের কাজ অবিলম্বে শুরু করে যত দ্রুত সম্ভব তা শেষ। রাধামনিতে হর্টিকালচার দপ্তরের অব্যবহৃত পানবাজারটি বাহারি পাতার বাজার হিসাবে চালু।
৮) জেলার কোলাঘাট স্টেশন সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের জায়গায় বসা বাজারটিকেও আধুনিক মানের ফুলবাজার হিসেবে গড়ে তুলতে রেল দপ্তরকে চিঠি লেখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি।
৯) ফুলচাষের সামগ্রিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ক্লাস্টার্স স্কিমে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন প্রভৃতি। আধিকারিকবৃন্দ দাবীগুলির যৌক্তিকতা স্বীকার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।

No comments