সাইকেলের ব্রেক- আশিস কুমার পন্ডা
একজন শিক্ষক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন।শিক্ষকঃ তোমাদের সবারই সাইকেল বা মোটর সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। এই নিয়ে কোন দ্বিমত নেই যে ব্রেক হল যে কোন যানবাহন…
সাইকেলের ব্রেক- আশিস কুমার পন্ডা
একজন শিক্ষক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন।
শিক্ষকঃ তোমাদের সবারই সাইকেল বা মোটর সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। এই নিয়ে কোন দ্বিমত নেই যে ব্রেক হল যে কোন যানবাহনের অন্যতম প্রধান অংশ, যাকে বাদ দিয়ে যানটিকে ব্যবহার করা কার্যত সম্ভব নয়। কিন্তু, একটু ভেবে বলত, সাইকেলের ব্রেক ঠিক কিভাবে তোমাদের সাহায্য করে?”
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহী হোল না। কেউ কেউ আবার প্রশ্নটিকে অবান্তর মনে করে চুপ করে রইলো। একজন উতসাহী ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল, “স্যার। ব্রেক ছাড়া সাইকেল থামানো যাবে না। স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছেন, ব্রেক না কষলে সাইকেল চলতেই থাকবে।“
আরেকজন ছাত্র বললো, ”স্যার, সাইকেল থামানোর অনেক উপায় আছে। প্যাডেল বন্ধ করে দিলে সাইকেল কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে নিজে থেকেই থেমে যাবে। এ ছাড়া কোন দেওয়াল, খুঁটি বা অন্য কোন যানবাহনকে ধাক্কা দিয়ে সাইকেল থামাতে পারি। তবে, এতে আমাদের, সাইকেলের বা যার সঙ্গে ধাক্কা লাগবে সকলের ক্ষতি হতে পারে। তাই ব্রেক সাইকেলকে মুহূর্তের মধ্যে নিরাপদে থামাতে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করে।”
তৃতীয় ছাত্র উত্তর দিল, "স্যার, ব্রেক আমাদের ধীরগতিতে এবং নিয়ন্ত্রিত গতিতে সাইকেল চালাতে সাহায্য করে।"
বাকি কয়েকজন ছাত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই উত্তরগুলিই দিতে লাগলো। তাই শিক্ষক নিজেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, "ব্রেক কষে, যখনই প্রয়োজন ঠিক তখনই সাইকেলের গতি কমানো বা থামানো যায়। সাইকেলের উপরে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকা খুবই দরকার, যাতে আমরা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারি। তোমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে, তোমরা সবাই ঠিক উত্তর দিয়েছ। এক মুহুর্তের জন্য, ধরে নাও যে তোমাদের সাইকেলে কোন ব্রেক নেই। এই অবস্থায় তোমরা কত জোরে সাইকেল চালাতে চাইবে?" ঘন্টায় ১ কিলোমিটার? ঘন্টায় ১০ কিলোমিটার? নিরাপত্তার কথা মনে রেখে, ব্রেক ছাড়া কখনই সাইকেল চালানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। হয়তো কিছুদূর দ্রুতগতিতে তোমরা এগিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু এক সময় বুঝতে পারবে, ছুটন্ত সাইকেল তোমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই; দরকারের সময় গতি কমাতে বা থামাতে পারছো না। এই পরিস্থিতি হয়তো, কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তোমাকে বা অন্য মানুষকে ভয়ঙ্কর বিপদে ফেলে দিতে পারে।
জোরে সাইকেল চালানোর সময় হঠাৎ করে এক অপ্রত্যাশিত তীক্ষ্ণ বাঁক চোখে পড়লে তোমরা কি কর? একই গতি বজায় রেখে সাইকেল নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা কর? অবশ্যই না। কারণ তোমরা ভালো করেই জান, সাইকেল তার স্থায়িত্ব হারাবে এবং বাঁকের বিপরীত দিকে পিছলে যাবে বা রাস্তা থেকে ছিটকে যাবে। তাই, তোমরা সাইকেলের গতি কমিয়ে, রাস্তার দিকে মনোনিবেশ কর এবং হ্যান্ডেল শক্ত হাতে ধরে রাখো। তীক্ষ্ণ বাঁক পার করে সাইকেলের গতি আবার বাড়িয়ে দাও। একইভাবে, যখন তোমরা স্পিড ব্রেকার, ভিড় বা ট্রাফিক জ্যামের মুখোমুখি হও, প্রতিবারই তোমরা সাইকেলের গতি কমিয়ে নাও, নিরাপদে বাধা অতিক্রম করে এবং আবার গতি বাড়িয়ে নাও।
সুতরাং, আমার দৃষ্টিতে, সাইকেলের ব্রেক আমাদের গতি কমানো বা আবদ্ধ করে রাখার জন্য নয়। পরিবর্তে, ব্রেকের কারণেই আমরা ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে দ্রুতগতিতে সাইকেল চালানোর সাহস করি এবং কম সময়ে ও নিরাপদে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারি।"
ক্লাসে তখন পিন পতনের গভীর নীরবতা! শিক্ষকের এই শক্তিশালী যুক্তি ছাত্রদের চিন্তায় ফেলে দিল। হঠাৎ করে সাইকেলের ব্রেক যেন আরোহীদের আটকে রাখার বদলে, দ্রুতগতিতে এগিয়ে দেওয়ার কাজ করতে শুরু করলো। শিক্ষার্থীদের চোখ খুলে গেল, তারা নতুন করে সাইকেলকে আবিষ্কার করলো! ব্রেকের এমন এক শক্তির কথা তারা এর আগে কখনও ভাবেনি।
কিছুক্ষণ বিরতির পর শিক্ষক আবার বলতে শুরু করলেন, “ঠিক একইভাবে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, আমরা আমাদের মাতাপিতা, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, শিক্ষক, পরামর্শদাতা এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের আশীর্বাদ পাই যারা আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত তৈরি করে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই বিশেষ ব্যক্তিরা আমাদের ভালোবাসেন এবং আমাদের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে দিতে চান। আমাদের সবচেয়ে খারাপ সময়েও তারা আমাদের পাশে থাকেন। নিরলসভাবে তারা আমাদের জীবনযাত্রার গতি, অগ্রগতি এবং দিশা সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন, আমাদের বিচার করে, নানারকম সমালোচনা ও প্রশ্ন করেন। কিন্তু, সচরাচর, আমরা তাদের উপদেশবাক্য, সাবধানতা বা কঠিন প্রশ্নগুলিকে ব্রেক হিসাবে দেখি, কারণ সেগুলি আমাদের গতি কমিয়ে দেয়, বা আমাদের থামিয়ে দেয়। তারা এক গন্ডির মধ্যে আমাদের সীমাবদ্ধ করে রেখে আমাদের হতাশ করে দেয়। একটু অন্যভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই বিধিনিষেধগুলি আসলে শৃঙ্খল নয়, শৃঙ্খলা, যা আমাদের ঝুঁকি নিতে সাহায্য করে, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেয়! কারণ, কখনও কখনও আমাদের গতি কমাতে হয়, বিরতি দিতে হয় যাতে আমরা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারি! এই ধরনের প্রশ্ন এবং বিধিনিষেধের (পর্যায়ক্রমিক ব্রেক) কারণেই আজ আমরা নিরাপদে আমাদের কাঙ্ক্ষিত জীবনের গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছি। এই ব্রেকগুলি না থাকলে, আমরা পিছলে যেতে পারতাম, দিক হারাতে পারতাম বা দুর্ভাগ্যজনক কোন ঘটনার শিকার হতে পারতাম। এইভাবে, ব্রেকগুলি আমাদের এক অস্থায়ী সীমানার মধ্যে সুরক্ষিত করে রাখে এবং তারপরে আমাদের জন্য নতুন স্বাধীনতা উন্মুক্ত করে দেয়।
জীবন চাকার ঘূর্ণিপাকে আমরা সবাই ব্যস্ত। স্বপ্নপূরণের ব্যস্ত রাস্তায় প্রাণপনে ছুটতে গিয়ে, প্রায়শই আমরা আমাদের জীবনে শক্তিশালী ব্রেক প্রয়োগকারী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা এবং অকৃত্রিম মর্যাদা দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ি। এই মহামানবদের ঋণ কখনও শোধ করা যাবে না, তার চেষ্টাও করা উচিত নয়। তাদের ভূমিকাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়ে প্রশংসা করা উচিত। এটি করার সবচেয়ে ভালো উপায় হল আমাদের কাজের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা; তারা যে শিক্ষায় আমাদের প্রশিক্ষিত করেছেন, সেই শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা ও ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে আমরা তাদের ভুলিনি, তাদের ভালবাসি, তারা আমাদের প্রনম্য এবং তাদের আশীর্ব্বাদ আমাদের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
No comments