কুয়াশার অন্ধকারে বিস্মৃত এক গোলরক্ষক -আশিস কুমার পন্ডা১৮৬০-এর দশকের শুরু থেকে ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত, ইংল্যান্ডে ক্রিসমাসের দিনটিতেই ফুটবল ম্যাচ খেলার এক ঐতিহ্যময় পরম্পরা ছিল। এক সামাজিক উৎসবের মতো, বিভিন্ন শহর ও গ্…
কুয়াশার অন্ধকারে বিস্মৃত এক গোলরক্ষক -আশিস কুমার পন্ডা
১৮৬০-এর দশকের শুরু থেকে ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত, ইংল্যান্ডে ক্রিসমাসের দিনটিতেই ফুটবল ম্যাচ খেলার এক ঐতিহ্যময় পরম্পরা ছিল। এক সামাজিক উৎসবের মতো, বিভিন্ন শহর ও গ্রামে এই সব স্থানীয় প্রতিযোগিতা বা ‘ডার্বি’ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে খেলোয়াড়রা মাঠে লড়াই করতেন এবং দর্শকরা উত্তেজনায় ভরপুর থাকতেন।
এই ধারাবাহিকতায়, ১৯৩৭ সালের এই দিনটি কিন্তু ইংল্যান্ডের ফুটবলের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেদিন যে এক অসাধারণ জয় বা কোন যুগান্তকারী বিপর্যয় ঘটেছিল, তা নয়, তবে সেদিনের এক অভিনব ও মর্মস্পর্শী ঘটনা আজও সকলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সেদিন, সকাল থেকেই লন্ডনের বেশির ভাগ জায়গা কনকনে ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়, যার ফলে শহর জুড়ে বেশ কয়েকটি ফুটবল ম্যাচ স্থগিত বা বাতিল করা হয়। কিন্তু, ঐতিহ্যবাহী স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ স্টেডিয়ামের চিত্র ছিল একেবারে অন্য রকম। কুয়াশার ঘনঘটা এখানে না থাকায়, স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীরা ঐতিহ্যবাহী 'লন্ডন ডার্বি' দেখার জন্য সকাল থেকেই স্টেডিয়ামে জড়ো হতে শুরু করেন। এই ম্যাচের প্রবল দাবীদার চেলসি এফসি খেলবেন তাদের নিজেদের মাঠে এবং বিপরীত দিকে কিংবদন্তি গোলরক্ষক স্যামুয়েল বার্ট্রাম, অধিনায়ক হিসাবে চার্লটন অ্যাথলেটিকের দলকে পরিচালনা করবেন। সমর্থকদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা, প্রিয় দল ও খেলোয়াড়দের কলা কৌশল দেখার জন্যে তারা খেলা শুরু হওয়ার অপেক্ষা করছেন।
খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই স্টেডিয়ামে কুয়াশার আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। দৃশ্যমানতা খারাপ হওয়ার কারণে, রেফারিকে বেশ কয়েকবার খেলা বন্ধ করে আবার চালু করতে হয়। খেলোয়াড়রা কোনমতে কুয়াশার ধোঁয়ার মধ্যে খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দলদুটি ১-১ গোলে সমতায় এসে যায়, কিন্তু, কুয়াশা এতটাই ঘন হয়ে যায় যে খেলোয়াড়রা একে অপরকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না। খেলার ঘন্টাখানেকের মাথায়, রেফারির কাছে খেলা বাতিল করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। তিনি খেলা শেষের লম্বা হুইশেল বাজিয়ে দেন এবং সবাই মাঠ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন।
দুর্ভাগ্যবশত মাঠের অন্য প্রান্তে, চার্লটনের গোলরক্ষক ও অধিনায়ক স্যাম বার্ট্রাম সমর্থকদের উল্লাস এবং চিৎকারের কারণে খেলা শেষের বাঁশি শুনতে পাননি। তিনি ভেবেছিলেন যে তার সতীর্থরা চেলসির গোলবক্সের কোথাও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। কুয়াশায় তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও, তিনি জানতেন যে গোলরক্ষক হিসাবে দলের জন্য তাকে সতর্ক থাকতে হবে। তাই তিনি হাঁটু ভাঁজ করে, শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে, সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে, স্থিরচোখে এমনভাবে প্রস্তুত ছিলেন, যেন, যে কোন মুহূর্তে এক অদৃশ্য বল তার গোলের দিকে ছুটে আসতে পারে। কনকনে ঠান্ডায়, সামান্য উষ্ণতার জন্য পা ছোঁড়াছুঁড়ি করলেও, মিনিটের পর মিনিট বারট্রাম তার গোলের সামনে মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রেফারির বাঁশি আর শোনা যাচ্ছিল না। দর্শকদের চিৎকার, ধীরে ধীরে দূরের প্রতিধ্বনির মতো, কুয়াশার গহন শূন্যতায় মিশে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই, মাঠে নীরবতা নেমে এলো। বারট্রামের তখনও কোনও সন্দেহ ছিল না যে তার বিলম্বিত একাকীত্বের অর্থ হল তার সতীর্থরা অন্য প্রান্তে ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন, সম্ভবত গোল করার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে, তিনি মাঠে একেবারে একা এবং এমন একটি গোল পাহারা দিচ্ছেন যাকে আর পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
মিনিট পনের পেরিয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই বারট্রামের একাকীত্ব শেষ হয়ে গেল। কুয়াশার অন্ধকার ভেদ করে এক ব্যক্তি তার কাছে এগিয়ে এলেন; তিনি ছিলেন মাঠের একজন পুলিশ অফিসার। অফিসার শান্তভাবে তাকে জানালেন যে ম্যাচটি কুয়াশার জন্যে বাতিল হয়েছে এবং খেলোয়াড়রা পনেরো মিনিট আগেই মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন। নির্বিকার বার্ট্রাম ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে লকার রুমের দিকে পা বাড়ালেন। তার সহকর্মীরা ইতিমধ্যেই স্নান সেরে, জামাকাপড় বদলে ফেলেছেন। বার্ট্রাম লকার রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তারা হাসি এবং উপহাসে ফেটে পড়লেন, তার শিশুসুলভ নির্দোষতার জন্য তাকে নিয়ে মজা করতে লাগলেন। বার্ট্রাম সতীর্থদের দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসলেন, কিন্তু একবারও প্রশ্ন করলেন না, কেন তার সতীর্থরা তাকে ভুলে গেলেন, যখন কুয়াশার মধ্যে তিনি একা তাদের গোল পাহারা দিচ্ছিলেন!
আজও, ‘স্যাম বার্ট্রামের কুয়াশার মধ্যে গোল পাহারা দেওয়া’ ফুটবল ভক্তদের কাছে খেলার ফলাফল কিংবা পরিসংখ্যানের বাইরে এক আবেগপূর্ণ কাহিনী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে; যেখানে একজন নিঃসঙ্গ ব্যক্তি অন্ধকার পরিবেশে অটল নিষ্ঠার সঙ্গে দলের জন্যে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ এই ঘটনাটিকে নিছক মজা বলে মনে করেন, কেউ বেচারা গোলরক্ষকের জন্য করুণা বোধ করেন, কেউ আবার লকার রুমে বার্ট্রামের অনুপস্থিতি লক্ষ্য না করার জন্য তার সতীর্থদের দায়ী করেন। কিন্তু প্রত্যেকেই গোলরক্ষকের উল্লেখযোগ্য মনোভাবের প্রশংসা করেন। এক ব্যক্তি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না, কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না, তবুও তিনি তার নিজের জায়গায় মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এক মুহূর্তের জন্যেও তার পাহারাতে ঢিল দেননি; তিনি জানতেন তার একটি কর্তব্য আছে, এবং পরিস্থিতি যাই হোক না কেন তিনি তা পালন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। পর্বের শেষেও, তার কোনও অনুশোচনা বা বিরক্তি ছিল না যে সতীর্থরা তাকে ভুলে গিয়ে, একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন, যখন তিনি তার দলের গোলপোস্ট পাহারা দিচ্ছিলেন!
গোলরক্ষক যেভাবে প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, ঠিক তেমনি কিছু বিশেষ মানুষ আমাদের জীবনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন যারা আমাদের স্বপ্ন এবং লক্ষ্য পূরণের জন্যে নেতিবাচক শক্তি থেকে আমাদের রক্ষা করেন। অন্যদিকে, যেভাবে গোলরক্ষক একটি গোল বাঁচানোর পর খেলাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যান এবং পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন, ঠিক সেইভাবে এইসব ব্যক্তিরা আমাদের নতুন সুযোগ কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পথ তৈরি করে দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এইসব ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা প্রায়ই আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায় এবং অনেক সময় তাদের প্রাপ্য গৌরব দিতে ভুলে যাই। তবুও, তাদের অবদানকে কোনমতেই ছোট করা যায় না। যখন পরিস্থিতি কুয়াশাচ্ছন্ন এবং অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, তখন আমরা রণে ভঙ্গ দিয়ে তাদের ভুলে গেলেও, এই গোলরক্ষকরা তাদের লক্ষ্যে অবিচল এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন, আশা করেন যে আমরা কুয়াশা পেরিয়ে সাফল্যের পথে ঠিক ফিরে আসব।
তাই, যারা আপনার স্বপ্ন রক্ষা করছেন, আপনার মঙ্গল কামনা করছেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে আপনাকে উৎসাহিত করছেন তাদের চিনে রাখুন, প্রশংসা করুন এবং তাদের প্রতি মনোযোগ দিন। এরাই হলেন আপনার জীবনের অখ্যাত নায়ক, নীরব শক্তি, যারা আপনাকে জীবনের খেলা জিততে সাহায্য করেন। এদের কখনোই অবহেলা বা ত্যাগ করা উচিত নয়, কারণ এরাই হলেন, আপনার জীবনের খেলার সত্যিকারের গোলরক্ষক।
No comments