Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

কে তোমার প্যারাসুট বেঁধেছেন? আশিস কুমার পন্ডা

কে তোমার প্যারাসুট বেঁধেছেন? আশিস কুমার পন্ডা
গল্প হলেও সত্যি।সময়কাল ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা দ্বিতীয় ইন্দোচায়না যুদ্ধ। আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ থেকে এক এক করে বিমান উড়ে গিয়ে উত্তর ভিয়েতনামের মাটিতে বোমা ফেলে চলেছে। সেই দলের ২৪ বছরের ক্যাপ্টে…

 




কে তোমার প্যারাসুট বেঁধেছেন? আশিস কুমার পন্ডা


গল্প হলেও সত্যি।সময়কাল ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা দ্বিতীয় ইন্দোচায়না যুদ্ধ। আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ থেকে এক এক করে বিমান উড়ে গিয়ে উত্তর ভিয়েতনামের মাটিতে বোমা ফেলে চলেছে। সেই দলের ২৪ বছরের ক্যাপ্টেন চার্লি প্লাম্ব, ইতিমধ্যে এফ-4 ফ্যান্টম জেট নিয়ে ৭৪টি সফল অভিযান করে ফেলেছেন। আর মাত্র পাঁচ দিন পরে ছুটি পাবেন, ফিরে যাবেন নিজের দেশে। দিনটা ছিল ১৯৬৭ সালের ১৯ মে। প্রতিদিনের মতো প্রায় ৫০০ মাইল উড়ে গিয়ে বোমা ফেলে ফিরে আসছিলেন, ঠিক সেই সময়, ভিয়েতনামের মাটি থেকে উড়ে এলো স্থলসেনার আগ্নেয়াস্ত্র, আঘাত করল জেটের পিছনের দিকে। তেলের ট্যাঙ্কে আগুন ধরে গেল, নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ৫০০০ ফুট উঁচু থেকে লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে জেট নীচে নামতে শুরু করলো। বিচক্ষণ চার্লি পিঠে বাঁধা প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন, প্যারাসুট হাওয়ায় ভেসে তাকে অক্ষত অবস্থায় নামিয়ে দিল ভিয়েতনামের এক ধানক্ষেতে। চার্লিকে ঘিরে ধরলেন  একদল চাষী, একটু পরে এলো সেনারা। সেনারা বেয়োনেটের খোঁচা দিয়ে অকথ্য অত্যাচার করতে করতে হ্যানয়ের এক যুদ্ধ কারাগারে তাকে বন্ধ করে দিল। ভাগ্যের পরিহাসে নাম হল যুদ্ধবন্দী (Prisoner of War বা POW)। প্রচন্ড মনোবল নিয়ে, চরম অতাচার সহ্য করে প্রায় ছ-বছর কাটালেন কারাগারের ঐ ছোট্ট কুঠরিতে। কুড়ি বছর ধরে ভিয়েতনামের যুদ্ধ (১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল) তখনও শেষ হয় নি, কিন্তু তিনি মুক্তি পেলেন। 

এই আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর গল্প কিন্ত এখানেই শেষ হয়নি। গল্পের পরের পর্যায়ে অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময় এবং রোমাঞ্চ।

এর পর কয়েক বছর কেটে গেছে। এক সন্ধ্যায় রাতের খাওয়া সারতে, সপরিবারে চার্লি গিয়েছেন শহরের এক রেস্তোঁরায়। হঠাত লক্ষ্য করলেন, অন্য টেবিলে বসে এক ব্যক্তি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন। তিনিও তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু অনেক কষ্ট করেও তাকে চিনতে পারলেন না। কিছুক্ষণ এইভাবে চলতে লাগলো। এক সময় তাকে অবাক করে ব্যক্তিটি টেবিলের কাছে উঠে এসে প্রশ্ন করলেন, "আপনি কি ক্যাপ্টেন প্লাম্ব?" চার্লি মাথা নাড়াতেই ব্যক্তিটি বলে চললেন, "আপনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে এফ-৪ জেট এর  পাইলট ছিলেন, ‘টপ গান’এর দলে ছিলেন, ‘কিট্টি হক’ যুদ্ধ পোত থেকে অনেক সফল অভিযান চালিয়েছেন। “চার্লির স্মৃতিতে ফিরে এল উত্তেজনাপূর্ণ সেই দিনগুলির কথা, বুঝতে পারলেন ব্যক্তিটি তাকে খুব ভাল করে চেনেন। ব্যক্তিটি বলে চলেছেন, "শেষ অভিযানের সময়, আপনার জেটে শত্রুদের গুলিতে আগুন লাগে, আর আপনি প্যারাসুট নিয়ে লাফ দিয়ে নিজের জীবন বাঁচিয়েছিলেন, তারপর আপনি ছয় বছর যুদ্ধবন্দী হিসাবে কাটিয়েছিলেন।" চার্লির এবার অবাক হওয়ার পালা, প্রশ্ন করলেন, "আপনি কীভাবে এতো কথা জানলেন?"

ব্যক্তিটি গর্বের সঙ্গে বলে উঠলেন "ক্যাপ্টেন, আমিই আপনার প্যারাসুটটি বেঁধেছিলাম।"

এক অতি সাধারন ব্যক্তির মুখে অসাধারন এক কৃতিত্বের অভিব্যক্তি! ক্যাপ্টেন চার্লি হতবাক হয়ে গেলেন, মুখে ভাষা আসছে না। টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ব্যক্তিটি চার্লির হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললেন, "ক্যাপ্টেন, আমার অনুমান, প্যারাসুটটি ঠিকমতো কাজ করেছিল!” চার্লি উত্তর দিলেন "হ্যাঁ স্যার, সত্যিই কাজ করেছিল, আর ঠিকমতো কাজ না করলে আমাকে সেইদিনই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হোত।"

"আপনার নিপুন আঙ্গুলগুলির জন্য অনেক ধন্যবাদ ও প্রার্থনা মনে মনে জানিয়েছি। কিন্তু আপনাকে সামনে থেকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর সৌভাগ্য যে হবে, তা জানতাম না।" চার্লি ভাববিহ্বল হয়ে তাকে প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতায় ভাসিয়ে দিলেন।

ব্যক্তিটি চার্লিকে সান্ত্বনা দিলেন, "ক্যাপ্টেন, সম্ভবত আমি আপনার জীবনে একমাত্র ব্যক্তি নই, যিনি আপনার প্যারাসুট বেঁধে দিয়েছেন। আপনার বাবা-মা আপনাকে পৃথিবীতে এনেছেন: প্রকৃতি আপনাকে আলো, হাওয়া, জল, খাবার দিয়েছেন: শিক্ষা গুরুরা আপনাকে জ্ঞান, বিদ্যা দিয়েছেন: পশু, পাখি, পতঙ্গ, পাহাড়, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, আপনাকে সঙ্গ দিয়েছে: আপনার পরিবার, সম্প্রদায়, বন্ধু আপনাকে মূল্যবান মনে করেছেন: অনেক অচেনা ব্যক্তি বিভিন্ন রকম পরিষেবা, সেবা, অনুগ্রহ, ভালোবাসা দিয়েছেন। আমি কেবল আপনার জেট থেকে লাফানোর প্যারাসুটটি বেঁধে দিয়েছিলাম। এই মহানুভবরা আপনার শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক প্যারাসুট বেঁধে দিয়েছেন; তাঁরাই আপনাকে জীবনযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করেছেন।“

সেই ব্যক্তিটির কথা ভেবে চার্লির সেই রাতে ঘুম এলো না। চার্লির ধারনা ছিল, তাঁর যুদ্ধজাহাজের ৫০০০ ব্যক্তির প্রত্যেকে তার সেবার জন্যে নিযুক্ত ছিলেন। সেই দিন তিনি প্রথম অনুভব করলেন একজন সাধারন প্যারাসুট রিগার তার মতো ক্যাপ্টেনের জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁদের কতবার দেখেছেন কিন্তু কখনও 'হ্যালো বা গুড মর্নিং বা কেমন আছেন?'- এর কোনটাই জিজ্ঞাসা করার কথা মনে আসে নি।

নৌবাহিনীর সেই প্যারাসুট রিগারের কথায় অনুপ্রানিত হয়ে গ্লেন দি ওয়েরফ-এর কলমে চার্লি লিখলেন এক অসামান্য জীবনকথা –‘I'm No Hero’, প্রকাশিত হল ১৯৭৩ সালের প্রথম দিনে। এক অসামান্য স্বীকারোক্তি, “কে তোমার প্যারাসুট বেঁধেছেন?”

আসল রূপকটি হল; কোন এক কারিগরের বাঁধা কেবলমাত্র একটি প্যারাসুট কোন ব্যক্তিকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারে না, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক চেনা অচেনা কারিগর, নিপুনভাবে এবং যত্ন করে একের পর এক প্যারাসুট বেঁধে দিয়েছেন। শিখরে পৌঁছানোর দৌড়ে এই নিপুন প্যারাসুট রিগাররা যেন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যান। কোন সম্মাননা দিয়ে বা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাদের ঋণ শোধ করার ধৃষ্টতা কখনোই করা উচিত নয়। নতমস্তকে তাঁদের যথাযথ সন্মান এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা তৃপ্ত ও শুদ্ধ হতে পারি।

No comments