গয়াধাম বাঙালির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি তীর্থ। মূলত বৈষ্ণব তীর্থ হিসেবে, বিষ্ণুপদ মন্দিরের জন্য এবং ফল্গু নদীর তীরে পিণ্ডদানের রীতির জন্যই আজ আমরা গয়াধামকে চিনি। এই গয়াধামেই শ্রীচৈতন্যদেব ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষিত হয়েছিলেন। আ…
গয়াধাম বাঙালির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি তীর্থ। মূলত বৈষ্ণব তীর্থ হিসেবে, বিষ্ণুপদ মন্দিরের জন্য এবং ফল্গু নদীর তীরে পিণ্ডদানের রীতির জন্যই আজ আমরা গয়াধামকে চিনি। এই গয়াধামেই শ্রীচৈতন্যদেব ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষিত হয়েছিলেন। আবার অল্প দূরেই বুদ্ধগয়া বুদ্ধের বোধিলাভের স্থান রূপে সুবিখ্যাত। কিন্তু আমরা ভুলে যাই গয়াধামের মাতৃসাধনার এক সুদীর্ঘ এবং প্রাচীন পরম্পরা আছে।
মহাভারতের বনপর্বে গয়ার উদ্যত পর্বতশিখরে সতীর যোনিপীঠের উল্লেখ আছে। পরবর্তী সময়ের তন্ত্রশাস্ত্রে এই উদ্যতশিখর হয়েছে ভস্মকূট পর্বত, মা মঙ্গলাগৌরীর পীঠ। এখানে সতীর স্তন পড়েছিল বলে তন্ত্রের গ্রন্থগুলি জানাচ্ছে। অর্থাত সুদীর্ঘকাল ধরে গয়াধাম মাতৃপীঠ রূপে বিখ্যাত। এই গয়াধামেই আছে পঞ্চদশ শতকের মা বারাহী দুর্গার মন্দির। আর বিষ্ণুপদ মন্দিরের কাছেই আছে পালযুগের মা গয়েশ্বরীর মন্দির। আজ সেই মা গয়েশ্বরীর কথাই আলোচনা করব।
কালিকা বঙ্গদেশে চ অযোধ্যায়াং মহেশ্বরী
বারাণস্যাং অন্নপূর্ণা গয়াক্ষেত্রে গয়েশ্বরী!!
ব্রহ্মযামলের আদ্যাস্তোত্রে এভাবেই মা গয়েশ্বরীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। মা গয়েশ্বরীর সম্বন্ধে স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী সত্যযুগের যে গয়াসুরের নামে এই তীর্থের নাম, মা গয়েশ্বরী সেই গয়াসুরের কুলদেবী ছিলেন। এই কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মাতৃসাধনার সুপ্রাচীন ইতিহাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আজও মা গয়েশ্বরী এই অঞ্চলের স্থানেশ্বরী মাতৃকা রূপেই পূজিত হন।
মা গয়েশ্বরীর বিগ্রহ শিলাময়ী। অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী রূপে মা এখানে বিরাজিতা। পাদপীঠে নবগ্রহ খোদিত। সমস্ত জগতের শৃঙ্খলার তিনি একমাত্র ধারিকা। তাই গ্রহদের গতিও তাঁরই চরণাশ্রিত।
"তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে"
মায়ের বিগ্রহ পালযুগের শিল্পরীতিতে নির্মিত।
গুপ্তযুগের পর থেকেই অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বাংলার গৌড় সারস্বতদের কুলদেবী ছিলেন মা অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী। গয়েশ্বরী মাতৃকাও সেই মাতৃসাধনার স্বর্ণযুগের স্মৃতি বহন করছেন। মন্দিরের দেওয়ালে একটি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছিল যা সম্ভবত পালরাজা মদনপালের ছেলে গোবিন্দপালের। মন্দিরে মা পার্বতী, ভৈরব, লকুলীশ, উমা মহেশ্বর সহ বিভিন্ন প্রাচীন মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।
পালযুগ ও সেনযুগে এই মাতৃপীঠ বাঙালির সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত ছিল। তুর্কি পাঠান আক্রমণে গয়েশ্বরী মাতৃমন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৪৫৯ সালে বাংলার এক রাজা দেবীদাস চৌধুরী মায়ের মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর ১৮৪৪ সালে কলকাতার নারায়ণ ঘোষাল এই মন্দিরের সংস্কার করেন। গয়াধামের স্থানেশ্বরী, গয়ার গ্রামদেবী মা গয়েশ্বরীর পীঠ রক্ষায় এভাবেই বাঙালির পূর্বসূরিরা নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন।
No comments