Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

একটি কথিত ভুল অনুবাদ: হিরোশিমা ও নাগাসাকির ট্র্যাজেডি— আশিস কুমার পন্ডা

একটি কথিত ভুল অনুবাদ: হিরোশিমা ও নাগাসাকির ট্র্যাজেডি— আশিস কুমার পন্ডা
যোগাযোগই (communication) মানবসম্পর্কের মূল যোগসূত্র, আর তার সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে আমরা কতটা দক্ষতার সঙ্গে আমাদের ভাবনাগুলিকে ভিন্ন মানুষ ও প্রেক্ষাপটের উপ…

 




একটি কথিত ভুল অনুবাদ: হিরোশিমা ও নাগাসাকির ট্র্যাজেডি— আশিস কুমার পন্ডা


যোগাযোগই (communication) মানবসম্পর্কের মূল যোগসূত্র, আর তার সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে আমরা কতটা দক্ষতার সঙ্গে আমাদের ভাবনাগুলিকে ভিন্ন মানুষ ও প্রেক্ষাপটের উপযোগী করে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতে পারি —তার উপর। প্রখ্যাত চীনা-মার্কিনি লেখক কেন লিউ একবার বলেছিলেন, “Every act of communication is a miracle of translation.” অর্থাৎ, প্রতিটি যোগাযোগই এক একটি অনুবাদের বিস্ময়। আমরা যখন একই ভাষায় কথা বলি, তখনও এক অর্থে আমরা অনুবাদ করে চলি — ভাবনা থেকে শব্দে, উদ্দেশ্য থেকে প্রকাশে, এবং এক মন থেকে আরেক মনে। এই অদৃশ্য অনুবাদ আরও গভীর হয়ে ওঠে ভাষাগত অনুবাদে, যেখানে কাজটি শুধু শব্দ বদল নয়, বরং এমন নিখুঁতভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া, যাতে পৃথিবীর অপর প্রান্তের মানুষ প্রেরকের মনের কথা পড়তে পারেন। এই শিল্পে নিপুণতার জন্য যেমন প্রয়োজন হয় ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গভীর জ্ঞান — তেমনি প্রয়োজন হয় প্রসঙ্গ, অনুভূতি ও প্রতিটি শব্দের উদ্দেশ্য বোঝার সংবেদনশীলতা।


বহুভাষিক এই পৃথিবীতে অনুবাদের গুরুত্ব আমাদের ধারণার থেকেও অনেক গভীর। তবুও, যত যত্নেই করা হোক না কেন, অনুবাদ কখনও কখনও বিচ্যুত হতে পারে। একটি মাত্র ভুল অনুবাদ অর্থ বিকৃত করতে পারে, উদ্দেশ্য বদলে দিতে পারে, এমনকি ঘটনাপ্রবাহও পাল্টে দিতে পারে। কখনও এমন ভুল কেবল বিব্রতকর বা হাস্যকর হয় — যেমন, কেএফসি’র (KFC) চীনা বিজ্ঞাপনে “Finger Lickin’ Good” (আঙুল চাটার মত সুস্বাদু) বাক্যটি ভুলবশত অনুবাদ হয়েছিল “Eat your fingers off” (তোমার আঙুলগুলো খেয়ে নাও)। কিন্তু, যখন চিকিৎসা, কূটনীতি বা যুদ্ধের ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ ভুল পথে যায়, তখন একটি ভুল শব্দ জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। ইতিহাস সাক্ষী আছে, এমন এক ভুল অনুবাদ একবার মানবসভ্যতার গতিপথই পাল্টে দিয়েছিল।


১৯৪৫ সাল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক মোড় পরিবর্তনের বছর। মিত্রশক্তি তখন ইউরোপে প্রায় চূড়ান্ত জয়ের পথে, অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে তারা এগিয়ে চলেছিল জাপানের বিরুদ্ধে — যে দেশ তখন প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থায়। ছয় বছর ধরে চলা যুদ্ধে পৃথিবীজুড়ে অজস্র প্রাণহানি ও অগণিত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে জার্মানির পটসডাম শহরে মিত্রশক্তির নেতাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ জুলাই, ১৯৪৫ — আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন এক যৌথ ঘোষণায় (পটসডাম ঘোষণা) জাপানকে এক বার্তা পাঠায়: বার্তাটি ছিল স্পষ্ট ও কঠোর — “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করো, না হলে দ্রুত ও সম্পূর্ণ ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত হও।”


জাপানি সাংবাদিকরা যখন প্রধানমন্ত্রী কানতারো সুজুকিকে প্রশ্ন করলেন জাপানের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তিনি জানালেন — সরকার এখনো বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। এ সময় তিনি যে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তা হলো — ‘মোকুসাতসু’ (mokusatsu)। এক নজরে শব্দটি সহজ মনে হলেও, ‘মোকুসাতসু’ শব্দটির অর্থ জটিল ও বহুমাত্রিক। এটি দুটি কানজি (জাপানি চিহ্ন) নিয়ে গঠিত — “মোকু” মানে “নীরবতা,” “সাতসু” মানে “হত্যা।” একসঙ্গে এই শব্দটির সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে — “উপেক্ষা করা,” “চুপ থাকা,” “নীরবে অবজ্ঞা করা,” “মন্তব্য না করা,” বা “জ্ঞানী ও সংযমী নীরবতা রক্ষা করা।” দুর্ভাগ্যবশত, এই বিবৃতি যখন মিত্রশক্তির অনুবাদকদের কাছে পৌঁছায়, “মোকুসাতসু” শব্দটির অর্থ অনুবাদ করা হয় “ignore with contempt” — অর্থাৎ, “অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করা।” আর এই অনুবাদেই ঘটে বিপর্যয়।


মিত্রশক্তির নেতারা আশা করেছিলেন জাপান আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু এই অনুবাদ যখন তাদের সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন জাপানকে দেখা হয় এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অবজ্ঞাপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে। পরিস্থিতিকে তারা ধরে নেন জাপানের স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান হিসেবে। ফলত, মিত্রশক্তি তাদের দেওয়া সতর্কবার্তা — “Prompt and utter destruction” বা “দ্রুত ও সম্পূর্ণ ধ্বংস” — বাস্তবে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।


পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের প্রথম দু’টি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করল — জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। মুহূর্তেই মৃত্যু হল হাজার হাজার মানুষের; আহত ও গৃহহীন হলেন অসংখ্য মানুষ। বিস্ফোরণের অভিঘাতে মাইলের পর মাইল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। আর পরবর্তী প্রজন্ম টেনে চললো রেডিয়েশনজনিত অসুখ, ক্যানসার, ও জিনগত বিকৃতি। মানবসভ্যতা এমন ধ্বংস আগে কখনও দেখেনি। একটি মাত্র শব্দ — ‘মোকুসাতসু’ — যেন মুছে দিয়েছিল দুটি শহরের প্রাণচিহ্ন। পরবর্তীতে, জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে, এবং সেই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

শেষকথা: ইতিহাসবিদরা আজও বিতর্ক করে চলেছেন — ‘মোকুসাতসু’ ঘটনায় আসলে ঠিক কোথায় ভুল হয়েছিল, বা কে দায়ী ছিলেন। কিন্তু আসল শিক্ষা দোষ খোঁজায় নয়, বরং এই উপলব্ধিতে —যে, চরম উত্তেজনার মুহূর্তে একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝিও ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে। ‘মোকুসাতসু’ ঘটনা আমাদের এও মনে করিয়ে দেয় — মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়া আসলে কতটা ভঙ্গুর, এবং যখন শান্তি ও ধ্বংসের মাঝের সীমারেখা খুব সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে, তখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্পষ্টতা, সংযম ও সহমর্মিতা রাখা কতটা জরুরি!

No comments