অভিজ্ঞতার অসহায়তা (Learned Helplessness): পাতলা দড়ি আর মহাশক্তিশালী হাতি--আশিস কুমার পণ্ডাশহরের চিড়িয়াখানার এক নিরিবিলি কোণে, এক দর্শক এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে যান। এক বিশাল হাতি, যার এক ধাক্কায় গাছ উপড়ে যেতে পারে, সে এক ছ…
অভিজ্ঞতার অসহায়তা (Learned Helplessness): পাতলা দড়ি আর মহাশক্তিশালী হাতি--আশিস কুমার পণ্ডা
শহরের চিড়িয়াখানার এক নিরিবিলি কোণে, এক দর্শক এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে যান। এক বিশাল হাতি, যার এক ধাক্কায় গাছ উপড়ে যেতে পারে, সে এক ছোট কাঠের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাকে বাঁধার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে একটিমাত্র পাতলা দড়ি। না কোন শিকল, না কোন ভারী বাধা—তবুও হাতিটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মুক্ত হওয়ার কোন চেষ্টাই সে করছে না।
দর্শকটি কৌতূহলী হয়ে একজন রক্ষীকে প্রশ্ন করেন, “এই বিশাল হাতি তো এক টানে দড়িটা ছিঁড়ে ফেলতে পারে! তাহলে চেষ্টা করে না কেন?”
রক্ষীটি হেসে উত্তর দেন, “হাতিটির শক্তির কোন অভাব নেই। আসলে, হাতিটি যখন ছোট ছিল, তখনও এই একই দড়ি দিয়ে ওকে বেঁধে রাখা হতো। ও তখন এতটা শক্তিশালী ছিল না, বহুবার দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চেয়েছে, কিন্তু, পারেনি। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর ও বিশ্বাস করে নিয়েছে যে এই দড়ি ও কোনদিন ছিঁড়তে পারবে না। তাই হাতিটি ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন, হাতিটি বড় হয়েছে, অনেক শক্তিশালী হয়েছে—তবুও সেই পুরানো বিশ্বাস ওর মনে গেঁথে আছে যে এই দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখন ও আর চেষ্টা করে না।”
এই ছোট্ট ঘটনাটাই তুলে ধরে এক গভীর মনস্তত্ত্ব—‘অভিজ্ঞতার অসহায়তা’ (Learned Helplessness)। যখন কোন ব্যক্তি বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হন বা নিজেকে বারবার অসহায় অনুভব করেন, তখন ধীরে ধীরে তিনি নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস হারান। তাই, তিনি একেবারেই চেষ্টা করা ছেড়ে দেন। এমনকি পরে যখন সেই বাধাগুলি আর নাও থাকে, তখনও তিনি আর চেষ্টা করেন না। গল্পের ছোট হাতিটির কাছে দড়ির বাঁধন ছিল অজেয় এক বাধা, কিন্তু বড় হাতিটির কাছে সেই দড়ি হয়ে উঠেছে এক মানসিক বিভ্রম। দড়ি তাকে আটকে রাখেনি, তাকে আটকে রেখেছে তার অভিজ্ঞতার অসহায়তা-তার পুরানো ব্যর্থতার স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা।
আমরাও এর ব্যতিক্রমী নই। আমাদের মধ্যে অনেকেই এমনই দড়িতে বাঁধা পড়ে থাকি। পুরানো ব্যর্থতা, অপমান, প্রত্যাখ্যান, অথবা বারবার হেরে যাওয়ার স্মৃতি- এই সব ‘অদৃশ্য দড়ি’ আমাদের এগিয়ে যেতে বাধা দেয়, টেনে ধরে রাখে অতীতের গণ্ডিতে।" আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি, “আমি কখনোই পারবো না”, “এটা আমার জন্য নয়”, বা “আমি তো আগেও অনেকবার বিফল হয়েছি”—আর এভাবেই একসময় আমরা থেমে যাই। অথচ বাস্তবতা হলো—আমরাও হাতির মতো বড় হয়েছি, শক্তিশালী হয়েছি, এবং পরিস্থিতিও বদলেছে। কিন্তু যদি আমরা সেই পুরনো বিশ্বাসগুলিকে এখনো স্বীকৃতি দিয়ে যাই, তাহলে আমরা আটকেই থাকব—বাস্তবের বাধায় নয়, বরং অতীতের স্মৃতির শিকলে।
এক ছাত্র ক্লাসে কথা বলতে ভয় পায়, কারণ একসময় তার কথায় সহপাঠীরা হেসে উঠতো। গরীবের বাড়িতে বেড়ে ওঠা সন্তান ভাবে, ধনী হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। ‘ধীরগতি’র তকমা পাওয়া এক ছাত্র তার আত্মবিশ্বাস চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলে। একজন চাকরি প্রার্থী বারবার বিফল হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। এ সবই একেকটি ‘অভিজ্ঞতার অসহায়তা’-এর গল্প। কিন্তু আশার কথা হলো—এই মানসিকতা বদলানো সম্ভব। সঠিক সহায়তা, উৎসাহ, সহানুভূতি এবং ছোট ছোট সাফল্য একজন মানুষকে পুরানো সীমাবদ্ধতার বিশ্বাস থেকে মুক্ত করে আনতে পারে। বিশ্বাস বদলে গেলে, জীবনের গতিও বদলে যায়।
যদি আপনি এক সময়কার কোন ব্যর্থতা বা আঘাতের কারণে আজ থেমে থাকেন, তাহলে নিজেকে আবার নতুন করে দেখুন। আপনি এখন আর সেই আগের মানুষ নন, যিনি বারবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। আপনি এখন বড় হয়েছেন, অনেক এগিয়েছেন, অনেক কিছু শিখেছেন। তাই, হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে, গল্পের হাতিটির কথা মনে করুন। যে দড়ি শৈশবে তার কাছে বাস্তব ছিল, আজ তা কেবলই এক বিশ্বাসের বন্ধন। পুরানো সেই বিশ্বাস ছিঁড়ে ফেলুন। সাহস করে সামনে এগিয়ে যান। আপনার অতীতের ব্যর্থতা, আঘাত বা সীমাবদ্ধতাকে নিজের ভবিষ্যতের পথে বাধা হতে দেবেন না। আপনার এখনকার বাধার চেয়ে আপনি অনেক বেশি শক্তিশালী। আবার চেষ্টা করুন। আর এবার—থেমে যাবেন না।
No comments