Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

দড়ির উপর হেঁটে আমেরিকা থেকে কানাডা- আশিস কুমার পন্ডা

দড়ির উপর হেঁটে আমেরিকা থেকে কানাডা- আশিস কুমার পন্ডা
কল্পনা করুন, জলদানব নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে এক দড়ি দুদিকে কষে বাঁধা হয়েছে এবং একজন ব্যক্তি সেই দড়ির উপর পা রেখে জলরাশির গর্জন এবং হিম শীতল জলকনার মেঘের  ভিতর দ…

 




দড়ির উপর হেঁটে আমেরিকা থেকে কানাডা- আশিস কুমার পন্ডা


কল্পনা করুন, জলদানব নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে এক দড়ি দুদিকে কষে বাঁধা হয়েছে এবং একজন ব্যক্তি সেই দড়ির উপর পা রেখে জলরাশির গর্জন এবং হিম শীতল জলকনার মেঘের  ভিতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন!

১৮৫৯ সালের ৩০শে জুন, মসিউর চার্লস ব্লদি নামে ৩৪ বছর বয়সী একজন ফরাসি এই অত্যাশ্চর্য কীর্তিটির জন্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।  তিনিই ছিলেন ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকে শুরু করে জলপ্রবাতের তলের ১৬০ ফুট উপর দিয়ে ১১০০ ফুট দূরত্ব দড়ির উপর হেঁটে গিয়ে কানাডার মাটিতে পা রাখেন। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে এবং উচ্ছ্বসিত জনতাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে, তিনি প্রায় দৌড়ে মাত্র আট মিনিট সময় নিয়ে আবার ফিরে আসেন। দু’ দেশের প্রায় ১০,০০০ দর্শক হতবাক হয়ে এবং বিস্ময়ের সঙ্গে সেদিন এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন।  তার জীবদ্দশায়, তিনি অনেকবার সামনের দিকে, পিছনের দিকে, চোখ বেঁধে, একটি বস্তার মধ্যে, ডিগবাজি খেয়ে, চেন দিয়ে পা বেঁধে, রণপায় চড়ে, এবং ঠেলাগাড়ি নিয়ে দড়ির উপর হেঁটে নায়াগ্রা পারাপার করেছেন। ব্লদির ভারসাম্য এতটাই নিখুঁত ছিল যে তিনি দড়ির উপর চেয়ারে বসে একটি ছোট টেবিলের উপরে রাখা প্লেটের উপর ওমলেট রেখে খেতে পারতেন। সারা জীবনে তিনি প্রায় ৩০০ বার নায়াগ্রা জলপ্রপাত পারাপার করেছেন এবং দড়ির উপর দিয়ে ১০,০০০ মাইলেরও বেশি হেঁটেছেন। ছেলেবেলা থেকে শুরু করে তার ৭৩ বছরের জীবনকালে তিনি দড়ির উপর দিয়ে এতটাই স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে হেঁটেছেন যতটা একজন সাধারণ মানুষ এক মসৃণ রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে পারেন। তার আত্মবিশ্বাস এতটাই তুঙ্গে ছিল যে তিনি কখনোই দড়ির নীচে সুরক্ষার জন্যে জাল ব্যবহার করেননি এবং জীবন বীমা করানোর প্রয়োজন মনে করেননি।


এমনই এক অনুষ্ঠানে, ব্লদি চোখ বেঁধে এক ঠেলাগাড়ি ঠেলে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটেন এবং ফিরে আসেন। দর্শকরা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, কিন্তু ব্লদি সেদিন প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি এই দুঃসাহসিক কাজ অনায়াসে করতে পারেন এবং এতে দর্শকদের কোন সন্দেহ ছিল না। দড়ি থেকে নেমে এসে তিনি দর্শকদের জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনাদের মধ্যে কে কে বিশ্বাস করেন, আমি চোখ বেঁধে এই ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পার করতে পারি?” প্রতিটি দর্শক উত্সাহের সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, "আমি বিশ্বাস করি, ব্লদি, আমি বিশ্বাস করি!" তিনি আবার দর্শকদের জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনাদের মধ্যে কে কে বিশ্বাস করেন, আমি এই ঠেলাগাড়িতে একজনকে নিয়ে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পার করতে পারি?" ভিড় আবার গর্জে উঠলো, প্রত্যেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমি বিশ্বাস করি ব্লদি। আপনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ টাইটরোপ ওয়াকার! আমি বিশ্বাস করি!" অবশেষে, ব্লদি দর্শকদের আহ্বান জানালেন, "আপনাদের মধ্যে কে কে এই ঠেলাগাড়িতে উঠতে চান দয়া করে এগিয়ে আসুন।"


কিন্তু ব্লদির ঠেলাগাড়িতে ওঠার মানে হল জীবনের ঝুঁকি নেওয়া, যখন ব্লদির একটি সাধারণ ভুল পদক্ষেপ মানেই নিশ্চিত মৃত্যু! দর্শকরা একে অপরের মুখ দেখতে লাগলেন, তাদের মধ্যে নেমে এল মৃত নীরবতা। কয়েক হাজার দর্শক যারা কিছুক্ষণ আগে চিৎকার করে বলছিলেন, "আমি বিশ্বাস করি, আমি বিশ্বাস করি!”-তাদের মধ্যে একজনও এগিয়ে এসে ঠেলাগাড়িতে ওঠার প্রস্তাব দিলেন না। ব্লদি অপেক্ষা করতে লাগলেন, হয়তো কেউ এগিয়ে আসার জন্যে সময় নিচ্ছেন! দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, একজন খুব পরিচিত ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। তিনি ছিলেন ব্লদির নিজস্ব ম্যানেজার, নাম হ্যারি কলকর্ড। ব্লদির উপরে তার এত বেশি আস্থা ছিল যে তার জীবনকে ব্লদির হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করলেন না।


১৮৫৯ সালের ১৭ই আগস্ট, কলকর্ডকে পিঠে বেঁধে ব্লদি নায়াগ্রা পার করার জন্যে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। তার নিজের ওজন এবং তার ম্যানেজারের ওজন বিবেচনা করে এই কাজে ছিল বিশাল ঝুঁকি। এত কঠিন পরীক্ষা এর আগে তিনি কখনও দেননি। দড়ির ঠিক মাঝখানে সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশে পৌঁছে, ব্লদি তার ম্যানেজারকে বললেন, “হ্যারি, আপনি এখন আর কলকর্ড নন; আপনিও  ব্লদি। যতক্ষণ না আমি এই জায়গাটি পেরিয়ে যাচ্ছি, আপনি আমার মন, শরীর এবং আত্মার একটি অংশ হয়ে থাকুন। যদি আমি দোল খাই বা কাত হয়ে পড়ি, আপনিও তাই করবেন। নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবেন না। আপনি অস্থির হয়ে উঠলে,  আমরা দুজনেই মারা পড়বো।" হ্যারির তার বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ বন্ধুর উপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল। সাবধানী ব্লদি তার দ্বিগুণ ওজন নিয়ে সাবলীলভাবে দড়ির উপর একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে নায়াগ্রা পার করে ফেললেন।


এই গল্পে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ছিল নিছক বিশ্বাস, কিন্তু, ব্লদির ম্যানেজার হ্যারি কলকর্ড সত্যিকারের আস্থার পরিচয় দিয়েছিলেন। যদিও দর্শকরা নিজেদের চোখে ব্লদির সাহসীক কীর্তি দেখেছিলেন, তারা সবাই বলেছিলেন যে তারা ব্লদিকে বিশ্বাস করেন, কিন্তু কার্যত ব্লদির হাতে নিজেকে সমর্পণ করার আস্থা তাদের কারোরই ছিল না।


এই গল্পে ব্লদির শেষ প্রশ্নের আগে দর্শকরা যেমন ব্লদির প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন, ঠিক তেমনি আপনার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের বেশিরভাগ মানুষও আপনাকে নিয়ে তাই করছেন কারণ আপনাদের মধ্যে আস্থার বন্ধন তৈরি হয়নি। তারা আপনার চারপাশে ঘোরাঘুরি করেন এবং আপনাকে বিশ্বাস করার ভান করেন, তার মানে এই নয় যে তারা আপনার আপনজন। কখনও কখনও তারা আপনাকে খুশি করার জন্যে সৌজন্যের খাতিরে আপনি যা শুনতে চান সেই কথা বলেন। যতক্ষণ না আপনি এমন কিছু জিজ্ঞাসা করছেন যা আপনার জন্যে তাদের মূল্যবান কিছু বিনিয়োগ করতে বাধ্য করবে, আপনি খুঁজে পাবেন না কে সত্যিই আপনার জন্য আছেন এবং কে নেই। আপনার জীবনে সত্যিকারের বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা এক অমূল্য উপহার, এবং আপনাকে অবশ্যই এমন লোকেদের দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে যাদের আপনি বিশ্বাস করতে পারেন এবং অবিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি সীমানা তৈরি করতে পারেন।


সবশেষে, আমাদের জীবনের যাত্রায় সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে শক্তি, আশা এবং সান্ত্বনা যোগানোর এক শক্তিশালী হাতিয়ার হল আস্থা। এই আস্থা ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরেও হতে পারে; এটা হতে পারে আমাদের নিজেদের উপর, অন্যদের উপর, জীবনের উত্কর্ষতার উপর আস্থা।  এমন কী অনেক অপরিচিত ব্যক্তি যেমন ডাক্তার, ট্যাক্সি ড্রাইভার, এবং শিশু যত্ন প্রদানকারীদের উপরও আমরা আস্থা রাখি, যারা আমাদের এমন সব পরিষেবা দেন যা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আস্থা আপনাকে সবকিছুর মধ্যে ইতিবাচক দিকগুলি দেখতে সাহায্য করে এবং আপনার কাজ করাও সহজ হয়ে যায়, সবচেয়ে কঠিন সময়েও আবহাওয়া নিজের অনুকূলে ধরে রাখা সম্ভব হয়। তাই, নিজের উপর আস্থা রাখুন, আপনার আশেপাশে আপনজনদের উপর আস্থা রাখুন, তাদের আস্থা অর্জন করুন, আপনার লক্ষ্য পূরণ হবেই হবে।

No comments